লোহাকাহন

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে লোহা আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে প্রাচীন এশিয়া মাইনরে (বর্তমানে তুরস্ক) হিট্টি জাতি খনিজ থেকে প্রথম লোহা নিষ্কাশন করতে পেরেছিল। তবে তারা দীর্ঘদিন এই পদ্ধতি গোপন রেখেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালে তারা বহিরাগতদের আগ্রাসনের কবলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। তাতে লোহা তৈরিকারীরাও পালিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মহামূল্যবান এই দক্ষতাও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। এভাবেই শুরু হলো ইতিহাসের লৌহ যুগ অধ্যায়।

একসময় লোহা সোনার চেয়েও দামি ছিল। তাই সোনার ওপর লোহা বসিয়ে অলংকার তৈরি করত প্রাচীন মানুষেরা। পরের কয়েক শতাব্দী কোনো যোদ্ধার হাতে লোহার তলোয়ার থাকা মানেই সে যেন অজেয়। তা দেখে প্রাচীন রোমান দার্শনিক প্লিনি কল্পনা করেছিলেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে লোহা ব্যবহার হবে। তখন মানুষ শুধু মুখোমুখি বা হাতাহাতিই করবে না, বরং শত্রুরা অনেক দূর থেকে পাখাওয়ালা অস্ত্র ছুড়বে। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের ব্যবহার প্লিনির ভবিষ্যদ্বাণীর সফলতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবেই দেখেন অনেকে। গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধেও ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে অনেকাংশে দায়ী লোহা।

বিভিন্ন মাপকাঠিতে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলের তালিকায় আছে লোহা। নক্ষত্রের ভেতরে নিউক্লিয়ার ফিউশনের সবচেয়ে ভারী যে মৌলটি তৈরি হয়, সেটি লোহা। বিশাল ভরের নক্ষত্রগুলো তাদের কেন্দ্রে বিভিন্ন মৌল তৈরি করে। ভূত্বক ও গলন্ত কোর হিসেবে ধরলে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচুর্যময় মৌল লোহা। পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্রের পেছনে লোহার ভূমিকাই প্রধান। এই চুম্বকীয় ক্ষেত্রই ক্ষতিকর মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। লোহা ছাড়া বর্তমান সভ্যতার কথা ভাবাও কঠিন। আক্ষরিক অর্থেই লোহা ছাড়া আমাদের শিল্পকারখানা মুখ থুবড়ে পড়বে। আর মানুষসহ উন্নত প্রাণীর রক্তের প্রোটিন তথা হিমোগ্লোবিনে থাকে লোহার পরমাণু, যা দেহকোষে অক্সিজেন বহন করে। আর এই প্রোটিনের কারণেই রক্ত লাল দেখায়। লোহার রাসায়নিক নাম ফেরাম (ferrum)। এ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে, যার অর্থও লোহা। আর লোহার রাসায়নিক সংকেত Fe দেওয়া হয়েছে এই ল্যাটিন নাম থেকেই।