বিড়ালকে এই ঝামেলায় ফেলে দেওয়া বিখ্যাত তত্ত্বটির নাম ‘শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল’তত্ত্ব। অতি পারমাণবিক কণাদের অদ্ভুতুড়ে স্বভাবের ওপর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে এ রকম তাজ্জব তত্ত্ব চলে আসে পদার্থবিজ্ঞানে। কোয়ান্টাম বিড়াল যে কেবল বেঁচে থাকতে পারে তা-ই নয়, একই সময়ে মৃত অবস্থায়ও থাকতে পারে অথবা জীবিত বা মৃত অবস্থাতেও থাকতে পারে। বিড়ালটার এ রকম অবস্থানকে বলা হয় সুপারপজিশন। একাধিক তরঙ্গ একই অবস্থানে একই সময়ে একই মাধ্যমে থাকছে, পানিতে যেমন করে থাকে শব্দতরঙ্গ আর আলোর তরঙ্গ। পদার্থবিজ্ঞান আর ব্যবস্থাপনাতত্ত্বে (Systems theory) সুপারপজিশন বৈশিষ্ট্য সব ধরনের রৈখিক ব্যবস্থাপনায় দুইয়ের চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া আসলে ক্রিয়ার যোগফল। এটা প্রতিটি ক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবেই ঘটে থাকে। যদি ‘ক’ সবুজ প্রতিক্রিয়া দেখায়, আর ‘খ’ দেখায় লাল, তবে ক+খ উত্পন্ন করবে সবুজ+লাল প্রতিক্রিয়া।
একটি বাক্সের ভেতরে বিড়ালটাকে আর অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পরমাণু রেখে বাক্সটা বন্ধ করে দিলে কী হবে? বিড়ালটা তেজস্ক্রিয়তার শিকার না হলে বেঁচে থাকবে। আর যদি তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়, তবে মারা যাবে। বাক্সের বাইরে থেকে আমরা ভাবতেই পারি, বিড়ালটা বেঁচে আছে অথবা বিড়ালটা বেঁচে নেই। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী এরউইন শ্রোডিঙ্গার সেই ১৯৩৫ সালে যে ধাঁধা তৈরি করেছিলেন, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে এখনো। কোয়ান্টাম সুপারপজিশনে একটি পরমাণু বা ফোটন ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাবনায় একাধিক অবস্থানের যোগফল হিসেবে থাকবে। বাইরের পৃথিবী যতক্ষণ পর্যন্ত দেখতে না পারছে এর অবস্থান, ততক্ষণ এর অবস্থান এমনই। একটি বা সেটার বিকল্প সম্ভাব্য অবস্থান জানা হয়ে গেলেই সুপারপজিশন ধসে পড়বে। শ্রোডিঙ্গার পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন, বৃহৎ দূরত্বে থাকা একাধিক কণা বা পার্টিকেল এ রকম সুপারপজিশনে থাকে এবং এই থাকাথাকির একটি নিয়ম তৈরি হয়ে আছে। জানা যায়, শ্রোডিঙ্গার এবং আইনস্টাইন নিজেদের মধ্যে চিঠি লিখে সুপারপজিশন নিয়ে আলাপ করতেন। এক চিঠিতে আইনস্টাইন পিপে আর বারুদের কথা বলেছিলেন। ধরা যাক, একটা ছোটখাটো একটা পিপের ভেতর কিছু বারুদ আছে। পিপের ভেতর বারুদের কোনো স্থিতিশীলতা নেই। ধরি, একটি সময়ে বারুদ সুপারপজিশনে থাকবে। অর্থাৎ, সেই সময়ে এটা বিস্ফোরিত অবস্থায় এবং অবিস্ফোরিত অবস্থায় বিরাজ করবে।
আমরা জানি, বিড়াল এরপর আর বিড়াল থাকেনি। সুপারপজিশন বিজ্ঞানের তর্ককে সুপারপজিশনে মহাবিশ্ব থাকতে পারে কি না, সেই আলাপেও টেনে নিয়েছিল। সুপারপজিশনে থাকা বিড়ালটাকে এত দিন তত্ত্বকথায় খুঁজে পেলেও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি দল প্রথমবারের মতো ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে (০.৫৪ মিটার বা প্রায় আধা গজ) সুপারপজিশনের ডেমোনেস্ট্রেশন দেখিয়েছেন। এখন বলা হচ্ছে, বিড়ালটা একই সময়ে যে দুটি স্থানে অবস্থান করতে পারে। গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সময়ে বেঁচে থাকতে পারে, মরে থাকতে পারে এবং এক সঙ্গে দুই জায়গায় অবস্থান করতে পারে। এর মানে কী? বিড়ালটা এক জায়গায় হয়তো রোদে বসে দুধের বাটিতে চুকচুক চুমুক দিচ্ছে, আরেক জায়গায় সেই একই বিড়াল সেই একই সময়ে আরামের ভাতঘুম দিচ্ছে।
হাতেনাতে পরীক্ষাটি করার পর এখন জোর গলায় বলা হচ্ছে, আমাদের নিত্যদিনকার জীবনে দূরত্ব আর সময়ের স্কেল মাথায় রেখেই সুপারপজিশন সম্ভব বলে মেনে নিতে হবে। মহাবিশ্ব হয়তো সত্যিই আমাদের ধারণায় স্পষ্ট নয় বা হবে না অথবা পরাবাস্তবতাতেই ডুবে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ধরা না পড়ছে বা পারিপার্শ্বিকতার মুখোমুখি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেকোনো কণা সত্যিকার অর্থে সুপারপজিশনে অবস্থান করতে পারে, অর্থাৎ একই সময়ে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে। যদি একটি মাত্র অবস্থানে থাকে, তার মানে এই নয় যে এর আর কোনো অবস্থান নেই বা ছিল না, সেই অবস্থানগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বা উবে গেলে তো পাওয়া যাবে না। গবেষণায় কণাগুলোকে মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো আচরণ করতে দেখা গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী মার্ক কাজেভিচ অতি ক্ষুদ্র অবস্থায় মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন আমাদের জানা সব পদার্থের আচরণ ব্যাখ্যা করে। পরে সাধারণ আপেক্ষিকতার সাহায্যে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করলেন এর সবচেয়ে বৃহৎ অবস্থায়। সুপারপজিশনের সূক্ষ্মতা বিজ্ঞানীদের আরও বড় উদাহরণ খুঁজে পেতে বাধা দিচ্ছে এখনো। নইলে সুপারপজিশনের সীমারেখা পরীক্ষা করে ঠিক কোন স্কেলে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান ভেঙে পড়তে পারে, তা জানতে পারলে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাঝে কোনো যোগসূত্র খুঁজে বের করতে পারতেন। তখন কি বাস্তবতার স্বভাব জেনে ফেলব আমরা? হয়তোবা।
হাতেনাতে যে পরীক্ষাটা হয়েছে, তার বিস্তারিত একটু জেনে নিই। এই জানার জন্যই দরকার বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর জার্মান-আমেরিকান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের যৌথ প্রয়াসে গড়ে ওঠা কৃতিত্বের কথা। পদার্থের চার অবস্থা নিয়ে বহুকাল কথা হয়েছে। পদার্থ বায়বীয়, তরল, কঠিন আর প্লাজমা অবস্থায় থাকতে পারে। ১৯৯০ সালের পর এই বাক্য বদলে গেল। পরম শূন্য তাপমাত্রার ধারাকে মেনে নিয়ে পরমাণুর দলকে ঠান্ডা করে ফেলার কথা জানা গেল। এই তাপমাত্রায় পৌঁছে গেলে পরমাণু একটির সাপেক্ষে আরেকটি যে একচুল নড়বে, সে রকম মুক্ত কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। এই পর্যায়ে এসে পরমাণুরা একে অন্যের সঙ্গে ঝাঁকি খেতে খেতে সমান শক্তির পর্যায়ে প্রবেশ করে। পরমাণুর দল পৌঁছে যায় এক আদর্শ অবস্থানে (কোয়ান্টাম অবস্থানে), যখন এরা সবাই মিলে একটি মাত্র পরমাণুর মতো আচরণ করতে থাকে, একে অন্যের থেকে আলাদা করা সম্ভব হয় না। এই পরমাণু তখন মুক্ত শক্তি হারিয়ে বাধ্য হয়ে যায় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন দশায় পৌঁছায়।
বোস-আইনস্টান ঘনীভবন তৈরির জন্য ভাসমান গ্যাসের একটি মেঘকে নিলেই চলে। অনেকে এর জন্য রুবিডিয়াম পরমাণুকে আদর্শ মানেন। পরমাণু থেকে শক্তি শুষে নিতে ব্যবহার করতে হবে লেজার বিম, ফলে পরমাণু হারাবে তাপ আর হয়ে যাবে ঠান্ডা। বাষ্পীভবন শীতলীকরণের মাধ্যমে পরমাণু আরও আরও বেশি ঠান্ডা হবে, তবে কঠিন জালির (ল্যাটিস) আকার ধারণ করবে না। কেননা, এর স্থিতিশক্তির চেয়ে গতিশক্তির মাত্রা থাকবে বেশি।
তাত্ত্বিকভাবে এ রকম মেঘ তৈরি করা সম্ভব, তা বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর আবিষ্কৃত তাত্ত্বিক কণার নাম দেওয়া হয় তাঁর নাম অনুসারে, বোসন। বিজ্ঞানী বসু কোয়ান্টাম মেকানিকসের পরিসংখ্যানগত সমস্যা নিয়ে কাজ করতে করতে তাঁর ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দেখলেন, বিজ্ঞানী বসুর অঙ্কটা কেবল পরমাণু নয়, আলোর ক্ষেত্রেও কাজ করার কথা। এতে দাঁড়িয়ে গেল বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, যা বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত মেঘ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় পরমাণু আচরণ করে সুপার পরমাণুর মতো। তখন এই পরমাণুকে দেখতে গেলে পরমাণু নয়, বরং চোখে পড়ে অস্পষ্ট বল, আলাদাভাবে যা থেকে পরমাণুকে চিহ্নিত করা যায় না। তত্ত্বটা পুরোপুরি প্রমাণিত হলো ১৯৯৫ সালে। এরিক এ কর্নেল এবং কার্ল ই ওয়েইমান যৌথভাবে বানিয়ে ফেললেন বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত মেঘ। ২০০১ সালে এর জন্যই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে ফিরে আসি আবার। বেশ কিছু অতিমাত্রায় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত ঠান্ডা মেঘ তৈরি করা হয়েছিল সেখানে। প্রতিটি মেঘ তৈরি হয়েছিল এক লাখ রুবিডিয়াম পরমাণু দিয়ে। জালির সাহায্যে লেজার বিম ব্যবহার করে গবেষক দল এই পরমাণু মেঘগুলোকে বাধ্য করলেন তরঙ্গের প্যাকেট হিসেবে ঝরে পড়তে, যেন এগুলো মেঘ নয়, ঝরনাধারা! ঝরে পড়তে থাকা তরঙ্গের প্যাকেট যেই ওপরে উঠছিল, লেজার বিম প্রতিটি প্যাকেটকে কমপক্ষে ২১.২৫ ইঞ্চি (৫৪ সেন্টিমিটার) দূরত্বে আলাদা করে দুটি প্যাকেটে পরিণত করে একটির সঙ্গে আরেকটিকে সুপারপজিশনে রাখলেন। এক সেকেন্ড সময় পর দুটি প্যাকেট আবার মিলে একটা হলো। তখন প্যাকেটটির বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে সুপারপজিশনে থাকার অবস্থানটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন বিজ্ঞানীরা এবং সফল হলেন। এ রকম ম্যাক্রোস্কোপিক সুপারপজিশনের সাফল্যের মূলে আছে অতিকায় ঠান্ডার প্রভাব। কত বেশি ঠান্ডা? নিম্নতম সম্ভাব্য তাপমাত্রা বা শূন্য ডিগ্রির চেয়েও এক বিলিয়ন কম ডিগ্রির সেই তাপমাত্রাকে বলা হচ্ছে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হতে পারে, এমন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
এরপর কী ঘটবে? কমপক্ষে ৩৩ ফুট বা ১০ মিটার স্কেলে ম্যাক্রোস্কোপিক সুপারপজিশন ঘটনার চেষ্টা চলছে। দেখা যাক কী ঘটে।
এত সব মাথায় রেখে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল দুটি বাক্সে থাকতে পারে কি না? তা জানতে বিজ্ঞানীরা প্রায় এক ইঞ্চি দূরত্বে দুটি অ্যালুমিনিয়ামের গর্ত বানিয়ে স্যাফায়ারের টুকরো ব্যবহার করে গর্ত দুটির ভেতরে আলোর স্থির তরঙ্গ তৈরি করেন। বিশেষ ইলেকট্রনিক উপাদান ব্যবহার করে প্রতি গর্তে আলোর দুটি ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটির ওপর আরেকটির সুপার ইম্পোজ ঘটানোর পর স্পষ্ট হয়, দুটি গর্তে দুটি ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকপ্রবাহ একই সময়ে অবস্থান করতে পেরেছে। তাই যদি হয়, একই সময়ে দুটি বাক্সে শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালটি কি থাকতে পারে না? বিড়ালটা দুটি বাক্সে বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা জানার জন্য এখন করতে হবে একটি মাত্র কাজ। দুটি বাক্সই খুলে দেখতে হবে!
লেখক: সম্পাদক, মাসিক নবারুণ
*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত