কে পাবেন ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল?

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ঘোষণা হবে পাঁচটি বিষয়ে এ বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই কমবেশি কৌতূহল। নোবেল পুরস্কারের পুরো প্রক্রিয়াটিই সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ঢাকা। কোন কোন বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বহুবছর। তবু আমাদের কৌতূহল তো থেমে থাকে না। এই লেখায় অনুমান করার চেষ্টা করব সম্ভাব্য কাদের হাতে যেতে পারে এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।

পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলো এখনো নোবেল পায়নি, সেগুলো মোটামুটি প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার যেমন উলফ প্রাইজ, ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, নিউটন মেডেল ইত্যাদি পুরস্কারও ভবিষ্যত নোবেলবিজয়ী হবার ভালো পূর্বাভাস দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেওয়া ২৬টি উলফ প্রাইজ বিজয়ীদের ১৪ জনই পরে নোবেল পেয়েছেন। আবার গবেষণাপত্রের সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বোঝার একটি ভালো উপায়। তবে অনেক বছরেই দেখা যায়, আলোচনার বাইরে কোনো একটা পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আরেকটি মজার ট্রেন্ড গত দুই দশক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে—দুয়েকবছর পরপর একবার করে মহাবিশ্ব (জ্যোতির্বিজ্ঞান/কণাপদার্থবিজ্ঞান), অন্যবার আলো ও পদার্থ (Light-Matter) এভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে অনেক বছর পরে ২০২১ সালে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিকসে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের অনুমানে দুইয়ে রেখেছিলাম কমপ্লেকস সিস্টেম আর জর্জো পারিসিকে। তাছাড়া গত একবছরে হিগস-বোসন বা  মহাকর্ষ তরঙ্গের মতো বিশাল কোনো আবিষ্কারও হয়নি।  তাই গত বছরের তালিকার প্রায় সবাই থাকবেন এবারও।

বেল ইনেকুয়ালিটির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ: অ্যালান আসপেক্ট, জন ক্লাউসার, অ্যান্টন জেইলিঙ্গার

কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম বিস্ময়কর বিষয় হলো কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট—যা ছিল কোয়ান্টাম মেকানিকসের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড় অভিযোগ। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন, পোডলস্কি ও রোজেন মিলে একটি গবেষণাপত্রে তাঁদের অভিযোগ একটি থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষার মাধ্যমে তুলে ধরেন। তার অনেক বছর পরে ১৯৬৪ সালে জন স্টুয়ার্ট বেল এই গবেষণাপত্রের অভিযোগের ওপর আরও কাজ ‘বেল থিওরেম’ প্রকাশ করেন। বেল থিওরেমের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হলে সেটা হবে কোয়ান্টাম মেকানিকসেরই প্রমাণ। ১৯৭২ সালে ক্লাউসার ও ফ্রিডম্যান, ১৯৮০-৮২ সালে আসপেক্ট ও ১৯৯৮ সালে জেইলিঙ্গার তাঁদের পরীক্ষায় বেল থিওরেমের প্রমাণ দেন। তাঁদের এই কাজ কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। এদের মধ্যে ফ্রিডম্যান ২০১২ সালে মারা যান। বাকি তিনজন ২০১০ সালের উলফ প্রাইজও পেয়েছেন। তাই অনেক বছরের মতো এবারও তাঁরা আছেন বিবেচনায়।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর, ডেভিড ডয়েচ

গত দশক ও সামনের কয়েক দশকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। চার্লস বেনেট ও জিলে ব্রাসা মিলে আবিষ্কার করেন কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির BB84 প্রোটোকল। দুজন মিলে ২০১৮ সালে পেয়েছেন উলফ প্রাইজ। ২০১৭ সালে বেনেট পান ডিরাক মেডেল, যাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ। পিটার শর তাঁর ‘শর অ্যালগোরিদম’-এর জন্য বিখ্যাত। এটি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক অনেকগুণ দ্রুত ক্রিপ্টোগ্রাফি ভেঙে ফেলতে পারে। ডেভিড ডয়েচ কোয়ান্টাম টিউরিং মেশিন ও বেল ইনেকুয়ালিটি নিয়ে কাজ করেছেন। এই চারজন একসঙ্গে পেয়েছেন ২০২৩ সালের ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স ব্রেকথ্রু প্রাইজ। অনেকে আশা করছেন, এই চারজনের মধ্যে দুই বা তিনজনকে (সর্বোচ্চ তিনজনকে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া হয়) একসঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখা যেতে পারে।                              

কসমোলজিক্যাল ইনফ্লেশন: অ্যালান গুথ, আলেক্সেই স্টারোবিন্সকি, আন্দ্রেই লিন্ডে

বিগ ব্যাংয়ের সময়ের ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে এত বিশাল আকার ধারণ করে এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বড় অমিমাংসিত সমস্যা। ৭০ ও ৮০-র দশকে এর সমাধান হিসেবে আসে কসমোলজিক্যাল ইনফ্লেশন তত্ত্ব, যার অন্যতম পুরোধা ছিলেন গুথ, স্ট্রাবিনোস্কি ও লিন্ডে। কসমোলজিক্যাল ইনফ্লেশন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বড় অর্জন, যা একইসঙ্গে মহাবিশ্বের বৃদ্ধির পরিমাণ, বিভিন্ন গঠন তৈরিসহ আরও অনেক অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। গত কয়েক দশকের সবগুলো কসমোলজিক্যাল অবজার্ভেশনে তাঁদের তত্ত্বের আরও সত্যতা মিলেছে। তাঁরা মিলে এর আগে পেয়েছেন কাভলি প্রাইজ, গ্রুবার প্রাইজ, শ প্রাইজ, ডিরাক মেডেলসহ সম্ভাব্য প্রায় সব পুরস্কার। তাই এবারের নোবেলের জোরালো দাবিদার হিসেবে তাঁরা বিবেচনায় থাকবেন অবশ্যই।

কসমোলজিক্যাল মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMBR): ভিয়াতচেশ্লাভ মুখানভ ও রাশিদ সুনায়েভ

মহাবিশ্বের শুরুতে পদার্থ ও আলো ছিল সমানভাবে বিস্তৃত—ঠিক স্যুপের মতো। তাহলে আজ কেন মহাবিশ্বের সকল ভর গ্যালাক্সির মতো কম্প্যাক্ট বা ঘন অবস্থায় আছে? এর সমাধান হিসেবে মুখানভ ও চিবিসভের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ধারণা দেন। সুনায়েভ ও জেলডোভিচ সময়ের সঙ্গে এই ফ্লাকচুয়েশন কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমান পর্যবেক্ষণ কীভাবে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার ধারণা দিতে পারে, তার তত্ত্ব দেন। আদর্শ ব্ল্যাকবডি থেকে সিএমবিআর (CMBR)-এর সামান্য যে পরিবর্তন ধরা পড়ে, তাদের নামে সেটার নামকরণ হয়েছে সুনায়েভ-জেলডোভিচ ইফেক্ট। মাইক্রোয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন ও দূরের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ এই দুই তত্ত্বেরই প্রমাণ দিয়েছে। চিবিসভ ও জেলডোভিচ ইতিমধ্যে মারা যাওয়ায় মুখানভ ও সুনায়েভ একসঙ্গে পেতে পারেন এবারের নোবেল পুরস্কার।

কসমোলজিক্যাল অবজারভেশন প্রজেক্ট WMAP:  চার্লস এল বেনেট, লাইম্যান এ পেজ জুনিয়র, ডেভিড স্পার্গেল

আধুনিক কসমোলজির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবজার্ভেশন স্যাটেলাইট ছিল উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব (WMAP)। বিগ ব্যাংয়ের পরে মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো যে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছে, তার নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMBR), বাংলায় বলা হয় মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। এটির আবিষ্কার ছিল বিগ ব্যাংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। WMAP স্যাটেলাইটের কাজ ছিল মহাবিশ্বের সিএমবি রেডিয়েশনের নিখুঁত ম্যাপিং করা যেন মোটামুটি সমান উজ্জ্বলতার মাঝে ছোট ছোট পার্থক্য খুজে পাওয়া যায়। এই কমবেশি উজ্জ্বল অংশগুলোর আকারের ওপর নির্ভর করবে মহাবিশ্বের মডেল কেমন হবে সেটা—যে কাজটি অনেক সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব হয়। এক কথায় বলা যায়, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল (ল্যামডা-সিডিএম মডেল) প্রমাণিত হয়েছে WMAP স্যাটেলাইটের উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে। WMAP স্যাটেলাইটে অবদানের জন্য ২০১৮ সালের ব্রেকথ্রু প্রাইজ ও ২০১০ সালের শ প্রাইজ পেয়েছিলেন বেনেট, পেজ ও স্পার্গেল। এছাড়া বেনেট ও পেজ আলাদাভাবে গ্রুবার প্রাইজ এবং বেনেট ২০১৭ সালে নিউটন মেডেলও পেয়েছেন।

লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, প্যারিস অবজারভেটরি