'বিশ্ব গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মেধা এ দেশের শিক্ষার্থীদের আছে - মোহাম্মদ আখতার হোছাইন'

বাঙালি বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক মানবদেহে থাকা প্রোটিনের পেপটাইডভিত্তিক ওষুধ তৈরির নতুন এক রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফলসহ গবেষণাপত্রটি ১৩ জুলাই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি-তে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রোটিনের গঠনের সঙ্গে আকৃতিতে মিলে যায়, গবেষণাগারে এমন কৃত্রিম পেপটাইড তৈরির নতুন রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তাঁরা। এ পদ্ধতির নাম ‘নন-কোভ্যালেন্ট পেপটাইড স্ট্যাপলিং’। এই পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে কৃত্রিম পেপটাইড তৈরি করা যাবে, যা প্রোটিনের মতো কার্যকর। এই পেপটাইড স্নায়ুরোগসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগানো যাবে।

এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। তিনি ফ্লোরে ল্যাবের দি ইনসুলিন পেপটাইডস গ্রুপের প্রধান এবং এই গবেষণা দলের নেতা। ১৯৯৮ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ণ বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি করতে পাড়ি জমান জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। এরপর ২০০৫ সালে কর্মসূত্রে যুক্ত হন ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে। ২০১২ সাল থেকে তিনি সেখানকার একটি গবেষণাগারের প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর গবেষণায় কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন উত্পাদনসহ মানবদেহের নানা রকম হরমোনের বিষয় নতুনভাবে ধরা দিয়েছে গোটা বিশ্বের গবেষকদের চোখে। বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা প্রকাশিত হলো।

বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আখতার হোছাইন
প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি তো কৃত্রিম রাসায়নিক ইনসুলিন তৈরি করছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

মোহাম্মদ আখতার হোছাইন: আপনি বাজারে যে ইনসুলিন পাবেন সেটি কিন্তু ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো অর্গানিজম থেকে তৈরি করা। কিন্তু আমাদের গবেষণাগারে আমরা ইনসুলিন তৈরি করছি রাসায়নিকভাবে। চেষ্টা করছি খরচ কমানোর। রাসায়নিকভাবে তৈরি করার একটি সুবিধা হলো যে আপনি তখন আপনার বিশেষ প্রয়োজনের জন্য বিশেষ ইনসুলিন উত্পন্ন করতে পারবেন। একটা অর্গানিজম থেকে তৈরি ইনসুলিনের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সাধারণ ইনসুলিন ফ্রিজে রাখতে হয়। কিন্তু রাসায়নিক ইনসুলিন ফ্রিজ ছাড়াও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। সম্প্রতি আমার একটি গবেষণা নিবন্ধে আমি দেখিয়েছি যে প্রায় চার দিন সাধারণ তাপমাত্রায় কিংবা ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপেও আমাদের গবেষণাগারে বিশেষভাবে তৈরি করা ইনসুলিন সংরক্ষণ করা যায়, সে চেষ্টাও আমরা করছি।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: এই বিশেষ ইনসুলিন কবে সাধারণ মানুষের হাতে আসবে?

মোহাম্মদ আখতার হোছাইন: মাত্র এর কাজ শুরু হয়েছে। মানুষের হাতে পৌঁছাতে সময় লাগবে। কারণ রাসায়নিকভাবে এ রকম ইনসুলিন তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল। আমরা চেষ্টা করছি কম খরচে এ ধরনের ইনসুলিন তৈরি করতে। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কবে এটা সাধারণ মানুষের হাতে আসবে।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার এই গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হতে পারে?

মোহাম্মদ আখতার হোছাইন: আমাদের গবেষণা আসলে সারা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কোথায় গবেষণা হচ্ছে সেটা ব্যাপার নয়। ইনসুলিনজনিত সমস্যাটি গোটা বিশ্বেই কমবেশি রয়েছে। আমাদের এই গবেষণায় সারা বিশ্বের মানুষই উপকৃত হবে। এ ছাড়া আমাদের গবেষণাগারে বাংলাদেশের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিই। তারা দেশে ফিরেও এমন গবেষণা করতে পারবে। আমাদের উদ্দেশ্য সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইনসুলিন আরও সহজলভ্য করা।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশের যেসব তরুণ গবেষণায় যোগ দিতে চান তাঁদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

মোহাম্মদ আখতার হোছাইন: তরুণদের বলি, স্বপ্ন দেখো। আগের তুলনায় আমাদের দেশে এখন গবেষণার সুযোগ অনেক বেশি। বিশ্বমানের বেশ কিছু গবেষণাগার দেশে গড়ে উঠেছে। আইসিডিডিআরবিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কিন্তু এখন অনেক বিশ্বমানের গবেষণাপত্র বড় বড় জার্নালে প্রকাশ হচ্ছে। তাই এখন যদি কেউ গবেষণা করতে চায়, আমাদের কিন্তু দেশেই কাজ করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের উচিত হবে তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়কে কাজে লাগানো। সারা বিশ্বে কী ধরনের গবেষণা চলছে সে বিষয়ে তাদের খোঁজখবর রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের শুধু বিসিএসের চিন্তা করলে চলবে না। সারা বিশ্বকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে সারা বিশ্বের গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মেধা এ দেশের শিক্ষার্থীদের আছে। এ ছাড়া গবেষণার জন্য যে সব সময়ই খুব দামি গবেষণাগারের প্রয়োজন হয়, সেটাও কিন্তু নয়। সামান্য হিসাব-নিকাশ দিয়েও কিন্তু অনেক ভালো মানের কাজ করা যায়। তাই নিজেদের চেষ্টা ও ইচ্ছা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

অনুলিখন: আলিমুজ্জামান

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত