অ্যারিস্টোটল, নিউটন ও মহাকর্ষ বলের গল্প

গ্যালিলির হাত ধরে আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম। জন্ম আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও। গ্যালিলিও প্রকৃতির সামান্য কিছু রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় সত্যিকারের গতি আসে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের হাত ধরে। তাঁর গতিসূত্র আর মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কারই পদার্থবিজ্ঞানের বৈপ্লবিক সূচনা।

মহাকর্ষ বল আবিষ্কারে কি নিউটনের ভূমিকাই মূখ্য? তার আগে কি আর কেউ এ কথা ভাবেনি। অনেকেই ভেবেছিল, কিন্তু সে ভাবনা-চিন্তাগুলোয় অনেক ফাঁক-ফোঁকর ছিল। নিউটন সেসব ফাঁক-ফোকর বুঁজিয়ে মহাকর্ষ বলকে একটা স্থায়ী কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে দেন।

দুই

খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক শ বছর আগের কথা। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে একছত্র দাপট গ্রিক পণ্ডিতদের। অ্যারিস্টোটলের নেতৃত্বে গ্রিক জ্ঞানের ঝাণ্ডা পত পত করে উড়ছে তখন।

সেকালে পৃথিবীকে সমতল মনে করত মানুষ। তখন স্বাভাবিকভাবেই ওপর-নিচ-এর ধারণাটা ছিল পরম। মনে করা হত, যেসব বস্তু বা প্রাণী স্বর্গীয় তাদের অবস্থান ওপরে, স্বর্গপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় তাদের অবস্থান মাটিতে কিংবা পাতালপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় সেগুলোকে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে একটা সময় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। তারপর এক সময় প্রমাণ হলো পৃথিবী সমতল নয়, গোলাকার। অ্যারিস্টোটল রীতিমতো যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেন পৃথিবী গোলাকার। তখন ওপর-নিচের অগের তত্ত্ব ভেঙে পড়ে। তাই পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে আগের ধারণা আর টেকেনি। বস্তু কেন ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে তা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে তার নতুন সমাধান দরকার হয়। অ্যারিস্টোটল আরেকটা মতবাদ দেন। সেটা হলো—পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আকাশের সব গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সকল বস্তুর গতি তাই পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। এজন্য বস্তুকে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলেও তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। শুধু আগুনের বিষয়টা একটু আলাদা। এর ভেতরে কঠিন পদার্থের ধর্ম অনুপস্থিত। তাই আগুন পড়ন্ত বস্তুর এই নিয়ম মেনে চলে না। পৃথিবীর কেন্দ্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে যায় ওপরে।

সেযুগে অ্যারিস্টোটলের প্রভাব ছিল অকল্পনীয়। ক্ষমতার দাপট নয়। জ্ঞান-গরিমায় সে কালে তার সমতূল্য কেউ ছিল না। স্বয়ং সম্রাট পর্যন্ত অ্যারিস্টোটলের যেকোনও কথা অন্ধের মতো মেনে নিতেন।

অ্যারিস্টোটল বলেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। গ্রহ-নক্ষত্রসহ সকল বস্তু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তার এই ভুল বিজ্ঞানের ইতিহাসে কালিমা লেপন করে রেখেছিল প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত। তবে কয়েকটা জায়গায় অ্যারিস্টোটল ঠিক ছিলেন। পৃথিবী যে গোলাকার একথা তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন।

অ্যারিস্টোটলের কিছু তত্ত্বের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন সে যুগের আরেক দার্শনিক অ্যারির্স্টাকাস। বিশেষ করে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, এ কথাটি তিনিই প্রথম বলেন। কিছু জ্যামিতিক পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হন সূর্য পৃথিবী থেকে বড়। বড় কোনো বস্তু তারচেয়ে ছোট বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরবে, এ কথাটা মানতে পারেননি অ্যারিস্টার্কাস। তিনি বললেন, পৃথিবী বাকি সব গ্রহগুলোর মতোই সাধারণ একটা গ্রহ। গ্রহগুলো সব সূর্যের চেয়ে ছোট। তাই সব গ্রহই তাদের চেয়ে বড় সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে বাধ্য। অ্যারিস্টার্কাসের দৃঢ় বিশ্বাস, দূর আকাশে যেসব তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে, সেগুলো একেকটা সূর্য ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু অ্যারিস্টার্কাসের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। তাহলে যে অ্যারিস্টোটলকে অবিশ্বাস করতে হয়!

কেনই বা সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে। কেন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না অনন্ত সহাকাশের দিকে? এ প্রশ্নের সমাধান তিনি দিতে পারেননি অ্যারিস্টার্কাস।

সে কালে বৈজ্ঞানিক সমাধানের জন্য সরাসরি পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করা হত না। পণ্ডিতেরা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত দিতেন, সেটাকেই সত্যি বলে বিবেচনা করা হতো। অ্যারিস্টোটলের আমলে মনে করা হতো, দুটো আলাদা ভরের বস্তুকে ওপর থেকে ফেললে একই সঙ্গে ভূমি স্পর্শ করবে করবে না। ভারি বস্তুটা আগে এবং হালকা বস্তুটা পরে মাটি স্পর্শ। এ ধারণা শিকড় গেঁড়ে ছিল মধ্যযুগ পর্যন্ত।

তিন

পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের যে ধারণা অ্যারিস্টোটল দিয়েছিলেন, তার ব্যাপক প্রসার হয় গ্রিক দার্শনিক টলেমির কারণে। অ্যারিস্টোটলের বিশ্বকে রীতিমতো একটা কাঠামো দেন তিনি। সেটাই বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়।

এদিকে গ্রিক অ্যারিস্টার্কাসের মতোই সৌরকেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের প্রস্তাব দেন ভারতীয় গণিতবিদ ও দার্শনিক আর্যভট্ট। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের একটা মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন। এরপর দশম শতাব্দীতে আরব বিজ্ঞানী আল হাজেন, একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুনি এবং চতুর্দশ শতাব্দী নাজিদ আল দিন আল খাজিনি সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকে পোক্ত করার চেষ্টা করেন। তীব্র বিরোধিতা করেন টলেমির মডেলের। এর পরেই ইউরোপে আবির্ভাব কোপার্নিকাসের।

কোপার্নিকাস বললেন, অ্যারিস্টোটলের মতবাদ ভুল; সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু কোপার্নিকাসের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। কোপার্নিকাসের মৃত্যুর প্রায় আড়াই দশক পরে জন্ম ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির। তিনি প্রমাণ করেন কোপার্নিকাসই ঠিক। এজন্য অবশ্য গ্যালিলিও অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করতে হয়। কাছাকাছি সময় জার্মান বিজ্ঞানী ইয়াহেনাস কেপলার দেখালেন কীভাবে, কোন পথে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। তিনি গ্রহগুলোর চলার পথের জন্য গাণিতিক সূত্রও আবিষ্কার করলেন।

‌এর মধ্যে গ্যালিলিও গ্যালিলি একদিন লক্ষ্য করলেন আশ্চর্য এক ব্যাপার। পিসার এক গির্জায় একটি ঝাড়বাতি ঝুলছিল। তখনকার দিনে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই ঝাড়বাতি তৈরি হতো অনেকগুলো মোমবাতি একটা বাতিদানে সাজিয়ে। গীর্জার এক কেয়ারটেকার ঝাড়বাতি থেকে পুরোনো মোমবাতি সরিয়ে নতুন মোমবাতি লাগাতে গেলেন। ফলে সেটা দুলতে শুরু করে। সাধারণত কোনো বস্তু যখন দুলতে শুরু করে, তখন তার গতি বেশি থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সেটা থেমে যায় । অর্থাৎ সময়ের সাথে বস্তুটির দোলন-গতি যায় কমে। দোলনের শুরুর দিকে দোলনের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তার বেশি থাকে। পরে গতি কমার সঙ্গে বিস্তারও কমতে থাকে।

গ্যালিলিও লক্ষ করেন, ঝাড়বাতিটির গতি যখন বেশি তখন, এপাশ থেকে ওপাশে যেতে যতটুকু সময় লাগছে, গতি কমে বিস্তার ছোট হয়ে গেলেও বাতিটাকে এপাশ থেকে ওপাশের শেষ বিন্দু যেতে একই সময় লাগছে। গ্যালিলিও বিষয়টা আরও ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য বাড়িতে এসে একটা সরল দোলক তৈরি করেন। ঘরের সিলিং বা কোনো ঝুলন্ত রডের সাথে একটা সুতো ঝুলিয়ে তার নিচে ভারি কিছু বেঁধে সরল দোলক তৈরি করা যায় সহজেই।

গ্যালিলিও তেমন একটা দোলক তৈরি করে পরীক্ষা করে দেখলেন, দোলকের বিস্তার ও কমুক আর বাড়ুক, একটা পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করতে একই সময় লাগে। গ্যালিলিও তখন দোলকের সুতা ও ঝুলন্ত বস্তুটার ভর পরিবর্তন করে দেখলেন। তারপর কিছু সিদ্ধান্তে এলেন—

১. দোলকের দোলন কালের ওপর ঝুলন্ত বস্তুর ভরের কোনো সম্পর্ক নেই।

২. সুতার ভর ও মোটা-চিকনের কোনো সম্পর্ক নেই দোলনকালের সঙ্গে।

৩. দোলনকালের সাথে সুতার দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আছে। সুতার দৈর্ঘ্য বাড়ানো-কমানো হলে দোলনকালের পরিবর্তন হয়।

গ্যালিলিও ভাবলেন, দোলকের এই গতি বস্তুর পতনশীল অবস্থার গতি ছাড়া কিছুই নয়। অর্থাৎ, বস্তুটি যদি সুতো দিয়ে বাঁধা না থাকত, তাহলে সেটা দোলকের এই গতিতেই নিচে পড়ত। আবার ভারী ও হালকা বস্তু একই দোলকে ঝুলিয়ে দিলে তাদের দোলনকালের কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং পতনশীল বস্তু নিচের দিকে পড়তে গেলে পড়ন্ত গতির ওপর বস্তুর ভর কোনো প্রভাব ফেলবে না।

একটা ভারি ও একটা হালকা বস্তু একই উচ্চতা থেকে ফেললে দেখা যাবে এসদুটি একই সময়ে মাটিতে পড়বে- এই ধারণা বদ্ধমূল হয় গ্যালিলিওর মনে। আরেকটা পরীক্ষার কথা ভাবেন তিনি। এ নিয়ে একটা গল্প চালু আছে, গ্যালিলিও নাকি পিসার হেলানো মিনার থেকে একটা ভারি ও একটা হালকা বস্তু একসাথে ফেলে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এই গল্পের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে গ্যালিলিও এ ধরনের একটা পরীক্ষা করেছিলেন, সেটা ঠিক। তিনি উঁচু স্থান থেকে একটা ভারি আর একটা হালকা বস্তু একই সময়ে মাটিতে ফেলেছিলেন। এবং দেখেছিলেন, দুটি একই সময়ে মাটিতে পড়ছে।

চার

গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরে জন্ম নিউটনের। তিনি অগ্রজ বিজ্ঞানীদের কাজগুলোকে পূর্ণতা দিলেন। দিলেন কেপলারের সূত্রের ব্যাখ্যা। গ্যালিলিও জড়তার নীতির গণিতিক প্রমাণ দিলেন। আবিষ্কার করলেন মহাকর্ষের সুন্দর ও কাঠামোবদ্ধ এক সূত্র। এটা নিয়ে একটা গালগল্প আছে। সেটা বোধহয় সবার কম বেশি জানা—আপেলের গল্প। এ গল্পের সত্যতা কতটুকু নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই। তখন লন্ডনে প্লেগ রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে। নিউটন প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে লন্ডন ছেড়ে এক বাস করছেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই তাঁর মাথায় মহাকর্ষ বলের কারণটা মাথায় আসে। সেটা ১৬৬৫ সালে। কাজ শুরু করেন সেটা নিয়ে। সঙ্গে ছিল গতিসূত্রের ব্যাখ্যা। দু বছর খেটেখুটে সেগুলো গণিতের ভাষায় লিখে ফেলন। জন্ম হয় কালজয়ী বই প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা। অদ্ভুত কারণে বইটি তিনি প্রকাশ করেন বিশ বছর পর। মহাকর্ষ, গতিসূত্র আর বলবিদ্যার আসল রহস্য তখন উন্মোচিত বিজ্ঞানী সমাজে।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মূল সুর ছিল, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক। এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপতিক। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলে।

আরেকটু সহজ করে বলা যেতে পারে। দুটি বস্তুর ভর যত বাড়ে, তত তাদের ভরের গুণফলের মানও বাড়ে। সুতরাং বস্তু দুটোর ভর যত বেশি হবে, তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের মানও তত বাড়বে। আবার বস্তু দুটোর দূরত্ব যদি বাড়ে তবে তাদের মধ্যে আকর্ষণ বলের মান কমবে। এই কমার হার বর্গাকারে। অর্থাৎ দূরত্ব যদি বেড়ে দ্বিগুণ হয় তবে মহাকর্ষ বলের মান কমে আগের মানের এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে।

নিউটনের আপেল পড়ার গালগল্পের একটা ইতিবাচক দিক আছে। তাই সেটা নিয়ে আলাপ করা যেতেই পারে। ভাবুন, নিউটনের জায়গায় আপনি একটা আমগাছের নিচে বসে আছেন। ধপাস করে একটা আম আপনার সামনে পড়ল। তাহলে কী ভাবতেন আপনি? আমটা নিচেই বা পড়ল কেন? ওপরেও তো উঠে যেতে পারত।

সেটা হয়নি। কারণ ওই মহাকর্ষ বল। পৃথিবী ও আম পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। মানে টানছে। সেই টানেই আম পৃথিবীর দিকে ছুটে এসেছে।

এখানে আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে, আম কেন পৃথিবীর দিকে ছুটে এলো, পৃথিবীও তো যেতে পারত?

হ্যাঁ, পারত। কিন্তু যায়নি তার ভরের কারণে। পৃথিবীর ভর বেশি, তার স্থিতি জড়তাও বেশি। তাই আমকে নিজের দিকে টানার ক্ষমতাও এর অনেক বেশি। অন্যদিকে আমও পৃথিবীকে নিজের দিকে টেনেছে, কিন্তু পৃথিবীর টানের তুলনায় সেই টান এত কম যে, পৃথিবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকেই ছুটে আসতে হয়েছে। শুধু আম নয়, যেকোনো পড়ন্ত বস্তু একই কারণে পৃথিবীতে এসে পড়ে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, দুটো বস্তুর মধ্যে যার ভর বেশি মহাকর্ষ বল সেদিকেই যদি ক্রিয়া করে, তাহলে চাঁদ কেন পৃথিবীর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে না, সূর্যই বা কেন পৃথিবীকে নিজের দিকে টেনে নেয় না? সেটা জানার আগে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার। অনেকে হয়তো বলবেন, মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তু আরেকটা বস্তুকে টানছে, তাহলে কি পাশাপাশি হেঁটে চলা দুজন মানুষ পরস্পরকে আকর্ষণ করছে?

এ প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই করছে।

তাহলে কেন সেটা আমরা বুঝতে পারি না?

পারি না, কারণ দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলেও তারা কিন্তু মুক্তভাবে নেই। দুজনকেই আকর্ষণ করছে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল। সেই বল আবার তাদেরকে নিচের দিকে আকর্ষণ করছে। আরও আছে পৃথিবীর ওপর চলার জন্য ঘর্ষণজনিত বল।

দুটো মানুষকে মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে পরস্পরের কাছে আসতে হলে পৃথিবীর আকর্ষণ বল আর ঘর্ষণজনিত বল, দুটোর বাধাই টপকাতে হবে। সেটা অসম্ভব ব্যাপার। তাই দুজন মানুষের মধ্যে কিংবা পৃথিবীপৃষ্ঠের দুটো বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বলের প্রভাব খুবই সামান্য। সাধারণভাবে সেটুকু বোঝা যায় না।

মোটকথা, মহাকর্ষ বলের ক্যারিশমা বুঝতে হলে দুটো বস্তুর অন্তত একটা বিরাট ভরের হতে হবে। ধরা যাক, দুটো বস্তুর একটার ভর ১০ কেজি, আরেকটার ২০ কেজি। তাহলে তাদের গুণফল হবে ২০০ কেজি। কিন্তু একটা বস্তুর ভর যদি ১ কেজি এবং আরেকটার ভর যদি ১০০০ কেজি হয়, তবে এদের ভরের গুণফল হবে ১০০০ কেজি। ২০০ কেজির চেয়ে ১০০০ কেজি অনেক বেশি। এখন দুই ক্ষেত্রেই যদি বস্তু দুটোর মধ্যবর্তী দূরত্ব একই হয়, তাহলে প্রথমোক্ত বস্তু দুটোর মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের পরিমাণ নিশ্চয়ই শেষোক্ত বস্তু দুটোর আকর্ষণ বলের তুলনায় কম হবে!

পৃথিবী আর আমের ক্ষেত্রে হিসাব অনেকটা এরকম। আমের ভর যত কমই হোক, পৃথিবীর ভর বিশাল। তাই ক্ষুদ্র আম আর বিরাট পৃথিবীর মধ্যে আকর্ষণ বলও বিশাল।

এখন ফিরে আসি আগের প্রশ্নে, আমই বা কেন পৃথিবীর দিকে ছুটে এলো, পৃথিবী কেন আমের দিকে গেল না?

আসলে যার ভর যত বেশি তার আকর্ষণ করার ক্ষমতাও তত বেশি। অনেকটা চুম্বকের মতো, এটা বিরাট সাইজের বিরাট আকর্ষণ বলের চুম্বকের পাশে একটা ছোট্ট চুম্বক রাখলে, ছোট চুম্বক মুহূর্তের মধ্যে বড় চুম্বকের টানে তার গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। তাই আমই পৃথিবীর ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

পাঁচ

বিরাট ভরের একটা বস্তু শুধু অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করেই দায়িত্ব শেষ করে না। এরচেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় একে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত আমরা জানতাম কেপলারের সূত্রানুযায়ী, সৌরজগতে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘুরছে। কিন্তু কোন্ জাদুবলে গ্রহগুলো তার দিকে ছুটে যাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা কেপলারের সূত্রে ছিল না। ১৬৮৪ সালের দিকের কথা। কেপলারের সূত্র নিয়ে কাজ করছিলেন নিউটনের বিখ্যাত বন্ধু এডমন্ড হ্যালি। এই ভদ্রলোকের নামেই বিখ্যাত হ্যালির ধূমকেতু। একদিন হ্যালি এ নিয়ে নিউটনের সাথে আলাপ করছিলেন। কথায় কথায় নিউটন বলে ফেললেন, কেপলারের সূত্রের সমাধান তিনি ২৫ বছর আগেই করে ফেলেছেন। শুনে অবাক হলেন হ্যালি, নিউটনের মুখে শুনলেন, মহাকর্ষ নামে আশ্চর্য এক সূত্রের গল্প!

এমনিতে মহাকর্ষ বলের সীমা অসীম। কিন্তু মহাবিশ্বের অন্য তিন প্রকার বলের তুলনায় এর আকর্ষণ শক্তি অনেক কম। তার মানে, মহাকর্ষ বলের ব্যাপ্তি যতদূর পর্যন্তই হোক, এ নিতান্তই দুর্বল আকর্ষণী বল।

বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে তাঁর মহাকর্ষ ক্ষেত্র কত দূর পর্যন্ত শক্তিশালী। যেমন সূর্যের এই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পৃথিবী থেকে অনেক বেশি। আবার বুধ গ্রহের মহাকর্ষ সীমা পৃথিবীর থেকে অনেক কম।

আরেকটা কথাও সত্যি। মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর থেকে কোনো হালকা বা গতিশীল বস্তুও বেরিয়ে যেতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বায়ুমণ্ডলের কথা। বায়ুমণ্ডলের উপাদান গ্যাসীয় পদার্থগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের বাইরে যেতে পারে না। কারণ, গ্যাসের প্রতিটা পরমাণুকে পৃথিবী মহাকর্ষ বল দ্বারা নিজের দিকে টানছে।

এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে, মহাকর্ষ বলই যদি গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণু বা অণুগুলোকে আকর্ষণ করে রাখে তবে তাদের কেন এত উপরে ওঠার প্রবণতা?

একটা কথা বোধহয় কারো অজানা নয়, কঠিন পদার্থের ভেতর অণু-পরমাণুগুলো বেশ শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধনের কারণে গায়ে গায়ে লেগে থাকে। তাই কঠিন পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে না। তাই নিতান্ত ভঙ্গুর না হলে একটা হালকা কঠিন পদার্থের ওপর তুলনামুলক ভারী কোনো কঠিন পদার্থ রাখলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু তরল পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো অনেকটা মুক্তভাবে থাকে। অনেকগুলো তরল পদার্থ একটা পাত্রে যখন রাখা হবে, তখন একটা হিসাব নিশ্চিতভাবে এসে যাবে—কে ওপরে থাকবে আর কে নিচে থাকবে। এখানেও এদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় মহাকর্ষ বল। যে তরলের ঘনত্ব বেশি, তার ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব বেশি থাকবে। তাই তুলনামূলক ভারী তরলটা মহাকর্ষ টানের ফলে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকতে চাইবে। অন্যদিকে হালকা তরলের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব তুলনামূলক কম। তাই সে ভারী তরলকে নিচের দিকে জায়গা ছেড়ে দেবে আর নিজে উঠে যাবে উপরে। এক বালতি পানির ভেতর কিছু মধু ঢেলে দেখলেই এ ব্যাপারটার সত্যতা মিলবে।

ঠিক ওপরের মতোই ঘটনা ঘটে গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থে। গ্যাসীয় পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো বলতে গেলে প্রায় মুক্তভাবে থাকে। সুতরাং এদের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাবও থাকে অনেক কম। তবুও তো থাকে। আমাদের গোটা বায়ুণ্ডলটাকে বলা যায় গ্যাসীয় পদার্থের সমুদ্র। সব গ্যাসের ঘনত্ব যেমন সমান নয়, তেমনি সব গ্যাসের অণু/পরমাণু সমান ভারী নয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারী ও বেশি ঘনত্বের গ্যাসগুলো ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে। হালকা গ্যাসগুলো উঠে যায় ওপরের দিকে।

এখানে আরেকটা প্রশ্ন জাগতে পারে মনে—বায়ুমণ্ডলের স্তর যেখানে শেষ, অন্যবস্তুকে নিজের বুকে টেনে আনার ক্ষমতার সীমাও কি সেখানে শেষ ?

উত্তর হলো—না, সেখানে নয়। আমাদের পৃথিবীতে মোট যে গ্যাসীয় পদার্থের পরিমাণ তা দিয়ে মহাকর্ষ সীমার পুরোটাই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই বায়ুমণ্ডলীয় সীমার বাইরেও মহাকর্ষ ক্ষেত্র রয়েছে। বায়ুর ছড়িয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যের কথা ভাবলে এই প্রশ্নটা মাথায় এসে যেতে পারে। এ কথা ঠিক, গ্যাসের পরিমাণ যাই হোক, তাকে যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তার সবটুক আয়তন ওই গ্যাস দখল করে। কিন্তু মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে এমন গ্যাস পাত্র হিসেবে ধরলে চলবে না। কারণ গ্যাস পুরো ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যেতে চাইলেও মহাকর্ষ বলের টান তা হতে দেয় না।

ছয়

ইচ্ছে করলেই কি কেউ মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পেরুনো যায়? অনেক পুরোনো প্রশ্ন এটা। এখন এ বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। চাইলেই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পেরোনো যায় না। তবে একটা শর্ত পূরণ করতে পারলে সেটা অসম্ভবও নয়। তার প্রমাণ মহাশূন্যযান আর স্যাটেলাইটগুলো। অবশ্য এগুলো উৎক্ষপণ করা হয় রকেটের সাহায্যে। আসলে এই রকেটের ভেতরেই রয়েছে মহাকর্ষ ক্ষেত্র ছাড়িয়ে যাওয়ার দাওয়ায়। কোনো মহাকর্ষ ক্ষেত্র পেরুতে হলে একটা নির্দিষ্ট বেগে ছুটতে হবে। এই বেগকে মুক্তিবেগ বলে। মুক্তিবেগের মান সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। রকেট উেক্ষপণের সময় তার গতিবেগ থাকে সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটারের বেশি।

মহাকর্ষ সূত্রে সময়ের কথা বলেননি নিউটন। মহাকর্ষ বলের যে মানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সময়ের কি কোনো প্রভাব থাকবে না? একটা বস্তুর ওপর আরেকটা বস্তুর মহাকর্ষ বলের ক্রিয়া সংঘটিত হতে কত সময় লাগবে? দুটো বস্তুর কোনো একটা বস্তুর যদি ভরের পরিবর্তন হয় তাহলে তাদের মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তনটা হতে কত সময় লাগবে?

পৃথিবী আর সূর্যের কথাই ধরা যাক। সূর্যের মহাকর্ষ টান আর পৃথিবীর রৈখিক বেগের পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মোটামুটি ১৫ কোটি কিলোমিটার। ধরা যাক, মহাকাশের আরেকটি বিরাট নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে সূর্যের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাল সামলাতে না পা পেরে সূর্য তার অবস্থান থেকে খানিকটা সরে গেল। ফলে পৃথিবীর সাথে তাঁর দূরত্বের হেরফের হলো। ফলে মহাকর্ষ বলের মানেরও পরির্তন ঘটবে। কিন্তু পৃথিবী ঠিক কখন টের পাবে মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়েছে? তা কি সূর্যের অবস্থানচ্যূত হওয়ার সাথে সাথে? নাকি পরে? পরে হলে, সেটা কত পরে?

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলছে দূরত্বের হেরফের হলে বস্তুদ্বয়ের আকর্ষণ বলেরও হেরফের হবে। তাই সূর্যের অবস্থানচ্যূত হলে সাথেই সাথেই পৃথিবী তা টের পেয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াচ্ছে?

মহাকর্ষীয় আকর্ষণ কি দূরক্রিয়া? মানে কালক্ষেপণ না করেই কোনো বার্তা কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে দেয়া? তা কি সম্ভব?

এখানেই আসলে মূল সমস্যা। কিন্তু নিউটনের সময়ে এই ক্রটির কথা কেউ ভাবেনি। পরে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হলো, সে ঘটনায় যাওয়ার আগে আরো একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সে আলোচনা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: গ্রাভিটি আর্ক/ডেভিড ডার্লিং

থিওরি অব এভরি থিং/মূল: স্টিফেন হকিং/রূপন্তর: আবুল বাসার

ব্রিটানিকা ডট কম