আলো আর তড়িৎকৌশলের অপূর্ব সন্ধি

আমার ছেলেবেলার একটা দুর্দান্ত আকর্ষণ ছিল ক্যামেরা নামক জাদুকরি বস্তুটি। ছবি তোলার পর থেকে শুরু হতো অপেক্ষা, কখন সেটা ছবিশালা থেকে ঝকঝকে কাগজে ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসবে। ছবি তোলা থেকে ছাপানো অবধি ঝামেলাও তো আর কম ছিল না−ক্যামেরার ফিল্ম বের করো, সেটার ওপর এটা-সেটা নানা কেমিক্যাল দাও, ডার্করুমে নিয়ে ওয়াশ করো। আজকের দিনে যেখানে নেহাত আনাড়ি হাতও দেদারসে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে বাহবা কুড়াচ্ছে। এই তো, ১০ বছর আগে তো সেটা করার জন্য রীতিমতো পেশাদারি কাবিলতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যেত না। আর ভিডিও করার কথা তো ছিল স্রেফ নবাবি আমলের ব্যাপার-স্যাপার। কী এমন ম্যাজিক হয়ে গেল এইটুকু সময়ের ভেতর যে রহস্যঘেরা প্রযুক্তি চোখের নিমেষে হয়ে গেল হেলাফেলায় করা খেলার ব্যাপার?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমরা ক্যামেরার আসল রহস্যটা একটু সাদা ভাষায় বোঝার চেষ্টা করব। আমাদের চোখের মতো ক্যামেরার একটা লেন্স আছে, যেটা দিয়ে ক্যামেরার সামনে থাকা কোনো কিছু থেকে ঠিকরে আসা আলোকে লেন্সের পেছনে একটা ফিল্মের ওপর ফোকাস করা হয়।

ফিল্মের ওপর এমন একটা পদার্থের আস্তরণ দেওয়া থাকে, যেটা আলোকসংবেদী। মানে কিনা যেখানে যেখানে আলো পড়ে, ফিল্মের সেই জায়গাটায় একটা বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এর গুণাগুণ খানিকটা বদলে যায়। তারপর সেই ফিল্মকে নিয়ে নানাবিধ কারসাজির পর বেরিয়ে আসে আসল ছবি। এতে সময় আর হ্যাপা তো অনেক আছেই, তার ওপর আরেক মুশকিল হচ্ছে, ফিল্মের ওপর একবার আলো পড়ে কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন হওয়ার পর ওটার ওপর আর নতুন করে ছবি তোলা যায় না। কারণ, বিক্রিয়া তো যা হওয়ার হয়েই গেছে।

আধুনিক যুগের ডিজিটাল ক্যামেরার কেরামতি ঠিক এখানেই যে আলোকসংবেদী রাসায়নিক বিক্রিয়ানির্ভর ফিল্মের বদলে এসেছে ইলেকট্রনিক ফটো সেন্সর। ক্যামেরার লেন্স থেকে খানিকটা দূরে এই রকম অসংখ্য অতি ক্ষুদ্রাকায় সেন্সর তার বিশাল বাহিনী নিয়ে আলো ধরার জন্য ওত পেতে থাকে। আলোর কণা এই সেন্সরে পড়া মাত্র সেখানে ইলেকট্রনের কারেন্ট তৈরি হয়। তাতে সুবিধাটা কি জানেন? আমাদের বাসার লাইট যেমন আমরা যতবার খুশি অফ করতে আর অন করতে পারি, এই সেন্সরগুলোও তেমনি যতবার ইচ্ছা অন-অফ করা যায়। এখানে সেন্সর অন-অফ করা হয় আলো দিয়ে। ঠিক কোন কোন সেন্সর অন হয়েছে ক্যামেরা শাটার টেপার পর, সেই তথ্য আরেকটা মেমরিতে রাখা হয়। এই মেমরিও হচ্ছে আবার অসংখ্য ছোট ছোট ইলেকট্রনিক সুইচ, যার কেতাবি নাম হলো ট্রানজিস্টর, তার সমন্বয়ে তৈরি। আমাদের কম্পিউটার, সেলফোন ইত্যাদি যাবতীয় বুদ্ধিমান যন্ত্রের মগজও তৈরি আসলে এই ট্রানজিস্টরের বিলিয়ন বিলিয়ন গুচ্ছ দিয়ে।

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পিক্সেলে ভাগ করা ছবি

সব আধুনিক যন্ত্রের ডিজাইনে এত ট্রানজিস্টরের ছড়াছড়ি কেন? একটা দলছুট নিঃসঙ্গ ট্রানজিস্টরের আসলে কানাকড়ি দামও নেই। কেননা সেটা পারে শুধু পাওয়ার অফ হতে আর পাওয়ার অন হতে। কিন্তু এ রকম অতি ক্ষুদ্র আর সামান্য ট্রানজিস্টর যখন একসঙ্গে জোট বাঁধে, হেন দুরূহ গাণিতিক সমস্যা নেই, যা তারা সমাধান করতে পারে না। আজকে অবশ্য ঠিক ট্রানজিস্টরের কথা আমরা বলতে বসিনি। তবে ছোট ছোট কাজ মিলে কী রকম বিশাল একটা কাজ করে ফেলা সম্ভব। আলোর কণার আচরণ কেমন হবে, সেটার ব্যাখ্যা নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অসামান্য একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন আরেক জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে। সেটা বোস-আইনস্টাইন থিওরি নামে সুপরিচিত। খুব বড় আঁকিয়ে না হলে নিখুঁতভাবে বিজ্ঞানী বসুর এই ছবি আঁকা মুশকিল। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, এই ছবিকে আমি অনেক ছোট ছোট বর্গাকার গ্রিডে ভাগ করেছি। একেকটা ছোট গ্রিডের ভেতরের অংশটুকু এঁকে ফেলা কিন্তু তেমন কোনো কঠিন কাজ না।

আসলে আপনি চাইলে আরও অনেক ছোট ছোট ভাগে পুরো ছবিটাকে এমনভাবে ভাগ করে ফেলতে পারেন যে প্রতিটা গ্রিডের ভেতর বড়জোর পেনসিলের একটা ফোঁটা থাকবে। তারপর কোন কোন বক্সে পেনসিলের ফোঁটা দিতে হবে, সেটা সাবধানে খেয়াল করে আপনি হুবহু এ রকম আরেকটা ছবি বানিয়ে ফেলতে পারেন, একটু সময় হয়তো লাগবে, এই যা। দেখাই যাচ্ছে, ছবি আঁকার মতো কত জটিল একটা কাজকে চাইলেই আমরা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে একেবারে জলের মতো সহজ বানিয়ে ফেলতে পারি। আসলে শুধু ছবি আঁকা বলছি কেন, কঠিন কঠিন অঙ্ক কষার মতো সব বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকেই এ রকম অসংখ্য ছোট ছোট মামুলি কাজে ভাগ করা যায় বলেই ট্রানজিস্টর জিনিসটা দুনিয়াব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারদের এত পছন্দের।

একটু আগে আমরা যে একটা ছবি নিয়ে একেকটা গ্রিডে ভাগ করে দেখালাম, এগুলোর একেকটাকে বলে পিক্সেল। ডিজিটাল পর্দায় আসলে এ রকম অসংখ্য পিক্সেল আকারে একটা ছবি দেখানো হয়। আপনি টিভিপর্দার খুব কাছাকাছি চোখ নিয়ে গেলে এই আলাদা আলাদা বিভিন্ন রঙের পিক্সেলগুলো পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। আবার ক্যামেরার চটকদারি বিজ্ঞাপনেও দেখবেন, কোন ক্যামেরায় কত বেশি পিক্সেল আছে, সেটা বেশ ঢোল পিটিয়ে বলা হয়। যেমন এক মেগাপিক্সেল ক্যামেরা মানে এর লেন্সের পেছনে দশ লাখ আলোকসংবেদী সেন্সর আছে, যেগুলো আলো আছে কি নেই, তার ওপর নির্ভর করে অতি ক্ষুদ্র তড়িত্ সংকেত তৈরি করে। তড়িত্ সংকেত দিয়ে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আমরা এটাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মোবাইলে আমরা যেমন অনেকক্ষণ কাজ চালানোর জন্য চার্জ জমা করে রাখি, সে রকম একটা তথ্যকে অসংখ্য ছোট ভাগে ভাগ করে সে অনুযায়ী ডিজিটাল মেমরিতে আমরা একেকটা সুইচে একেক রকম ইলেকট্রিক চার্জ জমা করে রাখি। এগুলোকে পরে ইচ্ছামতো কপি করা যায়, চাইলে এদের যোগ করা যায়, নানাভাবে বিতরণ করা যায় ইত্যাদি। শক্তির রূপগুলোর কথা একবার ভাবা যাক। যেমন শব্দশক্তি, তাপশক্তি, আলোকশক্তি, এগুলোর কোনোটাকেই কিন্তু এভাবে সংরক্ষণ করা যায় না। উত্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো বিকিরিত হয়ে হারিয়ে যায় পরিবেশে। এই যে আমি কম্পিউটারের বাটন প্রেস করে লিখে যাচ্ছি, সেখানেও মেকানিক্যাল সংকেত রূপান্তর হচ্ছে তড়িৎ সংকেতে, তারপর যান্ত্রিক মগজে সংরক্ষিত হচ্ছে ইলেকট্রিক চার্জ হয়ে।

এই লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল, আপনাদের বিভিন্ন আলোক তড়িৎ যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ক্যামেরা আর তার ফটো সেন্সরের কথা নিয়ে আমরা বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটালাম বটে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এইটুকুর ভেতরেই আসলে অন্যান্য অনেক আলোক তড়িৎ যন্ত্রের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে। সোলার সেলের কথাই ধরুন না কেন, যেটা সূর্যের আলোকে তড়িত্শক্তিতে পরিণত করে। সোলার সেলের মূল নীতি কিন্তু ক্যামেরার ফটো সেন্সরের মতোই। পার্থক্য হচ্ছে, সোলার সেলের ক্ষেত্রে কত বেশি দক্ষতার সঙ্গে শক্তির রূপান্তর হলো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ আর ফটো সেন্সরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভুলভাল সংকেত (নয়েজ) এড়িয়ে সঠিক আলোক রশ্মিকে চিনে খুদে তড়িত্ সংকেত তৈরি করা। আবার এলইডি (LED) আর লেজারের (Laser) কথা যদি বলি, তবে এরা হচ্ছে আসলে ফটো সেন্সরের বিপরীত। ফটো সেন্সরে আলো থেকে তড়িৎ প্রবাহ তৈরি হয়, আর এলইডিতে তড়িৎ প্রবাহ করলে আলো তৈরি হয়। লেজারেও ব্যাপারটা তা-ই। এইতো বছর কয়েক আগেই জাপানের তিনজন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে নীল রঙের এলইডি তৈরির কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে। আপনারা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে যে ডিসপ্লে দেখতে পান, সেটা আসলে একটা সাদা রঙের এলইডি থেকে বিভিন্ন রঙের ফিল্টারের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা আলো। বাড়িতে পুরানো ডিজিটাল মোবাইল থাকলে ফেলে না দিয়ে এর স্ক্রিনের কলকবজাগুলো খুলে দেখুন তো, এলইডিটা খুঁজে পান কিনা, স্ক্রিনের কিনারের দিকে থাকার কথা। আর লেজার শো তো নিশ্চয়ই দেখেছেন, আজকাল বড় বড় ফেস্টিভ্যাল শুরুই হয় লেজার রশ্মি দিয়ে হরেক রঙের আলোর খেলা দেখিয়ে। দোকান থেকে পেনসিলের মতো যে লেজার কিনতে পাওয়া যায়, সেটা দিয়ে অন্ধকারে বহুদূরের কোনো দেয়ালে আলো ফেলে মজার মজার ছবি তৈরির খেলা শৈশবে আমরা কে না করেছি। তবে লেজার কিন্তু শুধু এই মিছেমিছি তামাশা করার কাজেই নয়, অনেক দারুণ গুরুত্বপূর্ণ কাজেও একেবারে অপরিহার্য।

ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য যে অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয়, সেটার ভেতরের আলোর উত্স হচ্ছে লেজার। লেজারের বড় গুণ হচ্ছে, এর আলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে না। তাই যেদিকে লেজার গান তাক করবেন, সেই দিকে এর আলো সোজা পথ ধরে বহু বহু দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে। একটা মজার ব্যাপার হলো, ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রংসহ তিন মার্কিন নভোচারী যখন অ্যাপোলো ১১ নভোযানে চড়ে চাঁদে পা রেখেছিলেন, তাঁরা জানতেন, চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটা পৃথিবীর অনেকেই বিশ্বাস করবে না। তাই তাঁরা চাঁদের বুকে একটা রেট্রোরিফ্লেক্টর বসিয়ে রেখে আসেন। আপনি যদি পৃথিবী থেকে একটা তেমন শক্তিশালী লেজার ঠিকঠাক চাঁদের দিকে তাক করেন, দেখবেন সেটার আলো কেমন করে রেট্রোরিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসছে। মানুষের চন্দ্রবিজয়ের কী চমত্কার সহজ, অথচ অকাট্য একটা প্রমাণ সম্ভব হয়েছে এই লেজারের কারণে, তা-ই না?

আলোক বিজ্ঞান আর তড়িৎকৌশলের এই অপূর্ব সম্মিলন আমাদের জন্য আরও কত না চমকপ্রদ যুগান্তকারী আবিষ্কার করে চলেছে, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে সেটা নিজের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াটাও একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বুয়েট এবং পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত