কোয়ান্টাম দোলনা

‘দোল দোল দোলনি, রাঙা মাথায় চিরুনি, বর আসবে এখনি, নিয়ে যাবে তখনি।’

কন্যা যখন দোলনায়

ঘোমটা মাথায় চুপটি করে বসে না থেকে বিয়ের কনে দোলনায় দুলছে। দোলনাটি কন্যাকে নিয়ে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছে, ফিরে আসছে, আবার যাচ্ছে। কন্যাকে ধরতে হলে বরকে কোথায় হাত বাড়াতে হবে? কন্যা যদি কোয়ান্টাম জগতের বাসিন্দা হয়, তবে হাত বাড়াতে হবে দোলনা যখন মাঝপথে। আর কন্যা যদি আমাদের সাধারণ জগতে বাস করে, তবে কন্যাকে বাহুবন্দী করার সম্ভাবনা প্রান্তিক এলাকায় সবচেয়ে বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, কোয়ান্টম তত্ত্ব একেবারে উল্টো কথা বলছে। আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের যে আইনগুলো বিজ্ঞানী নিউটন দিয়েছেন, সেগুলোর ওপরে নির্ভর করে কোয়ান্টাম কন্যার দিকে হাত বাড়ানো বোকামি হবে।

ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পদার্থবিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের দোলনার অঙ্কের হাত থেকে রেহাই নেই। ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটে, পরমাণুর ভেতরে ও বাইরে, আলোর ঢেউয়ে, আমাদের হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিতে, বস্তুর অস্তিত্বের কেন্দ্রে, এমনকি শূন্যতার ভেতরেও চলছে এই দোলাদুলি! বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে আইনস্টাইন ও স্টিফেন হকিংসের মতো বিজ্ঞানীদের এই একই অঙ্ক শিখতে হয়েছে। পাঠশালায় সবাইকে যেমন গরুর রচনা লেখা শিখতে হয়! গণিতজ্ঞ অয়লার বলেছেন, ‘আমি যখন একটা অঙ্কের সমাধান করেছি, সেই সমাধান কাজে লেগেছে ভিন্ন একটি অঙ্কের সমাধানে।’ গরুর রচনা শিখেছ, কিন্তু পরীক্ষায় এসেছে নদীর রচনা। গরুকে ঘাস খাওয়াতে নদীর পাড়ে নিয়ে চলো! অঙ্ক একটা অট্টালিকার মতো, যার ভিত ও দেয়াল তৈরি হয়েছে বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতি দিয়ে, সবার ওপরে আছে ক্যালকুলাস। শৌখিন বুদ্ধির চর্চা, মুদির দোকানের লাভ-ক্ষতির হিসাব, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় ফেল করানো এবং গণিতভীতি তৈরি করা ছাড়া পাটিগণিতের তেমন কোনো কাজ নেই! পদার্থবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কোনো অচেনা অঙ্কের সম্মুখীন হলে প্রথমেই ভাবতে হবে যে অঙ্কটির সঙ্গে দোলনার অঙ্কের কোনো মিল আছে কি না।

কন্যার ছবি তোলা

ধরা যাক, কন্যা দোলনায় ক্রমাগত দোল খেয়েই যাচ্ছে এবং আপনি ক্যামেরা দিয়ে এলোপাতাড়ি তার ছবি তুলছেন। এভাবে এক হাজার ছবি তোলা হয়ে গেল। এবারে ছবিগুলো পরীক্ষা করা যাক। দোলনের মাঝামাঝি স্থানকে স্থিতি বিন্দু (Equilibrium point) বলা যাক। শুরুতে দোলনাটি যখন ঝোলানো হয়, তখন গতিহীন দোলকের শেষ প্রান্ত এই স্থিতি বিন্দুতে অবস্থান করে। কন্যা যখন দোল খাচ্ছে, তখন সে বারে বারে এক প্রান্ত থেকে স্থিতি বিন্দুর ওপর দিয়ে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে এবং আবার ফিরে আসছে। এই একবার যাওয়া এবং ফিরে আসার মোট সময়কে দোলনকাল বলে। স্থিতি বিন্দু থেকে প্রান্তিক বিন্দুর দূরত্বকে বিস্তার বলে। ১ সেকেন্ডে যতবার দোল খাওয়া হয়, তাকে বলে কম্পাঙ্ক।

যে ছবিগুলো তোলা হয়েছে, তাতে কন্যাকে দোলনের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাবে। কখনো সে প্রান্তদেশে, কখনো স্থিতি বিন্দুতে, কখনোবা মাঝামাঝি কোনো স্থানে। ছবিগুলোর মধ্যে কন্যাকে দোলনার প্রান্তদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে, স্থিতি বিন্দুতে সবচেয়ে কম। কন্যাটি সবচেয়ে দ্রুতবেগে যাবে স্থিতি বিন্দুতে, তারপরে যতই ওপরে উঠতে থাকবে, ওর গতিবেগ ততই কমতে থাকবে। একেবারে প্রান্ত বিন্দুতে থেমে যাবে, তারপরে আবার নিচে নামার পালা। যেহেতু ক্যামেরাম্যান কন্যার ছবি এলোপাতাড়িভাবে তুলে যাচ্ছে, কন্যা যেখানে যত ধীরে যাবে, সেখানে ক্যামেরায় ওর ফটো ওঠার সম্ভাবনা ততই বেশি হবে। যদি এক হাজারটা ছবি তোলা হয়, তবে দেখা যাবে যে বেশির ভাগ ছবিতেই কন্যা আছে প্রান্তিক এলাকায়। সবচেয়ে কমসংখ্যক ছবিতে কন্যাকে স্থিতি বিন্দুর ধারেকাছে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই দোল খাওয়া কন্যাকে পেতে হলে প্রান্তিক অবস্থানে খোঁজ করাই বিজ্ঞানসম্মত কাজ হবে। কিন্তু এ হলো আমাদের প্রতিদিনের দৃশ্যমান জগতের কথা, যেখানে কন্যার ভর হয়তো ৫০ কিলোগ্রাম। যদি কন্যার ভর একটি পরমাণুর বা একটা ইলেকট্রনের ভরের সমান হতো? তাহলে সব হিসাব পাল্টে যেত! কোয়ান্টাম-কন্যাদের আচরণ, চালচলন একেবারেই আলাদা।

সরল দোলকের সূত্র এই

দৃশ্যমান জগতের দোলাদুলি নিয়ে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও অনেক মাথা ঘামিয়েছিলেন। তিনি ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। এক রোববারে সেখানকার গির্জায় পাদরির ধর্মীয় উপদেশ শুনছেন। ঘরের ছাদ থেকে একটা বিশাল ঝাড়বাতি ঝোলানো আছে। বাইরের দমকা বাতাস মাঝেমধ্যে বাতিটিকে দুলিয়ে দিচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে ঝাড়বাতিটা যত জোরেই দুলুক না কেন, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে ওর একই সময় লাগছে। বাড়িতে ফিরে এসে দোলকের ভর কম-বেশি করে, দোলনার দড়ি লম্বা-খাটো করে এবং দোলনার গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে গ্যালিলিও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

দোলনার দোলাদুলির তিনটি সূত্রকে এখন এভাবে লেখা হয়: (১) দোলনকাল দোলকের ভরের এবং দোলনের পরিমাণের (amplitude) ওপরে নির্ভর করে না, (২) দোলনকাল দোলকটির দড়ি কতটুকু লম্বা, তার বর্গমূলের ওপরে সরাসরি নির্ভর করে এবং (৩) দোলনকাল মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণের বর্গমূলের সঙ্গে পরোক্ষভাবে (ব্যস্তানুপাতে) নির্ভর করে।

বাঁচতে হলে নাচতে হবে

আমরা শুরুতেই বলেছিলাম যে কোয়ান্টাম কন্যাকে ধরার জন্য দোলনার মাঝপথে হাত বাড়াতে হবে। কথাটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। কোয়ান্টাম কন্যা যখন শান্ত, মনে নেই অভিমান রাগ-অনুরাগের ছোঁয়া, একটুও উত্তেজিত নয়, তখন ওকে মাঝপথে পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কন্যার এই দশাকে কোয়ান্টাম তত্ত্বে গ্রাউন্ড স্টেট বলে ডাকা হয়। এরপরে আছে প্রথম উত্তেজিত স্টেট, দ্বিতীয় উত্তেজিত স্টেট ইত্যাদি। প্রতিটি স্টেটে কন্যার শক্তির পরিমাণ হবে, En = ( n+1/2) hf

ওপরের সমীকরণে n–এর মান হতে হবে ০, ১, ২, ৩, ৪, ইত্যাদি; h হলো প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম ধ্রুবক, h=6.63 x 10-34 জুল-সেকেন্ড এবং f হলো দোলনের কম্পাঙ্ক। কন্যার কোয়ান্টাম দশা n–এর মানের ওপরে নির্ভর করে, n=০, ১, ২ ইত্যাদি, যথাক্রমে, গ্রাউন্ড, প্রথম উত্তেজিত, দ্বিতীয় উত্তেজিত দশা বলে পরিচিত। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে একেবারে শান্ত অবস্থানেও (n=0) কন্যার শক্তি আছে, যার পরিমাণ হবে (১/২)hf; কোয়ান্টাম তত্ত্বে একে ‘শূন্য দশার শক্তি’ বলে ডাকা হয়। কন্যার পক্ষে কখনোই স্থির হয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। বাঁচতে হলে ওকে নাচতে হবেই!

আমরা যাকে তাপমাত্রা বলি, তা হলো পদার্থের অণু-পরমাণুর গড় গতিশক্তি। তাপমাত্রা শূন্য হলে (০ কেলভিন, পরমশূন্য তাপমাত্রা -২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) অণু-পরমাণুর দশা কী হবে? আগে মনে করা হতো যে শূন্য তাপমাত্রায় সব ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে যায়। কোয়ান্টাম তত্ত্বে গতিশূন্যতা সম্ভব নয়, গতি হারিয়ে গেলে বস্তুর অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যায়। একেবারে শান্ত কন্যা পাওয়ার আশা চিরতরে ছেড়ে দিন।

কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্বমতে ∆x ∆p ≥ ℏ/2। এখানে ∆x এবং ∆p হলো অবস্থান এবং ভরবেগ মাপার অনিশ্চয়তা। যে থেমে গেছে, তার গতি বা ভরবেগ নেই, তাই ভরবেগের অনিশ্চয়তা নেই। ওপরের সমীকরণ থেকে এমন বস্তুর অবস্থানের অনিশ্চয়তা হয়ে যাবে অসীম (∞)। তাকে মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা সমান, ওর অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে, ও সবার মধ্যে হারিয়ে গেছে!

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র