ইলেকট্রনিক পাঠশালা-৭

ডায়োড কীভাবে কাজ করে?

গত সংখ্যার পর

সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড হলো একটি পি-টাইপ ও একটি এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সংযোগে তৈরি একটা ব্যবস্থা (ছবি ১)। এর ফলে এ ব্যবস্থার একদিকে সহজে কারেন্ট যেতে পারে, অন্যদিকে নয়। এ টাইপ দুটো কী, তা পরের পর্বে আলোচনা করব। ছবি ১-এর বাঁ দিকের মতো ডায়োডের পি-টাইপ দিকটি একটি ব্যাটারির ‘+’ প্রান্তে ও এন-টাইপ দিকটি ব্যাটারির ‘-’ প্রান্তে সংযোগ দেওয়া হলে ডায়োডের মধ্য দিয়ে সহজে কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারে। এ সংযোগকে বলা হয় ‘ফরোয়ার্ড বায়াস’ বা সম্মুখ পক্ষপাত। তির চিহ্ন দিয়ে কারেন্ট চলছে, দেখানো হয়েছে। সার্কিটে কারেন্ট মাপার যন্ত্র হিসেবে একটি অ্যামিটারের ছবি দিয়ে তার কাঁটাকে শূন্য থেকে বেশি একটি অবস্থানে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এ সার্কিটে কারেন্ট চলছে। তবে এটি বাস্তব সার্কিট নয়। সার্কিটের বর্তনী বা লুপের মধ্যে একটি রেজিস্টর দিয়ে কারেন্ট সীমিত করতে হবে। নইলে অতিরিক্ত কারেন্টের ফলে ডায়োড উত্তপ্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু ফরোয়ার্ড বায়াসের ধারণা দেওয়ার জন্য এভাবে দেখানো হয়েছে।

ছবি ১: পি-টাইপ ও এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সংযোগে তৈরি ডায়োড ও তার সাংকেতিক চিহ্ন। ব্যাটারির সংযোগ অনুযায়ী বাঁ দিকের সার্কিটে ফরোয়ার্ড বায়াস, ডানদিকেরটিতে রিভার্স বায়াস।

অন্যদিকে ছবি ১-এর ডান দিকে ডায়োডটি উল্টিয়ে ব্যাটারির সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ডায়োডের এন-টাইপ দিকটি ব্যাটারির ‘+’ প্রান্তে ও পি-টাইপ দিকটি ব্যাটারির ‘-’ প্রান্তে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সংযোগে কিন্তু কোনো কারেন্ট প্রবাহিত হবে না। অ্যামিটারও তাই ‘০’ (শূন্য) কারেন্ট নির্দেশ করছে। এ সংযোগকে বলা হয় ‘রিভার্স বায়াস’ বা বিপরীত পক্ষপাত। এভাবে একদিকে কারেন্ট যাওয়া ও অন্যদিকে না যাওয়াটিই হচ্ছে ডায়োডের ধর্ম বা চরিত্র। ধর্মটি আরও ভালোভাবে ফুটে উঠেছে ছবি ২-এর চারিত্রিক গ্রাফে। একে ডায়োডের I-V গ্রাফও বলা হয়ে থাকে। ফরোয়ার্ড বায়াসে ভোল্টেজ শূন্য থেকে বাড়ালে গোড়ার দিকে খুব অল্প কারেন্ট থাকে। কিন্তু অল্প একটি নির্দিষ্ট ভোল্টেজ পার হলে কারেন্ট হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। এ ভোল্টেজকে বলা হয় ‘ফরোয়ার্ড ড্রপ ভোল্টেজ’। ছবিতে VF দিয়ে এটি দেখানো হয়েছে। তবে এ চরিত্রটি পাওয়া যাবে ডায়োডটি অন্ধকারে থাকলে। আলো পড়লে তার চরিত্র কিছুটা বদলে যায়। তাই সাধারণ ব্যবহারের ডায়োডগুলোকে কালো প্লাস্টিকের বা ধাতুর তৈরি আবরণের মধ্যে সম্পূর্ণ আটকে রাখা হয়, যেন তাতে আলো পড়তে না পারে।

অন্যদিকে রিভার্স বায়াসে ভোল্টেজ বাড়াতে থাকলেও কারেন্ট প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকে। বলতে গেলে কারেন্ট প্রবাহিত হয়ই না। তবে ভোল্টেজ বাড়ানোরও একটি সীমা আছে। অনেক বাড়ালে পর একটি ভোল্টেজে হঠাৎ কারেন্ট সাংঘাতিকভাবে বাড়তে থাকে, যাকে বলা হয় রিভার্স ব্রেকডাউন। যে ভোল্টেজে তা হয়, তাকে বলা হয় ব্রেকডাউন ভোল্টেজ। ছবিতে VBr দিয়ে এটি দেখানো হয়েছে।

ছবি ২: ডায়োডের চারিত্রিক গ্রাফ

আমরা আগের পর্বে জেনার ডায়োড নিয়ে আলোচনায় দেখেছিলাম কীভাবে রিভার্স ব্রেকডাউনকেও কাজে লাগিয়ে কনস্ট্যান্ট ভোল্টেজ সার্কিট তৈরি করা যায়। সেখানে এটিকে জেনার ভোল্টেজ নামে উল্লেখ করেছিলাম। তবে ডায়োডের বেশির ভাগ ব্যবহার হচ্ছে তার এই একদিকে কারেন্ট প্রবাহিত হতে দেওয়ার, আর অন্যদিকে ঠেকিয়ে দেওয়ার গুণটি। সে একটি একমুখী দরজার মতো কাজ করে, যা কেবল একদিকে খোলে আর অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য ইলেকট্রনিকসের প্রথম যুগে যখন বায়ুশূন্য কাচের টিউবে এ ধর্মটি তৈরি করা হয়েছিল, সে টিউবটিকে বলা হতো ইলেকট্রনিক ভালভ (Valve)। পানির পাম্পে আমরা ভালভের সঙ্গে পরিচিত, যা পানিকে কেবল একদিকে চলতে দেয়, অন্যদিকে দেয় না। সেখান থেকেই নামটি ধার করা হয়েছিল। তবে ডায়োডের এ ধরনের ব্যবহারে আমরা এমনভাবে ডিজাইন করি, যেন সার্কিটে উপস্থিত কোনো ভোল্টেজ রিভার্স বায়াসের ব্রেকডাউন পর্যন্ত বেড়ে না যায়।

লাইট এমিটিং ডায়োড (এলইডি) কিন্তু একই জিনিস। তবে এর সেমিকন্ডাক্টরগুলো মৌলিক পদার্থ নয়, যৌগিক। ফরোয়ার্ড বায়াস করলে এলইডি আলো বিকিরণ করে। গ্যালিয়াম, আর্সেনিক ও ফসফরাসের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট পরিমাণ নিয়ে তৈরি করা যৌগিক পদার্থের ডায়োডগুলো লাল, কমলা, সবুজ ও হলুদ আলো বিকিরণ করে। নীল আলো আসে গ্যালিয়াম ও নাইট্রোজেনের যৌগিক সেমিকন্ডাক্টর থেকে। আর সাদা আলো তৈরি করা যায় দুটি উপায়ে। লাল, সবুজ ও নীল এলইডির আলো মিশিয়ে সাদা আলো তৈরি করা যায়। অর্থাত্ এ ক্ষেত্রে তিনটি এলইডি ব্যবহার করা হয়। তবে এ পদ্ধতিটি কমই ব্যবহূত হয়। সাধারণত নীল এলইডি থেকে সাদা এলইডি তৈরি করা হয়। এলইডির কেলাসের ওপরে একটি পাতলা ‘ফসফো’র-এর প্রলেপ দেওয়া হয়।

ফসফোরটি নীল আলোর কিছু অংশকে হলুদ আলোয় পরিবর্তন করে। তারপর মূল নীল আলো এবং হলুদ আলো মিশে সাদা রঙের অনুভূতি দেয়, যদিও এটি সব রঙের মেশানো সাদা নয়।

ফরোয়ার্ড বায়াসে কারেন্ট প্রবাহিত করার জন্য যে ভোল্টেজ ড্রপ VF অতিক্রম করতে হয়, তার পরিমাণ বিভিন্ন ডায়োডের পদার্থের ওপর নির্ভর করে। সিলিকন দিয়ে তৈরি ডায়োডের জন্য VF হয় প্রায় শূন্য দশমিক ৭ ভোল্ট ও জার্মেনিয়ামের তৈরি ডায়োডের জন্য প্রায় শূন্য দশমিক ৩ ভোল্ট। লাল, হলুদ, সবুজ এলইডির জন্য হয় প্রায় ১ দশমিক ৬ ভোল্ট থেকে ২ দশমিক ২ ভোল্ট। আর নীল ও সাদা এলইডির জন্য প্রায় ৩ দশমিক ২ ভোল্ট। অর্থাত্ ডায়োডটিকে ফরোয়ার্ড বায়াসে কাজ করানোর জন্য ন্যূনতম এ পরিমাণ ভোল্টেজ দিতে হবে।

ছবি ১-এ পি-টাইপ ও এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সংযুক্ত ডায়োডের পাশেই ডায়োডের সাংকেতিক চিহ্ন দেখানো হয়েছে। চিহ্নটির মধ্যে একটি তিরের ছবি দেখা যাচ্ছে। এটি নির্দেশ করছে কোন দিকে সহজে কারেন্ট যাবে, আর সেটিই ফরোয়ার্ড বায়াসের দিক। এর উল্টোমুখী কারেন্টকে আটকে দেওয়া হবে। এটি বোঝানোর জন্য একটি আড়াআড়ি দণ্ড দেখানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে তিরের দিক হচ্ছে ডায়োডের পি-টাইপ থেকে এন-টাইপের দিকে।

সোলার সেলও কিন্তু মূলত একটি ডায়োড। বৈদ্যুতিক শক্তি তৈরির জন্য এখন এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। সাধারণত সিলিকন থেকে তৈরি হয় সোলার সেল। তবে আজকাল অন্যান্য যৌগিক সেমিকন্ডাক্টর থেকেও তৈরি হচ্ছে। এ সেলের ওপর আলো পড়লে ভেতরে অনেক মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত হোল আলাদা হয়ে গিয়ে বাইরের সার্কিটে ইলেকট্রনের প্রবাহ তৈরি করতে পারে। এভাবে সোলার সেলটি আলোকশক্তির কিছু অংশকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে

রূপান্তর করতে পারে। সাধারণ ডায়োডে আলো ঢুকতে দিলেও এ ঘটনা ঘটবে। যেমনটি করা হয় ফটোডায়োডগুলোয় (Photodiode)। তবে এগুলো আকারে খুবই ছোট, তাই কারেন্টের পরিমাণ হবে খুবই সামান্য। আলোকশক্তির তীব্রতা মাপতে ফটোডায়োড ব্যবহার করা হয়। এটির নাম তখন হয়ে যায় সেন্সর (Sensor)। অন্যদিকে সোলার সেল হলো শক্তি উত্পাদক, প্রয়োজনমতো পর্যাপ্ত শক্তি তৈরির জন্য অনেক বড় আকারে তৈরি করা হয়। মনে রাখতে হবে শূন্য থেকে কেউ শক্তি উত্পাদন করতে পারে না। সোলার সেল আলোর শক্তির কিছু অংশকে বিদ্যুত্ শক্তিতে রূপান্তর করে মাত্র।

লেখক: অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত