বিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীজুড়ে বহির্জাগতিক প্রাণ অনুসন্ধান করে বেড়িয়েছেন। খুঁজেছেন কার্বনভিত্তিক বুদ্ধিমান প্রাণ কিংবা সিলিকনভিত্তিক বা অ্যামোনিয়া যৌগনির্ভর প্রাণ। এটা আমাদের জানা জরুরি এ কারণে যে প্রাণের প্রকৃতি, আর অন্য জায়গায় প্রাণ আছে কি না, তা আসলে একই প্রশ্নের দুটো দিক। তা হলো, ‘কেন আমরা এখানে?’ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে সিলিকনভিত্তিক প্রাণ মানুষ বহির্জগতে খুঁজে মরছে, সেই সিলিকননির্ভর বুদ্ধিবৃত্তি কৃত্রিমভাবে পৃথিবীতে প্রায় তৈরি করে ফেলেছে মানুষ, যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির দিকে। অর্থাৎ বহির্জগতে সেই অতি বুদ্ধিমান প্রাণের (যদি থেকেও থাকে) সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই মানুষ দেখা পেয়ে যাবে নিজের সৃষ্ট সিলিকননির্ভর প্রাণের। কিন্তু খোদ কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিবিষয়ক গবেষকেরা দুঃশ্চিন্তায় আছেন: বাস্তবের সিলিকন স্বত্ত্বা দেখার আগেই পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে কার্বনভিত্তিক মানুষের, নিজের সৃষ্ট এই সিলিকনভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এটাকে একধরনের পরিহাসও বলা যেতে পারে।
এরকম একটা সময়ে মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথা জানান দিল। বাংলাদেশে খুব স্বল্প, বিচ্ছিন্ন কিছু চেষ্টা ছাড়া এটিই একমাত্র বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা, যেটি নিয়মিত বের হচ্ছে। অথচ এরকম একটি সময় এমন নানা প্রচেষ্টায় ছেয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। বিজ্ঞানের প্রচেষ্টাগুলো বেগবান করার কোনো উদ্যোগ ছাড়াই আমরা নানারকম স্বপ্নের কথা বলে চলেছি।
ভবিষ্যতকে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করা যায় না, তবে একে মোকাবেলার কিছু উপায় আমরা জানি। এটা আমরা ৩০ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র থেকে বুঝতে পারি। অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানের বাস্তবতার আলোয় পরিবর্তন বা ভবিষ্যত মোকাবেলার প্রচেষ্টা আমাদের থাকে।
বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে তাকালে কতগুলো ঘটনা বা ভবিষ্যদ্বাণী চোখের সামনে কেমন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রাযুক্তিক বা টেকনোলজিক্যাল অভিঘাত। উল্কাপিন্ডের অভিঘাতে গ্রহ-উপগ্রহগুলো ক্ষত-বিক্ষত হলেও প্রযুক্তির কারণে সমাজ-সভ্যতা ও পারিবারিক বন্ধনগুলো নড়বড়ে হয়ে উঠছে। ছোটরা বড়দের অভিজ্ঞতা নিতে চাইছে না। শুধু তা-ই নয়, অবজ্ঞা করছে; কিছু ক্ষেত্রে অসম্মানের পর্যায়ে পৌঁছেছে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক; শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। শুধু ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি প্রস্থের একটি স্মার্ট যন্ত্রই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এটা যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গল্পের মতো, যেখানে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিপরীত: পিতা ছোট এবং পুত্র বড়।
ভবিষ্যতকে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করা যায় না, তবে একে মোকাবেলার কিছু উপায় আমরা জানি। এটা আমরা ৩০ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র থেকে বুঝতে পারি। অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানের বাস্তবতার আলোয় পরিবর্তন বা ভবিষ্যত মোকাবেলার প্রচেষ্টা আমাদের থাকে। এভাবেই আমরা এগিয়ে যাই। স্মার্ট প্রযুক্তির কারণে পরিস্থিতিটা এমন যে বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে ভার্চ্যুয়াল জগতকে বাস্তব ভেবে জীবনের সম্পর্কগুলো নিরূপণ করা শুরু করেছে বর্তমান প্রজন্ম, যা আমাদের ভুলের প্রায়শ্চিত। যেখানে মৃত্যু সফটওয়্যার গেমের মতো সাময়িক, সেই পরম বিশ্বাসে যাওয়া যে আমরা আবার জীবিত হব। এতে জীবনের প্রতি মমতা, ভালোবাসা ক্রমাগত হারিয়ে যায়। সাম্প্রতিক অনেক কিছুই বলছে, তা-ই ঘটে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল আফ্রিকা-এশিয়ার দেশগুলো প্রযুক্তির এই অভিঘাতে আক্রান্ত হচ্ছে; তবে এই বাণিজ্যের লোভ ও লাভের থাবা থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর তরুণ প্রজন্মও রেহাই পাবে না।
কেন আমাদের এই প্রজন্ম এরকম একটি বাস্তবতার দিকে গেল, প্রাযুক্তিক অভিঘাতের করাল গ্রাসের শিকার হলো তরুণ প্রজন্ম? এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে প্রাযুক্তিক বয়োঃসন্ধিকাল, যা সৃষ্টি করেছে এই টেকনোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট বা প্রাযুক্তিক অভিঘাতের কালো থাবা। পুরো পৃথিবীটাই যেন মানবিকভাবে ভবিষ্যতহীন হয়ে পড়েছে। যেন মানবিকতাই সমাপ্তির পথযাত্রী।
প্রাযুক্তিক বয়োঃসন্ধিকাল আসলে কী? আমাদের জীবনে স্বাভাবিকভাবে যে বয়োঃসন্ধিকাল আসে, তাকে কৈশোরের বয়োঃসন্ধিকাল বা বায়োলজিক্যাল অ্যাডেলোসেন্স বলা যায়। কৈশোরে শিশুরা শারীরিকভাবে নতুন এমন কিছু অনুভব করে, অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকশিত হয়; যেগুলো সম্পর্কে সে কিছু জানে না। তখন সেই কিশোর সঠিক নির্দেশনা বা পরিপক্কতা ছাড়া মারাত্মক ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, অবশ্য নতুন যেকোনো কিছুর ক্ষেত্রেই কিছুটা এই সম্ভাবনা থাকে।
স্যামুইলোভিচ স্কলোভস্কি, নিকোলাই কার্দেশেভ হয়ে কার্ল সাগান সমস্যাটিকে সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ কন্ডিশন বা আত্মধ্বংস হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন: আর তা হলো প্রাযুক্তিক বয়োঃসন্ধিকাল; ফ্রাংক ড্রেক থেকে ফ্রিম্যান ডাইসন—সবাই বললেন ওই একই কথা।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, প্রযুক্তিক বয়োঃসন্ধিকাল এ ধরনের সমস্যা তৈরি করে। যেটার একটা প্রচ্ছন্ন আভাস দেন আইনস্টাইন। তিনি বিশ্বমেলা-১৯৩৯ দেখে আইডিয়াস অ্যান্ড অপিনিয়ন গ্রন্থের ‘টাইম ক্যাপসুলে বার্তা’ প্রবন্ধে একটা সতর্কবার্তা যুক্ত করেছিলেন প্রাযুক্তিক উন্নতির ব্যাপারে; ঔপন্যাসিক ও বিজ্ঞানী সিপি স্নোর ‘দ্য টু কালচার’ বক্তৃতায় (১৯৫৯) এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলতে চাইছিলেন, বিজ্ঞান এবং মানবতা যে মানুষের বৌদ্ধিক জীবন উপস্থাপন করে, তা দুটি সংস্কৃতিতে (টু কালচার) বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যা সমাজের ইন্টিগ্রিটি বা অখণ্ডতাকে নষ্ট করে চলেছে, এক ভারসাম্যহীন সভ্যতার সূচনা ঘটাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, শিকারী সময়কার যে একাকিত্ব মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, তাকে আমরা আবার ডেকে আনছি। অথচ আমরা বলে বেড়াচ্ছি, এতসব আয়োজন, প্রাযুক্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য।
স্যামুইলোভিচ স্কলোভস্কি, নিকোলাই কার্দেশেভ হয়ে কার্ল সাগান সমস্যাটিকে সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ কন্ডিশন বা আত্মধ্বংস হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন: আর তা হলো প্রাযুক্তিক বয়োঃসন্ধিকাল; ফ্রাংক ড্রেক থেকে ফ্রিম্যান ডাইসন—সবাই বললেন ওই একই কথা। শুধুই ব্যবসার জন্য, শুধুই অন্যের চেয়ে লাভে এগিয়ে থাকার জন্য এই ভারসাম্যহীন প্রাযুক্তিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে—প্রাযুক্তিক আত্মধ্বংস। আর যারা এর উদগাতা, তারা নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে, ভয়ানকভাবে পুঁজিকেন্দ্রিভূত করছে; আবার তারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলে চলেছে।
বিজ্ঞানের এই কথাগুলো বলার জন্য বিজ্ঞানচিন্তার মতো অনেক প্ল্যাটফর্ম দরকার। অথচ নিয়মিত আছে একটি: বিজ্ঞানচিন্তা। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার এই প্রচেষ্টা যেন অন্যদের প্রণোদিত করে এরকম বিজ্ঞান পত্রিকা করার। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার এই প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে রইল অভিনন্দন।