অগ্নিশিখা এসো এসো, আনো আনো আলো।
আনো শক্তি, আনো দীপ্তি, আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গাছ, পেট্রল, জ্বালানি গ্যাস, কয়লা, মানুষ—সবার দেহেই আছে কার্বন পরমাণু, বাতাসে আছে অক্সিজেন পরমাণু। এই দুই পরমাণু খুব কাছাকাছি এলে একটা বিপদ হতে পারে। এই বিপদের নাম আগুন! আগুন নিয়ে নাকি খেলা করতে নেই, কিন্তু প্রকৃতি আগুন নিয়ে সারা বেলা খেলা করে চলেছে। বাতাসের অক্সিজেন অণু আমার গায়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে, আগুন লাগার আশঙ্কা আছে, কিন্তু লাগছে না।
সবকিছু মাধ্যাকর্ষণের টানে মাটিতে এসে পড়ে, বৃষ্টির পানি, বৃন্তচ্যুত আম, ডানাভাঙা পাখি। কিন্তু প্রদীপের শিখা, চুলার আগুন ওপরে উঠতে চায়। দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের ফুলকি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানকে উপেক্ষা করে শুধু ওপরের দিকেই ওঠে। কেন? আগুন কী দিয়ে তৈরি?
পদার্থবিদদের মৌলিক কণাদের তালিকায় ফোটন বলে এক কণার কথা লেখা আছে। আগুন কি ফোটন?
সবচেয়ে কম তাপমাত্রা হলো প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা শূন্য কেলভিন (0 K)। একে পরম শূন্য (Absolute zero) তাপমাত্রা বলে ডাকা হয়। যেকোনো বস্তু, যার তাপমাত্রা শূন্য কেলভিনের ওপরে, সে তাপ বিকিরণ করবে, যদি তার চেয়ে ঠান্ডা কোনো বস্তুর সংস্পর্শে রাখা হয়। আমি, আপনি, টেবিল, চেয়ার, গাছ, পাখি—সবাই তাপ ছড়াচ্ছি। ফ্রিজের ভেতরে রাখা বরফের টুকরাগুলোও তাপ ছড়াতে পারে, যদি এর চেয়ে কম তাপমাত্রার কোনো বস্তু ফ্রিজের ভেতর তৈরি করা যায়। কারণ, বরফের তাপমাত্রা শূন্য কেলভিনের অনেক ওপরে। আমাদের দেহের অণু সব সময় নড়াচড়া করছে, একজন আরেকজনের সঙ্গে ঠোকর খাচ্ছে। এতে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত হচ্ছে, আর তা থেকেই এই তাপের উত্পত্তি। তাপের আদান-প্রদান চলছে সারাক্ষণ। আমি যে পরিমাণ তাপ ছড়াচ্ছি, তার চেয়ে বেশি গ্রহণ করলে আমার তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, উল্টো হলে তাপমাত্রা কমে যাবে। বস্তুর তাপমাত্রা যত বাড়বে, অণু-পরমাণুর ঝাঁকাঝাঁকি তত বাড়বে, তাপও ছড়াবে আরও বেশি। একটা কাঠের টুকরো চুলোয় পড়ে আছে, ওর তাপমাত্রাও হয়তোবা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ও যে তাপ ছড়াচ্ছে, তাকে চোখে দেখা যায় না। ওর তাপমাত্রা বাড়িয়ে ৩০০ ডিগ্রির কাছাকাছি নিয়ে এলে ওর উত্তাপ আমার গায়ে এসে লাগবে। ও তখন ইনফ্রারেড রেডিয়েশন বা অবলোহিত বিকিরণ ছড়াচ্ছে। এই বিকিরণ আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু অনুভব করতে পারি। তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রির কাছাকাছি হলে কাঠের টুকরাটিকে ঘিরে লাল, হলুদ ও গোলাপি রঙের খেলা জমে উঠবে। গরম হালকা বাতাস ওপরে উঠতে থাকবে, ঠান্ডা বাতাস কাঠটিকে ঘিরে নিচে নামতে শুরু করবে। খুব ছোট ছোট জ্বলন্ত কাঠের টুকরা স্ফুলিঙ্গ হয়ে বাতাসের সঙ্গে ওপরে ছড়িয়ে পড়বে। আর যেগুলো পুরোপুরি জ্বলেনি, সেগুলো কালো ধোঁয়া হয়ে ওপরে উঠতে থাকবে।
এ ঘটনাকে আমরা বলব, কাঠটিতে আগুন ধরে গেছে! আগুনের শিখাটি হলো উত্তপ্ত বাতাস এবং তার সঙ্গে মিশে থাকা কাঠের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্বলন্ত কণা, ওরা ছড়াচ্ছে হরেক রকমের ফোটন কণা। এরাই উত্তাপ ও আলো নিয়ে ছুটে আসছে। শিখার কোনো কোনো স্থানে বাতাসের নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুর ইলেকট্রনরা নিচের কোয়ান্টাম ঘর থেকে ওপরে লাফ দিচ্ছে এবং আবার ঝাঁপ দিয়ে নিচে চলে আসছে। সেখানকার আগুনের রং হবে নীল ও সাদায় মেশানো। তাপমাত্রা আরও বাড়লে ইলেকট্রনরা এক পরমাণু ছেড়ে আরেক পরমাণুতে ঢুকে পড়তে শুরু করবে, আগুনের এই দশাকে বলে প্লাজমা।
কাঠে আগুন ধরানো এবং সেই আগুন বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন পরমাণু। দুটো অক্সিজেন পরমাণু মিলে একটি অক্সিজেন অণু গঠিত হয়, বাতাসে এ অণু আছে যথেষ্ট পরিমাণে।
বাতাসের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলে এই অণুগুলো আরও জোরে ছুটবে। এরা কাঠের গায়ে আঘাত করলে কাঠের পুরোনো জৈব অণুগুলো ভেঙে যাবে। কার্বন পরমাণু বেরিয়ে এসে বাতাসের অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে জোড়া লেগে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস তৈরি করে। রসায়নশাস্ত্রে একে বলে দহন (Oxidation) প্রক্রিয়া। এই ভাঙা-গড়ার খেলা থেকে কিছু বাড়তি শক্তি জোটে। এই শক্তি আবার ব্যবহূত হয় নতুন ভাঙা-গড়ার খেলায়। এটা একধরনের চেইন বিক্রিয়া। যতক্ষণ কাঠ ও অক্সিজেন আছে, এই আগুন ততক্ষণ দ্রুত ছড়াতেই থাকবে। একটা ছোটখাটো আগুনকে দ্রুত নিভিয়ে ফেলার জন্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ থেকে বের হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। এই গ্যাস বাতাসের অক্সিজেন গ্যাসের জায়গা দখল করে আগুন নিভিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। তবে খুব বড় আগুন নিভিয়ে ফেলতে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। পানির তাপ ধারণক্ষমতা খুব বেশি। তাই পানি কাঠ আর অক্সিজেনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে, আগুনের তাপ পানিতে ঢুকে পড়বে, আগুন নিভে যাবে।
সাধারণ আগুন
CH4 + 2O2 = CO2 + 2H2O + (শক্তি)
জৈবিক আগুন
C6H12O6 + 6O2 = 6CO2 +6H2O + (শক্তি)
সালোকসংশ্লেষণ
6CO2 + 6H2O + (সূর্যালোক) = C6H12O6 + 6O2
ওপরের তিনটি সমীকরণের দিকে আমি মাঝেমধ্যে তাকাই। মনটা ভালো হয়ে যায়। মোনালিসার হাসি দেখে শিল্পীদের মন যেমন ভালো হয়ে যায়! প্রথম সমীকরণটি আগুনের, দুটি ছুটে চলা অক্সিজেন অণু একটি জৈব অণুকে (মিথেন) ধাক্কা দিয়েছে। অক্সিজেন অণু ভেঙে দুটি অক্সিজেন পরমাণু পাওয়া গেছে, মিথেন অণু ভেঙে হয়েছে একটি কার্বন পরমাণু এবং চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু। এই পরমাণুগুলো আবার নিজের ইচ্ছায় নতুন করে জুটি বেঁধেছে—একটি কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু এবং দুটি পানির অণু। নতুন জুটির মধ্যে ভালোবাসা (বৈদ্যুতিক আকর্ষণ) বেশি। তাই এই ভাঙা-গড়ার খেলা থেকে বাড়তি শক্তি জোটে। এই শক্তি আগুনের তাপ ও আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় সমীকরণটি ধিকিধিকি আগুন হয়ে আমাদের শরীরে সর্বক্ষণ জ্বলছে। তাই তো আমরা বেঁচে আছি! আমরা নিশ্বাসে যে অক্সিজেন টেনে নিই, আর প্রতিদিন যা খাই, তা থেকে আমাদের কোষ বানায় পানি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড। সেই সঙ্গে জোটে শক্তি। শেষ সমীকরণটি দ্বিতীয় সমীকরণের উল্টো। এখানে গাছের পাতা সূর্যের আলো, বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি থেকে খাদ্য ও অক্সিজেন বানাচ্ছে।
সূর্যের আলো কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভেঙে ফেলছে, অক্সিজেন বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছের শরীরের প্রধান উপাদান কার্বন। আর সেটা আসে বাতাস থেকে, মাটি থেকে নয়। একটা গাছ মাটি ছাড়াই দিব্যি জীবন কাটাতে পারে। ইদানীং পৃথিবীজুড়ে হাইড্রোপোনিক (Hydroponic) চাষ শুরু হয়েছে, গাছের শিকড় পুষ্টিমিশ্রিত পানিতে ডোবানো থাকে। এখানে মাটি বা লাঙলের কোনো বালাই নেই।
সূর্যের আগুনের শক্তি কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভাঙে। এই অণুটিকে জোড়া দিয়ে আমাদের শরীর জ্বালায় আরেক ধরনের আগুন। সেই আগুনের শক্তি দিয়ে আমরা কাজ করি, আমাদের ফুসফুস ওঠানামা করে, আমাদের হূিপণ্ড ধুকপুক করে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত