কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ৪

আগেই আলো কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে বেঁকে যায় তার আলোচনা করেছি। কিন্তু আপেক্ষিকতার বিচরণক্ষেত্র তো হচ্ছে স্থানকাল। তাহলে স্থানের মাঝে বক্রতা এলে সময়ও তো ঠিক একই রকমভাবে প্রভাবিত হওয়ার কথা। আসলে ঠিক এমনই ঘটে। কিন্তু সময় যে বাঁকছে—কথাটার মানে কী? এটা ব্যাখ্যা করার আগে আমাদের বক্রতা কী জিনিস, সেটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। এ জন্য আমরা চিরায়ত ছবির কাছে ফিরে যাই।

পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, প্রথম বা ক গ্রাফে কোনো বক্রতা নেই কিন্তু দ্বিতীয় বা খ গ্রাফে তা আছে। এটা গণিত ছাড়া প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে সরলরৈখিক গ্রাফটিতে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একই দূরত্ব অতিক্রম করছে। তার মানে দূরত্বের পরিবর্তনের হার এখানে নির্দিষ্ট। অন্যদিকে দ্বিতীয় গ্রাফটিতে এটা দেখা যাচ্ছে না। সেটাকে এই দূরত্বের পরিবর্তনের হারটিও পরিবর্তিত হচ্ছে। যাঁরা জানেনতাঁরা হয়তো বলবেন, আরে দূর! এটা আর বিশেষ কী? এখানে তো ত্বরণ হচ্ছে!

একদম ঠিক কথা! কিন্তু আমাদের ধর্তব্যের বিষয় হচ্ছে বক্রতাকে আমরা ত্বরণ হিসেবে চিন্তা না করে দূরত্বের পরিবর্তনের হারটির নিজেরই পরিবর্তনের হার হিসেবে চিন্তা করব। ক্যালকুলাসের মতো তথাকথিত জটিল বিষয় পুরোপুরি এড়াতে চাইছি না। তাই পাঠকের বিরক্তির কারণ হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও সামান্য ক্যালকুলাস ব্যবহার করব। আশা করি, যাঁদের গাণিতিকভাবে ব্যাপারগুলো জানার ইচ্ছা প্রবল, তাঁরা পিছু হটে না গিয়ে গুগল বা উইকিপিডিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন। যাইহোক, দূরত্বের পরিবর্তনের হার (যাকে আমরা বেগ বলি) তা হচ্ছে v = dx/dt. এখানে dt সময়ে বস্তু dx দূরত্ব অতিক্রম করছে। আর বক্রতা (তথা ত্বরণকে) আমরা নির্দেশ করব a = dv/dt দিয়ে। ত্বরণকে আমরা v এর উপরিউক্ত গাণিতিক সংজ্ঞা ব্যবহার করে লিখতে পারি, a = d(dx/dt)/dt = d2x/dt2। এখানে আমরা d/dt কে পরিবর্তনের হার বের করার গাণিতিক প্রক্রিয়া হিসেবে চিন্তা করছি। ঠিক এই ধরনের সংজ্ঞাই আমরা আইনস্টাইনের সমীকরণ লেখার জন্য পরে ব্যবহার করতে পারব।

ওপরের প্যারাগ্রাফের প্রায় সবটুকুই আমরা নিউটনীয় কাঠামো থেকে তুলে দিয়েছি। তাহলে আইনস্টাইনীয় আপেক্ষিকতার ছোঁয়া এখানে কোথায়? এখানে আমরা দুটো পরিবর্তন আনব। প্রথমত, আমাদের মনে রাখতে হবে বিশেষ অথবা সাধারণ দুই ধরনের আপেক্ষিকতার কাঠামোর মাঝে সময়, যা আমরা ওপরে t দিয়ে নির্দেশ করেছি, তা একটা সর্বজনীন বস্তু নয়। বরং আগের আলোচনাগুলোতে দেখেছি, ঘড়িতে মাপা সময়ের মান পর্যবেক্ষক ও ঘড়ির মাঝের বেগের ওপর নির্ভর করে। তাহলে আমরা কোন সময় নিয়ে কাজ করব? এটা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। সেটা হলো স্থানকাল বা দেশকালের মাঝে ঘটনাগুলোর ভেতরের দূরত্ব। সেই সহচলমান (Comoving) ঘড়ি দিয়ে মাপা সময়ের সমান। সহচলমান বলতে আমরা বোঝাব যে ঘড়ি পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে স্থির রয়েছে।

তার মানে ওপরের গাণিতিক সংজ্ঞায় আমরা যে সময়টি ফর্মুলার হারে (Denominator) ব্যবহার করছি তার জায়গায় এই সহচলমান ঘড়িতে মাপা সময় দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে। এই সহচলমান ঘড়ির মাপা সময়কে আমরা প্রপার (Proper) সময় বলে অভিহিত করি। আর আগের যে সময়কে হটালাম, তাকে এখন একটি আরও স্থানাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করব। এই চতুর্মাত্রিক বর্ণনার কথা আমরা আগের সংখ্যাগুলোতেই বর্ণনা করেছি। কিন্তু গতির বর্ণনায় প্রপার সময়ের ব্যবহার আইনস্টাইনের হাতেই শুরু। এবং এটা দিয়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ E0=mc2 প্রতিপাদন করতে পেরেছিলেন। তাহলে সময়ের বক্রতা এখন সহজেই বোঝানো সম্ভব। এটার জন্য আমাদের শুধু ওপরের (ক) গ্রাফের উলম্ব অক্ষে সাধারণ স্থানাঙ্ককে সময়ের বিপরীতে প্লট না করে বরং প্রপার সময়ের সাপেক্ষে সময়কে প্লট করলেই হবে। এ রকম চিত্র ব্যবহার করে আমরা ইতিমধ্যেই কাল দীর্ঘায়ন (Time dilation)-এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আপেক্ষিক গতি ধ্রুব ছিল। তার জন্য সময় যে গুণিতকে (Factor) দীর্ঘায়িত হয়, তার মানও ধ্রুব থাকে। কিন্তু ত্বরণবিশিষ্ট গতির ক্ষেত্রে বেগ বাড়ার কারণে এই গুণিতকের মানটাও বাড়তে থাকে। স্থানকাল চিত্র ব্যবহার করে এই ঘটনাটি সহজেই বোঝানো যায়।

ঠিক আগের মতোই, আমরা একটা আলোর উত্স নিই। সেটা যেন নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি আলোর ঝিলিক দেয়। এবার আমরা রকেটের পিঠে চেপে সুষম ত্বরণে এই উত্স থেকে দূরে যেতে থাকি। তাহলে আমাদের স্থানকাল ছবিটি হবে নিম্নরূপ:

আমরা ছবিতে দেখতে পাচ্ছি যে আলোর উত্স থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর আলো নির্গত হলেও রকেটে বসে আমরা আলোর ঝিলিকের মাঝের সময়কে ক্রমেই বাড়তে দেখব। এর একটা সরাসরি প্রভাব আমরা দেখব আলোর রং বা কম্পাঙ্কের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ত্বরণের কারণে ক্রম অপস্রিয়মাণ আলোর উেসর কমপাঙ্ক আমাদের কাছে তুলনামূলক কম দেখাবে। আবার সমতুল্যতার নীতি অনুসারে ত্বরণের প্রভাব আর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের প্রভাবকে আমরা আলাদা করে দেখতে পারব না। আমাদের মনে হবে, উত্সটিরও আমাদের সাপেক্ষে ত্বরণ ঘটছে। সেই ত্বরণের প্রভাব আর মহাকর্ষের প্রভাব একদম এক। এখান থেকে আমরা সরাসরি বুঝতে পারছি, মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কারণে আলো বা ফোটনের কম্পাঙ্ক কমে যাবে। যাকে আমরা মহাকর্ষীয় লোহিত বিচ্যুতি (Gravitational redshift) বলি। এটা খুব সহজভাবে বোঝাতে গেলে আমাদের প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম নীতি ও আইনস্টাইনের সমতুল্যতা নীতি একসঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। ধরা যাক, আমরা একটা ফোটন দেখতে পেলাম, যার মহাকর্ষের প্রভাবহীন অবস্থায় কম্পাঙ্ক f, অতএব প্ল্যাঙ্কের ধারণা অনুযায়ী ফোটনটির শক্তি হবে hf। কিন্তু মহাকর্ষের প্রভাব থেকে বের হতে হলে তাকে মহাকর্ষের বিপরীতে কিছু শক্তি ক্ষয় করতে হবে। এবং সেখান থেকে অবমুক্ত হলেই আমরা ফোটনটিকে শনাক্ত করতে পারব। তাহলে এই শক্তি ক্ষয়ের কারণে তার কম্পাঙ্ক যাবে কমে এবং তার মান যদি হয় f’ তবে hf’ = hf ~ V.

এখানে V হচ্ছে মহাকর্ষ ক্ষেত্র থেকে বেরোনোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি। সেটা আমাদের কাছে স্থিতিশক্তি হিসেবে পরিচিত। নিউটনীয় কাঠামোয় V = m ΔΦ .

এখানে ΔΦ হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণের বিভবের (Potential) পরিবর্তন। এখন ফোটনের ভর আমরা জানি শূন্য, তাই m = 0 হলে আমাদের f=f’ পাওয়ার কথা। কিন্তু আপেক্ষিকতার কাঠামোয় মাধ্যাকর্ষণের উত্স ভর নয়। বরং এটার উত্স হবে শক্তি। সে জন্য আমাদের m = E/c2 = hf/c2 ব্যবহার করতে হবে। এটা ব্যবহার করলে আমরা পাই, f’ = f ( 1 - (ΔΦ/c2)) ।

এখান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি আলোর রং সামান্য হলেও পরিবর্তিত হবে। যদিও সমতুল্যতার নীতি সহজ ব্যবহার করে আমরা এই ফলাফলগুলো দেখাচ্ছি, এর মানে এই নয় যে সাধারণ আপেক্ষিকতার

সব ঘটনার ব্যাখ্যা এত সহজে প্রতিপাদন করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন টেন্সরের ক্যালকুলাসের সম্যক জ্ঞান। তবে এটা বিজ্ঞানচিন্তায় আলোচনা করা ঠিক কি না তা সম্পাদকমণ্ডলী আর পাঠকই নির্ণয় করে দেবেন।

সবশেষে মনে করিয়ে দিই, এই কম্পাঙ্কের পরিবর্তন শুধু কাগজ-কলমে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়নি-এটা ১৯৬০ সালে পাউন্ড ও তাঁর ছাত্র রেবকা এবং স্বতন্ত্রভাবে ড্রেভার এই পরিবর্তনটি পরীক্ষাগারে শনাক্ত করেছিলেন। উল্লেখ্য, ড্রেভারের নাম LIGO-এর সঙ্গে আজ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও তাঁর এই মহাকর্ষীয় লোহিত বিচ্যুতির ওপর কাজও কোনোভাইে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এই সিরিজের আগের লেখা:

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ১

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ২

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান-৩