মিউ থেকে মিওয়ন

পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ এক তত্ত্বের নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেলে মৌলিক কণাগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একভাগ ফার্মিয়ন, আরেক ভাগ বোসন। ফার্মিয়ন হলো বস্তুকণা। যেমন ইলেকট্রন। আর বোসন হলো বস্তুকণাদের মধ্যে বলের বাহক। যেমন ফোটন। ফার্মিয়নকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়। কোয়ার্ক ও লেপটন। কোয়ার্কের বাইরে যেসব কণা থাকে, সেগুলোই লেপটন। যেমন ইলেকট্রন, মিওয়ন ও টাউ কণা।

লেপটন পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্য হলো মিওয়ন। এরা মৌলিক বস্তুকণা। অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, এ পরিবারের প্রথম প্রজন্মের সদস্য কণা ইলেকট্রন এবং তৃতীয় প্রজন্মের সদস্য টাউয়ন বা টাউ-ইলেকট্রন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে কিছু মিলও আছে। ইলেকট্রন ও টাউয়ন কণার সঙ্গে মিওয়ন কণার অনেক দিক দিয়ে মিল। যেমন এদের সবার চার্জ ঋণাত্মক। আবার একই মৌলিক বলের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এগুলো। তবে তিন কণার মধ্যে পার্থক্যও বিস্তর। যেমন ইলেকট্রনের চেয়ে মিওয়ন প্রায় ২০৭ গুণ ভারী। টাউ কণা মিওয়নের চেয়ে ১৭ গুণ ভারী। মিওয়নের ভর প্রায় ১০৫ MeV/c2

প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে মিওয়ন কণা তৈরি হচ্ছে। উচ্চশক্তির কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বা বিকিরণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত হানলে এ কণা তৈরি হয়।

তবু মিওয়নকে হেভিওয়েট কণা বলা যায় না। কারণ এরা অন্য কণাদের চেয়ে হালকা। ইলেকট্রনের সঙ্গে মিওয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত হলো, ইলেকট্রন স্থিতিশীল, কিন্তু মিওয়ন অস্থিতিশীল। মানে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। খুব অল্প এদের আয়ু। গড়ে এক সেকেন্ডের দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ ভাগের এক ভাগ সময়ে ক্ষয় হয়ে অন্য কণায় পরিণত হয় মিওয়ন। অন্যভাবে বললে, গড়ে ২.২ মিউ সেকেন্ডে মিওয়ন ক্ষয়ে যায়। এ ক্ষয় প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় অন্য হালকা কণা। যেমন ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো।

প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে মিওয়ন কণা তৈরি হচ্ছে। উচ্চশক্তির কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বা বিকিরণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত হানলে এ কণা তৈরি হয়। এই মহাজাগতিক রশ্মিতে থাকে সূর্য থেকে আসা কণা কিংবা মহাকাশের অন্য এলাকা থেকে আসা কণা। আমাদের বায়ুমণ্ডলে মহাজাগতিক রশ্মি আঘাত হানলে অসংখ্য নতুন কণা তৈরি হয়। এদের মধ্যে থাকে বিপুল সংখ্যক মিওয়ন। সেগুলো ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে। সমুদ্র সমতলে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গ মিটারে প্রায় ১০০টি মিওয়ন শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিমভাবে এ কণা তৈরি করা যায় পার্টিকেল এক্সিলেটরেও। মিওয়ন কণার ধর্ম বা অন্যান্য বিষয় গবেষণার জন্য এভাবে মিওয়ন তৈরি করা হয়।  

মিওয়ন কণা তৈরি হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মির সংঘর্ষে। এ কণার আয়ু গড়ে মাত্র এক সেকেন্ডের দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ ভাগের এক ভাগ।

আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রমাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মিওয়ন কণার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, মিওয়ন কণা তৈরি হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মির সংঘর্ষে। এ কণার আয়ু গড়ে মাত্র এক সেকেন্ডের দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ ভাগের এক ভাগ। এ আয়ু নিয়ে মিওয়ন তৈরি হওয়ার পর যদি আলোর গতিতে চলে, তাহলে মাত্র ৬০০ মিটার পথ পেরিয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কণাটি পৃথিবীর ওপরে তৈরি হওয়ার পর পাড়ি দেয় আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার। এভাবে নেমে আসে ভূপৃষ্ঠে। সে জন্যই সেখানে এ কণা অসংখ্যবার শনাক্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এটা কীভাবে সম্ভব?

এর উত্তর পাওয়া যায় আইনস্টাইনের প্রণীত বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে। এ তত্ত্ব অনুসারে, কোনো বস্তু বা কণা প্রায় আলোর গতিতে চললে আমাদের চোখে বা সাপেক্ষে তার সময় ধীর হয়ে যাবে। মানে, কমে যাবে তার বয়স বাড়ার হার। মিওয়ন কণার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটে।

মিওয়ন কণা প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। মানে সেই ভারত ভাগের সময়

২.

মিওয়ন কণা প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। মানে সেই ভারত ভাগের সময়। ব্রিটিশদের ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়। সে আবিষ্কার ছিল অনেকটা দুর্ঘটনাক্রমে। তবে এ কণার সঙ্গে বিজ্ঞানীদের পরিচয় এরও প্রায় এক দশক আগে। ১৯৩৭ সালে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নতুন একটি কণার দেখা পান মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড অ্যান্ডারসন এবং সেথ নেডারমেয়ার। কণাটি আসলে কী, তা কেউ জানতেন না। পরীক্ষায় দেখা গেল, আবিষ্কৃত কণাটি ইলেকট্রনের চেয়ে ভারী, কিন্তু প্রোটনের চেয়ে হালকা। মানে একটা মাঝামাঝি ভরের কণা। তাই শুরুতে বিজ্ঞানীরা এদের নাম দেন মেসন। কেউ কেউ ডাকতে লাগলেন মেসোট্রন। এ নামগুলোর উৎপত্তি গ্রিক শব্দ মেসো (meso) থেকে। বাংলা মেসোমশাইয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে গ্রিক মেসো অর্থ ইন্টারমিডিয়েট। মানে, মাঝামাঝি বা মধ্যবর্তী। মিওয়ন কণার ভর ইলেকট্রন ও প্রোটনের মাঝামাঝি হওয়ার কারণে এ নামে ডাকা হতো কণাটিকে।

 ১৯৪৭ সালে একে ইলেকট্রনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটা কণা হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

এর কিছুদিন পর আবিষ্কৃত হলো আরেকটি কণা। তার ভরও ইলেকট্রন ও প্রোটনের মাঝামাঝি। কিন্তু তাদের অন্যান্য ধর্ম আলাদা। তাই দুটি কণাকে আলাদা করতে নতুন এ কণার নাম দেওয়া হয় পাই মেসন। আর আগের কণার নাম দেওয়া হলো বা µ-মেসন বা মিউ মেসন নামে। গ্রিক বর্ণমালা থেকে ধার করা হয়েছিল পাই ও মিউ নামটি। পরে পাই মেসন সংক্ষেপে হয়ে গেল পাইয়ন এবং মিউ মেসন সংক্ষেপে হয়ে গেল মিওয়ন। এখন কণা পদার্থবিদরা একে আর মেসন নামে ডাকেন না। কারণ মেসন কণা গঠিত হয় কোয়ার্ক কণা দিয়ে। মিওয়ন কণাও দুটি কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত বলে একসময় ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, এরা আসলে ইলেকট্রনের জাত ভাই। ১৯৪৭ সালে একে ইলেকট্রনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটা কণা হিসেবে শনাক্ত করা হয়। সেই সঙ্গে ওই কণাকে শনাক্ত করা হয় লেপটনের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্য হিসেবেও। 

মিওয়ন কণা ক্ষণস্থায়ী। তৈরি হওয়ার অতি অল্প সময়ের মধ্যে এরা অন্য হালকা কণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমাদের চারপাশে যে স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে, তার একটা অংশ এ কণা।
মিওয়ন কণা ক্ষণস্থায়ী। তৈরি হওয়ার অতি অল্প সময়ের মধ্যে এরা অন্য হালকা কণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।

৩.

শুরুতে মিওয়ন কণাকে পছন্দ করতে পারেননি কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা। কারণ এর আবিষ্কারের পর এক বিভ্রান্তিতে পড়েন তাঁরা। তার কারণ তখনও দ্বিতীয় প্রজন্মের অন্য কণাগুলো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই মিওয়ন, কী, কেন কীভাবে—এসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের কাছে। সে সময় এক বিজ্ঞানী তো অসহিষ্ণু হয়ে বলেই বসেন, ‘এ জিনিস অর্ডার করল কে?’

সব বিভ্রান্তি ও তর্কবিতর্কের অবসান হয় ১৯৬০-এর দশকে। সেসময় গড়ে ওঠল স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এর মাধ্যমে এ কণাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।

আগেই বলেছি, মিওয়ন কণা ক্ষণস্থায়ী। তৈরি হওয়ার অতি অল্প সময়ের মধ্যে এরা অন্য হালকা কণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমাদের চারপাশে যে স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে, তার একটা অংশ এ কণা। এরা অনায়াসে পদার্থ বা বস্তুর ভেতর ঢুকে যেতে পারে। গোটা পৃথিবী, বিল্ডিং, এমনকি মানবদেহের ভেতর দিয়ে এরা কোনো বাধা ছাড়াই খুব সহজেই চলে যেতে পারে৷ ভূপৃষ্ঠের বেশ নিচেও তাই এদের সনাক্ত করা গেছে। আসলে আমাদের হাতের তালুর ভেতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় একটা মিওয়ন কণা চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা তার কিছুই বুঝতে পারছি না। 

মিওয়নের দোষ-গুণ তো জানা হলো। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর কাজ কী? এর উত্তর হলো, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর কোন ব্যবহার নেই বললেই চলে। মানে একে ভাত তরকারির সঙ্গে খেতে পারবেন না। কিংবা মাথায় বা গায়ে মাখাও যাবে না। তবে অন্য কিছু ক্ষেত্রে কণাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন মিসরের গ্রেট পিরামিডের ভেতরে গুপ্ত কক্ষ আবিষ্কারের ব্যবহার করা হয়েছিল মিওয়ন কণা। কণাপদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষা ও গবেষণায় এ কণার ব্যবহার আছে। আর আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রমাণে এ কণার ভূমিকার কথা আগেই বলেছি।

সূত্র:

পার্টিকেল ফিজিকস: আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ

হাউ টু ফাইন্ড আ হিগস বোসন/ ইভো ভ্যান ভালপেন

কোয়ার্কি কোয়ার্ক/ বেনজামিন বার এবং বোরিস লেমার, রিনা পিকোলো

উইকিপিডিয়া