সাক্ষাৎকার
‘বিজ্ঞান-সংস্কৃতির বলয়ে বেড়ে না উঠেও বিজ্ঞানী হওয়া যায়’—এম জাহিদ হাসান
এম জাহিদ হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক। তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ৮৫ বছর ধরে অধরা কণা ভাইল ফার্মিয়ন আবিষ্কার করেন ২০১৫ সালে। সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী টপোলজিক্যাল অপরিবাহীতে পর্যবেক্ষণ করেছেন কোয়ান্টাম প্রভাব।
গত ২০২০ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হয়েছিলেন শিশু-কিশোরদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। সেই প্রশ্নোত্তর পর্বের চুম্বক অংশ প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির তৎকালীন একাডেমিক সদস্য এবং বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং-এর পিএইচডি গবেষক ইবরাহিম মুদ্দাসসের।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: শুভ সন্ধ্যা সবাইকে, স্বাগত জানাচ্ছি শিশু–কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রশ্নোত্তর পর্বে। এই পর্বে খুদে বিজ্ঞানীদের প্রশ্নের জবাব দেবেন ড. এম জাহিদ হাসান। আমরা জুম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে এম জাহিদ হাসানের সঙ্গে আলোচনা করব। আলোচনায় যারা আগ্রহ দেখিয়েছিল, সেসব শিক্ষার্থীকে আমরা যুক্ত করেছি। এ ছাড়া আজ শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি এ আলোচনায় যুক্ত হওয়ার জন্য। আমি সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আজকের অনুষ্ঠানে, যারা ফেসবুকের মাধ্যমে দেখছে। আমি প্রথমেই ড. এম জাহিদ হাসানকে স্বাগত জানানোর জন্য অনুরোধ করছি বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সহসভাপতি, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান স্যারকে।
মুনির হাসান: ধন্যবাদ ইবরাহিম। সারা দিন তোমাদের অনেক প্রোগ্রাম হচ্ছে। সবাই নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। তারপরও আমরা খুবই আনন্দিত, আমাদের সঙ্গে ড. জাহিদ হাসানকে পেয়েছি, আমি ড. জাহিদ সম্পর্কে কিছু বলে যেতে চাই। টাঙ্গাইলের শ্রীপুরে জাহিদ হাসানের বাড়ি এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। লেখাপড়ার পর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ঘুরে বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ছোটবেলায় তাঁর একটা শখ ছিল, আইনস্টাইন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন, তিনিও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা ও অধ্যাপনা করছেন। আমি নিশ্চিত, তোমরা সবাই জানো, জাহিদ হাসান বছর কয়েক আগে একটা ব্রেকথ্রু করেছেন বিজ্ঞানে। ভাইল ফার্মিয়ন নামের একটা কণা, যে কণাটি ৮৫ বছর ধরে খোঁজা হচ্ছিল, সেটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন। জাহিদ একজন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট, অর্থাৎ বেশির ভাগ কাজই করেন পরীক্ষাগারে এবং অনেককে পিএইচডি দিয়েছেন। তাঁর একটি ভালো লেখা অর্থাৎ পেপার আছে, ইতিমধ্যে অনেকবার সেটা প্রকাশিত হয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, বিজ্ঞানের একটা কাজ ভালো কি না বোঝা যায়, তার যে পেপারটা, সেটা অন্যরা কতবার কোট করে, তার ওপর। এখন আমি জাহিদ হাসানের কথা শুনতে চাই। ড. জাহিদ আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি, প্রথমেই শুনতে চাই, আপনার মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা কখন–কীভাবে গড়ে উঠল এবং কীভাবে কী নিয়ে এখন কাজ করেন, তারপর আমাদের ছেলেমেয়েরা আপনার সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেবে।
এম জাহিদ হাসান: ধন্যবাদ মুনির ভাই এবং শিশু-কিশোর সায়েন্স কংগ্রেস আয়োজকদের। আমি অনেক খুশি যে বাংলাদেশে কংগ্রেস শুরু হয়েছে। আমি যখন তোমাদের বয়সে, তখন সায়েন্স অলিম্পিয়াড বা কংগ্রেস কিংবা সায়েন্স ফেয়ার ছিলই না। ওই সময় আমি ঢাকায় বড় হই। তখন আমরা যাঁরা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলাম, বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের জীবনটা কেমন ছিল, সেটা বলার চেষ্টা করব। আমি নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে একটু বলি। আমার খুব ছোটবেলায় বিজ্ঞানের প্রতি ও রকম কোনো ফ্যাসিনেশন ছিল না। খুব ছোটবেলার একটা ঘটনা আমাকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলে। তখন আমার বয়স ৩ কি ৪। সে সময় আমার আব্বা প্রায়ই দেশের বাইরে যেতেন। দেশে ফেরার সময় অনেক খেলনা নিয়ে আসতেন আমার জন্য। একবার এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এলেন। তবে সেটা খেলনা নয়, শোপিস। দেখতে খুব সুন্দর। আসলে জিনিসটা সত্যিকারের কোরাল দিয়ে তৈরি। সমুদ্রের নিচে যেমন করে কোরাল থাকে, তেমনই দেখতে। সত্যিকারের কোরালই ছিল ওটা। আমার জন্য আব্বা খেলনাও এনেছিলেন সেবার। কিন্তু সেগুলোর চেয়ে এটাতেই আমার আকর্ষণ ছিল বেশি। কিন্তু সেই জিনিসটা স্পর্শ করাও নিষেধ ছিল আমার জন্য।
এ কোরালটার কারণেই আমার ভাবনার জগৎ ওলট-পালট হয়ে যায়। আমি আরও জানতে চাই, সমুদ্রের নিচে কীভাবে এত সুন্দর গাছের মতো বা একটা প্রাণীর মতো এত সুন্দর একটা জিনিস তৈরি হলো। এটা আমার কাছে অনেক বড় রহস্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই রহস্যের জবাব আমার কাছে ছিল না। আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম। পরে বই পড়ে জানা শুরু করলাম।
এরপর সাত–আট বছর বয়সে ঘটে আরেকটা ঘটনা। তখন আমার একটা খেলনা ছিল। একটা কম্পাস, দিক নির্ণায়ক কম্পাস। তত দিনে আমি অনেকগুলো গল্পের বই পড়ে ফেলেছি। বিশেষ করে ভূতের গল্প। সুতরাং ভৌতিক ব্যাপারস্যাপারগুলোও আমার মনে আসন গেড়ে বসে ছিল। তখন আমার মনে হতো, কম্পাসের কাঁটা একা একাই কীভাবে ঘুরে যায়। নিশ্চয় ভৌতিক কোনো ব্যাপার এর পেছনে কাজ করছে। নইলে কম্পাসের কাঁটাগুলো একা একা দিক চিনতে পারে কীভাবে? এটা কে করে? কেউ তো করে দেয় না। আমি তখন কম্পাসটা খুলে কাঁটাগুলো ঘুরিয়ে দিলাম। তারপর সেটা আবার জোড়া দিয়ে দেখলাম কী হয়? একই ব্যাপার! কাঁটা সেই উত্তর–দক্ষিণ দিকেই মুখ করে থাকে। কেন থাকে? এর ভেতরে রহস্য আছে? এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে কোনো সত্তা। এ রহস্যের সন্ধান আমাকে করতেই হবে। এর সন্ধান করতে গিয়েই একসময় জানতে পারলাম, কম্পাসের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে চৌম্বক বল। কিন্তু এই বল কখনো দেখা যায় না। শুরু হলো আমার বিজ্ঞানযাত্রা। সবকিছুর পেছনে কারণ খুঁজতে শুরু করলাম। পেতে চাইলাম বৈজ্ঞানিক সমাধান।
চৌম্বক বল আমরা চোখে দেখি না। কিন্তু এই বল একটা নিয়ম মেনে চলে, সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না। পরে আরও জানলাম, মহাবিশ্বে এমন অনেক কিছুই আছে, যেগুলো সরাসরি আমরা দেখতে পাই না। তাই বলে এগুলো ভূতের কারসাজি নয়। তবে ভূতের সঙ্গে চৌম্বক বলের পার্থক্য আছে। ভূতের গল্পগুলো আমরা প্রমাণ করতে পারি না, পরীক্ষা করে দেখতে পারি না। অন্যদিকে চৌম্বক বল একটা ল বা নিয়ম মেনে চলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একে প্রমাণও করা যায়। এ নিয়মটা জানার চেষ্টাই আমাকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
বিজ্ঞান আর কল্পকাহিনির মূল পার্থক্যটা হলো বিজ্ঞানের এই নিয়ম মেনে চলাটা। বিজ্ঞানের নিয়মগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়। পরীক্ষা করে এই নিয়মটা যে সত্যি, সেটা প্রমাণ যেমন করা যায়, ভুল প্রমাণের সুযোগও আছে। এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই কৈশোরেই বুঝে গেলাম, বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে। সেটা বই পড়ে শেখার আগেই। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনা দুটিকে আসলে রহস্যগল্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়। রহস্যগল্প আমরা খুব মজা নিয়ে পড়ি। শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত জানি না কী হতে চলেছে। বিজ্ঞানটাও এমন। কিছু সমাধান করার চেষ্টা করুন, রহস্যগল্প পড়ার মতোই অনুভূতি হবে।
কথাসাহিত্য ও বিজ্ঞানের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, বিজ্ঞান নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে। আপনি সম্ভবত কিছু নিয়ম চিহ্নিত করতে পারবেন, জিনিসটা কীভাবে কাজ করে। তাই বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে অনুভব করবেন, একটি রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছি। আপনি যদি হৃদয় ও মনকে একত্র করতে পারেন, তাহলে এতে আপনার মনোযোগ চলে যাবে একটি রহস্যের দিকে, এতেই হয়তো রহস্যটা সমাধান করতে পারবেন এবং কিছু তৈরি করতে পারবেন। এটা আসলে একদম বেসিক স্তরের কাজ। এখান থেকেই বিজ্ঞানের শুরু। বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এঁদের বেশির ভাগই আমার সঙ্গে একমত, কৈশোরে রহস্যের একটি ধারণা তৈরি হয়, সেই রহস্য আপনাকে আকর্ষণ করে। হয়তো রহস্যের যে সৌন্দর্য আছে, সেটাই আমাদের বুঝতে হবে, এই জিনিসটা কীভাবে কাজ করে, কেন কাজ করে। এ অনুভূতিটা যখন আমার ভেতর তৈরি হলো, তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আমি বিজ্ঞানী হতে চাই। তখন বিজ্ঞানে আক্ষরিক অর্থেই মগ্ন হয়ে গেলাম। যখন নবম অথবা দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে একটা বই লিখে ফেলি। বইটার নাম ছিল এসো ধূমকেতুর রাজ্যে।
এ জন্য আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছিল। বিশেষ করে হ্যালির ধূমকেতু। বইটা অবশ্য শুধু হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে লেখা নয়। ধূমকেতু সম্পর্কে সাধারণ একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে এতে। ছোটবেলায় চুম্বক আর কোরাল যে বৈজ্ঞানিক আবেশ আমার ভেতর তৈরি করেছিল, সেটা অব্যাহত থাকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও। সেই পরীক্ষার মধ্যেও ইচ্ছাশক্তির জোরে আমার রহস্যের অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছি। সেগুলো নিয়ে ভেবেছি, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। একই ব্যাপার আমার সন্তানদের মধ্যেও দেখতে পাই। তারাও বিজ্ঞানে পড়ছে।
বিজ্ঞান এবং কল্পকাহিনির মূল পার্থক্যটা হলো বিজ্ঞানের এই নিয়ম মেনে চলাটা। বিজ্ঞানের ল বা নিয়মগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়। পরীক্ষা করে এই নিয়মটা যে সত্যি, সেটা প্রমাণ যেমন করা যায়, ভুল প্রমাণের সুযোগও আছে
আমি যা শিখতাম, বা পড়তাম কিংবা বোঝার চেষ্টা করতাম, অথবা যেগুলো পড়া উচিত, সেগুলো আমি লিখেও রাখতাম। এমনকি বই লেখার সময়ও আমি কারও সঙ্গে সে বিষয়ে কথা বললে এবং কিছু জিনিস শিখলে তা লিখে নোট করে ফেলতাম। আমার অনেক ডায়েরি আছে। সেগুলোতে আমার সায়েন্টিফিক চিন্তা নিয়ে লেখা আছে। একসময় নিজেকে বোকা মনে হতো। আমার কাছে অনেক বই আছে, তাহলে সেগুলো লিখে কেন সময় ব্যয় করছি।
নোবেলজয়ী স্টিভেন ওয়েইনবার্গের কাছে কোয়ান্টাম মেকানিকস পড়েছি। তিনি প্রথম দিনের ক্লাসেই বলেছিলেন, আপনি যা শিখবেন, তা লিখে রাখুন। কিন্তু আমার তো আরও শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের কেউ এ কথা বলেননি। তখন একটা বিষয় আমি অনুভব করি, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না পেলেও আমার শৈশবের বিজ্ঞানশিক্ষাটা ঠিকমতো এগিয়েছিল। আমি এমন এক পরিবারে জন্মেছিলাম, বেড়ে উঠেছিলাম, সেই পরিবারে আমার আগে কেউ বিজ্ঞানে পড়েনি। তাই আমি কিছুটা অনিশ্চয়তায়ও ভুগতাম। তারপর আমি ঠিক পথে এগিয়েছিলাম। তাই বলব, বিজ্ঞান-সংস্কৃতির বলয়ে বেড়ে না উঠেও বিজ্ঞানী হওয়া যায়।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: আমরা ড. জাহিদ হাসানের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প শুনলাম। একটা কম্পাস বা কোরালের রহস্য সমাধান করতে এভাবেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ আছে। সায়েন্স কংগ্রেসে যাঁরা অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের সবাই সায়েন্টিফিক মেথডোলজি ফলো করে ছোটখাটো গবেষণা করে তবে এসেছেন। আপনার জীবনে সায়েন্টিফিক মেথডোলজি ফলো করে করা প্রথম গবেষণা কোনটা ছিল? আরেকটা প্রশ্ন করব সঙ্গে, প্রথম সেই গবেষণা সফল হয়েছিল কি না।
জাহিদ হাসান: এটা ভালো প্রশ্ন। আমি যখন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ছাত্র ছিলাম, তখন প্রথম সত্যিকার গবেষণাটা করি। সেটা ছিল ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ নিয়ে গবেষণা। একটা রিসার্চ পেপার লিখেছিলাম। গবেষণার ভিত্তিটা ছিল ম্যাগনেটিক ফিল্ড, ইলেকট্রিক ডায়নামিক অব চার্জ এবং স্থান–কালের সাপেক্ষে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের একটা সমাধান তৈরি। লরেঞ্জ রূপান্তরে স্থান–কাল সমতল। বিশেষ আপেক্ষিকতাও এ কথাই বলে। কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বলে স্থান–কাল মোটেও সমতল নয়, বক্র বা বাঁকা। বাঁকা স্থান-কালে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সমাধান কেমন হবে? বিশেষ করে ব্ল্যাকহোলের আশপাশে স্থান–কাল যে বিশালাকারে দুমড়ে যায়, সেখানে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে কী ফল পাওয়া যাবে, এটাই ছিল আমার গবেষণার বিষয়। তবে আমার সেই গবেষণাপত্রটা প্রকাশিত হয়নি। কারণ, এটা ছিল অনেকটা ওয়ার্মআপের মতো। এর সমাধান আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আমি জানতাম না। তখন আমার ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। তাই সমাধান থাকলেও সেটা গুগল সার্চ করে জানার সুযোগ ছিল না।
আমার সত্যিকারের প্রথম গবেষণা ছিল কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নিয়ে। এটা আসলে ফিল্ড থিওরির একটা অংশ। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে যদি একটা লিনিয়ার কোয়ান্টাইজ সিস্টেম যোগ করি, সেটা আইনস্টাইন-মিনকোস্কির সাধারণ আপেক্ষিকতার বাইরে নতুন একটা ফিল্ড থিওরির জন্ম দেয়। সেই পথে হেঁটে হয়তো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের হদিস মিলতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এখনো প্রমাণিত নয়। তাই আমার সেই গবেষণাও পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি।
আমার দ্বিতীয় কাজটা ছিল স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে। এই তত্ত্ব কীভাবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ বা উচ্চমাত্রার জিনিস তৈরি করতে পারে, সেটা নিয়ে কাজ করেছিলাম। এগুলোই ছিল প্রথম দিকের কাজ। কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নিয়ে থিওরিটিক্যাল কাজ অনেক হচ্ছে, কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন। তখন সিদ্ধান্ত নিই, আমি এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিজ্ঞানী হব। আমি ফলিত পদার্থবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে উঠি। তারপর আবার তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় ফিরে যাই। আগে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ফান্ডিং কম ছিল। এখন তাত্ত্বিক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান, উভয়ই ক্ষেত্রেই ফান্ডিং আসছে। সুখের কথা, সম্প্রতি আমি নিজেও মিলিয়ন ডলারের একটা ফান্ডিং পেয়েছি।
হাইপার ড্রাইভের সাহায্যে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে প্রবেশ করা সম্ভব। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই তাত্ত্বিক। পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ নেই।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ, আমি আসলে কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, সেগুলোর উত্তর আপনি দিয়ে দিয়েছেন। আমরা বরং শিক্ষার্থীদের কাছে চলে যাই। অনেকেই আপনার কাছে প্রশ্ন করেছে। তাদের ভেতর থেকে একজনের প্রশ্ন নেব আমি। প্রথম প্রশ্ন করেছে মুস্তাবির ইসরাইল।
মুস্তাবির ইসরাইল: মহাবিশ্বের চার ধরনের বলের মধ্যে মহাকর্ষ সবচেয়ে দুর্বল বল। অথচ নক্ষত্র তৈরির সময় এই বল অণু–পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ করে কীভাবে? সাধারণ আপেক্ষিকতা এ বিষয়ে কী বলে?
জাহিদ হাসান: সত্যি বলতে কি, মহাকর্ষ বলকে আমরা যত দুর্বল বলি, সেটা এত দুর্বল নয়। আমরা যখন মহাকর্ষ বলকে দুর্বল বলি, তখন বিদ্যুৎ–চুম্বকের বল কিংবা সবল নিউক্লীয় বলের সাপেক্ষে দুর্বল বলি। কিন্তু অন্য বলগুলোর তুলনায় অনেক বড় পরিসরে মহাকর্ষ বল অতটা দুর্বল নয়। বিশেষ করে ব্ল্যাকহোল বড় নক্ষত্রের কাছে স্থান–কাল অনেক বেশি বেঁকে যায়। তাই এই অর্থে বলা যায়, মহাকর্ষ বল খুব শক্তিশালী হয়। নক্ষত্র তৈরির সময় অনেক বেশি কণা এক জায়গায় জড়ো হয়, তাদের মিলিত ভরও অনেক বেশি। তাই স্থান–কালকে অনেক বেশি বাঁকিয়ে দেয়। তাই মহাকর্ষ শক্তিশালী হয় অনেক। এ জন্য কণাদের ওপর ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারটা পুরোটাই সাধারণ আপেক্ষিকতার অংশ।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ। পরের প্রশ্নটা করবে সাদিয়া জাহান।
সাদিয়া জাহান: স্যার, আমাদের পাঠ্যবইয়ে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি, কিন্তু হোয়াইটহোল বিষয়ে কোনো লেখা থাকে না। সহজ ভাষায় হোয়াইটহোল সম্পর্কে জানতে চাই।
জাহিদ হাসান: পাঠ্যবইয়ের ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে জানা যায়। কারণ, ব্ল্যাকহোলের পরীক্ষামূলক প্রমাণ আছে। এটা ইতিমধ্যে অনেকবার শনাক্ত করা হয়েছে। তাই আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ব্ল্যাকহোল আছে। যদিও ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কী আছে, আমরা এখনো জানতে পারিনি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বা এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি করে বিশাল ব্ল্যাকহোল আছে, এ কথা এখন প্রমাণিত। এগুলোর ভর ১০ হাজার সৌরভরের সমান। কণা পদার্থবিজ্ঞানে যেমন সব কণার প্রতিকণা আছে, যেমন ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন। প্রতিসাম্য বিবেচনা করে কসমোলজিক্যাল থিওরি অনুযায়ী ব্ল্যাকহোলেও একটি বিপরীত চরিত্রের বস্তু থাকা উচিত। ব্ল্যাকহোল যেমন সবকিছু শোষণ করে নেয়, তেমনি সেই বস্তুটা সবকিছু প্রতিফলন করবে। সেটাই হোয়াইটহোল। পাঠ্যবইয়ে এর সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায় না; কারণ, এর পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ নেই। একে শনাক্ত করাও এখন সম্ভব নয়। এটা তাত্ত্বিক ও গাণিতিকভাবে প্রমাণিত একটা ধারণা। কিন্তু এ জিনিসটা কোথায় থাকতে পারে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল আছে। তত্ত্ব বলে যেকোনো ব্ল্যাকহোলের সঙ্গেই একটা করে হোয়াইটহোল থাকা উচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, হোয়াইটহোলগুলো আলাদা একটা মহাবিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। অন্য সেই মহাবিশ্বের সঙ্গে এই মহাবিশ্বের এমনিতে যোগাযোগ নেই। তবে দুটো মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযোগটা তৈরি করতে হতে পারে ব্ল্যাকহোল আর হোয়াইটহোলের মাধ্যমে। অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্বের ব্ল্যাকহোল আর অন্য মহাবিশ্বের হোয়াইটহোল—দুটি মিলে একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করে। হাইপার ড্রাইভের সাহায্যে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে প্রবেশ করা সম্ভব। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই তাত্ত্বিক। পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ নেই।
ইব্রাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ, তার মানে টেক্সট বুকে বিষয় আসতে হলে সেটার এক্সপেরিমেন্টাল প্রমাণ দরকার।
জাহিদ হাসান: হ্যাঁ, স্কুলের বইগুলোতে সাধারণ এই নিয়ম মানা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সট বইগুলোতে এসব বিষয় থাকে। সেগুলো নিয়ে গবেষণা হয় এবং অনেক রিসার্চ পেপার আছে।
ইব্রাহিম মুদ্দাসসের: এবার ফেসবুক থেকে একটা প্রশ্ন নিতে চাই। প্রশ্নটা করেছেন শরীফ জামাল। তিনি লিখেছেন, কীভাবে আমরা বাচ্চাদের স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত রাখতে পারি। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ইউরোপ-আমেরিকার স্কুলগুলোতে এ দেশের ছেলেমেয়েরা কীভাবে অংশ নিতে পারে?
জাহিদ হাসান: এ দেশে বিজ্ঞান কংগ্রেস বা বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, এগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়। আর ইউরোপ-আমেরিকার সামার স্কুলগুলোতে অংশ নেওয়া খুব সহজ। এই যে আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, সবার সঙ্গে কথা বলছি। এভাবেই ইউরোপ-আমেরিকার সামার স্কুলেও অংশ নিতে পারেন অনলাইনের মাধ্যমে। এ ছাড়া সশরীর উপস্থিত হয়ে ল্যাবগুলো দেখে যেতে পারেন। তবে কিছু জটিলতা আছে। এ জন্য বিশেষ ভিসা নিতে হবে। সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ভিসাপদ্ধতি সহজ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ। আমরা এবার পরের প্রশ্নে যাই। প্রশ্ন করবে আদিবা হাসান।
আদিবা হাসান: স্যার, আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমার প্রশ্নটা হলো, আলো থেকে বেশি গতির কিছু আছে নাকি?
জাহিদ হাসান: খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন। আলোর থেকে বেশি গতির কণা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। কিন্তু এগুলো সবই তাত্ত্বিক পর্যায়ে আছে। বিজ্ঞানীদের এখনকার ধারণা হলো, আমাদের মহাবিশ্বে আলোর গতির চেয়ে বেশি গতির কণা নেই। কিন্তু অন্য মহাবিশ্বে থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: পরের প্রশ্নটা করবে মুনতাসিবা হোসেন। আমরা এখন তার প্রশ্ন শুনব।
মুনতাসিবা হোসেন: স্যার, আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ি। আমি স্পেসটাইম মেট্রিক্স টেনসর নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে আটকে গেছি। আমি শেপ ফাংশন কী, সেটা বুঝতে পারছি না।
জাহিদ হাসান: শেপ ফাংশন হলো সমতল জ্যামিতির অংশ। অর্থাৎ এই ফাংশনের ফলাফল হিসেবে আমরা যেটাই পাব, সেটার আকৃতি হবে দ্বিমাত্রিক। অর্থাৎ এটা ফ্ল্যাট মেট্রিক্স, অনেকটা বিছানার চাদরের মতো। কিন্তু স্পেসটাইম মেট্রিক্স কিন্তু শুধু সমতলই। বক্র জ্যামিতিও আছে। সেটা সমাধান করার জন্য কার্ভ ফাংশনের দরকার হবে। কোনো গোলাকার বস্তুর পৃষ্ঠতল, কিংবা হাইপারবোলা কিন্তু বক্র জ্যামিতির উদাহরণ। এগুলোর সমাধান করতে হলে মেট্রিক্স টেনসরকে সমাধান করতে হবে কার্ভ ফাংশনের মাধ্যমে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: মুনতাসিবা, আশা করি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছ। এবার প্রশ্ন করবেন ইশতিয়াক আকিব।
ইশতিয়াক আকিব: স্যার, আমি ইশতিয়াক আকিব। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ছি। স্যার, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যখন ভাইল ফার্মিয়ন আবিষ্কৃত হয়, তখন বিভিন্ন নিউজ বা আর্টিকেল থেকে জেনেছিলাম, ভাইল ফার্মিয়নকে ইলেকট্রনিকে ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক জগতে একটা বিপ্লব হবে শুনেছিলাম। ইলেকট্রনিক সার্কিটে কবে নাগাদ এটা ব্যবহার করা যাবে?
জাহিদ হাসান: বিজ্ঞানকে প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে হলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ভাইল ফার্মিয়নকেও ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহার করার জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করা হয়ে গেছে। এর ফান্ডিং করছে বিখ্যাত ফান্ডিং এজেন্সি ডারপা (DARPA)। এই প্রতিষ্ঠানই ইন্টারনেট আর চালকবিহীন কার তৈরিতে ফান্ডিং করেছিল। ডারপা ফান্ডিং করেছে, এটা নিয়ে বিশাল একটা টিম কাজ করছে। তবু এর ফল পেতে ২০-২৫ বছর লেগে যেতে পারে। ভাইল ইলেকট্রনিকসে আরও ফান্ডিং করেছে মুর ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর। কম্পিউটারে যে মুর’স ল আছে, সেটা এই গর্ডন মুরেরই থিওরি। মুর ফাউন্ডেশনই আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো ইন্টেল। এই ফাউন্ডেশন মূলত কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ভাইল ইলেকট্রনিক ব্যবহারের জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ স্যার, ফেসবুক থেকে আরেকটা প্রশ্ন নিতে চাই। ফেসবুক থেকে প্রশ্নটা এ রকম, আপনি শুরুতে বলেছেন যে আপনি একটি বই পেয়েছিলেন ধূমকেতুর ওপর। এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে আপনি লিখতে শুরু করেছিলেন একটি বই। ওই বইটি কি প্রকাশিত হয়েছিল?
জাহিদ হাসান: আবদুল্লাহ আল-মুতীর সাগরের রহস্যপুরী নামে একটা বই ছিল। আরেকটা ছিল এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে। তখন অনেক কম বই ছিল, এখনকার মতো ইন্টারনেট ছিল না। ওই বইগুলো পড়ে আমার মনে হলো, আরও পড়া উচিত। তখন আমার বাসা ছিল সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির লাইব্রেরিতে ইংরেজি বই পড়া শুরু করলাম। এ ছাড়া আমার বাসায় আগে ধানমন্ডিতে আমেরিকান কালচার সেন্টার ছিল। সেখান থেকেও ইংরেজি বই পড়েছি। পরে ব্রিটিশ কাউন্সিলেও যাওয়া-আসা শুরু করি। এসব বই পড়তে গিয়ে মনে হলো, আমি নিজেও কিছু লিখি। সুতরাং এসো ধূমকেতুর রাজ্যে লেখার আইডিয়া মাথায় এল। অনেক খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এ বিষয়ে আগে কেউই বাংলায় বই লেখেনি। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বইটা লেখা শুরু করি। এরপর আমাকে আবদুল্লাহ আল-মুতীর সঙ্গে আমার বাবা পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তাঁকে আমার পাণ্ডুলিপিটা পড়তে দিই। তিনি দু-তিনটা জায়গায় সংশোধন করেন আর বলেন, কোনো ভুল তিনি পাননি বইয়ে। তারপর বইটা প্রকাশিত হয়।
তানিয়া নাসরীন: স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে, আপনি কাজ অথবা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে কখনো ব্যর্থ হয়েছেন?
এম জাহিদ হাসান: হ্যাঁ, আমার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির যে রিসার্চ প্রজেক্ট ছিল, সেটিতে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমার থিসিসটা ছিল কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির একটা ধারাবাহিক তত্ত্ব খুঁজে বের করা, স্ট্রিং তত্ত্ব ব্যবহার না করে। কিন্তু ওই প্রজেক্টে কেউ এখনো সফল হতে পারেনি। তাই খারাপ লাগে না। তবে ভালো লাগে এটা ভেবে যে আমি সত্যিই ভাগ্যবান। কারণ, আমাকে এত বড় একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: আপনি কি এখনো সেই তত্ত্বটা নিয়ে চিন্তা করেন? ওটার সমাধানের কথা ভাবেন?
জাহিদ হাসান: ঠিক তা নয়, আমি আসলে ওই ফিল্ড থেকেই সরে এসেছিলাম। আমি স্ট্যানফোর্ডে চলে এসেছিলাম। কারণ, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিকসের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল। আবার তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও কাজ করেছি। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছি। তাই আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঝুঁকে পড়ি। অন্যদিকে ইলন মাস্কের কথাই চিন্তা করুন। আমি আর তিনি একই ব্যাচের ছাত্র ছিলাম। তিনি ফিজিকস পড়েছেন কিন্তু পরে প্রকৌশলবিদ্যার দিকেই মনোযোগী হয়েছেন।
নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করেই রকেট তৈরির প্রযুক্তি এখনো আসেনি। নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করতে হলে ফিউশন শক্তি ব্যবহার করতে হয়, যেমনটা হাইড্রোজেন বোমায় ব্যবহৃত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ঝামেলা আছে। ফিউশনের শক্তি হয়তো রকেট মডিউলকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: ধন্যবাদ স্যার, একদমই আমাদের জানা ছিল না এ ব্যাপারটা—আপনি আর ইলন মাস্ক একই ব্যাচের ছাত্র ছিলেন এবং এটাও জানা ছিল না ইলন মাস্ক ফিজিকসে ছিলেন আর আপনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ছিলেন।
জাহিদ হাসান: আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, কিন্তু কখনোই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: আচ্ছা, আমরা শেষ প্রশ্নটা নেব। প্রশ্নটা করবে সাবিত আল ফাইয়াজ।
সাবিত আল ফাইয়াজ: স্যার, যদি অ্যান্টিম্যাটার জিনিস দিয়ে কোনো ধরনের রকেট তৈরি করতে চাই। আমাদের কী জিনিস প্রয়োজন?
জাহিদ হাসান: নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করেই রকেট তৈরির প্রযুক্তি এখনো আসেনি। নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করতে হলে ফিউশন শক্তি ব্যবহার করতে হয়, যেমনটা হাইড্রোজেন বোমায় ব্যবহৃত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ঝামেলা আছে। ফিউশনের শক্তি হয়তো রকেট মডিউলকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। এ জন্য ফিউশন শক্তি ব্যবহার করে রকেট তৈরির সম্ভাবনা মাত্র ১ শতাংশ। তাই বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিম্যাটার ব্যবহারের কথা চিন্তা করছেন। অ্যান্টিম্যাটার ব্যবহারেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কীভাবে এই অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে হবে, সেটা কীভাবে তৈরি হবে। প্রতিকণা ইতিমধ্যে সার্নে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিকণা দিয়ে প্রতিপরমাণু তৈরি করা যাবে। প্রতিকণার নিউক্লিয়াস থাকবে। সেই নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি উৎপাদন করে রকেটের জ্বালানি তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এটাও অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ধরনের প্রযুক্তি আসতে এক শ বছর কিংবা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা প্রশ্নোত্তর পর্ব এখানেই শেষ করছি। ড. জাহিদ হাসানকে অনুরোধ করব, শিশু-কিশোর কংগ্রেসের খুদে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য। তারপর মুনির হাসান স্যারের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে আজকের অনুষ্ঠান শেষ করব।
জাহিদ হাসান: ধন্যবাদ, আমি খুব সংক্ষেপে বলতে চাই, বিজ্ঞানী হতে হলে তোমাকে কৌতূহলী হতে হবে, রহস্য অনুসন্ধানের মানসিকতা থাকতে হবে। বিজ্ঞানী হতে চাইলে বিজ্ঞানীদের জীবন সম্পর্কে পড়তে হবে, জানতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতো। যখন তুমি কোনো উপন্যাস পড়ো, নিজেকে সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রই ভাবতে শুরু করো। বিজ্ঞানীদের জীবন সম্পর্কে পড়তে গেলেও একই অনুভূতি হবে, নিজেকে বিজ্ঞানী বলে মনে হবে, তুমি বিজ্ঞানী হতে চাইবে। বিজ্ঞান কংগ্রেস কিংবা বিজ্ঞান উৎসবগুলোতে বেশি বেশি অংশগ্রহণ করো, তাহলে বিজ্ঞানচর্চার মধ্যেই থাকবে, বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নটা বড় হতে থাকবে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞানের বীজ বপন করতে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য।
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০২০