তাপপ্রবাহ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং করণীয়

জ্যৈষ্ঠ মাসে তীব্র মাত্রার গরম পড়বে, এটা স্বাভাবিক এবং তা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। গ্রীষ্মের দুপুরে তীব্র গরমের বর্ণনা বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। কড়া রোদে রাস্তার পিচ গলে যায়।

মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়। পশুপাখি, গাছপালা সবই যেন খরতাপে কাতর হয়ে পড়ে। এই স্বাভাবিক জলবায়ু-সংক্রান্ত প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে ইদানীং বৈশ্বিক পর্যায়ে নতুনভাবে ভাবা হচ্ছে। কারণ, গ্রীষ্মকালে গরমের যে স্বাভাবিক রূপ ছিল, তা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে তা বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের কারণ ঘটাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা অর্থাৎ পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে আর্দ্রতা বাড়া।

কোনো একটি স্থানে, কোনো একটি সময়ে গত ৩০ বছরের অথবা গত তিন দশকের তাপমাত্রার গড়কে ওই স্থানের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এভাবেই স্বাভাবিক গড় উচ্চ তাপমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়। যদি এই স্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা থেকে ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৫-৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি পরিলক্ষিত হয়, তখন একে তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (World Meteorological Organization) পাঁচ দিন ধরে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা হলে তাকে তাপপ্রবাহ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক তাপমাত্রা তিন দিনের বেশি পরিলক্ষিত হলে তাকে তাপপ্রবাহ বলেছে। ভারতীয়দের হিসাবে, বাতাসের আর্দ্রতার সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রা হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়, এই তথ্যের ভিত্তিতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক মাত্রাকে তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

স্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা হিসাব করতে ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালকে স্বাভাবিক সময় ধরা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর তাপপ্রবাহ এবং এর প্রভাব নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে। গত বছর ভারতে ৩ হাজার ৫০০-এর অধিক লোক তাপপ্রবাহে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ওই দেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত মানুষ মারা যায়, তার থেকে বেশি মানুষ মারা যায় তাপপ্রবাহে।

বাতাসের তাপমাত্রার সঙ্গে আপেক্ষিক (Relative humidity) আর্দ্রতাকে সম্পৃক্ত করে তাপপ্রবাহের মাত্রা (Heat index value) নির্ণয় করা হয়। প্রদত্ত সারণিতে সাদা, হলুদ, কমলা ও লাল—এই চার রঙের মাধ্যমে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এই ইনডেক্সের মান ৩৩-এর কম হলে শুধু সাবধানতা অবলম্বন করলেই হবে। অর্থাত্ এ ক্ষেত্রে অনুভূত তাপের মান ৩৩ ডিগ্রির কম হবে। ৪০-এর মতো থাকলে তা বিপজ্জনক। আর ৫০ বা ৫৫ ছাড়িয়ে গেলে মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অর্থাত্ ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট, বাতাসের আর্দ্রতা ৪০ শতাংশ থাকে তাহলে Index-এর মান হবে ৩৭। কিন্তু আর্দ্রতা ৭০ শতাংশের ওপরে উঠলেই তা মারাত্মক বিপদের স্তরে পৌঁছে যাবে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলে আর বাতাসের আর্দ্রতা ৫০ শতাংশ থাকলেই তা মারাত্মক বিপদ নির্দেশ করবে। এই মানগুলোকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৪০ শতাংশ আর্দ্রতা হলে তা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মতো অনুভূত হবে। কিন্তু ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যদি বাতাসে ৭০ শতাংশ আর্দ্রতা পরিলক্ষিত হয়, তাহলে সেই তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো অনুভূত হবে। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং আর্দ্রতা ৯৫ ভাগ হলে বাইরে তা ৪২-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হবে। এই চার্ট ব্যবহার করে আমরা আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও তাপের মান মিলিয়ে বাইরে কী ধরনের তাপমাত্রা অনুভূত হবে, তা বুঝতে পারব। অর্থাত্ এই চার্টের মাধ্যমে বাতাসের প্রকৃত তাপমাত্রার সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা মিলিয়ে কত গরম অনুভূত হবে, তা নির্ধারণ করা যায়।

আমাদের শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। অর্থাত্ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত বাইরের তাপমাত্রা শরীরের ওপর প্রভাব ফেলার কথা নয়। কিন্তু ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যদি ৭০ ভাগ আর্দ্রতা থাকে, অনুভূত তাপমাত্রা হবে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১৩৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, মরুভূমিতে বা আরব দেশে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট নিয়মিত তাপমাত্রা হয়, তাহলে তারা টিকে থাকে কী করে? উত্তর খুবই সহজ। কারণ, সেখানে বাতাসের আর্দ্রতা খুবই কম।

তাপপ্রবাহে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৃদ্ধ, শিশু এবং যারা বাইরে কাজ করে। গবাদিপশুও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাপপ্রবাহকে এখন নীরব ঘাতকও বলা হচ্ছে। শুষ্ক আবহাওয়ার অঞ্চলে তাপপ্রবাহের প্রভাব ততটা পরিলক্ষিত না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এই ব্যাপারে ইতিমধ্যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হচ্ছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপপ্রবাহে হিটস্ট্রোক হতে পারে। সেই সঙ্গে তীব্র তাপমাত্রায় পুড়ে যেতে পারে চামড়া। এমনকি জ্বর হওয়ার প্রকোপও বেড়ে যেতে পারে। চামড়া পুড়ে লাল হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া শিরটান (Cramp) রোগ হয়ে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে রাখতে হবে। তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতা মিলিয়ে দেখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে, যাতে আমাদের শরীর পানিশূন্য না হয়ে যায়। পানিশূন্যতা ঠেকাতে বা কষ্ট অনুভূত হলে লবণ পানি, লেবুর রসযুক্ত পানি বা লেবুর শরবত; খাবার স্যালাইন খাওয়া যেতে পারে। বুদ্বুদ উত্পাদন করা পানীয় পান না করাই ভালো। এমনকি চা অথবা কফি পান করাও ভালো না। হালকা রঙের সুতি পোশাক পরিধান করা যেতে পারে এবং খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন হয় ঢিলেঢালা। দিনের বেলায় ঘরের বাইরে বের হলে চোখে সানগ্লাস ব্যবহার করা ভালো। তীব্র রোদে মাথা ঢেকে রাখা উচিত এবং টুপি কিংবা ছাতা হলে আরও ভালো হয়। সরাসরি সূর্যের আলো পরিহার করা উচিত। পোষা জীবজন্তুকে ছায়ায় রাখা উচিত।

বিশ্ব ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। ২০১৬ সালটি এযাবত্ কালের সবচেয়ে উষ্ণ বছর ছিল। উষ্ণতার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতাও বাড়ছে। কাজেই তাপপ্রবাহ-সংক্রান্ত সমস্যা দিন দিন বাড়বে।

লেখক: ইমিরেটাস অধ্যাপক, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়