‘বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে আসলে কিছু নেই’—জামাল নজরুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞানী

বাংলাদেশি গণিতবিদ, বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ববিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাংশনাল ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড থিওরেটিক্যাল ফিজিকসে অনার্স করেছেন। মাস্টার্স করেছেন ১৯৬০ সালে। সেখানেই ছিলেন ১৯৬৭-৭১ পর্যন্ত। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্ব পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। সেখান থেকে আবার কেমব্রিজে ফেরেন। আর আশির দশকে ফিরে আসেন দেশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌতবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন দেশে ফিরে।

দেশের বাইরে তিনি জে এন ইসলাম নামে পরিচিত। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ দ্য ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজিও প্রকাশিত হয়েছে কেমব্রিজ থেকে। জে এন ইসলাম শেষজীবনে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, মহাকর্ষ ও কসমোলজি নিয়ে গবেষণা করেছেন। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে জানার জন্য ৯০-এর দশকে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর পক্ষ থেকে জে এন ইসলামের বাসভবনে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন পত্রিকাটির বিজ্ঞান পাতা ‘একুশ শতক’-এর বিভাগীয় সম্পাদক মুনির হাসান (বর্তমানে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক)। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে মহাবিশ্বের অনাগত ভবিষ্যতের কথা, চূড়ান্ত পরিণতির কথা। সাক্ষাত্কারটি সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।

জামাল নজরুল ইসলামঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

মুনির হাসান: মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলোচনার শুরুটা নিশ্চিতভাবে বিগ ব্যাং দিয়ে শুরু করা উচিত। মহাবিশ্ব সৃষ্টির একাধিক তত্ত্বের মধ্যে বিগ ব্যাং তত্ত্বটির সপক্ষে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই অবস্থান নিয়েছেন। কেন?

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে বিজ্ঞানীরা একেবারে নিঃসন্দেহ নন। তারপরও জন্মের তত্ত্ব হিসেবে বিগ ব্যাংয়ের পাল্লা ভারী হওয়ার পেছনে রয়েছে বেশ কটি জোরালো প্রমাণ। এর প্রধানটি হলো মহাবিশ্বের প্রসারণ। বিশের দশকে রুশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান যখন আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্বের সমীকরণের সমাধান করেন, তখনই বোঝা গেল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, ক্রমাগত। কিন্তু নিউটনের স্থির মহাবিশ্বের পক্ষে বিশ্বাস এত প্রবল ছিল যে খোদ আইনস্টাইনই মহাবিশ্বের প্রসারণ ঠেকানোর জন্য এক ভুল করে বসলেন। তিনি নিজের সমীকরণে একটি মহাজাগতিক ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট) বসিয়ে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঠেকানো তত্ত্ব প্রকাশ করলেন। পরে অবশ্য আইনস্টাইন স্বীকার করেন, এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। যাহোক, এডউইন হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে নিশ্চিতভাবে জানান, মহাবিশ্বের সবকিছু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি সরে যাওয়া (গ্যালাক্সি এবং) তারাদের লোহিত সরণ থেকে তিনি দেখালেন, এই সরে যাওয়ার হারও আমরা বের করতে পারি। এ থেকে উল্টোভাবে হিসেব করলে বোঝা যায়, একসময় মহাবিশ্বের সবকিছু এক বিন্দুতে একীভূত ছিল। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি (বর্তমান হিসেবে, ১ হাজার ৩৮০ কোটি) বছর আগে মহাবিশ্বের সব তারা, গ্যালাক্সি, ধূলিকণা একসঙ্গে ছিল এবং এক মহাবিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং) থেকে সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে এটি একটি ভালো প্রমাণ।

 

মুনির হাসান: মহাবিশ্বের প্রসারণ ছাড়া আর কোনো জোরালো প্রমাণ কি আছে বিগ ব্যাংয়ের পক্ষে?

জামাল নজরুল ইসলাম: নিশ্চয়ই আছে। চল্লিশের দশকে রুশ বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামোর একটা গবেষণা থেকে আমরা জানি, বিগ ব্যাংয়ের সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল প্রচণ্ড। সেই তাপমাত্রায় এক বিশাল বিস্ফোরণ যদি ঘটে, তবে সৃষ্ট বিকিরণের একটা অবশেষ এখনও থাকবে। হিসাব করে দেখা গেল, আমাদের চারপাশে সুসংহত সেই বিকিরণের মাত্রা হবে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি কেলভিন। ১৯৬৪ সালে দুজন রেডিওবিজ্ঞানী (আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন) ঠিকই তা খুঁজে পেলেন এবং তা তত্ত্বের সঙ্গে মিলেও গেল।

মুনির হাসান: আপনি বলছেন, মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। তা, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে কোন স্থানে?

জামাল নজরুল ইসলাম: সাধারণভাবে আমাদের স্থান (Space) সম্পর্কে যে ধারণা বা বিশ্বাস, তা দিয়ে এটি বোঝা বেশ কষ্টকর। আসলে মহাবিশ্ব কোনো স্থানে প্রসারিত হচ্ছে না; বরং মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার ফলে এর ভেতরকার পদার্থগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ছে। এই মধ্যবর্তী অংশই আসলে স্থান বা স্পেস।

 

মুনির হাসান: স্পেসের কথা যেহেতু উঠলই, তাহলে একটু টাইমের কথাও বলা যাক। স্টিফেন হকিং তাঁর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইতে বলেছেন, বিগ ব্যাংয়ের আগে ‘ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন।’ তিনি কেন এ কথা বলেছেন?

জামাল নজরুল ইসলাম: আসলে ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে বলা যায় না। বিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্বাস না জড়ানোই ভালো। তবে সময়ের ধারণাই এমন যে ‘বিগ ব্যাংয়ের আগে’ বলে আসলে কিছু নেই। হকিংয়ের কাছ থেকে আমরা এটি জেনেছি যে সময়ের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। কাজেই বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে কিছু নেই। নিউটনের সময়ের চিরন্তন বহমানতার তত্ত্বটি সঠিক নয়।

মুনির হাসান: আমাদের চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো অনেক গ্যালাক্সি বা ক্লাস্টার দেখছি আমরা। বলা হচ্ছে, এগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরে যাওয়া কি চলতে থাকবে, না একসময় শেষ হয়ে যাবে?

জামাল নজরুল ইসলাম: তাহলে প্রথমে আমাদের বোঝা দরকার, মহাবিশ্বটা খোলা বা মুক্ত (Open) নাকি বদ্ধ (Closed)। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি আসলে এই প্রশ্নের জবাবের ওপর নির্ভর করছে। এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার অনেক উপায় রয়েছে। প্রথমত, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার বের করা, কিংবা মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব বের করা। এটি আবার মহাবিশ্বের প্রসারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করে হাবল ধ্রুবকের সঙ্গে মিলিয়েও এটি বের করা যায়। যেভাবেই করা হোক না কেন, এসবের সঙ্গে অনেক অনিশ্চয়তা যুক্ত রয়েছে, যে কারণে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে মহাবিশ্বকে মুক্ত বলা যেতে পারে।

জামাল নজরুল ইসলাম
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মুনির হাসান: মহাবিশ্ব আমাদের জন্য বড় ব্যাপার। এর আগে আপনি কি আমাদের একটু ছোটখাটো ব্যাপার, যেমন তারার মৃত্যু সম্পর্কে কিছু বলবেন?

জামাল নজরুল ইসলাম: গড়পড়তাভাবে তারার তিনটি অন্তিম দশার কথা আমরা জানি। যথাক্রমে শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র ও কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। আমাদের সূর্যের মতো তারাগুলো শেষ বয়সে শ্বেতবামনে পরিণত হয়। সেখানে ভারী পদার্থের পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো ছাড়া পেয়ে বের হয়ে আসে এবং ইলেকট্রনের চাপ মহাকর্ষকে (অর্থাৎ মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করার মাধ্যমে) ব্যালান্স করে। সূর্য যখন শ্বেতবামন হবে, তখন এর ভর যা আছে তা-ই থাকবে, কিন্তু আকার হবে পৃথিবীর সমান।

নিউট্রন তারায় একটি বড় নিউক্লিয়াসে শুধু নিউট্রন থাকে। সূর্যের ভরের একটি নিউট্রন তারার ব্যাস হবে মাত্র ১০ কিলোমিটার। আর সূর্যের ভরের চেয়ে কিছু বেশি ভরের তারাগুলো শেষ জীবনে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে বা কেন্দ্রের কাছাকাছি বস্তুর ঘনত্ব প্রায় অসীম হয়, অথচ এগুলোকে দেখা যায় না। কারণ এর মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে এর থেকে আলোও বের হতে পারে না।

 

মুনির হাসান: তাহলে আমাদের মহাবিশ্বে যেখানে এখন শ্বেতবামন, নিউট্রন তারা, সেখানে ব্ল্যাকহোল থাকবে?

জামাল নজরুল ইসলাম: ঠিক তা-ই। কমবেশি ১০১১ বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের সব তারা নিজেদের অন্তিম দশায় পৌঁছে যাবে। তখনো গ্যালাক্সিগুলোর পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়া অব্যাহত থাকবে। এরপর আজ থেকে ১০১৮ থেকে ১০২৭ বছর পর মহাবিশ্বজুড়ে এ রকম গ্যালাকটিক ব্ল্যাকহোলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে।

জামাল নজরুল ইসলাম
ফাইল ছবি: নাসির আলী মামুন

মুনির হাসান: তাহলে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্ব কতকগুলো ব্ল্যাকহোলের সমষ্টিতে পরিণত হবে এবং সেগুলোই চিরকাল থাকবে?

জামাল নজরুল ইসলাম: ক্লাসিক্যাল ফিজিকস তাই বলে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রয়োগ করে স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন, ব্ল্যাকহোল থেকেও বিকিরণ বের হয়ে আসছে। এই বিকিরণকে আমরা হকিং বিকিরণ বলি। এই বিকিরণ যদি হতে থাকে, তাহলে ব্ল্যাকহোলও একসময় সম্পূর্ণ বিকিরিত হয়ে যাবে। একটি স্টেলার ব্ল্যাকহোলের আয়ুষ্কাল ১০৬৫ বছর আর গ্যালাকটিক ব্ল্যাকহোল বাঁচবে প্রায় ১০১০০ বছর। এর অর্থ দাঁড়াল, ১০১০০ বছর পর মহাবিশ্বজুড়ে থাকবে খালি জায়গা এবং কিছু বিক্ষিপ্ত নিউট্রন তারা, শ্বেতবামন, ছোট গ্রহ ও গ্যালাক্সি থেকে ছিটকে পড়া বস্তুপুঞ্জ।

 

মুনির হাসান: এই শীতল বস্তুগুলো কি কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে, নাকি মহাবিশ্ব এখানেই শেষ?

জামাল নজরুল ইসলাম: না, এই শীতল বস্তুগুলোও কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে এবং এফ জে টাইসনের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এই পরিবর্তন হবে মূলত কোয়ান্টাম টানেলিং এফেক্টের জন্য। জটিল পদার্থবিজ্ঞানে না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, টানেলিং এফেক্টের মাধ্যমে শ্বেতবামনগুলো প্রথমে নিউট্রন তারায় এবং পরে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই প্রক্রিয়ায় একটি শ্বেতবামনের নিউট্রন তারায় পরিণত হবে ১০৭৬ বছর লাগবে।

মুনির হাসান: এসব সম্ভাবনার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

জামাল নজরুল ইসলাম: আছে। এখন পর্যন্ত আমরা প্রোটনকে স্থায়ী বলে জানি। কিন্তু কোনো কোনো তত্ত্ব বলছে, প্রায় ১০৩১±৫ বছরে প্রোটনও ক্ষয় হয়ে যায়। এটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ ভালোভাবেই পরিবর্তিত হবে।

 

মুনির হাসান: যে টাইম-স্কেলের কথা আপনি বলছেন, তাতে জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার আদৌ কোনো দরকার আছে কি?

জামাল নজরুল ইসলাম: তা অবশ্য ঠিক। কারণ যে টাইম-স্কেলের কথা আমরা বলছি, সে পর্যন্ত কোনো ধরনের জীবনের অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা বলা খুবই মুশকিল। তবে জীবনের অন্যতম শর্ত হলো, শক্তির প্রাপ্যতা। এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আরও কয়েক শ কোটি বছর সূর্য থাকবে এবং শক্তির অভাব হবে না। তারপর সভ্যতাকে অন্য কোনো তারার খোঁজে যেতে হবে। ১০১১ বছরের মধ্যে সব তারা শেষ হয়ে যাবে। তখনো কোনো সভ্যতার পক্ষে একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল থেকে শক্তি আহরণ করা সম্ভব, যেমনটা রজার পেনরোজ দেখিয়েছেন। নীতিগতভাবে, এভাবে ১০১০৩ বছর কাটানো যাবে। এভাবে কোনো না কোনো রূপে জীবনের টিকে থাকাটা অসম্ভব নয় বলেই মনে করি।