ঘ্রাণশক্তিতে পিছিয়ে নেই মানুষও!

শুরুতেই আপনাদের এক কুকুরের গল্প শোনাই। এ এক আশ্চর্য কুকুর। এর নাম ববি। ইতিহাসে খ্যাত ‘ববি দ্য ওয়ান্ডার ডগ’ নামে। তো একবার তার মালিক ইন্ডিয়ানায় ঘুরতে গেছে। সঙ্গে তাকেও নিয়ে গেছে। একপর্যায়ে দেখা গেল, ববিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কই গেল? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না ববিকে। বাধ্য হয়েই তার মালিক তাকে রেখেই চলে এল ওরিগনের নিজ বাড়িতে। এর মাঝে কেটে গেল ছয় মাস। এক দিন হঠাৎ দেখা গেল ববি ফিরে এসেছে বাড়িতে। তাদের বিস্ময় আর ফুরায় না!

বিস্মিত হওয়ারই কথা। কারণ, ইন্ডিয়ানা থেকে ওরিগনের দূরত্ব ২ হাজার ৫৫১ মাইল। ববিকে পাড়ি দিতে হয়েছিল মরুভূমি, পাহাড়ি এলাকাও। এহেন কীর্তির কারণে তাকে নিয়ে পরে সিনেমাও বানানো হয়েছে। সেই সিনেমার নাম দ্য কল অব দ্য ওয়েস্ট। অনেক আগের সিনেমা। নির্বাক ছবির আমলের।

ববির ঘটনা তো গেল, এবার প্রিন্সের ঘটনা বলি। প্রিন্স নাম শুনে ভাববার কোনো কারণ নেই সে কোনো রাজা-বাদশাহর ছেলে বুঝি! মোটেও তা নয়! সে এক আইরিশ কুকুর। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। প্রিন্সের মালিক একজন সৈনিক। ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন। যুদ্ধে তাঁর পোস্টিং হলো ফ্রান্সে। প্রিন্সকে বাড়িতে রেখে গেলেন। প্রিন্স ছিল খুব প্রভুভক্ত। খুঁজে খুঁজে ঠিকই হাজির হলো ফ্রান্সে। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্রিন্স কী করে ফ্রান্সে গিয়েছিল, সেটা আজও বিস্ময় সবার কাছে।

এত লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ববির ফিরে আসা কিংবা প্রিন্সের মনিবকে খুঁজে পাওয়া কীভাবে সম্ভব! এ জন্য আমরা স্মরণ নিতে পারি টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বনি বেভারের। তিনি জানাচ্ছেন, কুকুরের আছে অসাধারণ ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা। তারা একবার যে পথ দিয়ে গেছে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেই পথ দিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। আর সে জন্য ঘ্রাণশক্তির বিচারে মানুষের চেয়ে কুকুরের অবস্থান ছিল অনেক ওপরে।

কিন্তু এত দিন মিথ্যা জেনে এসেছি। এমনটাই বলছেন রাটগারস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও স্নায়ুবিজ্ঞানী জন ম্যাকগ্যান। ঘ্রাণ চিনতে পারার ক্ষেত্রে মানুষ কুকুরের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। প্রায় সমানে সমান। সায়েন্স সাময়িকীর ১২ মে সংখ্যায় জন ম্যাকগ্যান তাঁর গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, সত্যি বলতে মানুষের ঘ্রাণশক্তি অনেক প্রখর। এমনকি তা কুকুরের সমগোত্রীয়। মানুষ প্রায় এক লাখ কোটি গন্ধ আলাদাভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম।

তাহলে এত দিন ধরে যে ভুল ধারণা, এর ভিত্তি কী? ভিত্তি হলো মানুষের অলফ্যাক্টরি বাল্বের আকৃতি নিয়ে ধারণা। উল্লেখ্য, প্রাণীদের ঘ্রাণশক্তির বিষয়টি নির্ভর করে অলফ্যাক্টরি সিস্টেমের ওপর। স্তন্যপায়ী সব প্রাণীর ক্ষেত্রে এ স্নায়ুর কার্যকারিতা প্রায় এক রকম। এত দিন মানুষের অলফ্যাক্টরি বাল্বের আকৃতি ছোট বলে ধরে নিয়ে ঘ্রাণশক্তি কম বলে মনে করা হতো।

কিন্তু জন ম্যাকগ্যানের গবেষণা এটিকে ভুল প্রমাণিত করেছে। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের অলফ্যাক্টরি বাল্ব আসলে বেশ বড়। এর মাধ্যমে আমরা চারপাশ থেকে যেসব গন্ধ নিই, তা বাছবিচার করার জন্য মস্তিষ্কের যে নির্দিষ্ট এলাকা রয়েছে, সেটা অন্য সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর সমান। ফলে অন্য প্রাণীদের চেয়ে মানুষের সক্ষমতা কম নয়। তাই বলা যায়, ঘ্রাণশক্তির ক্ষেত্রে কুকুরের চেয়ে মানুষ কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

লেখক: বিজ্ঞানকর্মী ও সাংবাদিক

সূত্র: সায়েন্স জার্নাল

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত