বর্তমানে জীবিত অন্যতম সেরা এই ১০ বিজ্ঞানীকে আপনি চেনেন?

বর্তমানে জীবিত অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানীদের আপনি চেনেন

বর্তমানে জীবিত পৃথিবীর সেরা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকা করা কি সম্ভব? তালিকা তো করাই যায়, কিন্তু তা মানতে চাইবেন না অনেকেই। যুক্তিগুলোও ফেলনা হবে না কোনোভাবেই। যেমন কোনো তালিকায় হয়তো রিচার্ড ডকিন্স বা মিচিও কাকু নেই, কিংবা হয়তো নেই ডেমিস হাসাবিস। মার্কিন পদার্থবিদ মিচিও কাকু না থাকলে তবু কেউ কেউ হয়তো মেনে নিতে পারেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা, ২০২৪ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী ডেমিস হাসাবিসকে বাদ দেওয়া তো রীতিমতো অন্যায়! এরকম কথা থাকবে, বিতর্ক থাকবে, খানিকটা দুঃখও থাকবে—এই লেখার প্রায় ৭ বছর আগে যে আমাদের কালের নায়ক স্টিফেন হকিং গত হয়েছেন—তবু আমাদের আলোচনাটা কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে। কোত্থেকে করা যায়?

বিগ থিংক, গুগল, নিউ ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে সহায়তা নিয়ে সেই আলোচনার চেষ্টা এটি। তবে, শিরোনাম খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এখানে ‘সেরা’ বিজ্ঞানী বলা হয়নি, ‘অন্যতম সেরা’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ আপনার মতে এই তালিকায় আরও যাঁর কথা আসা উচিৎ ছিল, তাঁকে মোটেও ‘সেরা নয়’ বলা হচ্ছে না।

তাহলে আসুন, পৃথিবীর অন্যতম সেরা জীবিত ১০ বিজ্ঞানীর কথা জেনে আসা যাক সংক্ষেপে।

স্যার টিম বার্নার্স–লি
ছবি: রয়টার্স

১. টিমোথি বার্নার্স লি

নাম শুনে চিনতে না পারলেও ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’-এর উদ্ভাবককে এই তালিকায় রাখার ব্যাপারে আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না। ঠিক ধরেছেন, ব্রিটিশ কম্পিউটারবিজ্ঞানী টিম বার্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা ডব্লিউ-ডব্লিউ-ডব্লিউ (www)-এর উদ্ভাবক। হাইপারটেক্সট-এর মাধ্যমে যে তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব, তা তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন। হাইপারটেক্সট ইন্টারনেটের দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর বলা যায়। যেকোনো ওয়েবসাইট যে এইচটিএমএল নামের ‘ইট-পাথর’ দিয়ে বানানো হয়, তার পূর্ণরূপ হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ; এর শুরুর শব্দটির কথাই বলছিলাম। শুধু ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবই নয়, পৃথিবীর প্রথম ওয়েবসাইটটাও বানিয়েছেন এই ভদ্রলোক, ১৯৯১ সালে।

২. জেন গুডউইল

জেন গুডউইল ব্রিটিশ প্রাইমেটোলজিস্ট—প্রাইমেট বা স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেন। শিম্পাঞ্জির ব্যাপারে তাঁকে পৃথিবীর শীর্ষ বিশেষজ্ঞ বলা যায়। শিম্পাঞ্জিদের সামাজিক ও পারিবারিক মিথস্ক্রিয়া, পারস্পরিক আচরণ নিয়ে গবেষণা করছেন ৫৫ বছরের বেশি। তিনি দেখিয়েছেন, শুধু মানুষ নয়, শিম্পাঞ্জিও বিভিন্ন টুল বা যন্ত্রের ব্যবহার শিখতে পারে। জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ রক্ষায় তাঁর কাজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. অ্যালান গুথ

মার্কিন এই তত্ত্বীয় পদার্থবিদ এবং কসমোলজিস্ট ‘থিওরি অব কসমিক ইনফ্লেশন’-এর নেপথ্য কারিগর। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের জন্ম বা বিগ ব্যাংয়ের খানিকক্ষণ পর গোটা মহাবিশ্বটা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত হারে অনেক বেশি প্রসারিত হয়। এরই নাম দেওয়া হয়েছে কসমিক ইনফ্লেশন। আজকের মহাবিশ্ব কাঠামোর অনেক রহস্যের সমাধান মেলে এই তত্ত্বে, জানা যায় মহাবিশ্বটা কেন আজ এত বড়। গুথ ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস প্রাইজ, দ্য ক্যাভলি প্রাইজসহ বেশ কিছু সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন, তবে নোবেল পুরস্কার পাননি।

স্ট্রিং তত্ত্ববিদ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত বাঙালি বিজ্ঞানী অশোক সেন।
ছবি: প্রথম আলো

৪. অশোক সেন

ভারতীয় তত্ত্বীয় পদার্থবিদ অশোক সেন ভারতের হরিশচন্দ্র রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ও অধ্যাপক। স্ট্রিং থিওরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। এ জন্য পেয়েছেন ফান্ডামেন্টাল প্রাইজ ইন ফিজিকসসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ভারত সরকারের ‌‘পদ্মভূষণে’ ভূষিত এই বিজ্ঞানী রয়্যাল সোসাইটির সদস্য।

জেমস ওয়াটসন

৫. জেমস ওয়াটসন

না, শার্লক হোমসের ওয়াটসন নন, ডাবল হেলিক্সের আবিষ্কারক জেমস ওয়াটসন মার্কিন আণবিক জীববিজ্ঞানী এবং জিন গবেষক। ওয়াটসন ও ক্রিক যৌথভাবে ডিএনএর ডাবল হেলিক্স বা দ্বিসূত্রক গঠন আবিষ্কার করেন (উল্লেখ্য, এ গবেষণায় রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের অবদানও কোনো অংশে কম নয়)। এ জন্য ১৯৫৩ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

টু ইউইউ ও তার আবিষ্কৃত অণু
ছবি: সংগৃহীত

৬. তু ইউইউ (Tu Youyou)

২০১৫ সালে প্রথম চৈনিক নারী হিসেবে এন্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগ উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পান ইউইউ। এশিয়া এবং আফ্রিয়ায় এই ড্রাগ লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এই ড্রাগের দুটি উপাদান যৌগ আর্টেমিসিনিন এবং ডাইহাইড্রোআর্টেমিসিনিন আবিষ্কারে তিনি ঐতিহ্যবাহী চীনা মেডিসিন ব্যবহার করেছেন। ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবন অনেক সহজ ও উন্নত হয়েছে তাঁর গবেষণায় ভর করে।

নোম চমস্কি
ছবি: এএফপি

৭. নোম চমস্কি

নোম চমস্কি দার্শনিক হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁকে আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনকও (The father of modern linguistics) বলা হয়। তবে শুধু এই একটি বিষয়ে নয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতেই চমস্কির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আধুনিক চেতনাবিজ্ঞান তথা কগনিটিভ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বলেও তাঁকে গণ্য করা হয়।

৮. শিনইয়া ইয়ামানাকা

নোবলজয়ী জাপানি স্টেম কোষ গবেষক। দেহের জীবিত কোষকেও যে স্টেম কোষে পরিণত করা যায়, তা আবিষ্কারের কারনে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২০১২ সালে। ২০১৩ সালের ব্রেকথ্রু প্রাইজও উঠেছে তাঁর হাতে। আধুনিক জীববিজ্ঞানের অন্যতম আগ্রহের বিষয় স্টেম কোষের কল্যাণে দৃষ্টি, শ্রবণসহ বিভিন্ন অঙ্গের দুরারোগ্য ব্যধি থেকেও মুক্তি মিলছে।

৯. এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন

অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান আণবিক জীববিজ্ঞানী ব্ল্যাকবার্ন ২০০৯ সালে ‘এন্টি-এজিং’ নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কোষের টেলোমিয়ার—যা কোষের ক্রোমোজম রক্ষায় ও কোষ বিভাজনে ভূমিকা রাখে—নিয়ে তাঁর গবেষণা থেকে এন্টি এজিংবিষয়ক জ্ঞানে নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। টেলোমিয়ার ক্ষয়ে যাওয়ার সঙ্গে বয়স বাড়া ও বুড়িয়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। ব্ল্যাকবার্ন ‘টেলোমারেজ’ নামে একধরনের এনজাইম আবিষ্কার করেন যৌথভাবে, যা টেলোমিয়ারের ক্ষতি সারিয়ে তুলতে পারে।

CHRISTOPHER MICHEL

১০. জেনিফার ডাউডনা

নোবেলজয়ী জৈবরসায়নবিদ ও জিন গবেষক জেনিফার ডাউডনা যৌথভাবে ক্রিসপার-ক্যাস৯ আবিষ্কার করেন। জিন এডিটিং বা সম্পাদনার জন্য এটি একধরনের ‘জৈব কাচি’ হিসেবে কাজ করে। এটি ব্যবহার করে, জিন সম্পাদনা করে বিভিন্ন রোগ যেমন সারিয়ে তোলা যায়, তেমনি তৈরি করা যায় প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরিতেও এর ব্যবহার হয়েছে, হচ্ছে আধুনিক ওষুধ শিল্প ও জিন গবেষণার প্রায় সব ক্ষেত্রে।

শেষের আগে

এই তালিকায় অনেকেই নেই। নেই রজার পেনরোজের মতো নোবেলজয়ী পদার্থবিদ, গর্ডন মুরের মতো প্রযুক্তিবিজ্ঞানীসহ আরও অনেকে। এ কথা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয়, এই তালিকায় যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরাও আসলে কোনো অংশে কম নন। আপনি কি তাঁদের চেনেন? না চিনলে এই সূত্রে নাহয় পরিচয় হয়েই গেল, কী বলেন?

সত্যি বলতে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রগুলো এত বৈচিত্র্যময় এবং বিপুল যে কোনোভাবেই শুধু ‘সেরা ১০’ জীবিত বিজ্ঞানী নির্বাচন বা বাছাই করা সম্ভব নয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই আলোচনা চলুক, আমরা তাঁদের কাজের ব্যাপারে আরও জানি; এবং যাঁরা এ তালিকায় নেই, তাঁদের অনেকেই উল্লেখিত বিজ্ঞানীদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নন—এ কথাও স্বীকার করে নিই নির্দ্বিধায়।

সূত্র: বিগ থিংক, নিউ ইঞ্জিনিয়ার, উইকিপিডিয়া