নিউক্লিয়ার ব্যাটারি: চার্জ ছাড়াই চলবে অর্ধশতাব্দী!

নিউক্লিয়ার ব্যাটারির প্রতীকী ছবি

খেলা, নাটক নাকি ডকুমেন্টারি—এই দ্বন্দ্ব মিটতে না মিটতেই রিমোটের ব্যাটারি শেষ। নতুন ব্যাটারি না ভরলে আর চ্যানেল পাল্টানোর উপায় নেই। চ্যানেল পাল্টানোর ঝগড়াঝাটি আপাতত তুলে রেখে রিমোটের ব্যাটারি কে আনতে যাবে, তা নিয়ে আরেকদফা ঝগড়া শুরু হওয়ার জোগাড়! কিন্তু কেমন হতো, যদি রিমোর্টের ব্যাটারির চার্জ ৫০ বছরেও না ফুরাত? শুধু রিমোর্ট কেন, চার্জ দেওয়ার বিড়ম্বনা ছাড়াই মোবাইল ফোনটা যদি চলত বছরের পর বছর? ভাবতেই ভালো লাগছে, তাই না?

সাধারণ ডাবল এ (AA) বা ট্রিপল এ (AAA) ব্যাটারিকে ড্রাই-সেল ব্যাটারিও বলা হয়। (বলে রাখি, ডাবল এ, ট্রিপল এ হলো ব্যাটারির আকার—রিমোটে সাধারণত ট্রিপল এ সাইজের ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। ডাবল এ ব্যাটারি এর চেয়ে কিছুটা বড়।) কারণ, এ ব্যাটারিগুলো শুষ্ক। ভেতরে তরল ইলেকট্রোলাইট বা তড়িৎবিশ্লেষ্য রাসায়নিক দ্রবণের পরিবর্তে থাকে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড বা জিংক ক্লোরাইড। অ্যানোড বা ধনাত্মক তড়িৎদ্বার এবং ক্যাথোড বা ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার হিসেবে থাকে জিংক ও ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড। রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে ব্যাটারি থেকে তড়িৎ প্রবাহ সঞ্চালিত হয়। উপাদান নির্দিষ্ট হওয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে পারে। ফলে, দ্রুতই এর তড়িৎ প্রবাহ পরিচালনার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। আমরা বলি, ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেছে।

ব্যাটারির এ রাসায়নিক বিক্রিয়ার বদলে যদি সঠিকভাবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে কিন্তু এত দ্রুত চার্জ শেষ হওয়ার কথা নয়। কারণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া উপযুক্ত পরিবেশ ও বিক্রিয়কের নির্দিষ্ট অনুপাতে ঘটে। মানে পর্যাপ্ত উপাদান থাকলেও সেগুলো যদি অনুকূল পরিবেশ না পায় কিংবা তাদের অনুপাত যদি ঠিক না থাকে, তাহলে বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। তা ছাড়া রাসায়নিক বিক্রিয়া আসলে মৌল বা যৌগের ইলেকট্রনের কক্ষপথে ঘটে। এটা একটা সীমাবদ্ধতা। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার বিষয়টা এরকম নয়। বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় আমরা দেখি, পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো ক্ষয় হতে হতে যতক্ষণ ভিন্ন আরেকটা পরমাণুতে রূপ না নিচ্ছে, ততক্ষণ বিক্রিয়া চলতে থাকে। অর্থাৎ এ বিক্রিয়া ঘটে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। সেখান থেকে বিপুল শক্তি পাওয়া যায়।

পরমাণুর প্রায় পুরোটা—বলা চলে, ৯৯.৯ শতাংশ—ভরই যেহেতু নিউক্লিয়াসে জমা থাকে, তাই এখান থেকে যে শক্তি পাওয়া সম্ভব, তা অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায় না। হয়তো বলতে পারেন, ভরের সঙ্গে শক্তির সম্পর্ক কী? এর উত্তরে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সেই সূত্রটা আরেকবার দেখে নিতে হবে। E=mc2। এ সূত্র বলে, ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এ সূত্র থেকে শক্তির পরিমাণটাও জানা যায়। সেটা হলো, কোনো বস্তু থেকে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ ওই বস্তুর ভর ও আলোর বেগের বর্গের সমান! আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে বলা যায়, এখানে বস্তুর ভর মানে, স্থির অবস্থায় ভর। যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।

বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই নিউক্লিয়ার ব্যাটারি নিয়ে কাজ করছেন। সফলভাবে নিউক্লিয়ার ব্যাটারি কেবল তৈরিই করেননি, রীতিমতো ব্যবহার করছেন নানা কাজে। উদাহরণ দিই।

বেটাভোল্টের তৈরি নিউক্লিয়ার ব্যাটারি

২০২০ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মঙ্গলে পার্সিভিয়ারেন্স রোভার নামে একটি রোবোটিক যান পাঠায়। ওই রোভার এখন পর্যন্ত সচল আছে। পাঠাচ্ছে মঙ্গলের নানা তথ্য। পার্সিভিয়ারেন্সের শক্তির উৎস কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ নয়। রেডিও আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর বা আরটিজির মাধ্যমে শক্তি পায় এ রোবোযান। জ্বালানি: প্লুটোনিয়াম ডাই-অক্সাইড। সিবেক ক্রিয়ার মাধ্যমে এতে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা হয়। সিবেক ক্রিয়া আর কিছুই নয়, দুটি ভিন্ন পরিবাহীর দণ্ডের দুই প্রান্ত তার দিয়ে যুক্ত করে যদি বদ্ধ বর্তনী তৈরি করা হয়, আর পরিবাহী দুটির দুই প্রান্তে তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে, তাহলে এদের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে থাকে। পার্সিভিয়ারেন্সের শক্তি যোগাতে নভোযানটিতে আছে ৫ কেজি প্লুটোনিয়াম ডাই-অক্সাইড। এই আরটিজি বোর্ড পার্সিভিয়ারেন্সের জন্য প্রায় ১১০ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। তবে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হওয়ায় পরিমাণটা কমছে একটু একটু করে। কারণ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় একটু একটু করে ক্ষয় হচ্ছে প্লুটোনিয়াম।

মহাকাশযানের শক্তির চাহিদা মেটাতে আরটিজি চমৎকার প্রযুক্তি। কিন্তু প্লুটোনিয়াম-২৩৮ অতিমাত্রায় বিষাক্ত ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তাই এ জিনিস আর যা-ই হোক, দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা যন্ত্রে আপনি-আমি কেউই দেখতে চাইব না।

তাহলে কি নিউক্লিয়ার ব্যাটারির স্বপ্ন এখানেই শেষ? মোটেও না। এ বছরের শুরুর দিকে বেটাভোল্ট নামে চীনা এক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে নিউক্লিয়ার শক্তি সমৃদ্ধ ব্যাটারি।

কিছু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ক্ষয় হওয়ার সময় বিটা রশ্মি নিঃসরণ করে। সহজ করে বললে, বিটা রশ্মি হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। উচ্চ শক্তির ও উচ্চ গতির ইলেকট্রনের প্রবাহ। অর্থাৎ এসব আইসোটোপ ক্ষয় হওয়ার সময় ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়।

যদি এ ধরনের আইসোটপের পাতলা একটি পাতকে দুটি অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাকটরের পাতের মধ্যে রেখে দিই, তাহলে ক্ষয়ের কারণে নিঃসৃত ইলেকট্রন খুব সহজেই ধরা যাবে। আর ইলেকট্রনের স্রোত অর্ধপরিবাহীর মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ শক্তি।

নিউক্লিয়ার ব্যাটারির প্রতীকী ছবি

এই প্রযুক্তিটি কিন্তু নতুন নয়। সেই ১৯৭০ দশকের। সে কালে বেটাভোল্টের তৈরি এ ব্যাটারিগুলোতে ব্যবহার করা হতো দুষ্প্রাপ্য মৌল প্রমিথিয়াম। ১৯৭০-এর দশকে পেসমেকারে এ ব্যাটারি ব্যবহার করা হতো। পরে অবশ্য কম দামী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির কারণে বাজারে আর টিকতে পারেনি বেটাভোল্টের এ ব্যাটারি।

বর্তমানে বেটাভোল্টের ব্যাটারিগুলোতে প্রমিথিয়ামের বদলে ডায়মন্ড বা হীরা দিয়ে তৈরি সেমিকন্ডাক্টরের দুটি পাতের মধ্যে নিকেল-৬৩ আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। এর শক্তি খুব কম। মাত্র ১০০ মাইক্রোওয়াট শক্তি সরবরাহ করতে পারে। এদিকে সাধারণ ডাবল এ ব্যাটারি যোগান দিতে পারে ২.৪ ওয়াট শক্তি। তবে ডাবল এ ব্যাটারি পূর্ণমাত্রায় ঘণ্টাখানেক ব্যবহারের পরই এর শক্তি ফুরিয়ে যায়। অন্যদিকে বেটাভোল্টের এই নতুন নিউক্লিয়ার ব্যাটারি ৫০ বছর ধরে যথেষ্ট শক্তি সরবরাহ করতে পারবে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ, নিকেল-৬৩ আইসোটোপের অর্ধায়ু প্রায় ১০০ বছর। অর্থাৎ, ৫০ বছরে এ ব্যাটারির কর্মক্ষমতা কমবে মাত্র ২৫ শতাংশ। বলা প্রয়োজন, তেজস্ক্রিয় নিকেল ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কপার বা তামায় পরিণত হয়।

১৯৭০-এর দশকে পেসমেকারে এ ব্যাটারি ব্যবহার করা হতো

বেটাভোল্টের ব্যাটারিগুলো তুলনামূলকভাবে বেশ নিরাপদ। কারণ, আলফা ও গামা রশ্মি দেহকোষের যে পরিমাণ ক্ষতি করে, বিটা রশ্মি তথা ইলেকট্রন সেরকম ক্ষতি করে না। সত্যি বলতে, এ ক্ষতির পরিমাণ নিতান্ত কম। তা ছাড়া ধাতব পদার্থ দিয়ে খুব সহজেই ইলেকট্রনের প্রবাহ আটকে দেওয়া যায়। তবু যদি ভাবেন, এ ব্যাটারি ক্ষতি করতে পারে, এ ব্যাপারে বেটাভোল্টের মজার একটি দাবির কথা বলা যেতে পারে। এ ধরনের নিউক্লিয়ার ব্যাটারির মাধ্যমে নিজের ক্ষতি করতে চাইলে আপনাকে ব্যাটারি খুলে সেটা খেয়ে ফেলতে হবে! হ্যাঁ, সত্যিই এ দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আশা করা যায়, এ কাজ কেউ করবে না।

কবে নাগাদ এসব ব্যাটারির কার্যক্ষমতা ১০০ মাইক্রোওয়াট থেকে বাড়িয়ে কাজের উপযোগী পরিসরে নিয়ে আসা যাবে, এখন তারই অপেক্ষা। বিজ্ঞানীরা দিন-রাত এ নিয়ে কাজ করছেন। এ ধরনের নিউক্লিয়ার ব্যাটারি হয়তো ভবিষ্যতে আপনার-আমার পরিচিত ডিভাইস, যেমন মোবাইল বা ল্যাপটপে স্থান করে নেবে। ব্যাটারি বদল বা চার্জ দেওয়ার যন্ত্রণা মনে করে হয়তো তখন মনে মনে হাসব আমরাই।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, টম’স হার্ডওয়্যার, উইকিপিডিয়া