‘কখনো প্রশ্ন করা থামানো যাবে না’—আব্দুল কাইয়ুম, সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। পাশাপাশি তিনি প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক। বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়তে অসাধারণ ভূমিকা পালন করছেন। দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক লেখা লিখছেন দৈনিক ও মাসিক পত্রিকায়। একসময় দৈনিক প্রথম আলোতে নিয়মিত লিখেছেন জনপ্রিয় বিভাগ ‘কার্যকারণ’। লিখেছেন কিশোর-তরুণদের জন্য বিজ্ঞান ও গণিতের বই। এর মধ্যে মজার গণিত, গণিতের জাদু, প্রশ্নোত্তরে বিজ্ঞানের কী ও কেন, বিজ্ঞানের রাজ্যে কী ও কেন উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি ঢাকা কলেজ বিজ্ঞান ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. তৌফিকুল হালিম, আবরার জাওয়াদ, আসিফ ইকবাল, মো. হুযাইফা, হাসনাত সাঈম, আসহাবিল ইয়ামিন ও মাহি আল রাইয়ান। আজ, ১৮ জানুয়ারি আব্দুল কাইয়ুমের জন্মদিনে সাক্ষাৎকারটি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।

আব্দুল কাইয়ুমঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রশ্ন: আপনার শৈশবকালের কোনো স্মরণীয় ঘটনা শুনতে চাই।

আব্দুল কাইয়ুম: আমার কৈশোর জীবনের শুরু ঢাকায়। এর আগে আমরা ছিলাম বরিশালে। আমার আব্বা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর চাকরির সুবাদে বরিশাল থেকে বদলি হয়ে ফরিদপুর হয়ে ঢাকায় এসেছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের কথা। তখন আমি স্কুলে ভর্তি হই। একটু বেশি বয়সেই ভর্তি হয়েছিলাম। ১৯৫৫ সালে। তখন আমাদের বাসা ওয়ারীতে। ওয়ারী তখন অভিজাত এলাকা। আমার স্কুলটাও ছিল ভালো। পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনযাত্রা, জীবনপ্রণালী সব শেখাতেন। শিক্ষকরা আমাকে বরাবরই আকৃষ্ট করতেন। বেত মেরে পড়াতেন না। তাঁদের শেখানোর পদ্ধতি ছিল খুব আকর্ষণীয়। প্রথম দিন যখন স্কুলে যাই, তার আগের দিন আমার আম্মা কেডস জুতা সাদা কালি দিয়ে রং করে দিলেন। সেটা পরে গেলাম। গিয়ে দেখি কেউ স্যান্ডেল পরে এসেছে, কেউ এসেছে খালি পায়ে। নানা জনের নানারকম অবস্থা। আমার জুতা পরা দেখে তাদের কাছে নতুন মনে হলো। তারা এসে বলে, ‘আমাদের একজন নতুন বন্ধু আসছে রে। কেমন আছিস?’ তারা এ কথা বলে, আর পাড়া দিয়ে আমার জুতাটাকে নষ্ট করে (হাসি)। তা, আমি আর কিছু বলিনি। এই হলো আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা।

ওদিকে স্যার এসে বললেন, ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’। তখন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস হতো মাঠে। আমি চিন্তা করছি, এই মাটিতে কীভাবে কী? তখন স্যার বুঝিয়ে দিলেন। একটি আলপিন যদি মেঝেতে পড়ে, সে শব্দটাও যেন সবাই শুনতে পায়। ওদিকে আমি আবার চিন্তা করছি, পিন ড্রপ সাইলেন্সের মানে কী! এখানে পিন পড়লে তো কোনো শব্দ হবে না। তাহলে শুনবে কে? এসব চিন্তা করছি, এর মধ্যে ‘বটা’ নামে এক ছেলে শব্দ করল। স্যার বললেন, ‘কে? আসো, এখানে আসো।’ স্যার ওকে বললেন, ‘ব্যাঙ হয়ে থাকো।’ আমি তা দেখলাম। এই ছিল তখন অবস্থা।

আরেকদিনের কথা মনে পড়ে। আমি তখন সম্ভবত সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। খেলাধুলা করতাম। ফুটবল খেলতাম, ক্রিকেট পরে শুরু করেছি। ফুটবলটাই বেশি। তখন প্রতিদিন তিনবার যেতাম স্কুলে। ভোর বেলা উঠে, ৫-৬টার সময় গিয়ে বকুল ফুল নিতাম কিছু। তারপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার আসতাম। এসে খেয়ে আবার স্কুলে। দুপুরে যেতাম বাসায়। বাসায় আসতে-যেতে লাগত ১৫ মিনিট। হেঁটেই যেতাম। টিফিন খেয়ে আবার স্কুলে। আবার ছুটির পর এসে একটু নাস্তা করে খেলতে যেতাম। এভাবে স্কুল থেকে পড়াশোনা, খেলাধুলা, আচার-আচরণ, সবদিক থেকেই আমার গড়ে ওঠা। আর বাসার পরিবেশ তো আছেই। একদিন আমি স্কুলে যাব। পরীক্ষা চলছে। হঠাৎ ১১টার সময় মনে হলো, আজকে তো সকালে পরীক্ষা ছিল। আমি ভাবছি বিকালে। এর মধ্যে আমাদের ক্লাস টিচার এলেন। আমি ক্লাসে প্রথম ছিলাম। এসে বলছেন, ‘তোমার তো পরীক্ষা!’ স্যার রিক্সা করে আসছেন। স্যারের সঙ্গে গেছি। খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। উনি আমাদের খুব স্নেহ করতেন। ছাত্রদের হাতের লেখা শেখাতেন। এগুলো খুব ভালো লাগত। আন্তরিকতা ছিল। পড়াশোনার দিক থেকে এগুলোই বলা যায়। আর লাইব্রেরি ছিল। বই নিতাম, গল্পের বই। সেখানে যেসব বই পড়েছি, বড় হয়ে আবার পড়তে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ আরও অনেকের উপন্যাস পড়তাম। এভাবেই বড় হয়েছি আরকি।

আব্দুল কাইয়ুম
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রশ্ন: আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা কলেজে। এই কলেজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরোনো কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?

আব্দুল কাইয়ুম: ১৯৬৫ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। তারপর ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। ঢাকা কলেজে তখন রাজনীতি শুরু হয়েছে। আইয়ুব (খান)-বিরোধী আন্দোলন চলছে। তার মধ্যে আমি জড়িয়ে গেলাম।

সে সময় আমাদের টিচার ক্লাসে ঢুকে বলতেন, ‘যারা যারা আমার ক্লাসে লেকচার শুনতে আগ্রহী নয়, তারা চলে যাও। আমি চোখ বন্ধ করে ১০ পর্যন্ত গুনব।’ অনেকে চলেও যেত। কিছুক্ষণ পর তিনি লেকচার শুরু করতেন। পরবর্তী কালে সাংবাদিকতার জন্য তাঁর সাথে কয়েকবার দেখা হয়। আমাদের একজন স্যার ছিলেন। উনি আমাদের অন্যতম সেরা শিক্ষক ছিলেন। আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের কারণে আমরা কয়েকজন বহিষ্কৃত হই। সেলিম, আমি রাজনীতি করতাম। আমরা তখন চলে যাই জগন্নাথ কলেজে। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে পরীক্ষা দিই। ভালোই রেজাল্ট হলো। এরপর তো বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে রাজনীতির আগে ছিলো শরীর-স্বাস্থ্য ও লেখাপড়া। আমাদের একটা নিয়ম ছিল। প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে বাসায় আসতে হবে। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে বসতে হবে পড়তে। আর সূর্যোদয়ের পর একটু হেঁটে এসে পড়া। সকাল-সন্ধ্যা পড়া, এটি ছিল নিয়মিত। আর স্কুলের পড়া স্কুলে। এটা ছোটবেলার শিক্ষা। নিয়মিত বই পড়ার উপকারিতাও পরে পেয়েছি। পড়াশোনা চর্চা, লাইব্রেরি থেকে বই আনা, বই পড়ে বই জমা দেওয়া, লেখালেখি—সব করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তার অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বক্তব্য দিচ্ছেন আব্দুল কাইয়ুম
ছবি: বিজ্ঞানচিন্তা

প্রশ্ন: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কেমন ছিল তখনকার সময়?

আব্দুল কাইয়ুম: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত আসলে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই। তখন মোনেম খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। একাত্তরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। হলে থাকি। কার্জন হলের কাছে এফ এইচ হলের ছাত্র ছিলাম। একদিকে ঢাকা হল, অন্যদিকে ছিল এফ এইচ হল। শহীদুল্লাহ হলও ছিল ওপাশে। ওখানে থাকতাম। আর বাড়ি যেহেতু ঢাকায় স্থায়ী, মাঝেমধ্যে বাসায়ও থাকতাম। ভালো ছাত্র ও যোগ্যতা অনুযায়ী হলে সিট পেয়েছিলাম। সেখানে আবার আমার বন্ধুরাও থাকত।

তখন আমাদের স্নাতকের প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা হবে। ক্লাস হতো শহীদ মিনারের কাছে এক বিল্ডিংয়ে। একদিন প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে প্র্যাক্টিস করছি, হঠাৎ ‘মানি না, মানবো না’ স্লোগান নিয়ে মিছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণার বিরুদ্ধে ছিল এ মিছিল। আমরাও আন্দোলনে ছিলাম। আমরা ক্লাশ থেকে বের হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু তখন এসে ওঠেন স্টেডিয়ামের ওখানে ডিআইটি বিল্ডিংয়ে। ওখানে উনি মিটিং করে এলেন। সবাইকে বললেন, পর পর হরতাল চলতে থাকবে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্ররা সংগঠিত হয়েছিল। ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত এভাবে আন্দোলন চলে।

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?

আব্দুল কাইয়ুম: আমার মাথায় ছিল, আমাদের শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানুষকেও সচেতন করতে হবে। জনসাধারণকে তাদের জীবন, উন্নত মান, জীবন নিয়ে ভাবানো—এককথায় এটিই ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা।

আব্দুল কাইয়ুমের লেখা প্রশ্নোত্তরে 'বিজ্ঞানের কী ও কেন' বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রশ্ন: বিজ্ঞানচিন্তা নামে জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক আপনি। এই ম্যাগাজিন শুরু করার পেছনের যাত্রাটা যদি সংক্ষেপে আমাদের বলেন…

আব্দুল কাইয়ুম: আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ি, তখন আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন বঙ্গজীত দত্ত। উনি গণিত পড়াতেন। তিনি এসে আবার পড়া ধরতেন। একদিন পড়াতে পড়াতে বললেন, তিনি রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছেন। আব্দুল কাইয়ুম একজন বিজ্ঞানী হয়েছে। বড় হয়ে অনেক বই লিখেছে। আমার মাথায় তখন ঢুকল যে বিজ্ঞানের দিকে যেতে হবে। তারপর যখন আমি লেখালেখি শুরু করি, বিজ্ঞানকে লেখায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করি। আমার অনেক লেখাতেই কিন্তু বিজ্ঞান আছে।

প্রথম আলোয় আসি, এর আগে ছিলাম ভোরের কাগজ-এ, আমি ছিলাম সেখানে, মতি ভাই (প্রথম আলো সম্পাদক) ছিলেন। সেখানে বললাম, আমি বিজ্ঞান নিয়ে লিখব। তখন ‘কী ও কেন’ অংশে আমি লেখা শুরু করলাম। যেমন আকাশের তারা মিটমিট করে জ্বলে কেন, আমরা বাতাস থেকে অক্সিজেন কীভাবে নিই—এসব। মূলত যেসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা সব সময় চিন্তা করতাম, কিন্তু উত্তর পেতাম না, সেগুলো নিয়ে লিখতাম। তারপরে একদিন দু-একজন প্রকাশক এসে বললেন, আমার লেখা ছাপাবেন। আমি বললাম, ছাপুন। তারপর ইউপিএলের (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) একজনের কাছে গেলাম। তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করলেন। তাঁরা খুবই হাই কোয়ালিটি লেখা ছাপান। আমার লেখা পড়ে বললেন, ঠিক আছে। তখন আমি ধারাবাহিকভাবে ‘কার্যকারণ’ নাম দিয়ে লেখা শুরু করি। এটি কিন্তু এখনো ছাপা হয়। প্রায় ১০টি বই বের হয়েছে।

সবই ছিল এমন ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর। এরপর প্রথমা প্রকাশন থেকে, শিশু একাডেমি থেকেও আমার এমন বই প্রকাশিত হয়েছে। একদিন আমরা আলোচনা করলাম, মতি ভাইও বললেন—তুমি একটা ম্যাগাজিন বের করো প্রথম আলো থেকে। তখন এই মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকা এল। আমরা নাম দিলাম বিজ্ঞানচিন্তা। এতে আমার সঙ্গে বাসারও (বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার) ছিল, এখনও আছে। প্রথমা থেকেও বিজ্ঞান নিয়ে কিছু বই বের হচ্ছে, কেন কেন এবং কেন—এমন বই। আমার আরও কিছু চিন্তা আছে। একটা চিন্তা আছে, সেটা হয়তো প্রথম আলো থেকেও করতে পারি বা অন্য কোথাও থেকে। এটা একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমি মনে করি। তবে এ বিষয়ে এখন আলোচনা করতে চাই না।

আব্দুল কাইয়ুমের লেখা 'বিজ্ঞান কমিকস: কী ও কেন'-এর প্রচ্ছদ

প্রশ্ন: বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদনা ও কিশোর আলোয় লেখার মাধ্যমে দেশব্যাপী তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে যে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছেন, এটি তাদের সৃজনশীল মনোভাবকে উৎসাহিত করতে কীরকম ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন?

আব্দুল কাইয়ুম: এ ব্যাপারে আমি একটি কথাই বলব—সবাই যে বিজ্ঞানী হবে, তা না। সবাই যে একেবারে ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি সবকিছু জানবে, বুঝবে—তাও আমি মনে করি না। তবে সবার এমন একটা জায়গায় আসা দরকার, যেখানে সে বিজ্ঞান না বুঝলেও তার মূলকথাটা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে। এতে করে আমাদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার সূত্রপাত ঘটবে। যেটা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘নেভার স্টপ আস্কিং কোশ্চেন।’ মানে, কখনো প্রশ্ন করা থামানো যাবে না। সব প্রশ্ন করো, জেনে নাও। যারা প্রশ্ন করে, তাদের হতাশ করো না। যতটা পারো, তাকে উত্তর দাও। এটি কিন্তু অনেক বড় একটি শিক্ষা।

আমরা যারা অভিভাবক আছি, আমাদের ছেলেমেয়ে বা আশপাশে যারা বাচ্চা, তাদের আমরা বলি, ‘চুপ থাক, এত জানার দরকার কী? বেশি কথা বলে।’ এটা বললে কিন্তু জানার আগ্রহ কমে যায়। তখন সে নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠে। আর আমি যাকে উৎসাহিত করব, সে অনেক জানবে, তার আগ্রহ থাকবে এবং এ আগ্রহ থেকে সে অনেক ওপরে উঠতে পারবে। এটা বিজ্ঞানচর্চার অনেক বড় একটি অংশ। সে জন্য আমি মনে করি, বিজ্ঞান নিয়ে এমন কিছু লেখা থাকা দরকার, যা তাকে আরও জানতে, আরও প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে। এতটুকু যদি করতে পারি, তবে আমি বলব, আমি সন্তুষ্ট। আমি যেটা চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি।

কিন্তু ব্যাপার হলো কী, সহজ করে লেখা খুব কঠিন। আমি যখন তাত্ত্বিক গবেষণাপত্র লিখব, তখন কিন্তু আমার পাঠক কমে যাবে। কিন্তু এটারও দরকার আছে। যে জীববিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে চায়, তাকে এই ছোট গণ্ডিতে থাকলে তো হবে না। তাকে আরও জানতে হবে। সেটাও একটা সফলতা। এটাও বিজ্ঞানচিন্তার মাধ্যমে আসবে বলে আমি মনে করি।

বিজ্ঞান উৎসব ২০২২-এ আগ্রহী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য রাখছেন আব্দুল কাইয়ুম

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধিৎসু ও কৌতুহলী মনোভাবকে আরও উজ্জীবিত করতে এবং দক্ষতা বিকাশে সহশিক্ষা কার্যক্রম কীরকম ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

আব্দুল কাইয়ুম: সহশিক্ষার প্রয়োজন আছে। আমাদের হয়েছে কী, প্রথম থেকে একটা চিন্তা—মেয়েরা সব পারে না; ছেলেরা রান্না করতে পারে না, মেয়েরা আবার পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। তবে এখন দেখা গেছে, মানুষ এখন এই অনেক দিনের চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এখন ধরো, আধুনিক রাষ্ট্র যেগুলো, মেয়েরাও অফিসে যাচ্ছে। পরিশ্রমের কাজ, বুদ্ধির কাজ করছে। ছেলেরাও কাজ করছে। ছেলে-মেয়ে পার্থক্য যেন না থাকে এবং সবার সাথে যে আচার-আচরণ, সেটা যেন মর্যাদাসম্পন্ন হয়।

আর সহশিক্ষা কার্যক্রমের মূল বিষয় হলো, স্কুলে তো সব একদম শিখিয়ে দেওয়া যায় না। ছেলে-মেয়েরা সেগুলো সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিখবে। শিক্ষকদেরও এদিকে মনোযোগী হতে হবে। আধুনিক শিক্ষায় যা হয়, ৯ম-১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সব পড়তে হয়। টিচারদের কাজ হচ্ছে, কে কী ভালো পারে, তা দেখা। সে অনুযায়ী তাকে অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া।

উচ্চশিক্ষার জন্য কিছু পরীক্ষা দিতে হয়, যেমন স্যাট (SAT), জিআরই (GRE)। এসব পরীক্ষায় বুদ্ধির পরীক্ষাও নেওয়া হয়। তবে অনেকে এসব পরীক্ষা দিতে চায় না। এজন্য আলাদা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। আসলে এগুলো করা উচিত। সহশিক্ষার মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ হয়। 

প্রশ্ন: বর্তমান বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন এআই প্রযুক্তি মানুষের কর্মক্ষমতা যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি এর অপপ্রয়োগের বিষয়টিও সবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী ?

আব্দুল কাইয়ুম: আমি আসলে এটার ভালো বা খারাপ দিক নিয়ে চিন্তা করি না। এটাকে আমি একটা আধুনিক প্রযুক্তি মনে করি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর অবদান রাখার অনেক সুযোগ আছে। যদি এআই না থাকত, তবে হয়তো তিনজন তিনটি মত আমাকে দিত। তিনজন তিন ধরনের কাজ করত। আমি সেখান থেকে গবেষণা করে এগোতাম। এআইও তো এমনই। এ ছাড়া এটা অনেক কাজ সহজে করে দিতে পারে। শুধু ওকে বলে দিলেই হয়। তবে কী করছে, সেটা আমাকে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। 

আব্দুল কাইয়ুম গণিতের বইও লিখেছেন কিশোরদের জন্য

প্রশ্ন: আগামী ৫০ বছর পর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চিত্র আপনার কাছে কীরকম? সেই সম্ভাবনাময় আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আব্দুল কাইয়ুম: আমার মনে হয়, আধুনিক এ যুগে তোমাদের প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে এবং তা হবে। আগামী ৫০ বছরে বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের যে পার্থক্য, তা ঘুচে যাবে অনেকটা। এখনও দেখা যায়, আমাদের আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানচর্চা করা তরুণ আছে। প্রথম আলো এগুলোর কথা নিয়মিতই প্রকাশ করে। যেমন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেখানো হয়েছে, যেকোনো এক গরীব ঘরের ছাত্রী মানসম্মত রেজাল্ট করেছে, তাকে আমরা এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে (এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ) ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলাম। এখন সে প্যারিস চলে গেছে। সে ছিল একজন সাধারণ মেয়ে, এখন ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ সব ভাষা শিখেছে এবং সেরা জায়গায় কাজ করছে। এভাবে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। আরও নানাভাবে এগোচ্ছে। এই তরুণদের আরও সুযোগ করে দিতে হবে আমাদের। আমি মনে করি, এভাবে এগোতে পারলে ৫০ বছর পর আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব।

মজায় গণিত শিখতে পারবে কিশোর-কিশোরীরা 'সরস গণিত' পড়ে

প্রশ্ন: ঢাকা কলেজ সায়েন্স ক্লাবের সদস্য বা এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের জন্য আপনার বার্তা কী ?

আব্দুল কাইয়ুম: তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম, তোমাদের—তরুণদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা। তোমরা বিভিন্ন প্রশ্ন করে যে জানার চেষ্টা করছ, তোমরা যা চিন্তা করছ, এটা ঢাকা কলেজে গড়ে উঠছে। আমি আশাবাদী যে আমাদের তরুণরা আরও জানা, বোঝার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাবে। এ জন্য খোলা মন রাখতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ইচ্ছা থাকতে হবে। আর তাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা এমন হতে হবে যেন তারা অপরকে উৎসাহিত করতে পারে। এতে আমাদের সমাজও উন্নত হবে। কিন্তু তাদের নিয়ে হয়তো প্রচার হয় না। তারা তাদের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। তারা এগিয়ে যাবেই। আমরা যারা অভিভাবক আছি, আমাদের চিন্তা করতে হবে কীভাবে তরুণদের চিন্তা-চেতনা, উদ্দীপনা সবার সামনে নিয়ে আসা যায়।