ম্যাটার বা পদার্থ—এ শব্দের ব্যাপকতা পদার্থবিদদের কাছে সীমাহীন। সাধারণভাবে পদার্থ বলতে বোঝানো হয় মহাবিশ্বের সব বস্তুকণাদের। শক্তিকে সাধারণত এর বাইরে ধরা হয়। তবে পদার্থবিদদের দৃষ্টিতে সব ধরনের শক্তি বা কোয়ান্টাম ফিল্ডও এ আওতায় পড়ে। সহজ করে বলতে গেলে, স্থান-কাল ছাড়া সব কিছুই পদার্থের তালিকার সদস্য। সে হিসেবে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গদেরও এক ধরনের পদার্থ বলা যেতে পারে। একই কথা খাটে ভরহীন ফোটনদের বেলায়ও। এমনকি প্রতিকণাদেরও ঠাই হতে পারে পদার্থের তালিকায়।
মহাবিশ্ব জুড়ে থাকা বিচিত্র সব পদার্থ সম্পর্কে আমাদের যে চূড়ান্ত জানাশোনা রয়েছে, তা কিন্তু নয়। উদাহরণ হিসেবে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তুর কথাই ভাবুন। মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% গঠিত হয়েছে এদের দিয়ে। অথচ এদের নিয়ে নিশ্চিতভাবে আমরা বলতে গেলে তেমন কিছুই জানি না। হয়তো এরা আসলে আমাদের পরিচিত অন্যান্য বস্তুকণাদের মতোই, কোনো রহস্যময় কারণে লুকিয়ে রয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। আবার, এরা তৈরি হতে পারে সম্পূর্ণ নতুন কিছু দিয়ে। যাদের কিনা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
যাহোক, এসব বৈচিত্রের ভীড়ে মহাবিশ্বের সব পদার্থদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এদের সবার ভর অঋণাত্মক। অর্থাৎ, হয় এদের ভরের মান হয় শূন্যের চেয়ে বেশি, নয়তো পুরো শূন্য। মহাবিশ্বের কোথাও ঋণাত্মক ভর বা শক্তির দেখা মেলে না। অবশ্য দেখা না গেলেই যে অস্তিত্ব থাকবে না, এমনটা কখনো জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকস বা সাধারণ আপেক্ষিকতার মতো পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বগুলো এদের অস্তিত্বকে নাকচ করে দেয় না মোটেও!
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে পদার্থের শক্তির ঘনত্ব বাঁকিয়ে ফেলতে পারে স্থান-কালকে। শক্তির ঘনত্ব যত বেশি হবে, তত বেশি হবে বক্রতার পরিমাণ। এই তত্ত্বের কোথাও বলা নেই, শক্তির ঘনত্বের সামনে ছোট্ট করে একটি ঋণাত্মক চিহ্ন থাকতে পারবে না। যদি সত্যি এমনটা সম্ভব হয়, তাহলে সেই স্থানকালের বক্রতার ধরন হবে খুব অদ্ভুত। কিন্তু তাতে কী? মহাবিশ্বটাই তো অদ্ভুতুড়ে জিনিসের আড্ডাখানা। আসলেই যদি ঋণাত্মক ভর বা ঋণাত্মক শক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে নিমিষেই আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের দুয়ার। ওয়ার্মহোল, ওয়ার্প ড্রাইভের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর প্রযুক্তিগুলো চলে আসবে মানুষের হাতের নাগালে। চোখের পলকেই পৌঁছানো যাবে মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে।
ক্যাসিমির ইফেক্ট
ঋণাত্মক ভর বা ঋণাত্মক শক্তির পদার্থদের খোঁজে বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেমে নেই। এরই মাঝে তারা পরীক্ষাগারে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা। ১৯৪৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক ক্যাসিমির সর্বপ্রথম এর কথা বলেন। তাঁর নাম অনুসারে এ ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছে ক্যাসিমির ইফেক্ট। ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা তৈরির জন্য খুব বেশি কাঠ-খড় পোড়াতে হয় না। প্রয়োজন পড়ে কেবল দুটি বড়-সড় আকৃতির ধাতব প্লেট। এদের পাশাপাশি এমনভাবে রাখতে হয় যেন মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানের পরিমাণ হয় খুব সামান্য। এরপর গোটা সিস্টেমকে যদি ভ্যাকুয়ামের মধ্যে রাখা হয়, তাহলেই প্লেট দুটির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে আপনা-আপনি তৈরি হবে ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা। খুব সহজ, তাই না?
এবারে চলুন, গোড়া থেকে জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে দুই প্লেটের মাঝখানের ফাঁকা স্থানে ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা তৈরি হয়। শুরুতেই ভ্যাকুয়াম সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু তথ্য জেনে নেব। ধরুন, টেবিলের ওপরে একটি মুখ বন্ধ করা খালি কাচের পাত্র রাখা আছে। আপাতদৃষ্টিতে এর মধ্যে খালি চোখে দৃশ্যমান কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। তবে দেখা না গেলেও পাত্রটি কিন্তু মোটেও খালি নয়। কারণ, এর মধ্যে থাকবে অণু-পরমাণুসহ অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব। যদি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাত্রের মধ্যে থাকা সব কণাদের সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই কেবল তৈরি হবে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, প্রকৃত ভ্যাকুয়াম তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন কেবল প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের আবির্ভাবে বদলে যায় সব হিসাব নিকাশ। অচিরেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, আক্ষরিক অর্থে ভ্যাকুয়াম তৈরি করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ, মহাবিশ্বের কোনো স্থানই সত্যিকার অর্থে খালি হতে পারে না। সর্বত্রই প্রতিনিয়ত একেবারে শূন্য থেকে ভেলকিবাজির মতো আবির্ভূত হচ্ছে অগনিত কণা ও প্রতিকণা। সেই কণাগুলো নিমিষেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এদেরকে সাধারণভাবে ভার্চ্যুয়াল কণা নামে ডাকা হয়। প্রতিনিয়ত এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার নাম দিয়েছেন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এ প্রক্রিয়ায় সব ধরনের শক্তির কণা ও প্রতিকণার আবির্ভাব হতে পারে।
এবার ফিরে আসা যাক ধাতব প্লেট দুটির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে। কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কারণে সেখানেও ক্রমাগত আবির্ভূত ও মিলিয়ে যাওয়ার কথা হরেকরকম ভার্চ্যুয়াল কণাদের। ঘটেও ঠিক তা-ই। তবে পাশাপাশি আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেখানে। ধাতব প্লেট দুটির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে সব ধরনের শক্তির কণার আবির্ভাব হতে পারে না। একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরের শক্তিবিশিষ্ট কণার আবির্ভাব ঘটে শুধু।
এমনটা হওয়ার কারণ কী? আসলে, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণার তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে। যে কণার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি, সেটির শক্তি তত কম। ধাতব প্লেটদ্বয়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানের দূরত্ব খুব কম হওয়ায় সেখানে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কণারা আবির্ভূত হতে পারে না। কেবল দেখা মেলে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কণাদের। ফলে সেখানে সামগ্রিকভাবে কমে যায় শক্তির ঘনত্ব।
এভাবে ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা তৈরি করাকে অনেকে শুভংকরের ফাঁকি মনে করতে পারেন। কারণ, আপাতদৃষ্টিতে সেখানে স্বাভাবিকের তুলনায় কম শক্তি ঘনত্বের এলাকা তৈরি হয়, ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্ব নয়। আসলে বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই ক্যাসিমির ইফেক্টের তাৎপর্য ধরা পড়ে। আমরা যদি স্বাভাবিক ভ্যাকুয়াম শক্তির ঘনত্বকে শূন্য হিসেবে ধরে নিই, তাহলে কোনো সন্দেহ ছাড়াই ক্যাসিমির ইফেক্টের মাধ্যমে পাওয়া অঞ্চলটুকুকে ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের এলাকা বলা যাবে।
লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)
সূত্র: বেঞ্জামিন ভার, বরিস লেমার ও রিনা পিকোলোর কোয়ার্কি কোয়ার্ক: এ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস অবলম্বনে