আইনস্টাইনের আলোর বাক্স

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে আইনকে সব সময় এক হাত নিতে চেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এ জন্য একের পর এক যুক্তি খাড়া করেছিলেন। প্রতিবারই পাল্টা যুক্তি দিয়ে আইনস্টাইনকে ধরাশায়ী করেছিলেন নীলস বোর আর তাঁর শিষ্যরা। বোরবাহিনীর বিপক্ষে আইনস্টাইনের সর্বশেষ আঘাত ছিল কল্পিত ফোটন বাক্স এক্সপেরিমেন্ট। তা নিয়েই মজার এই বৈজ্ঞানিক আখ্যান...

প্রতীকী ছবি

শত যুক্তিতেও ‘তালগাছ আমার’ বলে যাঁরা গোঁ ধরে বসে থাকেন, তাঁদের পেছনে যুক্তি আর সময় ব্যয় করা কেবল শক্তিক্ষয়। বিজ্ঞানজগতেও এ ধরনের গোঁ ধরা যে ক্ষতির কারণ, তার প্রমাণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি। কিন্তু আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে গোটা বোর বাহিনী সময় ও শক্তি ক্ষয় করেছিল ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ফাঁকফোকর বুজিয়ে একে আরও শাণিত করে তুলতেও সক্ষম হয়েছিল তারা। আইনস্টাইন বরাবরই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, বারবারই তাঁর কপালে এঁকেছেন পরাজয়ের তিলক, তবু তিনি দমে যাননি। আবার হাজির হয়েছেন নতুন শক্তি সংগ্রহ করে, নতুন কোনো যুক্তি ও থট এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে। তাতে প্রথমে বোর-হাইজেনবার্গরা একটু হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু কক্ষচ্যুত হননি, পাল্টা যুক্তি আর বিশ্লেষণে নিজেদের শাণিত করে জবাব দিয়েছেন আইনস্টাইনকে। এভাবে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর আঘাতে আঘাতে আরও খাঁটি হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের সর্বকালের সফল তত্ত্বটি।

শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল নামের থট এক্সপেরিমেন্টটা ছিল বোর বাহিনীর ওপর প্রথম আঘাত। কিন্তু কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে বোর-হাইজেনবার্গরা দেখিয়েছেন, যত অদ্ভুতুড়েই হোক, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগৎটা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে বা হচ্ছে। সুতরাং, মানতেই হবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আইন। শুধু তা–ই নয়, বোর বাহিনী আইনস্টাইনের ছোড়া প্রশ্নগুলোরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সুতরাং, আইনস্টাইন হার স্বীকার করতে বাধ্য হন। কিন্তু সেটা ছিল ওপরে ওপরে। ভেতরে–ভেতরে তিনি অটল ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে। আর খুঁজছিলেন নতুন কোনো ফাঁকফোকর।

দুই

১৯৩০ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপর আইনস্টাইন হানেন দ্বিতীয় আঘাত। মোক্ষম। আরেকটা থট এক্সপেরিমেন্ট করে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনিশ্চয়তার ভিতটাকে। বোরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। একটু যেন দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ভাবতে হবে আরও ভালো করে। আইনস্টাইনের নতুন এই থট এক্সপেরিমেন্ট যদি সত্যি হয়, তাহলে মিথ্যা হয়ে যাবে অনিশ্চয়তার তত্ত্ব। ভেঙে পড়বে তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর সাধের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কাঠামো।

সেই বছর ষষ্ঠ সলভে সম্মেলন বসেছিল ব্রাসেলসে। আগের বছর কোপেনহেগেনে ধরাশায়ী আইনস্টাইন সবার সামনে হাজির করলেন তাঁর নতুন থট এক্সপেরিমেন্ট। আইনস্টাইন হাজির করেছিলেন এক অদ্ভুত বাক্স। যার ভেতরে থাকবে একটি ঘড়ি, আর বক্সভর্তি ফোটন। নিচে থাকবে একটি স্প্রিংয়ের ওয়েট বাক্স।

আইনস্টাইন বললেন, ঘড়ি আর সব ফোটনসহ বাক্সটা ওজন করতে হবে। তারপর মাপতে হবে সেটার ভর। বাক্সে থাকবে একটা ছিদ্র, থাকবে একটা শাটার। শাটারটা নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকবে একটি সুইচ। খুব দ্রুত সেটি কাজ করে। আর ছিদ্রটা খুব সরু। কোনো এক মুহূর্তে একটাই ফোটন বেরিয়ে যেতে পারবে সেই ছিদ্র দিয়ে। ছিদ্রের শাটারের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ঘড়ির মেকানিজম। একটি ফোটন যখন ছিদ্র দিয়ে বের হবে, সেই মুহূর্তটা গণনা করবে ঘড়িটা। নিখুঁত সময়। এরপর আবার মাপা হবে বাক্সের ভর। একটি ফোটন যেহেতু বেরিয়ে গেছে, সুতরাং কমে যাবে বাক্সের ভর। কীভাবে? স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ফোটন ভরহীন। তাই একটি ফোটন বেরিয়ে গেলে ভরের কোনো নড়চড় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটা যখন থট এক্সপেরিমেন্ট, আর কাজ হচ্ছে কণাজগৎ নিয়ে, তাই ভরশক্তির সমীকরণ E=mc2, যেটা আইনস্টাইনের অমর কীর্তি, সেটিতে তিনি বলেছিলেন, ভরকে শক্তিতে পরিণত করা যায়। তেমনি উল্টো প্রক্রিয়ায় শক্তিকেও ভরে পরিণত করা সম্ভব। তাই আইনস্টাইন বললেন, ফোটন বেরিয়ে যাওয়ার পর কমে যাবে বাক্সের ভর। আগের ভর থেকে পরের ভরটা বাদ দিলেই আমরা পেয়ে যাব ফোটনের ভর বা শক্তি।

জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলে, কোনো কণার ভরবেগ এবং অবস্থান একই সঙ্গে নির্ণয় করা অসম্ভব। তেমনি আরও বলে, কোনো কোয়ান্টাম কণার শক্তি ও সময় একই সঙ্গে পরিমাপ করা অসম্ভব। কিন্তু আইনস্টাইনের নতুন এই থট এক্সপেরিমেন্ট বলছে ভিন্ন কথা। ভর মাপার যন্ত্রটা লাগানো আছে বাক্সের সঙ্গেই। তাই প্রতিমুহূর্তের ভর ওটা মেপে দেখাচ্ছে। কিন্তু ঘড়িটাও এমনভাবে রয়েছে যে মুহূর্তের ফোটনটা ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তের সময় জানিয়ে দিচ্ছে। আবার ঠিক সেই মুহূর্তে ফেলতে পারছে ফোটনের ভর বা শক্তি।

তিন

আইনস্টাইনের এই নতুন আঘাতে বোর থ মেরে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারেননি। কিন্তু অনিশ্চয়তা নীতিতে তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস। পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রতিটা প্রামাণ কথা বলছিল অনিশ্চয়তার নীতির পক্ষেই। তাই আইনস্টাইনের নতুন এই থট এক্সপেরিমেন্ট যে সম্ভব, সে কথা তিনি মানতে নারাজ। কিন্তু সঠিক কোনো যুক্তিও তো পাচ্ছিলেন না। তবে একটা না একটা ফাঁক আছে, এটা তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এখন গোয়েন্দাগিরি করে সেটিই বের করতে হবে।

সে রাতটা নির্ঘুম কাটল বোরের। সারা রাত উথালপাতাল ভাবনা। তারপর শেষ রাতে এল সেই ইউরেকা মোমেন্ট। আগেরবার শ্রোডিঙ্গার নিজের তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে আইনস্টাইনের পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু বোর বাহিনী কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে দিয়েছিল জবাব, দেখিয়েছিল শ্রোডিঙ্গার তাঁর নিজের তত্ত্বের বিপক্ষে গিয়ে কী ভুলটা করেছেন। এবার শ্রোডিঙ্গার নেই আইনস্টাইনের পক্ষে ঢাল ধরার জন্য। একাকী আইনস্টাইনকে কুপোকাত করার জন্য তাঁর তত্ত্বেরই আশ্রয় নিলেন বোর। বুমেরাংয়ের মতো সেটি গুঁড়িয়ে দিল আইনস্টাইনের নতুন থট এক্সপেরিমেন্টের সব সাজসজ্জা।

ধরা যাক, শান্ত নদী। বাতাসের তোড়ও নেই। তাই নদীর পানিও শান্ত। সেখানে একটা খুঁটিতে বাধা আছে একটা ছোট্ট ডিঙি। হঠাৎ একটা ভারী জাহাজ ছুটে গেল ডিঙিটার পাশ দিয়ে

চার

১৯১৫ সালে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এই নতুন তত্ত্ব দিয়েই ২০০ বছর ধরে রাজত্ব করা নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিউটন বলেছিলেন, ভরের কারণেই বস্তুর ওপর মহাকর্ষ বল কাজ করে। যে বস্তু যত ভারী, তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ক্ষমতা তত বেশি। আইনস্টাইন দেখালেন, মহাকর্ষীয় বল আদতে কোনো আকর্ষণ বল নয়, বস্তুর ভরও এই বলের উৎস নয়। তার বদলে আইনস্টাইন জন্ম দিলেন মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র তত্ত্বের। এ জন্য ক্ষেত্র তিনি ধার করেছিলেন ফ্যারাডে-ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্রের কাছ থেকে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে মহকর্ষীয় ক্ষেত্র। একটা ভারী বস্তু যখন নড়াচড়া করে, সেটা তখন সেই ক্ষেত্রে ঢেউ তোলে। ঢেউয়ের ধাক্কায় স্থানচ্যুত হয় ক্ষেত্রের ভেতরে থাকা অন্য কোনো বস্তু।

ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে আরেকটু সহজভাবে। ধরা যাক, শান্ত নদী। বাতাসের তোড়ও নেই। তাই নদীর পানিও শান্ত। সেখানে একটা খুঁটিতে বাধা আছে একটা ছোট্ট ডিঙি। হঠাৎ একটা ভারী জাহাজ ছুটে গেল ডিঙিটার পাশ দিয়ে। তার ফলে ঢেউ উঠল পানিতে। ঢেউয়ের ধাক্কায় তখন দুলে দুলে উঠবে ডিঙিটি; অর্থাৎ ডিঙিটি স্থানচ্যুত হবে। তবে পানির ঢেউয়ের সঙ্গে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধাক্কায় বস্তুগুলো স্থানচ্যুত হয় ঠিকই, কিন্তু ঢেউ শান্ত হলে আবার ফিরে আসে আগের অবস্থানে। পানিতে সেটা না–ও হতে পারে। এ জন্য ডিঙিগুলো বেঁধে রাখা হয়।

আইনস্টাইন নিজেই তাঁর তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণা মানতে রাজি ছিলেন না। এ জন্য সহকর্মী নাথার রোজেনকে নিয়ে রীতিমতো মহাকর্ষ তরঙ্গের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।

জেনারেল রিলেটিভিটির এই নীতিটাকেই বোর তাক করলেন আইনস্টাইনের দিকে। তিনি বললেন, ফোটনটা যে মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে বাক্স থেকে, তার নড়াচড়ায় ঢেউ উঠবে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে বা স্থান–কালে। ফলে প্রসারিত ও সংকুচিত হবে স্থান–কাল। নড়ে যাবে ঘড়ির অবস্থান। ঘড়িতে যদি সঠিক মাপ নিতে হয়, তাহলে স্থান–কালে ঢেউ তুললে চলবে না। অন্যদিকে ঘড়ির অবস্থান ফোটনের শক্তি যদি ঠিকঠাক পরিমাপ করতে চান, তখন সময় পরিমাপে অনিশ্চয়তা এসে যাবে; অর্থাৎ যে লাউ সেই কদু। আইনস্টাইনের বাক্সবোমাতেও কাজ হলো না। আরেকবার নাকাল হলেন বোরের কাছে। তবু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। একটা ফোটনের পক্ষে কি সম্ভব স্থান–কালের ওপর মহাকর্ষীয় ঢেউ তোলা। আর সেকালে আইনস্টাইন নিজেই তাঁর তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণা মানতে রাজি ছিলেন না। এ জন্য সহকর্মী নাথার রোজেনকে নিয়ে রীতিমতো মহাকর্ষ তরঙ্গের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সেই তিনিই মহাকর্ষ তরঙ্গ দিয়ে কোয়ান্টাম জগতের যুক্তি মানলেন কেন?

পাঁচ

ফোটনের পক্ষে কি সম্ভব স্থান–কালে ঢেউ তোলা? সাধারণ আপেক্ষিকতার বেশ কিছু সমাধানের একটি ছিল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষ তরঙ্গ। আইনস্টাইনের সূত্র দেখিয়েছিল, ভারী কোনো বস্তু যখন নড়াচড়া করে, তখন স্থান–কালের কিংবা মহাকর্ষ ক্ষেত্রে ঢেউ ওঠে। সে ঢেউ কতটা শক্তিশালী? একটা তথ্য জানলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বসানো হয়ে দুটি বিশাল আকৃতির যন্ত্র। এর মধ্যে বড়টির জন্য যে ইন্টারফেরোমিটার টিউব আছে, সেগুলোর একেকটির দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার। বিশাল ভরের দুটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের প্রচণ্ড সংর্ঘষে স্থান–কালে যে ঢেউ উঠেছিল, তার ফলে বেড়ে গিয়েছিল লাইগোর বাহু দুটি। সেটি মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার! যদিও সেটি বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে আসতে শক্তি হারিয়ে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে ভাববেন না, একটি ইলেকট্রন কিংবা একটি পরমাণুর পক্ষে সম্ভব স্পেস টাইমে এমন ঢেউ তোলা, যার ফলে নড়ে যাবে একটা ঘড়ির অবস্থান। হ্যাঁ, তাত্ত্বিকভাবে কিংবা গণিতের মারপ্যাঁচে হয়তো বের করে ফেলা সম্ভব একটি ইলেকট্রন স্পেস টাইমে কতটুকু ঢেউ তুলবে। কিন্তু সেটির মান এত ক্ষুদ্র, সেটি আসলে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। ফোটন ভরশূন্য কণা। তবে এর গতিশক্তি আছে। আর শক্তিকে যে ভরে পরিণত করা যায়, আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ থেকেই প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু একটা ফোটনের যে শক্তি, সেটি দিয়ে কতটুকু ভর তৈরি করা যায়।

সলভে কনফারেন্সের ফাঁকে আইনস্টাইন ও বোর
প্রাইভেটডোজেন্ট

উল্টো দিক থেকে ভাবুন। খুব সামান্য ভরকে যদি শক্তিতে পরিণত করা যায়, সেটির পরিমাণ অনেক। কারণ, ভর যখন শক্তিতে পরিণত হয়, তার সঙ্গে গুণ আলোর বেগের বর্গ। আলোর বেগটাই একটা বিশাল সংখ্যা। সেটাকে যদি বর্গ করা হয়, তাহলে দাঁড়াবে (8×108)2; অর্থাৎ 8×1016। সংখ্যাটা বিশাল, তাই অণু পরিমাণ শক্তিকে ভরে পরিণত করলে সেই ভর হবে বিশাল। কিন্তু শক্তিকে ভরে পরিণত করতে হলে ভরশক্তির সমীকরণটা একটু ঘুরিয়ে নিতে হবে। প্রাপ্ত ভর দাঁড়াবে m=e/c2। শক্তির পরিমাণ যত বেশিই হোক, সেটিকে যখন আলোর বেগের বর্গ দিয়ে ভাগ করা হচ্ছে, সেই মান খুবই ছোট হবে। একটা ফোটনের যে শক্তি, সেটাকে আলোর বর্গ দিয়ে ভাগ করলে যে ভরটা পাব, সেটি এত ক্ষুদ্র, অতটুকু ভর আসলে মহাকর্ষ ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ঢেউ তুলবে, তা না হয় আপনিই অনুমান করুন। তবে আপনার হিসাবের সুবিধার্থে আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি। চাঁদের ভর কিন্তু অতটা কম নয়। পৃথিবীর ৫০ ভাগের ১ ভাগ। তবে সেই ভরও কিন্তু অনেক—7.34767309×1022; অর্থাৎ ৭৩৪৭৬৭৩০৯০০০০০০০০০০০০ কেজি। এতটা ভর নিয়ে চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে। ফলে প্রতিনিয়ত মহাকর্ষ ক্ষেত্রে ঢেউ তৈরি হচ্ছে। সেই ঢেউয়ের পরিমাণ এতটাই কম যে লাইগোতে সেটি ধরাই পড়ছে না।

ছয়

আইনস্টাইন বিশ্বাস করুন আর না–ই করুন, বস্তুর নড়াচড়ায় যে স্থান–কালে ঢেউ ওঠে, সেটা তাত্ত্বিকভাবে সত্যি। এই সত্যি তিনি স্বীকার না করলেও পারতেন। বোরকে পাল্টা জবাব দিতে পারতেন, একটা ফোটনের শক্তি ভরে পরিণত হয়ে সেটি যে পরিমাণ ঢেউ তুলবে স্থান–কালে, তার পক্ষে সম্ভব নয় একটা ঘড়ির অবস্থানে নড়চড় করিয়ে দেওয়ার। কিন্তু আইনস্টাইন আক্ষরিক অর্থেই আটকে গেছেন নিজের তৈরি ফাঁসে। কারণ, একটি ফোটন বেরিয়ে গেলে বাক্সের ভর কমে যেতে পারে, এটা কল্পনা করাও কঠিন। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর পক্ষে এই ভাবনা সম্ভব। তাত্ত্বিক ও গাণিতিক যুক্তি আছে এর, কিন্তু বাস্তবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আর একটি অসম্ভব থট এক্সপেরিমেন্টকে নস্যাৎ করতে যে বোরও যুক্তি-তর্কের খাতিরেই ধরে নেওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ টেনে এনেছিলেন, এতে তাঁর বুদ্ধিরই প্রশংসা করতে হয়।

মোদ্দাকথা হলো, আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিরোধিতা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি কখনো গোঁড়ামিতে আটকে ছিলেন না। বরং তাঁর যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলে সেটা গ্রহণ করতে তাঁর দ্বিধা ছিল না।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: জন গ্রিবিন/ শ্রোডিঙ্গারস কিটেনস অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর রিয়েলিটি,

ইঞ্জ জার্গেন শ্মিড/ আইনস্টাইন’স ফোটন বক্স রিভাইসড

উইকিপিডিয়া

* লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট ২০২২ সংখ্যা প্রকাশিত