আলো আসলে কী?
আলোর একেবারে মৌলিক পরিচয় হলো এটি একধরনের বিকিরণ। বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণ। কিন্তু আলোর কণা আসলে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত নয়। আবার চুম্বকীয়ও নয়। তাহলে? আসলে আলো, বিদ্যুৎ বা চুম্বকত্ব সবই বিদ্যুত্চুম্বকীয় নামের প্রকৃতির অন্যতম মৌলিক বলটির বহিঃপ্রকাশ। ফলে আলো একাই বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকক্ষেত্র দুটোই উত্পন্ন করে।
সব আলো দেখা যায় না
বিদ্যুত্চুম্বকীয় বর্ণালির যে অংশ আমরা খালি চোখে দেখতে পাই তাকেই আমরা সাধারণত আলো বলি। আসলে কিন্তু বর্ণালির পুরো অংশই আলো। সেটা হতে পারে বেতার তরঙ্গ, গামা বা মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ। এরা সবাই সাধারণ আলোর মতোই এবং একই বেগে চলে। এ অদৃশ্য আলোগুলোর কোনোটি মানুষের শরীর ভেদ করে চলে যেতে পারে, কোনোটি আবার খুব দ্রুত খাবার উত্তপ্ত করতে পারে।
আলোর বেগ নির্দিষ্ট
একসময় মনে করা হতো আলো চলে অসীম গতিতে। ১৬৭৬ সালে ড্যানিশ বিজ্ঞানী রোমার প্রথম ভালোভাবে আলোর বেগ বের করেন। তিনি দেখেন, গ্রহগুলো যখন পৃথিবীর কাছে থাকে তখন তাদের আলোর পৃথিবীতে আসতে সময় কম লাগে। এ থেকেই তিনি গড় হিসাব করে ফেলেন। এখন আমরা জানি প্রতি সেকেন্ডে এই বেগ হলো ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার (প্রায় ৩ লাখ কিমি)।
আলোময় প্রাণী
কিছু কিছু প্রাণীও আলো তৈরি করতে পারে। এ ঘটনার নাম বায়োলুমিনিসেন্স। এদের বেশির ভাগের বাস সমুদ্রে। যেমন জেলিফিশ ও খোলসযুক্ত কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী। তবে আমরা সবচেয়ে পরিচিত জোনাকির আলোর সাথে। এ প্রাণীদের ত্বকের একটি রঞ্জক পদার্থের সঙ্গে বাতাসের অক্সিজেনের বিক্রিয়ার ফলে জ্বলে ওঠে এ আলো। কাজটি হয় লুসিফারেজ নামের একটি এনজাইমের প্রভাবে।
আলোর দ্বৈত চরিত্রের ছবি
আলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করে। আইনস্টাইনের সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা একই সঙ্গে আলোর এ দুটি চরিত্রের বহিঃপ্রকাশের আলোকচিত্র পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চেই সুইজারল্যান্ডের ইপিএফএলের বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম কাজটি করতে সক্ষম হন।
আলো একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ
বায়ুর মধ্য দিয়ে আলো সঞ্চালিত হয় তরঙ্গ আকারে। কিন্তু আলো আবার গঠিত কণা দিয়ে। বিখ্যাত দ্বি-চির পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর এই দুই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য জানা গিয়েছিল। এ পরীক্ষায় একটি আলোর উত্স থেকে নির্গত ফোটন সামনে রাখা দুটি লম্বালম্বি ফুটোযুক্ত পর্দার ওপর পড়ে। পেছনে আরেকটি ফুটোবিহীন পর্দা থাকে। আলো যদি শুধু কণা হতো, তবে একবারে একটিমাত্র ছিদ্র দিয়ে অপর পাশে যেতে পারত। কিন্তু দেখা গেল, বিপরীত পাশের পর্দায় আলোর দুটি লম্বা রেখার বদলে একটি ঝাঁজরি তৈরি হলো। কোথাও বেশি আলো। কোথাও কম। এটা সম্ভব শুধু আলো যদি তরঙ্গও হয় তবেই। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদেরকে সেটাই বলে—আলো একইসঙ্গে কণা ও তরঙ্গের মতো আচরণ করে।
খাবার গরম করতে আলো
মাইক্রোওয়েভও এক ধরনের বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণ। এ আলো দিয়েই খুব দ্রুত খাবার গরম করা হয়।
১. মাইক্রোওয়েভ উত্পন্ন করা হয় ম্যাগনেট্রন এর সাহায্যে। এটি হলো একটি ভ্যাকুয়াম টিউব। সাথে থাকে একটি ক্যাথোড। এটা থেকে নির্গত হয় ইলেকট্রন। একটি চৌম্বকক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে টিউব দিয়ে সঞ্চালিত করা হয়। এতেই মাইক্রোওয়েভ রূপে বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণ নির্গত হয়।
২. একটি ওয়েব গাইডের সাহায্যে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গকে ওভেনের মধ্যে পাঠানো হয়।
৩. তরঙ্গগুলো ওভেনের ভেতর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খাবারের অণুগুলো এই বিকিরণের শক্তি শোষণ করে নেয়। ফলে বেড়ে যায় তাপমাত্রা।
দেহভেদী আলো
আলো চলে যেতে পারে দেহ ভেদ করেও। এক্স-রে এমন এক ধরনের আলো। এক্স-রে যন্ত্রগুলো ক্যামেরার মতো কাজ করে। এ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট ও কম্পাঙ্ক খুব বেশি। ফলে এর শক্তি অনেক বেশি। এতই বেশি যে এটি অনায়াসে দেহ ভেদ করে চলে যেতে পারে। তবে চর্বি, হাড় ও দেহ কলা (টিস্যু) বিভিন্ন মাত্রায় কিছু পরিমাণ আলো (বিকিরণ) শোষণ করে নেয়। ফলে এক্স-রে ফিল্মে দেহের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়।
ব্যাকটেরিয়া দমনে আলো
অতিবেগুনি রশ্মিও অদেখা আলোর আরেক রূপ। এটি বায়ু থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর করে। এ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট। ফলে এটি ব্যাকটেরিয়ার মতো খুব ছোট প্রাণীকেও আঘাত করতে পারে। প্রবেশ করতে পারে দেহের অভ্যন্তরে। আলোর আঘাতে তছনছ হয়ে যেতে পারে ব্যাকটেরিয়ার কোষ। সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মির আঘাতে অন্য ছোট প্রাণীরা হুমকির মুখে পড়ে। এর ফলে মানুষের ডিএনএও বদলে যেতে পারে। তবে আমাদের সৌভাগ্য, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ওপরের ওজন স্তর অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে আসতে বাধা দেয়।
ক্যামেরা অন্ধকারেও দেখতে পারে
কুচকুচে কালো অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে তাপ-সংবেদী ক্যামেরা। এক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুটিকে হতে হবে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী। ১ থেকে ১৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার যেকোনো বস্তুই এক বিশেষ ধরনের আলো নির্গত করে। নাম ইনফ্রারেড বা অবলোহিত বিকিরণ। ইনফ্রারেড ক্যামেরার সেন্সর বিকিরণ শনাক্ত করতে পারে। বুঝতে পারে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপীয় বিকিরণ নির্গত হচ্ছে।
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত