বিজ্ঞান ও গণিতে নারীর অবদান

আজ ৮ মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও গণিতে নারীদের অবদান অনেক। বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় কাজ করেছেন, এমন কয়েকজন নারীদের নিয়ে আজকের এ আয়োজন।

মেরি কুরি

মেরি কুরি

বিজ্ঞানে নোবেল জয়ী প্রথম নারী মেরি কুরি। প্রথম নোবেল জয়ী ছাড়াও রেডিয়াম, পোলোনিয়াম আবিষ্কার এবং তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য মানুষ তাঁকে আজও স্মরণ করে। ১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডে কুরি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৯১ সালে প্যারিসে পিয়েরে কুরির সঙ্গে কাজ শুরু করেন একই গবেষণাগারে। এরপর বিয়ে করেন তাঁরা। দুজন একসঙ্গেই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। ১৯০৩ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন মেরি। তিনিই ফ্রান্সের প্রথম মহিলা হিসাবে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম মহিলা হিসাবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন তিনি।  ১৯১১ সালে রসায়নে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে নোবেল পান দ্বিতীয়বারের মতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক্সরে মেশিনের ব্যবহার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন তিনি। কাজের কল্যাণে জীবদ্দশাতেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সে মৃত্যু হয় মেরি কুরির। 

মারিয়া গিওপার্ট মায়ার

মারিয়া গিওপার্ট মায়ার

১৯৬৩ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মারিয়া গিওপার্ট দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। প্রথম নারী হিসাবে তাঁর ৬০ বছর আগে নোবেল পেয়েছিলেন মেরি কুরি।

১৯০৬ সালের ২৮ জুন জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন মায়ার। তাঁর সময়ের খুব কম নারীই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন। মারিয়া জার্মানির গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচিত হন কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে। ১৯৩০ সালে, ২৪ বছর বয়সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ এডওয়ার্ডকে বিয়ে করে তাঁর সঙ্গে বাল্টিমোরের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। কিন্তু হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় মারিয়াকে নিয়োগ দিতে চায়নি। ব্যথিত হন মারিয়া। তবে ডিপ্রেশনে থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানে নিজের কাজ ও গবেষণা চালিয়ে যান ঠিকই।

এরপর এই দম্পতি পাড়ি জমান নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। মারিয়া পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের জন্য ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ আলাদা করার কাজ করেন। এরপর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়াসের গঠন নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। তিনি দেখান, একটি পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটন ও নিউট্রনগুলো ভিন্ন শক্তিমাত্রার কক্ষপথে অবস্থান করে। এটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন নিউক্লিয়ার শেল মডেল। এই কাজের জন্য অন্য দুজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে নোবেল পেয়েছিলেন মারিয়া গিওপার্ট মায়ার।

মরিয়াম মির্জাখানি

মরিয়াম মির্জাখানি

মরিয়াম মির্জাখানি ছিলেন গণিতবিদ। বক্র স্থানের জ্যামিতিতে কঠিন ও বিমূর্ত সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিলেন। মরিয়ামের জন্ম ইরানের তেহরানে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেছেন।

মরিয়াম মূলত জিওডেসিক জ্যামিতি নিয়ে কাজ করেছিলেন। জিওডেসিক মানে বক্রতলের ওপর দুটি বিন্দুর মাঝে সর্বনিম্ন দূরত্ব। সাধারণত, দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্ব সরলরেখা। কিন্তু আমরা যদি বক্রতলে দুটি বিন্দুর সর্বনিম্ন দূরত্ব যোগ করি, তাহলে কি সেটা সরলরেখা হবে? না, সেটা বক্ররেখা হবে, সবচেয়ে ছোট বক্ররেখা। সমতলের সরলরেখার মতো। এই ব্যাপারটিই হলো জিওডেসিক।

এই জিওডেসিক জ্যামিতি নিয়ে কাজ করে ২০১৪ সালে মরিয়াম প্রথম ও একমাত্র নারী হিসাবে ফিল্ডস পদক অর্জন করেন। গণিতের নোবেল হিসাবে পরিচিত এ পদক। পুরস্কার পাওয়ার এক বছর আগে মির্জাখানির স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এমি নোয়েদার

এমি নোয়েদার

২০ শতকের প্রথম দিকের একজন বিখ্যাত গণিতবিদ এমি নোয়েদার। তাঁর গবেষণা আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও গণিতের দুটি মূল ক্ষেত্রে ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেছিল। ১৯১০-এর দশক থেকে ১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে জার্মানির গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসাবে তিনি কাজ করেছেন। এই সময়েই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো মানুষের সামনে এসেছে।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ নোয়েদার থিওরেম বা নোয়েদারের উপপাদ্য। এই উপপাদ্যটি প্রতিসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর উপপাদ্যটি আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

পরে নোয়েদার বিমূর্ত বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি করতেও সাহায্য করেন। এ কাজের জন্য তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন গণিতবিদদের মধ্যে। পাশাপাশি আরও চমৎকার কিছু মৌলিক কাজও রয়েছে তাঁর।

১৯৩৩ সালের এপ্রিলে অ্যাডলফ হিটলার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইহুদিদের বহিষ্কার করেন। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো নোয়েদারও বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। কিছুদিন তিনি নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থীদের পড়াতে থাকেন। কিন্তু বেশিদিন বাসায় পড়াতে পারেননি। জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩৫ সালের এপ্রিলে মারা যান নোয়েদার। এর আগে পেনিসেলভানিয়ার ব্রিন মর কলেজ এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি।

ক্যারেন উলেনবেখ

ক্যারেন উলেনবেখ

২০১৯ সালে মার্কিন গণিতবিদ ক্যারেন উলেনবেখ প্রথম নারী হিসাবে আবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এটিও গণিতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের মধ্যে একটি। উলেনবেখ জ্যামিতিক আংশিক অন্তরীকরণ সমীকরণ, গজতত্ত্ব ও যোগজীকরণযোগ্য পদ্ধতিতে যুগান্তকারী অর্জনের স্বীকৃতি হিসাবে এ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। বহুমাত্রিক মহাবিশ্বে সাবানের ফেনার আকার দেখতে কেমন, তা ক্যারেন উলেনবেখই প্রথম দেখিয়েছেন। সমতলের কাছাকাছি থাকা দুটি বিন্দুকে যোগ করলে একটি সরলরেখায় পরিণত হবে। এ সরলরেখা একমাত্রিক। কিন্তু সমতলের পরিবর্তে বিন্দু দুটি পৃথিবীর ওপরে কোনো স্থানে হলে তা আর সরলরেখা থাকবে না। বরং বৃত্তের ব্যাসে পরিণত হবে। এই ব্যাস-ই দ্বিমাত্রিক। আর সাবানের ফেনা বা বুদবুদ হলো ত্রিমাত্রিক। এখানেই (ত্রিমাত্রিকে) দেখা মিলবে বিভিন্ন জটিলতার। মাত্রা যত বাড়বে, জটিলতাও তত বাড়বে। এই জটিলতারই সমাধান করেছেন ক্যারেন উলেনবেখ। ক্যারেনের দেখানো পথ ধরেই গড়ে উঠেছে কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভিত। এভাবেই জ্যামিতি, বিশ্লেষণ আর গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন ক্যারেন।

অ্যাডা লাভলেস

অ্যাডা লাভলেস

অ্যাডা লাভলেস ১৯ শতকের গণিতবিদ। তাকেই বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার বলা হয়। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন। কিন্তু মায়ের উৎসাহে গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। অ্যাডার ১৭ বছর বয়সে তিনি গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্যাবেজের পরিকল্পনা করা কম্পিউটারের জন্য প্রথম প্রোগ্রাম করেন লাভলেস। ১৮৩৭ সালে লাভলেস অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ওপর লেখা একটি পেপার ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই পেপারের সঙ্গে তিনি নিজের অনেক নোট যুক্ত করে দেন। তাঁর লেখা নোটগুলো মূল পেপারের চেয়ে বড় ছিল। অ্যাডা লাভলেস বিজ্ঞান ও গণিতে অনেক নারীর প্রেরণা। প্রতিবছর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহকে লাভলেস দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রোগ্রামিং কর্মশালা ও বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স