কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত জগৎ

আমাদের চারপাশের যে জগতৎ আমরা দেখি তার সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতের আকাশ-পাতাল ফারাক। চিরায়ত জগতে যা অসম্ভব, কোয়ান্টাম জগতে তা ডালভাতের মতোই বাস্তব। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা অদ্ভুত তত্ত্বের ওপর। অনিশ্চয়তা নীতি। এই নীতি অনুযায়ী ঘোর বাস্তবতা বলে কিছু নেই খুদে কণিকাদের জগতে। পর্যবেক্ষণই এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আসল বাস্তবতা। এই জগতের পরিচিত কিছু নিয়ম বা নীতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি

দ্বি-চির পরীক্ষা ও কণা-তরঙ্গের বহু রূপ

একটি দেয়ালে দুটি ছিদ্র আছে। দেয়ালের অপর পাশে আছে একটি পর্দা। এখন দেয়ালে আলো ফেললে দুই ছিদ্র দিয়ে আসা আলো পর্দায় আলো-ছায়ার একটি নকশা তৈরি করবে। জানা কথা। কোথাও খুব অন্ধকার, কোথাও খুব উজ্জ্বল। কোথাও এর মাঝামাঝি অবস্থা। এখন কথা হলো, আলোর বদলে ইলেকট্রন নিক্ষেপ করলে কী হবে? পর্দার শুধু ছিদ্র বরাবর স্থানেই ইলেকট্রনের ধাক্কার রেশ থাকার কথা। কিন্তু না, এবারও নকশা পাওয়া গেল। আরও অদ্ভুত কথা হলো, একঝাঁক ইলেকট্রনের বদলে যদি একটি মাত্র ইলেকট্রনও নিক্ষেপ করা হয়, তবুও পাওয়া যায় নকশা। তার মানে ইলেকট্রনটি একই সঙ্গে দুটো ছিদ্র দিয়েই যাচ্ছে! ঠিক তাই। সেটা সম্ভব হচ্ছে কণাটির তরঙ্গধর্মী আচরণের জন্য। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায়, কণারাও তরঙ্গের মতো আচরণ করতে পারে। থমাস ইয়ং ১৮০১ সালে প্রথম পরীক্ষাটি করেন। তবে সে সময় এর মূল গুরুত্ব বোঝা যায়নি। পরে ১৯২৪ সালে ডি ব্রগলি প্রমাণ করেন, সব জড় পদার্থ তরঙ্গের মতো আচরণ করতে পারে।

কোয়ান্টামের অদ্ভুত জগৎ

অনিশ্চয়তা নীতি

হাইজেনবার্গের এই নীতি অনুসারে কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে নিখুঁত করে মাপা যাবে না। এ দুটো বৈশিষ্ট্যের একটি যত ভালোভাবে পরিমাপ করার চেষ্টা করা হবে, অপরটি হয়ে পড়বে ততই অনিশ্চিত। সাধারণভাবে কণার অবস্থান ও বেগের কথা বলা হলেও আরও অনেকগুলো বিজড়িত রাশির জন্য এ নীতিটি প্রযোজ্য। যেমন কণার শক্তি ও স্থায়িত্ব, বিভিন্ন অক্ষের দিকে ঘূর্ণন, কোনো ক্ষেত্রের শক্তি ও তার পরিবর্তন ইত্যাদি।

কোনো কণার অবস্থান বা বেগ জানার জন্য কণাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। আর এর জন্য আলো ফেলতে হয় কণাটির ওপরে। কিন্তু কণার আকার যেহেতু ছোট, তাই এর অবস্থান নিখুঁতভাবে জানতে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো দরকার। কারণ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিমাণের চেয়ে সূক্ষ্ম করে কণার অবস্থান জানা যায় না। এখন ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য মানে উচ্চ কম্পাঙ্ক। উচ্চ কম্পাঙ্ক মানে উচ্চ শক্তি। তার মানে সূক্ষ্ম অবস্থান জানতে হলে বেশি শক্তির আলো ফেলতে হবে। কিন্তু বেশি শক্তির এই আলো কণাটিকে অনেক বেশি উত্তেজিত করবে। ফলে এর অবস্থান জানা গেলেও বেগ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। আবার বেগের অনিশ্চয়তা কমিয়ে অর্ধেক করতে চাইলে অবস্থানের অনিশ্চয়তা হয়ে যাবে দ্বিগুণ।

কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট

আইনস্টাইন ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট আ ডিসটেন্স’ বা ‘দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড’। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টাম বিজড়ন প্রক্রিয়ার উদ্ভট ফলাফল নিয়েই তাঁর এই বক্তব্য।

কথাটার মানে হলো, দুটি বিজড়িত কণা অনেক দূরে অবস্থান করেও পরস্পর নির্ভরশীল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে। একে অপর থেকে যত দূরেই থাকুক, একের অবস্থান, ভরবেগ, ঘূর্ণন ইত্যাদি পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভর করে। হোক তারা শত শত কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। মনে করুন, কোনো স্ফটিক থেকে একটি লেজার রশ্মি নিক্ষিপ্ত হলো, যা একটি মাত্র ফোটন কণাকে ভেঙে দুটো বিজড়িত কণায় পরিণত করতে পারে। এখন দুটো ফোটন যদি দুই দিকে রওনা হয়ে যায়, পৌঁছে যায় লাখ-কোটি আলোকবর্ষ দূরেও, তবু একটির যেকোনো বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা মাত্রই অপরটির বৈশিষ্ট্য জানা যাবে। যেমন একটি যদি স্পিন-আপ কণা হয়, তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে, অপরটি হলো স্পিন-ডাউন কণা। যদি জানা যায়, একটি ঘুরছে ঘড়ির কাঁটার দিকে, তবে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেওয়া যাবে, অপরটি ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে। তাদের দূরত্ব ১ সেন্টিমিটার হোক কিংবা তারা মহাবিশ্বের দুই আলাদা প্রান্তেই থাকুক সেটা বিবেচ্য নয়। এখানেই আইনস্টাইনের ঘোর আপত্তি। তাঁর মতে, একটি কণার কিছু ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া তাত্ক্ষণিকভাবে অন্যটির ওপর পড়তে পারে না।

কারণ, (আপাতদৃষ্টিতে) লঙ্ঘিত হচ্ছে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অন্যতম একটি নীতি। কোনো তথ্যই আলোর চেয়ে বেশি বেগে যেতে পারে না। কিন্তু ১৯৬৪ সালে পদার্থবিদ জন বেল তাঁর ‘বেল অসমতা’র মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কণারা এমন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত আচরণ করতে পারে। যদিও তারা থাকে বহু বহু দূর। যে দূরত্বে আলোর চেয়ে দ্রুত কোনো তথ্য পৌঁছাতে পারার কোনো কথা নয়। এ ছাড়া প্রমাণ করেন, এমন ঘটনা ঘটতে কোনো সময়ই লাগে না। ফলে দূরত্ব কোনো প্রভাবই রাখতে পারে না এ ক্ষেত্রে। আসলে কোয়ান্টাম বিজড়ন আপেক্ষিকতা নীতির বিরুদ্ধে যায় না। কারণ, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কোনো স্থান থেকে অন্য স্থানে আলোর চেয়ে দ্রুত তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। আর কোয়ান্টাম বিজড়ন প্রক্রিয়ায় তথ্য প্রেরণ করা হয় না। এ কৌশল কাজে লাগিয়ে ঠিক আলোর চেয়ে দ্রুত তথ্য প্রেরণের কাজ সম্ভব নয়। পরবর্তী সময়ে অসংখ্য পরীক্ষায় বেল অসমতার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

থমাস ইয়ংয়ের পরীক্ষার নীতি ব্যবহার করে ইলেক্ট্রনের জন্য দ্বি-চির বা ডাবল স্লিট পরীক্ষা

কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন

এটি অনিশ্চয়তা নীতিরই একটি ফল। আগেই বলেছি, এই নীতির একটি উদাহরণ হলো কোনো ক্ষেত্রের শক্তি ও তার পরিবর্তন। আমরা যাকে শূন্যস্থান বলি, অর্থাৎ যেখানে কোনো পদার্থের অস্তিত্ব নেই, সেটাও আসলে ঠিক শূন্য নয়। অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে ক্ষেত্রের শক্তির মান ও তার পরিবর্তন একই সঙ্গে সঠিক করে জানা যাবে না। তার মানে, শূন্যস্থানের কোনো ক্ষেত্রের মান ও পরিবর্তনের হার একই সঙ্গে শূন্য হওয়া সম্ভব নয়। দুটোই শূন্য হওয়া মানে তো একই সঙ্গে দুটোই নিখুঁতভাবে জানা হয়ে গেল, যা অসম্ভব। ফলে, আমরা যাকে শূন্যস্থান বলি সেখানেও অবিরত তৈরি হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায় কণা। এগুলোকে বলা হয় ভার্চ্যুয়াল কণা। আর এ প্রক্রিয়ার নামই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। একসঙ্গে তৈরি হয় এক জোড়া বিপরীত চার্জের কণা। সৃষ্টির পরমুহূর্তে আবার এরা একে অপরকে বিলীন করে দেয় পল ডিরাকের আবিষ্কৃত কণা-প্রতিকণার ধর্ম অনুসারে।

আইনস্টাইন বলতেন, ‘তাহলে আমরা যখন তাকিয়ে থাকি না, তখন কি আকাশে চাঁদ থাকে না?’ কথাটা চাঁদের জন্য সত্য না হলেও অতিপারমাণবিক জগতে কিন্তু সত্য।

কোয়ান্টাম টানেলিং

চলতে চলতে আপনার সামনে যদি একটি পুরু দেয়াল এসে যায়, তাহলে আপনার যাত্রা ওখানেই শেষ। কিন্তু অতিপারমাণবিক কণারা আপনার মতো হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একটি প্রতিবন্ধকের পেছনে আটকা পড়া কোনো কণিকাকেও প্রতিবন্ধকের অপর পাশে দেখা যাবে তার একটি অশূন্য সম্ভাবনা রয়েছে। এটাও কণা-তরঙ্গের দ্বৈত আচরণের ফল। কণার জন্য কাজটি যত কঠিন, তরঙ্গের জন্য ততটা নয়। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এই উপায়েই। নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে পড়ে আলফা কণা। কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের কারণেই সূর্য থেকে তাপ বেরিয়ে আসে।

পরিমাপের আগে অস্তিত্বহীন?

আইনস্টাইন বলতেন, ‘তাহলে আমরা যখন তাকিয়ে থাকি না, তখন কি আকাশে চাঁদ থাকে না?’ কথাটা চাঁদের জন্য সত্য না হলেও অতিপারমাণবিক জগতে কিন্তু সত্য। পর্যবেক্ষণের আগ পর্যন্ত কণার অস্তিত্বই থাকে না। ২০১৫ সালে নতুন আরেকটি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এ কথা। অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ অ্যান্ড্রু ট্রাসকট নতুন করে এর প্রমাণ দেন। তিনি বলেন, ‘পরিমাপই সবকিছু। না তাকানো পর্যন্ত কোয়ান্টাম স্তরে বাস্তবতা বলতে কিছুই নেই।’ তাঁর দল পরীক্ষাটি চালান হিলিয়াম পরমাণু দিয়ে।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় একই বস্তু একই সঙ্গে একাধিক স্থানে থাকতে পারে। ব্যাপারটা সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।

ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞায়নের নামই ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা। ভৌত বস্তুর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় এটি এক অভিনব উপায়ের আশ্রয় নেয়। কণার ভৌত ধর্মকে এখানে প্রকাশ করা হয় ম্যাট্রিক্সের সাহায্যে। যে ম্যাট্রিক্সের উপাদানগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। উল্লেখ্য, গণিতের ভাষায় আয়তাকার করে কলাম ও সারিতে সাজানো একগুচ্ছ সংখ্যা বা প্রতীককে বলে ম্যাট্রিক্স। তত্ত্বটির আবির্ভাব ঘটে তিনজন বিজ্ঞানীর হাত ধরে—হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন ও প্যাসকাল জর্ডান। এই তত্ত্বেও কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ১৯২৬ সালে পাউলি হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালির বিবরণ দেন।

মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় একই বস্তু একই সঙ্গে একাধিক স্থানে থাকতে পারে। ব্যাপারটা সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। উপরন্তু কোনো কিছুকেই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। কোনো ঘটনা ঘটবে কি ঘটবে না, তা বলা যায় না, বলা যায় শুধু সম্ভাবনাটুকু। তবে কোয়ান্টাম মেকানিকসে এ ঘটনারই সহজ একটি সমাধানও আছে। সমাধানটি দিয়েছেন হিউগ এভারেট। ধরুন, আপনি একটি কয়েন টস করলেন। তাহলে আপনি তো আর একই সঙ্গে হেড ও টেইল পাবেন না। ধরুন, আপনি হেড পেলেন। তাহলে আরেক মহাবিশ্বেও আপনার মতোই আরেকজন আসলে টেইল পেয়েছেন। এভাবে প্রতিমুহূর্তে অপর এক মহাবিশ্বেও আরেকজন করে যাচ্ছে আপনার না-করা কাজ! কখনো হয়তো আপনি সফল হচ্ছেন। কখনো বা হেরে যাচ্ছেন অচেনা-অজানা এক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে!

সূত্র: আ ব্রিফার  হিস্ট্রি অব টাইম: স্টিফেন হকিং, এফন্যাল ডট জিওভি, ইউঅরিজন ডট এজু, ডিসকভার ম্যাগাজিন, নিউ অ্যাটলাস ডট কম, উইকিপিডিয়া

* লেখাটি ২০১৮ সালে জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত