প্রকৃতির মৌলিক বল ও তাদের ঐক্যের সন্ধান- ১

এই যে আমরা হাঁটি-দৌড়াই বা বসে থাকি, টান দিয়ে দরজা খুলি বা ধাক্কা দিয়ে চেয়ার সরিয়ে ফেলি—দৈনন্দিন জীবনের এ রকম অজস্র ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সব ঘটনার সঙ্গেই কোনো না কোনো ধরনের বল (force) যুক্ত আছে। হয় আমরা বল প্রয়োগ করছি অথবা আমাদের ওপর বল প্রযুক্ত হচ্ছে। ধাক্কা দেওয়া (Push) বা টান মারা (Pull)— এই ধরনের বলগুলো আমরা নিজেরাই তৈরি করি বলে ভেবে থাকি এবং এগুলো পরিমাপ করার পদ্ধতিও আমরা জানি। নিউটনের বিখ্যাত বলের সূত্র থেকে সহজেই এই ধরনের বল পরিমাপ করা যায়। এক কেজি ভরের কোনো স্থির বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে (অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে) চলমান করলে যদি ত্বরণের পরিমাণ এক মিটার/সেকেন্ড হয়, তাহলে ওই ধাক্কা-বলের পরিমাণ আসলে এক নিউটন (নিউটন হলো বলের একক)। আমরা আসলে এক শক্তি-সমুদ্রে বাস করি। কত ধরনের শক্তি নিয়ে যে আমরা খেলা করি বা শক্তিগুলো আমাদের নিয়ে খেলা করে, তার ইয়ত্তা নেই। একইভাবে বলা যায়, আমরা যা-ই করি না কেন, প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল আমাদের সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে—মহাকর্ষ বল (Gravitational force), বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force), সবল নিউক্লীয় বল (Strong nuclear force) এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল (Weak nuclear force)। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রথম দুটো বল তো সার্বক্ষণিকভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, বাকি দুটোও থাকে একই রকমভাবে, যদিও তাদের ভূমিকা ঠিক দৃশ্যমান নয়। আসুন, এদের পরিচয় জেনে নেওয়া যাক।

সবচেয়ে পরিচিত বলটির নাম মহাকর্ষ। এতই পরিচিত যে যিনি কোনো দিন বিজ্ঞান পড়েননি, তিনিও এই বলটির কথা জানেন। মহাবিশ্বের যেকোনো দুটো বস্তু বা বস্তুকণার মধ্যে এই বলটি কাজ করে। গাছ থেকে যে আম নিচের দিকেই পড়ে, পাখির মতো উড়ে যায় না বা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিলে মানুষ যে আকাশে না উঠে ভূপতিত হয়, তার কারণ পৃথিবী এবং ওই আমটি বা মানুষটির মধ্যে ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ বা মহাকর্ষ বল। এসব কথা সবারই জানা। এই বল আছে বলেই গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি না ঘুরত, দিন-রাত হতো কীভাবে? ঋতু পরিবর্তনই-বা কীভাবে হতো? সোজা কথায়, এই বলের অনুপস্থিতিতে প্রাণের উদ্ভবই অসম্ভব হয়ে পড়ত। মহাবিশ্ব গঠিতই হতো না, তার আবার প্রাণের উদ্ভব! শুধু তা-ই নয়, এই আকর্ষণ বল না থাকলে মানুষ পৃথিবীতে থাকতেই পারত না। আমরা যে মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছি, তার কারণ তো ওই আকর্ষণই, নইলে তো মহাশূন্যে অবস্থিত পৃথিবী থেকে আমরাও মহাশূন্যেই ছিটকে পড়তাম! এই বলের কারণেই আমাদের ওজন আছে, আর ওজন না থাকলে আমরা স্রেফ শূন্যে ভেসে বেড়াতাম।

সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে, ১৬৮৭ সালে, এই বলের ব্যাখ্যা দেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকেই নিউটনের এই মহাকর্ষ সূত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই সূত্রে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে অবস্থিত দুটো ভরবিশিষ্ট বস্তু পরস্পরকে একটি বল দিয়ে আকর্ষণ করে, এই বলের নাম মহাকর্ষ এবং এই বল বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যেকার দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক। গাণিতিক সমীকরণে লিখলে এই সূত্রটির চেহারা দাঁড়ায় এ রকম:

Fg=Gm1m2/r2

এখানে m1 ও m2 হচ্ছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বস্তুর ভর এবং r হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব। আর G হলো মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, যার মান:

G = 6.67 × 10-11 Nm2kg-2

তাঁর এই সূত্র দিয়ে মহাকর্ষিক ঘটনাবলির অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা গিয়েছিল। মহাবিশ্বের যেকোনো গ্রহ-নক্ষত্রে অভিকর্ষজ ত্বরণের মানও নির্ণয় করা যায় এই সূত্রের মাধ্যমে, যদি এর ভর ও ব্যাসার্ধ জানা থাকে। যেমন পৃথিবীতে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান প্রায় ৯.৮ মি/সে, আর চাঁদে এর মান প্রায় ১.৬২৫ মি/সে। অভিকর্ষজ ত্বরণের সঙ্গে বস্তুর ভর গুণ করলে এর ওজন নির্ণয় করা যায়। ধরা যাক, আপনার ভর ৫০ কেজি, তাহলে পৃথিবীতে আপনার ওজন ৪৯০ নিউটন আর চাঁদে গেলে আপনার ওজন হবে ৮১ নিউটনের কাছাকাছি। তার মানে চাঁদে গেলে আপনি অনুভব করবেন, আপনার শরীর প্রায় পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে, কারণ যে ভার (ওজন) আপনি এখানে বয়ে বেড়াচ্ছেন, চাঁদে যে তার ছয় ভাগের এক ভাগ হয়ে যাবে! এসব মজার হিসাব নিউটনের এই সূত্র ব্যবহার করেই করা সম্ভব হয়েছে। তবে বিশ শতকের শুরুতে এসে এই বলের এই নতুন ও অভিনব ব্যাখ্যা হাজির করেন আরেক মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বলছি সে ঘটনা।

মহাজাগতিক বস্তুগুলো—অর্থাৎ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি—সবই যে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণশীল, তা-ও ব্যাখ্যা করা গিয়েছিল নিউটনের সূত্র দিয়েই। শুধু একটি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানীদের একটু অস্বস্তি ছিল, সেটি বুধগ্রহের কক্ষপথের বিচিত্র আচরণ। গ্রহগুলো যার যার কক্ষপথে (Orbit) সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই কক্ষপথগুলো কিন্তু স্থির, অপরিবর্তনশীল। কিন্তু বুধগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। এর কক্ষপথও খানিকটা দোল খায়। এর কারণ কী? না, নিউটনের সূত্র দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। বিশ শতকের গোড়াতে, ১৯১৫ সালে, আইনস্টাইনের বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে এর ব্যাখ্যা মিলল। এই তত্ত্বে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা হলো একটু ভিন্নভাবে। তিনি জানালেন, নিউটনের সূত্রটি স্বল্প ভরসম্পন্ন বস্তুর আচরণ ব্যাখ্যায় দারুণ পারঙ্গম বটে, তবে কোনো বস্তুর ভর যদি খুব বেশি হয় কিংবা বস্তুর গতিবেগ যদি অতিমাত্রায় বেশি হয়, তাহলে ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা আগে জানতাম, মহাবিশ্বের স্থান হলো সমতলীয় (Flat), কিন্তু আইনস্টাইন জানালেন এক অভিনব এবং নতুন ধারণার কথা—অতিভরবিশিষ্ট বস্তুর উপস্থিতির কারণে স্থানকাল বেঁকে যায়, আর এই বক্র স্থানকালই (Space-time curvature) মহাকর্ষের মূল কারণ। ব্যাপারটা বোঝা একটু কঠিনই। ধরুন, আপনার কাছে বর্গাকৃতির বা আয়তাকার বেশ বড়সড় একটা রাবারের শিট আছে। এর চার কোনায় সুতো বেঁধে একটা শূন্য স্থানে টান টান করে ঝুলিয়ে দিন—অনেকটা মশারি টানানোর মতো করে। এবার সেই ঝোলানো রাবার-শিটের মাঝখানে ক্রিকেট বল আকারের একটা লোহার বল রাখুন (ক্রিকেট বলও রাখতে পারেন, একটু ভারী বস্তু রাখতে চাইলে লোহা বা পিতলের বল (Force নয়, Ball-এর কথা বলছি) হলে বেশ ভালো হয়। কী দেখতে পাচ্ছেন? রাবারের শিটটা নিচের দিকে বেশ খানিকটা বেঁকে গেছে, তাই না? আপনি যদি রাবারের এই শিটটাকে স্থান-কাল হিসেবে এবং লোহার বলটিকে কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র হিসেবে ভেবে নেন, তাহলে সহজেই বুঝে যাওয়ার কথা—ভারী বস্তুর উপস্থিতির প্রভাবে স্থান-কালের বেঁকে যাওয়া বলতে কী বোঝায়! কিন্তু স্থান-কালের বক্রতা নাহয় বোঝা গেল, এর সঙ্গে মহাকর্ষের সম্পর্ক বোঝার উপায় কী? ব্যাপারটা বোঝার জন্য লোহার বলটি তুলে নিন, রাবার-শিটটি ওই রকমভাবে বাঁধাই থাকুক। এবার একটি ছোট্ট মার্বেল নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে রাবার-শিটের যেকোনো এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দিকে ছুড়ে দিন। কী দেখতে পেলেন? মার্বেলের ভর যেহেতু ক্ষুদ্র, রাবার-শিটকে সে বাঁকাতে পারেনি, বরং বেগের কারণে সে অপর প্রান্তে চলে গেছে। অর্থাত্ স্থান-কালে যদি ভারী বস্তুর উপস্থিতি না থাকে, তাহলে সেটি সমতল (Flat) থাকবে এবং দ্রুতবেগে গতিশীল বস্তু সরলরেখায় তার ভেতর দিয়ে চলে যাবে (আলো সরলরেখায় চলে—ছোটবেলায় পড়া এই তথ্যের কথা কি মনে পড়ছে?)। এবার আবার লোহার বলটি রাবার-শিটের মাঝখানে রেখে ওটাকে বাঁকিয়ে দিন, যেমনটি আগে একবার করেছিলেন। তারপর ফের মার্বেলটি ছুড়ে দিন একই রকম বেগে, দ্রুতগতিতে, এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দিকে। এবার কি মার্বেলটি সরলরেখায় চলতে পারবে? যেতে পারবে অপর প্রান্তে? না। কারণ, লোহার বলের কারণে রাবারের স্থান-কাল নিচের দিকে বেঁকে গেছে, মার্বেলের জন্য এবার আর কোনো সরলপথ নেই, সে-ও তাই অবধারিতভাবে বক্রপথ অনুসরণ করবে এবং লোহার বলটিকে গিয়ে আঘাত করবে। মার্বেলটি কেন বেঁকে গেল, পরীক্ষাটা আপনি করছেন বলে সেই রহস্যটা সহজেই ধরতে পারছেন। কিন্তু বাইরে থেকে কেউ যদি ঘটনাটিকে পর্যবেক্ষণ করে, তার মনে হবে—মার্বেলটিকে লোহার বলটি আকর্ষণ করেছে! মানে মহাকর্ষ বল কাজ করছে এখানে! ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ক্রিকেট খেলা দেখেন নিশ্চয়ই! স্পিনাররা যেমন বল ছোড়ার সময় বলটাকে কায়দা করে ঘোরান, মানে স্পিন করেন, আপনিও যদি আপনার মার্বেলটি ছোড়ার আগে ওভাবে ঘোরান, মানে স্পিন করান, তাহলে সেটি লোহার বলটিকে আঘাত করার আগে তার চারপাশে সর্পিল পথে দু-চারবার ঘুরবে। ঠিক যেমন গ্রহগুলো ঘুরছে সূর্যের চারপাশে, ও রকম। আপনার মার্বেলের গতি যদি খুবই বেশি হয়, তাহলে মার্বেলটি, এমনকি বলের ওপর পতিত না হয়ে বেরও হয়ে যেতে পারে, তবে তার গতিপথ খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ লোহার বলের অনুপস্থিতিতে মার্বেলটি যে পথে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে গিয়েছিল, এবার লোহার বলের উপস্থিতিতে সৃষ্ট বক্রতার কারণে তার একই গতিপথ থাকবে না। এই যে গতিপথ পাল্টে গেল, অর্থাৎ নতুন গতিপথ তৈরি হলো। এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেই অপর প্রান্তে থাকা একজন দর্শক বুঝতে পারবে (লোহার বলটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে না জেনেও), মার্বেলটি আসার পথে কোনো একটি ভারী বস্তুর ‘আকর্ষণ’ পার হয়ে এসেছে। আর এ জন্যই সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসার সময় ঠিক সরলপথে আসে না, বুধ গ্রহের উপস্থিতির কারণে একটু বেঁকে আসে। কতটা বেঁকে আসে, আইনস্টাইন সেটি হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, যা পরে প্রমাণিত হয়েছে। কৃষ্ণগহ্বরের সীমানায় কোনো বস্তু এসে পড়লে, এমনকি আলোর মতো তীব্র গতিশীল কিছু এসে পড়লেও যে তা আর ওখান থেকে বেরোতে পারে না, তার কারণও ওই স্থান-কালের বক্রতা। কৃষ্ণগহ্বরের স্থান-কাল এতটাই বক্র যে আলো কেবল এর ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকে।

এভাবেই আইনস্টাইন মহাকর্ষের ধারণা পাল্টে দেন, একে একটি ‘বল’ হিসেবে না দেখে ‘স্থান-কালের বক্রতা’ হিসেবে অভিহিত করেন। তবে হ্যাঁ, তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে নিউটনের সূত্রও প্রতিপাদন করে দেখিয়েছিলেন, নিউটনের সূত্র আসলে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বেরই একটি বিশেষ রূপ—স্বল্প বেগ এবং ক্ষুদ্র ভরের জন্য নিউটনের সূত্রই প্রযোজ্য।

এ তো গেল মহাকর্ষের পরিচয়-বৃত্তান্ত। এরকমই আরেকটি মৌলিক বল—যার নাম বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল। আমাদের খুবই পরিচিত এই বলটি এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক মুহূর্তের জন্যও আমরা এর প্রভাব এড়াতে পারি না। কিন্তু প্রকৃতির আরও দুটো মৌলিক বল আছে—একটি সবল নিউক্লীয় বল, আরেকটি দুর্বল নিউক্লীয় বল, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্বন্ধে আমরা একেবারেই উদাসীন থাকি। ভবিষ্যতে আমরা তাদের নিয়ে আলোচনা করব।

লেখক: শিক্ষক, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত