ন্যানোর দুনিয়া

ন্যানোর জগৎ হলো এমন এক অতিক্ষুদ্রের জগৎ, যার থেকে ক্ষুদ্রতর কোনো কাঠামো তৈরি সম্ভব নয়। এটা দৈর্ঘ্যের সেই সীমানা, যার নিচে ইঞ্জিনিয়ারিং সম্ভব হয় না। এই অতিক্ষুদ্রের জগতে দৈর্ঘ্যের একক এক ন্যানো মিটার। এই ন্যানো জগতে অণু-পরমাণু তাদের নিজস্বতা প্রদর্শন করতে পারে। অনেক অণু-পরমাণু একত্রে মিলিত হয়ে নিজস্বতা হারিয়ে যখন একটা দলগত ঐতিহ্য প্রদর্শন করে, তখন সেটাকে বলে ‘ম্যাক্রোওয়ার্ল্ড’। এই বৃহতের জগৎ আমরা সচরাচর দেখে থাকি।

‘ন্যানো টেকনোলজি’ বলতে আসলে কী বোঝায়? এটা সেই প্রযুক্তি, যেখানে এমন সব পদার্থ বা সিস্টেম আছে, যাদের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধের অন্তত একটি মাত্রার দৈর্ঘ্য এক থেকে এক শ ন্যানো মিটারের মধ্যে। এমন পদ্ধতির সাহায্যে এদের ডিজাইন করা হয়েছে যা আণবিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সাধিত হয়েছে। আর এসব অংশবিশেষ আপনা থেকে বা বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে ম্যাক্রোস্কেলের কাঠামো তৈরি করতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তি তখনই বিকশিত প্রযুক্তি হবে, যখন আণবিক স্কেলে কার্যকর ভৌত বা রাসায়নিক নিয়মগুলোর যথাযথ প্রয়োগ এবং এদের নিয়ন্ত্রণের একটা পদ্ধতিবদ্ধ রূপ দাঁড় করানো সম্ভব হবে। আশা করা যায়, এই প্রযুক্তির আয়ত্তের ফলে আণবিক স্কেলে পদার্থের আশ্চর্য সব গুণাগুণ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। ফলে এসব ডিভাইসের বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক (মেকানিক্যাল), আলোকীয় (অপটিক্যাল), রাসায়নিক ধর্মাবলি অনেক উন্নত হবে।

মজার বিষয়, ন্যানো প্রযুক্তি তেমন কোনো পুরোনো বিষয় নয়। তাহলে আর এত লম্ফঝম্ফ কেন? আসলেই ব্যাপারটা অনেক পুরোনো—বহু কোটি বছরের পুরোনো একটা প্রযুক্তি—যেটা মানুষ কেবল সেদিন নজর দিতে শুরু করেছে। যে প্রযুক্তির কথা বলছি, সেটা আর কিছুই নয়, আমাদের অতিপরিচিত বায়োলজি বা জীববিজ্ঞান। বহু কোটি বছর ধরেই পৃথিবীতে অণুজীবেরা (মাইক্রোব) ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। অতিক্ষুদ্র ন্যানো আকৃতির বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আছে। এদের সাঁতারকাটার জন্য প্রয়োজনীয় প্রপেলারও প্রকৃতি তাদের দিয়েছে। জীবনের উপাদান বিভিন্ন প্রোটিন সংশ্লেষণে, ডিএনএ ব্যবহারে, অণুজীবদের জীবনে অহরহ এই ন্যানো জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বহু কোটি বছর ধরেই এটা চলছে। এমনকি পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পরও মানুষের নাকের ডগায় প্রকৃতি ন্যানো টেক করে গেছে। মানুষ সেটা টের পেল এই মাত্র কয়েক বছর হলো। ত্রিশ–চল্লিশের দশকে মানুষ বুঝতে শিখল, পদার্থের ন্যানো স্কেলে কী অভাবনীয় কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে। মানুষ আবিষ্কার করল কোয়ান্টাম মেকানিকস। এই মেকানিকস ব্যবহার করে মানুষ সলিড-স্টেট ডিভাইস বানাল। এল কম্পিউটার–বিপ্লব। তারপর মার্কিন প্রকৌশলী গর্ডন মুরের নীতি অনুযায়ী, প্রতি ১৮ মাসে মাইক্রোচিপের দৈর্ঘ্য কমতে থাকায় কম্পিউটারের স্পিড বা গতি বাড়ল দ্বিগুণ করে। অতঃপর একুশ শতক! আর এই শতকে এসে মানুষ বুঝতে শিখল, প্রকৃতি জীববিজ্ঞানের সাহায্যে যা করে এসেছে কোটি বছর ধরে, সেটা কৃত্রিমভাবেও করা যায়।

এক ন্যানো মিটার হলো ১০টি হাইড্রোজেন পরমাণুকে পরপর রাখলে যে দৈর্ঘ্য হয়, তার সমান। সাধারণ আলপিনের মাথার চেয়ে এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বা সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার এক হাজার ভাগের এক ভাগ কিংবা একজন পূর্ণদৈর্ঘ্য মানুষের সম্পূর্ণ পায়ের দৈর্ঘ্যের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ—এসব মাত্রা এক ন্যানো মিটারের সমান। আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ডক্টরেট গবেষণার বিষয় হিসেবে পানিতে চিনির ব্যাপনক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে, পর্যবেক্ষিত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি চিনির অণুর আকার নির্ণয় করেছিলেন। মজার ব্যাপার, এই চিনির অণুর আকারও এক ন্যানো মিটার।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পদার্থবিজ্ঞানীদের এক সভায় ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একটি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতার শিরোনাম ‘দেয়ার্স প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দ্য বটম’। ফাইনম্যানের এই বক্তৃতা পরবর্তী সময়ে ন্যানো টেকের ভিত্তিস্থাপন করে। ফাইনম্যান ছিলেন একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তদুপরি তাঁর সঞ্চালিত স্নাতক শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান–সংক্রান্ত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পাঠ্যবই বিশ্ববিদিত। কয়েক প্রজন্ম পদার্থবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার তিন খণ্ডের, ‌‘ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স’ থেকে পদার্থবিদ্যা শিখেছেন। তাঁর অনবদ্য কথনশৈলী আজও মাস্টারপিস হয়ে আছে। ফাইনম্যানের উপরোক্ত বক্তৃতাটিতে প্রায় সাত হাজার শব্দে ন্যানো টেকের অমিত সম্ভাবনা সম্পর্কে দৃকপাত করা হয়েছে। তাঁর ভাষায়: ‘আমি যা বলতে চাইছি, তা হলো অতিক্ষুদ্রের জগতে পদার্থের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ–সংক্রান্ত সমস্যা।’

এই বক্তৃতায় তিনি যেসব বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার অনেকই আজকালকার আধুনিক ল্যাবরেটরিতে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন ইলেকট্রন বিম ও আয়ন বিম ফ্যাব্রিকেশন, মলিকুলার বিম এপিট্যাক্সি, ন্যানো ইমপ্রিন্ট লিথোগ্রাফি, প্রোজেকশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি, পরমাণু স্তরে নিয়ন্ত্রণ, কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস, স্পিনট্রনিকস, মাইক্রো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস (এমইএমএস বা মেমস) ইত্যাদি। ফাইনম্যানের এই বক্তৃতার প্রায় ৬০ বছর পর আজ এ কথা বলা যায় যে তিনি একজন সত্যিকারের দ্রষ্টা বা ভিশনারি ছিলেন। আজ দুনিয়াজোড়া আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অগুনতি গবেষক, বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের দল ন্যানো নিয়ে কাজ করছে, অথবা ন্যানোর পেছনে ছুটছে। গবেষণা সংস্থাগুলোও ন্যানোতে লক্ষ লক্ষ ডলার গবেষণা বরাদ্দ দিচ্ছে। তবু এখনো ন্যানো সিস্টেম গণহারে উৎপাদন শুরু করা যায়নি। ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিকমপোনেন্ট ন্যানো ডিভাইস এখনো তৈরি হয়নি, যেটা কম্পিউটারে ব্যবহৃত মাইক্রোচিপের মতো জটিলতার বা দক্ষতার সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তবে বোঝা যায় যে অমিত সম্ভাবনাময় এবং একটি বিকশিত প্রযুক্তি হিসেবে ন্যানো প্রযুক্তির আবির্ভাব অত্যাসন্ন।

প্রযুক্তিবিদেরা দুটো উপায়ে এই ন্যানো ডিভাইস বানানোর চিন্তা করছেন। ‘টপ-ডাউন’ ও ‘বটম-আপ’। টপ-ডাউন নির্মাণ পদ্ধতিতে একটা বড় জিনিস থেকে ভেঙে ভেঙে ছোট ন্যানো কাঠামো তৈরি করা হয় (যেমন ইলেকট্রন বিম লিথোগ্রাফিতে করা হয়)। কিন্তু এই পদ্ধতিতে দশ ন্যানো মিটারের থেকে ছোট কাঠামো বানানো অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ‘সেলফ-অ্যাসেম্বলি’ পদ্ধতিতে অনেক ছোট ছোট উপাংশ মিলে একটি বড় অংশ তৈরি করা হয় ‘বটম-আপ’ অ্যাপ্রোচে। কিন্তু গণহারে ন্যানো কাঠামো উৎপাদনের প্রচেষ্টা এই দুইয়ের কোনো পদ্ধতিতেই এখনো সম্ভব হয়নি। রসায়নবিদেরা এই বিষয়ে বেশ অগ্রগতি পেলেও এখনো সর্বত্র গণহারে ন্যানো প্রযুক্তির রমরমা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। একটি কণা আরেকটির পাশে রাখলে কী হবে, সেটা গণনা করা যায়। কিন্তু অনেক কণা পরপর রাখলে তাদের আচরণ কেমন হবে, সেটা এখনো ঠিক নিশ্চিত করে গণনা করা যায়নি, নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা।

ন্যানো বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হলো, গুটিকয়েক অণু বা পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত সিস্টেমের সাধারণ ধর্মাবলি পর্যবেক্ষণ করা। এই সিস্টেমের দৈর্ঘ্য মাইক্রোসিস্টেমের তুলনায় ক্ষুদ্র, যাতে করে কোয়ান্টাম ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা যায়। মাইক্রোসিস্টেমে কোয়ান্টাম ক্রিয়া অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং ম্যাক্রোসিস্টেমে সেটা একেবারেই থাকে না। থাকে শুধু বহু কোটি অণুর ‘গড় ধর্মাবলি’। আর এটাই আমরা দৈনন্দিন জীবনে সচরাচর দেখে অভ্যস্ত। তত্ত্বের ভাষায় ন্যানো স্কেলকে বলা হয় ‘মেসোস্কেল’, যা ১০০ ন্যানো মিটারের চেয়ে ক্ষুদ্রতর। ন্যানো প্রযুক্তির অধীনে মেসোস্কেলে কার্যকর বৈজ্ঞানিক বিধিসমূহকে কাজে লাগিয়ে লাগসই ডিভাইস ডিজাইন ও নির্মাণ করা হয়। কোয়ান্টাম মেকানিকস একক অণু বা পরমাণুর ধর্ম বিশ্লেষণ করে। কিন্তু মেসোস্কেলে কার্যরত কয়েক শত অণু-পরমাণুর গণনা করাটা বেশ মুশকিল। কারণ, ওই স্কেল একটি অণু-পরমাণুর চেয়ে বৃহৎ, কিন্তু কোটি–খানেক অণু-পরমাণুর থেকে ক্ষুদ্রতর। কোয়ান্টাম মেকানিকসে একটি কণার জন্য গণনা করাটা যত সহজ, একাধিক কণার জন্য ততটা সহজ নয়। আবার গড় হিসাবের জন্য মেসোস্কেল অনেক ক্ষুদ্র। অর্থাৎ ন্যানো জগৎটি মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছে খুব বড়ও নয়, আবার খুব ছোটও নয়।

ন্যানো ইলেকট্রনিক ক্ষেত্র থেকে তিনটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে ন্যানো স্কেলে কার্যকর কোয়ান্টাম ধর্মাবলির বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। এই তিনটি ক্ষেত্র হলো বিদ্যুৎ ও তাপীয় পরিবহনের কোয়ান্টা আবিষ্কার ও বৈদ্যুতিক কুলম্ব বাধার আবিষ্কার।

১৯৮৭ সালে হল্যান্ডের ডেলফ্‌ট ইউনিভার্সিটিতে গবেষকেরা বিশেষভাবে নির্মিত কনট্যাক্ট-পয়েন্টের মধ্যে বৈদ্যুতিক পরিবহন পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এই ধাতব সংযোগ বিন্দুগুলোকে সংযোজনকারী অত্যন্ত সরু পরিবহন বা কন্ডাকশন চ্যানেলটিকে একটি বিশেষ অর্ধপরিবাহী (সেমিকন্ডাকটিং) পদার্থের মধ্যে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয় এবং এদের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহকে পরিবাহিত হতে বাধ্য করা হয়। এই পরিবহন পথটির প্রশস্ততা বদলানোর ফলে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা সরলরেখায় না বেড়ে কেবল ধাপে ধাপে বাড়ছে। অর্থাৎ সিঁড়ির মতো নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর পরিবাহিতা বাড়ে আর তারপর স্থির থাকে, নির্দিষ্ট দূরত্ব পর আবার বাড়ে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর দুই গবেষকও এই বৈদ্যুতিক ধর্ম দেখতে পেয়েছেন। বৈদ্যুতিক প্রবাহ যে কোয়ান্টায়িত হতে পারে, এটা তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। এই কোয়ান্টায়ন তখনই দেখা যায়, যখন ইনপুট থেকে আউটপুটে ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা সুন্দরভাবে বজায় থাকে। অতিক্ষুদ্র ন্যানো জগতেই এই কোয়ান্টায়নের বাস্তব ক্রিয়া দেখা যায়। ১৯৫৭ সালেই অবশ্য রলফ ল্যানডাউয়ের বৈদ্যুতিক প্রবাহের ওপর কোয়ান্টাম ক্রিয়া–সংক্রান্ত তাত্ত্বিক গবেষণাটি করেছিলেন। কিন্তু ফ্যাব্রিকেশন বা নির্মাণের কলাকৌশলের উন্নতির ফলেই কেবল ১৯৮৭ সালে সম্ভব হয়েছে পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল যাচাই করা।

১৯৮৫ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির কন্‌স্তান্তিন লিখারেভ ও তাঁর সহকর্মীরা তথাকথিত ‘কুলম্ব দ্বীপের’ থেকে একটি একটি করে ইলেকট্রন প্রবাহের সম্ভাবনা যাচাই করছিলেন। এই ‘কুলম্ব দ্বীপ’ হলো ন্যানো জগতের এমন এক কাঠামো, যা ন্যানো সার্কিটের অন্য উপাংশের সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষীণভাবে যুক্ত থাকে এবং এটি নিজেই একটি পরিবাহী। ‘কুলম্ব দ্বীপ’ থেকে যদি একটি একটি করে ইলেকট্রন সরানো বা যোগ করা সম্ভব হয় তবে ‘সিঙ্গেল ইলেকট্রন ট্রানজিস্টর’ সম্ভব হবে। কারণ ওই দ্বীপাঞ্চল থেকে বিদ্যুতের পরিবাহিতা নির্ভর করে সিঙ্গেল ইলেকট্রন বা একক ইলেকট্রন দ্বারা ওই দ্বীপাঞ্চলকে চার্জিত করা যায় কি না, তার ওপর। ১৯৮৭ সালে বেল ল্যাবের গবেষকেরা প্রথম একক ইলেকট্রন ট্রানজিস্টর নির্মাণ করতে সক্ষম হন। একক ইলেকট্রন চার্জিংয়ের এই ঘটনা ন্যানো জগতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যানো সার্কিটের আকৃতি যত ছোট হয়, এই একক ইলেকট্রন প্রপঞ্চ তত গুরুত্বপূর্ণ হয়। এই প্রক্রিয়ার আরেকটি নাম ‘কুলম্ব ব্লকেড’। ক্ষুদ্রাকৃতির অণু ‘কুলম্ব দ্বীপ’ হিসেবে কাজ করতে পারে। দুটো ধাতব সংযোগের মাঝখানে এসব বিশেষ অণু রাখলে তারা ‘কুলম্ব দ্বীপ’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এভাবে একক ইলেকট্রন ট্রানজিস্টর বানানো সম্ভব। এ প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নির্ভরযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির চেষ্টা চলছে এবং ইতিমধ্যেই বেশ সাফল্য এসেছে।

১৯৯৯ সালের দিকে ক্যালটেকে ন্যানো কাঠামোর তাপ পরিবহনক্ষমতা নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, অতিক্ষুদ্র চ্যানেল দিয়ে তাপ পরিবহনের একক কী তা নির্ণয় করা। বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার কোয়ান্টায়নের মতোই এই গবেষণার ফলে তাপ পরিবহনের কোয়ান্টা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে তৈরি সিলিকন নাইট্রাইডের অত্যন্ত সরু ন্যানো ব্রিজের মধ্য দিয়ে তাপ চালনা করা হয়। এই গবেষণার দ্বারা ন্যানো কাঠামো দিয়ে তাপ বহনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়। দেখা যায়, যদি ন্যানো ডিভাইসের ইনপুট থেকে আউটপুটে তাপকে কোনো যান্ত্রিক কম্পন দিয়ে পরিবহন করা যায়, তবে তাপ পরিবহনের একটি সর্বোচ্চ হার আছে, যার বেশি তাপ পরিবহন করা যায় না। ন্যানো যন্ত্র বানানোর জন্য এই সীমা জানা জরুরি। কারণ, যখন ওই যন্ত্রটি কোনো কাজ করবে এবং ফলে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবে, সেই তাপ যাতে সহজে অন্যত্র সঞ্চালিত হতে পারে, তার উপায় থাকতে হবে। নচেৎ যন্ত্রটি পুড়ে যাবে। কাজেই কী হারে তাপ পরিবাহিত হবে, সেটা জানা জরুরি। এটা আমরা সবাই জানি যে কম্পিউটার, (বিশেষ করে ল্যাপটপ) অনেকক্ষণ চললে কত গরম হয়ে ওঠে। তা ছাড়া কম্পিউটার চিপের গায়ে একটা ফ্যান সব সময়েই লাগানো থাকে। এখন এই চিপে যদি দ্বিগুণ বা তিন গুণ ট্রানজিস্টর আঁটা হয় (ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে), তাহলে চিপটাও সেই অনুপাতে বেশি গরম হবে। এই উৎপাদিত তাপকে বের করে নিতে হবে, নাহলে চিপ পুড়ে যাবে। খুব সরু গলিতে যেমন ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারে না, সে রকম ন্যানো সার্কিটেও তাপ বেরোনোর পথ খুব সংকীর্ণ থাকে। কাজেই ন্যানো সার্কিটের বেলায় ‘সরু গলিপথগুলোকে’ এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে ‘ন্যানো ব্রিগেডের’ গাড়িগুলো বেরোনোর পথ পায়। ন্যানোর ক্ষেত্রে যেহেতু তাপ কোয়ান্টায় কোয়ান্টায় বাহিত হয়, তাই এখানে এই কোয়ান্টাকে ক্ষুদ্র সাইজের ন্যানো ফায়ার ব্রিগেড গাড়ি হিসেবে কল্পনা করা যায়। সহজেই বোধগম্য যে, এই গাড়িগুলোর সাইজ যেহেতু নির্দিষ্ট, তাই সরু গলিপথ বা ন্যানো চ্যানেলের প্রশস্ততাও নির্দিষ্ট। কারণ চাইলেও ওই নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের চেয়ে ন্যানো চ্যানেলকে সরু করা যাবে না। নয়তো ন্যানো ডিভাইস পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাস্তবে হাতে-কলমে কাজ করতে গেলে এমন অনেক রীতিনীতির সম্মুখীন হতে হয়, যেটা কল্পনার রাশ

টেনে ধরে।

এই তিনটি উদাহরণ দিয়ে বোঝা গেল যে ন্যানো স্কেলে প্রকৃতি কেমন কোয়ান্টায়িত হয়ে যায়। ঘটনাবলি তখন আর মসৃণ থাকে না। তা ছাড়া ন্যানো জগতের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুনও আছে, যা মেনে চলতে হয়। আমাদের সচরাচর যে ম্যাক্রো জগৎ আছে, সেখানে ঘটনাবলি এ রকম কোয়ান্টায়িত বা বিচ্ছিন্ন নয়। কোয়ান্টাম–জগৎ এমনই বিচ্ছিন্ন এক জগৎ, যেখানে সবকিছু কোয়ান্টায় কোয়ান্টায় বা ঝলকে ঝলকে ঘটে। ম্যাক্স প্লাংক দেখিয়েছিলেন যে কোয়ান্টাম স্তরে শক্তি নিরবচ্ছিন্ন নয়, তা ঝলকে ঝলকে নির্গত বা শোষিত হয়। ন্যানো জগতেও এই একই ব্যাপার-স্যাপার দেখা যায়। এই সব ঝলকের রীতিনীতি ভালোমতো জেনে-বুঝে-শুনে তবেই না ন্যানো প্রযুক্তি বিকশিত হবে।

ন্যানো ডিভাইসের আলোচনায় ন্যানো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস (সংক্ষেপে এনইএমএস বা ‘নেম্‌স’) সম্পর্কে কিছু না বললে অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। নেম্‌স হলো আদতে মেম্‌স-এর ন্যানোরূপ। মেমসে যেমন মাইক্রো স্কেলে মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়, নেম্‌স তেমনি একই কাজ করা হয় ন্যানো স্কেলে। এ ক্ষেত্রে অতিক্ষুদ্র গিয়ার, ফ্লুইড চ্যানেল, ক্যান্টিলিভার ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়, যা দিয়ে অনেক দরকারি ইলেকট্রনিক গেজেট বানানো যায়। যেমন ন্যানো–স্কেলের ক্যান্টিলিভার দিয়ে অণু-পরমাণুর ভর মাপার যন্ত্র তৈরি করা যায়। ক্যান্টিলিভার হলো এমন এক লিভার যার এক প্রান্ত সংযুক্ত থাকে এবং অন্য প্রান্ত মুক্ত থাকে। এই ক্যান্টিলিভারের কম্পন তার ভরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ক্যান্টিলিভারের ওপর কোনো জিনিস রাখলে তার কম্পন বদলে যায়। কম্পনের এই পরিবর্তন থেকে নতুন ওই বস্তুর ভর পরিমাপ করা যায়। এই নিয়মকে কাজে লাগিয়ে অতিক্ষুদ্রাকৃতির ক্যান্টিলিভার তৈরি করা যায়, যা অণু-পরমাণুর ভর মাপতে সক্ষম। নেম্‌সকে সফল করতে হলে আগে কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেমন একটি সমস্যা হলো নেম্‌স যন্ত্র থেকে সিগন্যাল আহরণ করে মাইক্রোচিপে আনা যাতে করে ডিসপ্লেতে সংকেত দেখানো যায়। সমস্যা হলো, ন্যানো–স্কেলে যান্ত্রিক মুভমেন্ট এত সূক্ষ্ম যে সেটাকে যথাযথভাবে মাইক্রো সার্কিটে চালান করাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। যেমন ১০ ন্যানো মিটার পুরু একটি ন্যানো ক্যান্টিলিভারের মুক্তপ্রান্তের কম্পনের দৈর্ঘ্যমাত্রা মাত্র কয়েক ন্যানো মিটার। এই দৈর্ঘ্যমাত্রা এতই সূক্ষ্ম যে মাইক্রো সার্কিটের নয়েজের তুলনায় এটা ছোট হয়ে গেলে এই সংকেত আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। তা ছাড়া ন্যানো ক্যান্টিলিভারের সাইজ যত ছোট হবে এর নিজস্ব কম্পাঙ্ক তত বাড়বে। ফলে নেম্‌স ট্রান্সডিউসারকে যদি মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি পর্যন্ত কার্যক্ষম হতে হয়, তবে একে পিকোমিটার (১০-১২ মিটার) থেকে ফেটোমিটার (১০-১৫ মিটার) মাত্রার যান্ত্রিক মুভমেন্ট পরিমাপের জন্য সক্ষম হতে হবে।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী, পরিমাপ প্রক্রিয়া ন্যানো সিস্টেমকে ‘বিচলিত’ করে বা সিস্টেমটাকে পরিবর্তিত করে। এটা আর পূর্বের দশায় থাকে না। ফলে ন্যানো সিস্টেম থেকে তথ্যের আদান-প্রদানের কারণে সিস্টেমটি নিজেরই আক্রান্ত হওয়ার কথা। এখন একগুচ্ছ অণু বা পরমাণু দ্বারা গঠিত সিস্টেমের ক্ষেত্রে এই ‘বিচলন’ কতখানি ক্ষতিকর, সেটাও দেখার বিষয়। বিষয়টা না জানলে আমরা যে ন্যানো সিগন্যাল আহরণ করছি, তা কখনোই প্রকৃত সিগন্যাল হবে না। তা ছাড়া ন্যানো স্কেলে ‘সারফেস’ বা পৃষ্ঠতল একটা জরুরি ভূমিকা রাখে। মেম্‌সের ক্ষেত্রে সারফেস-টু-ভলিউম বা পৃষ্ঠতল ও আয়তনের অনুপাত খুবই নগণ্য থাকে। কিন্তু নেম্‌সের ক্ষেত্রে সেটা আর খাটে না। ফলে পৃষ্ঠতলের ভূমিকাও গুরুত্বের দাবিদার।

১৯৬৬ সালে একটি হলিউডি ফিল্ম ‘ফ্যানটাস্টিক ভয়েজ’-এ এক মজার সায়েন্স ফিকশন দেখানো হয়। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে একদল চিকিৎসককে বহনকারী একটি সাবমেরিনের আকৃতি অতীব ক্ষুদ্র হয়ে যায়। তারপর তারা একজন রোগীর রক্তপ্রবাহের সঙ্গে মিশে গিয়ে রোগীর মস্তিষ্কের একটি মারাত্মক জমাটবাঁধা রক্তের ক্লট সরাতে সক্ষম হয়। যদি ন্যানো প্রযুক্তি কোনো দিন বিকশিত হয়, তবে এমনটা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন ফিউচারিস্ট ও বিজ্ঞনীরা। ন্যানো প্রযুক্তির সবচাইতে লাগসই প্রয়োগ হবে মানবদেহেই। এমন সব ন্যানো যন্ত্রপাতি তৈরি হবে, যেগুলোকে রোগীর দেহে খাদ্য বা পানীয়ের সাহায্যে সহজেই প্রবেশ করানো যাবে। তারপর এই অতিক্ষুদ্র ডিভাইসগুলো সহজেই মানুষের রক্তের সঙ্গে ভেসে নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গে গিয়ে রোগ প্রতিহার করবে। অথবা ক্ষতিকারক কোষ বা টিস্যু বা ব্যাকটেরিয়া সংহার করবে। এমনকি রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ন্যানো–বট দিয়ে ন্যানো-সার্জারিও একদিন হয়তো সম্ভব হবে। আজকাল জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড খাদ্যের কথা আমরা জানি। তবে কি ভবিষ্যতে ন্যানো ইঞ্জিনিয়ার্ড খাদ্য পাওয়া যাবে, যেটা শরীরের জন্য কল্যাণকর হবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, হতেও পারে। যদিও এটা দূর কল্পনা, কিন্তু একেবারে অবাস্তব হয়তো নয়।

এই মুহূর্তে ন্যানো প্রযুক্তি যেভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা কেবলই শুরুর দিকের গবেষণা। ন্যানো সেন্সর ব্যবহার করে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরের ছবি দেখার সম্ভাবনাও আছে। ক্যানসারের রোগীর কোনো কোনো জিন মিউটেশনে অবদান রেখেছে, সেটাও আজকাল জানা সম্ভব হচ্ছে। ড্রাগ ডেলিভারির ব্যাপারেও ন্যানো প্রযুক্তি যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। ঠিক যে প্রত্যঙ্গের টিস্যু বা কোষ আক্রান্ত হয়েছে সেইখানে কোনো ন্যানো আকৃতির বাহন ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ড্রাগ–ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার নামই ড্রাগ ডেলিভারি। তবে ঠিক সিনেমার মতন ন্যানো আকৃতির এক নায়ক গিয়ে বন্ধ রক্তনালি লেজার রশ্মি ছুড়ে রোগীকে সুস্থ করে দেওয়ার মতো আহামরি ব্যাপার হয়তো হবে না। তবে ব্যাপারটা যে যথেষ্ট কার্যকর হবে, সেটা নিঃসন্দেহ, অন্তত আরোগ্য লাভ যে দ্রুততর হবে এবং আরও কার্যকরভাবে হবে সেটার জোর আশা চিকিৎসকেরা করছেন।

অনেকেরই আশা চিকিৎসার ক্ষেত্রেই হবে ন্যানো প্রযুক্তির প্রকৃত বিকাশ। এর কারণ, বায়োলজিই হলো ন্যানোর প্রকৃত সূতিকাগার। বায়োলজি বহু কোটি বছর ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আণবিক স্কেলে ইঞ্জিনিয়ারিং করে আসছে। অনেক অণু মিলে প্রোটিন তৈরি করছে, কোন প্রোটিন কোথায় লাগবে, সেসব আবার চমৎকারভাবে নথিবদ্ধ রাখা হয়েছে ডিএনএর কোডের মধ্যে। সেই কোড পড়ে সুন্দরভাবে মানুষ বা অন্য প্রাণীর দেহসৌষ্ঠব গঠন করা হয়। তারপর আবার পরবর্তী প্রজন্মে এই কোড স্থানান্তরিত হয়। পুরো মেকানিজমটাই ঘটে অতিক্ষুদ্র স্কেলে। ডিএনএর প্রতিটি কোড তৈরি হয়েছে কতগুলো জটিল জৈব-অণুর সমন্বয়ে, অণুগুলো তৈরি হয়েছে পারমাণবিক স্কেলে অনেক পরমাণুর সমন্বয়ে, পুরো কাজে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের নানা বিধি মানা হয়েছে। এককথায় এক সার্থক ন্যানো প্রযুক্তি যুগ যুগ ধরে চলছে প্রকৃতিতে। এর নাম আমরা দিয়েছি বায়োলজি। সেই একই প্রক্রিয়া এখন মানুষ চাইছে ইলেকট্রনিকস ও অন্যান্য ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল সিস্টেম ও চিকিৎসাবিদ্যায় অনুসরণ করতে। এই কৃত্রিম আয়োজনের নামই ন্যানো টেক।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়