ফোটনের নামটি জানো, জানো কি তার পরিচয়?

৬৬৫ সাল। স্যার আইজ্যাক নিউটন তাঁর বিখ্যাত প্রিজম পরীক্ষাটি করেন এ বছরেই। ছোট্ট একটি ছিদ্র দিয়ে আসা সাদা আলো ফেললেন প্রিজমের ওপর। প্রিজম ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কিন্তু আর সাদা থাকল না আলো। সাতটি রঙে ভাগ হয়ে গেল। রংধনুতে যে সাতটি রং থাকে, এখানেও পাওয়া গেল সেই সাত রঙের পট্টি। নিউটন ভাবলেন, সাদা আলো কেন এভাবে ভাঙল, তাহলে আলো কি কোনো কণা? নিউটন তা-ই মনে করতেন। মনে করতেন আলো ভরহীন কণা।

আলোকে কণা ধরলে কিছু সুবিধা হয় আলোর প্রতিফলন ব্যাখ্যা করতে। আয়না বা কোনো বস্তু থেকে কেন আলো প্রতিফলিত হয়ে আসে? নিউটন মনে করতেন, আলো কণা বলেই বস্তুতে বাঁধা পায় এবং প্রতিফলিত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে আসে। কিন্তু আলো কেন স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে চলে যায়? কেন আলোর ব্যতিচার, অপবর্তনই-বা দেখা যায়-নিউটনের কণা তত্ত্ব সে ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

আলো নিয়ে গবেষণা নিউটনই প্রথম করেনি। দশম শতাব্দীতে মিশরের খলিফার কাছ থেকে নীল নদে বাঁধ নির্মাণের জন্য টাকা নিয়েছিলেন আরবীয় বিজ্ঞানী আল হাজেন। কিন্তু তিনি হিসাব কষে দেখলেন, বাঁধ নির্মাণ সম্ভব নয়, তাই সেই টাকা আর রাজ সুবিধা ভোগ করে আল হাজেন শুরু করলেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা। আলোর ওপরে করলেন মৌলিক কিছু কাজ। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ ইউক্লিড মনে করতেন, মানুষের চোখ থেকে আলো বের হয়ে। সেই আলো গিয়ে পড়ে বস্তুর ওপর। তারপরই সেই বস্তুকে দেখতে পায় মানুষ। ইউক্লিডের এই ধারণা ভুল, এখকার স্কুলের বাচ্চারাও সেটা বোঝে। কিন্তু দশম শতাব্দীতে সেটা বোঝা অত সহজ ছিল না। বিশ্ব বিজ্ঞানে গ্রিক পণ্ডিতদের তখন দেবতার আসন। তাঁদের কথা অবিশ্বাস করার লোক সেকালে ছিল না বললেই চলে। কিন্তু সেই ধারণাতেই কুঠারাঘাত করলেন আল হাজেন। বললেন, মানুষের চোখ থেকে নয়, বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে যখন আমাদের চোখের ওপর পড়ে, তখনই আমরা বস্তুটাকে দেখি। অনেকেই তখন রে-রে করে তেড়ে এলেন, জাত গেল জাত গেল বলে চিত্কার-চেচামেচি করলেন। কোথাকার কোন আল হাজেনর ধৃষ্টতা কেমন করে হলো উইক্লিড-টলেমির তত্ত্ব ছুড়ে ফেলার! তখন হাজেন সমর্থন পেলেন আরবের দুই বিখ্যাত পণ্ডিত ইবন সিনা আর আল-বিরুনির।

আল হাজেন আলো নিয়ে গবেষণা করেছেন। আলো নিয়ে লিখেছেন সাত খণ্ডের ঢাউস এক বই—কিতাব আল-মানাজির। ইংরেজি অনুবাদে যার নাম হয় বুক অব অপটিকস। এই বইয়ে হাজেন বলেন, আলো ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে গেলে এর গতি কমে যায়। আগে মানুষ মনে করত আলোর গতি অসীম। এরপর অনেকেই আলো নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু শেষমেশ নিউটনই হয়ে ওঠেন নায়ক।

নিউটন যখন আলোর কণা তত্ত্ব চালু করছেন, সেই সময় তরঙ্গ তত্ত্ব চালু করেন জার্মান বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজে নিউটনের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাই হাইগেনসের তরঙ্গ তত্ত্বকে পাত্তা দিলেন না বিজ্ঞানীকুল। এর প্রায় দেড় শ বছর পর ডাবল স্লিট পরীক্ষার মাধ্যমে তরঙ্গ তত্ত্বের প্রমাণ দিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী থমাস ইয়াং। পদার্থবিজ্ঞানে সে এক বিপ্লব। তাতে তরঙ্গ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। চাপা পড়ে যায় নিউটনের কণা তত্ত্ব। এরপর ১৯০৫ সালের সেই মহাবিপ্লব। একের পর এক বিজ্ঞানের চেনা জগতে আঘাত হেনে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছেন তরুণ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ত্ব সে বছরই প্রকাশ হয়। পরমাণু তত্ত্বকেও আইনস্টাইন প্রতিষ্ঠিত করেন সে বছর, ব্রাউনীয় গতির ব্যাখ্যা দিয়ে। কিন্তু সে বছর আরও একটা যুগান্তকারী কাজ করলেন আইনস্টাইন। সেটিই পরে তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। সেটা হলো আলোক-তড়িৎকক্রিয়ার (photoelectric effect) ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যাতেই আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আসে আলোর কণা তত্ত্ব। এবার আর ভাসা-ভাসা নয়, দিনের আলোর মতোই আইনস্টাইন পরিষ্কার করে দিলেন আলোর কণা তত্ত্বকে। আলোর কণার নাম দিলেন কোয়ান্টা। আলোক তড়িৎকক্রিয়ার ব্যাখ্যা নতুন হলেও গল্পের শুরুটা আরও আগে।

১৮৭৩ সাল। প্রথমবারের মতো আলোক- তড়িৎকক্রিয়া লক্ষ করেন ব্রিটিশ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উলাফবি স্মিথ। তিনি অবশ্য বুঝতেই পারেননি ব্যাপারটি। এর ১৫ বছর পর বায়ুশূন্য ক্যাথোড টিউবের ভেতরে একদিন এক স্ফুলিঙ্গ দেখতে পান জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিখ হার্জ। ক্যাথোড টিউবের ক্যাথোড দণ্ডে অতিবেগুনি রশ্মি দিয়ে আঘাত করেছিলেন তিনি। এতে আলোর ঝলকানি দেখা দেয় টিউবের ভেতর। এটাও ছিল আলোক- তড়িৎকক্রিয়া। কিন্তু তখনো কেউ জানত না ওই স্ফুলিঙ্গটা কী বা কেন একে দেখা যায়। ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন জে জে থমসন। এরপরই জানা গেল, সেই স্ফুলিঙ্গটা আসলে ইলেকট্রন কণার স্রোত। থমসন ও ফিলিপ লেনার্ড আলাদাভাবে আলোক- তড়িৎকক্রিয়া পরীক্ষাটি আরও ভালোভাবে করলেন।

তবে সমস্যা একটা দেখা দিল। আলোক- তড়িৎকক্রিয়ার গাণিতিক ব্যাখ্যা কী? নিউটনের গতি তত্ত্বের পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। ব্যাখ্যা দিতে পারে না ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্চুম্বুকীয় তত্ত্বও। তাহলে?

তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আলোকে শুধু তরঙ্গই ভাবতেন। কণা তত্ত্ব বহু আগেই বাতিল হয়ে গেছে। তা ছাড়া আলোক- তড়িৎকক্রিয়া আলোর কম্পাঙ্কের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। সুতরাং আলোক- তড়িৎকক্রিয়ার ব্যাখ্যা তরঙ্গ তত্ত্বের ভেতরেই খুঁজতে হবে। কিন্তু একটা কণাকে ধাতুর ভেতর থেকে আলাদা করতে পারা তরঙ্গের পক্ষে কীভাবে সম্ভব?

তত দিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। অবশ্য বিজ্ঞানী মহলে তখনো সাড়া ফেলতে পারেনি সে তত্ত্ব। কিন্তু আইনস্টাইন ভাবলেন, আলো শক্তি ঠিক আছে, তরঙ্গও ঠিক আছে; আবার একই সঙ্গে কণাও। প্রায় দুই শ বছর পর আবারও ফিরে এল আলোর কণা তত্ত্ব। তবে নিউটনের কণা তত্ত্বের সঙ্গে নতুন কণা তত্ত্বের মিল সামান্যই। আইনস্টাইন দেখালেন, আলোর এই কণা তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সমাধানে যেটা ব্যবহার করেছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। প্ল্যাঙ্ক বলেছিলেন, কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ নির্গত হয় গুচ্ছ বা প্যাকেট আকারে। অর্থাত্ মহাবিশ্বের অবিরাম ছুটে চলা কোনো আলোক রশ্মিই ঠিক নিরবচ্ছিন্ন রশ্মি নয়। আলোক রশ্মি আসলে গুচ্ছ গুচ্ছ শক্তির বিচ্ছিন্ন প্রবাহ মাত্র। প্ল্যাঙ্ক বিকিরণ ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছকে বলেছিলেন শক্তির প্যাকেট বা কোয়ান্টাম। আইনস্টাইন আলোর সর্বনিম্ন শক্তির সেই প্যাকেটকেই বললেন কোয়ান্টাম কণা।

আলোর কণা ভরহীন। তবে গতিশীল ফোটনের ভরবেগ আছে, বললেন আইনস্টাইন। ভরবেগ ও শক্তিসম্পন্ন কণাকে তিনি তুলনা করলেন কামানের গোলার সঙ্গে। কামানের গোলা প্রচণ্ড বেগে কোনো বস্তুতে আঘাত হানে। গুঁড়িয়ে দেয় সেই বস্তুকে। তখন সেই বস্তুর টুকরো টুকরো অংশ প্রবল বেগে ছিটকে বেরিয়ে যায়। আইনস্টাইন বললেন, আলোর কণা প্রবল বেগে কামানের গোলার মতো গিয়ে আঘাত হানে ধাতুর পরমাণুতে। তখন পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেকট্রন কণা। আলো যদি কণা না হয়ে শুধু তরঙ্গ হতো তাহলে আলোক তড়িৎকক্রিয়া ঘটা সম্ভব হতো না।

আইনস্টাইন বললেন, আলোর একটা কণা গিয়ে আঘাত করে ধাতুর একটা পরমাণুর ওপর। সেই পরমাণু ফোটনের সবটুকু শক্তি শুষে নেবে। এই শক্তি পরমাণুতে ঢোকার পর চুপচাপ বসে থাকে না। সেই শক্তির একটা অংশ ব্যয় হয় পরমাণুর কক্ষপথে থেকে একটা ইলেকট্রনকে সরিয়ে ফেলতে। বাকি শক্তিটুকুও পরমাণু থেকে গ্রহণ করবে ইলেকট্রন। গতিপ্রাপ্ত হয়ে ইলেকট্রন ছুটে বেরিয়ে যাবে পরমাণু থেকে। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে আলোক তড়িৎকক্রিয়ার পাই টু পাই ব্যাখ্যা দিলেন।

এরপর তরুণ বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটিতে। এর ১৬ বছর পর ১৯২১ সালে আইনস্টাইন পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। হ্যাঁ, আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য নোবেল পাননি। পেয়েছিলেন আলোক তড়িৎকক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য। অর্থাত্ আলোর কণা ধারণাই আইনস্টাইনকে নোবেল এনে দেয়। তবে আলোর কণার ‘ফোটন’ করেন ফরাসি বিজ্ঞানী ক্রিথিয়োফ উলফারস আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী গিলবার্ট লুইস। সেটা ১৯২৬ সালের ঘটনা।

আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব ব্যবহার করে দেখা যায়, আলোক তড়িৎকক্রিয়া সংঘটিত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মুহূর্তের মধ্যেই আলোক তড়িৎকক্রিয়া সংঘটিত হয়। সেটা এক ন্যানো সেকেন্ড সময়ে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে, একটা ফোটন পরমাণুর একটা মাত্র ইলেকট্রনকে আঘাত করবে। ইলেকট্রন ফোটন থেকে কিছু শক্তি ধার করে প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। একটা ফোটনের শক্তি একটা ইলেকট্রনই গ্রহণ করে। অন্য কোনো ইলেকট্রনকে সেই শক্তির ভাগ সে দেয় না। তাই ইলেকট্রন সেই শক্তি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আলো যদি ফোটন কণা না হয়ে শুধু তরঙ্গগুচ্ছ হতো, তাহলে তার নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকত না। তরঙ্গের শক্তি ভাগ হয়ে যেত পরমাণুর সব ইলেকট্রনে। ফলে নির্দিষ্ট একটা ইলেকট্রন পরমাণুর বন্ধনমুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পেত না পর্যাপ্ত শক্তির জোগান। সব কটি ইলেকট্রনই শক্তি স্তর ভেদে কমবেশি আলগা হয়ে যেত। তখন সর্বশেষ শক্তি স্তরের ইলেকট্রনকে অপেক্ষা করতে হতো আরও আলোক তরঙ্গের ঝাঁক আসার। এভাবে ক্রমাগত একের পর এক আলোর ঝাঁক এসে ধাতুর পৃষ্ঠতলের প্রতিটা পরমাণুর প্রতিটা ইলেকট্রনকে শক্তি জোগাতে বহু সময় লেগে যেত। কিন্তু আলো যদি ফোটন কণা হয়, এ সমস্যাটা আর থাকে না।

আইনস্টাইনের ব্যাখ্যাকে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী রবার্ট অ্যান্ড্রুজ মিলিকন। যাচাই-বাছাই করে তিনি দেখলেন, আইনস্টাইনের সমীকরণ নির্ভুল। তখন আলোক- তড়িৎকক্রিয়া আলোড়ন তুলল বৈজ্ঞানিক সমাজে। নতুন করে জোয়ার কোয়ান্টাম তত্ত্বে। বেড়ে গেল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের খ্যাতিও। কিন্তু গলদ রয়ে গেছে প্ল্যাঙ্কের মূল কোয়ান্টাম তত্ত্বেই। প্ল্যাঙ্কের সমীকরণের ডান দিকে দুটো অংশ। একটা অংশে আলোকে বিকিরণ শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে, আরেকটা অংশে আলোকে দেখানো হয়েছে গুচ্ছশক্তির কণা হিসেবে। সমস্যাটা হলো, ডান দিকের প্রথম অংশটির হিসাব করতে হচ্ছিল ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্-চুম্বকীয় সমীকরণের সাহায্যে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বকে নিউটন ও ম্যাক্সওয়েল কারও সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে কিনা, সে তর্ক রয়েই গেল। সেটা করতে গেলে ত্রুটি থাকবেই। কিন্তু সেই ত্রুটি দূর করার মতো কোনো স্বতন্ত্র অঙ্ক প্ল্যাঙ্কের জানা ছিল না। আইনস্টাইনই প্রথম বিষয়টা নিয়ে কাজ করেন। একটা সমাধানও বের করেন তিনি। কিন্তু আইনস্টাইনের সমাধানটাও ঠিক ছিল না। অথচ প্ল্যাঙ্কের সেই তত্ত্ব ধরেই আইনস্টাইনের আলোক তড়িৎকক্রিয়া এবং বোরের কোয়ান্টাম পরমাণুর মডেল গড়ে উঠেছে। তাই প্ল্যাঙ্ক তত্ত্বের ত্রুটির প্রভাব এসব তত্ত্বেও রয়ে গেছে।

প্ল্যাঙ্ক বিকিরণ বা আলোকে বলেছিলেন শক্তির গুচ্ছ। আইনস্টাইন সেটার নাম দিলেন কোয়ান্টাম কণা। কণাই যদি হবে তবে সেটাতে তরঙ্গ সমীকরণ কেন, তা-ও আবার ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গ সমীকরণ থেকে পাওয়া রাশি। এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক সত্যেন বোস। তিনি ফোটনের তরঙ্গ চরিত্র বাদ দিয়েই পুরো হিসাবটা মিলিয়ে ফেললেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে। তাই বলে কিন্তু আলোর তরঙ্গ ধর্মের বিলোপ ঘটানোর চেষ্টা করেননি; বরং প্রতিষ্ঠা করলেন আলোর কণা তত্ত্বের সম্পূর্ণ একটা কোয়ান্টাম সমীকরণ। সত্যেন বোসের সেই গবেষণাপত্র প্রকাশ হলো বিখ্যাত জার্মান জার্নাল সাইটশ্রিফট ফ্যুর ফিজিকে। তখন হইচই পড়ে গেল বিজ্ঞান দুনিয়ায়। রাতারাতি সত্যেন বোসের নাম জেনে গেলেন বড় বড় বিজ্ঞানীরা। চিরদিনের জন্য ফোটনের সঙ্গে স্বর্ণাক্ষরে জড়িয়ে গেল সত্যেন বোসের নামও। মিলল তাঁর স্বীকৃতি।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামে পদার্থবিজ্ঞানের একটা শাখা আছে। সেই মডেল অনুযায়ী, পৃথিবীর সব কণা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। বোসন ও ফার্মিয়ন। পৃথিবীর সব কণা এই দুই শ্রেণির কণা দিয়ে তৈরি। যেসব কণা ফার্মি-ডিরাক তত্ত্ব মেনে চলে, তাদের বলে ফার্মিয়ন কণা। ফার্মিয়ন হলো সাধারণ বস্তুকণা: ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি। আর যেসব কণা বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব মেনে চলে, তাদের বলা হয় বোসন কণা। ফোটন কণাও একধরনের বোসন কণা। এসব কণা সাধারণ বস্তু কণা নয়, এরা বলবাহী কণা। বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গের বল বহন করে ফোটন কণা। ফোটন কণারা না থাকলে গোটা মহাবিশ্বই অন্ধকার হয়ে থাকত। অন্ধকার মহাবিশ্ব কল্পনা করা যায়! সূর্য নেই, নক্ষত্র নেই, আলো নেই—এমন এক মহাবিশ্বে প্রাণ ধারণের কথা অলীক কল্পনাতেও আনা কঠিন। সত্যি বলতে কি পৃথিবীতে প্রাণের যে মহাযজ্ঞ, তাতে বস্তুকণার অবদান যতখানি, পরোক্ষভাবে হলেও সমান গুরুত্ব ফোটন কণারও।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: নেচার

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত