ইথার, আপেক্ষিকতা এবং আইনস্টাইন 

প্রতীকী ছবি

চন্দ্রবিজয়ী অ্যাপোলো ১১-এর অভিযাত্রী মাইকেল কলিন্সকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি চাঁদে যাওয়ার সুযোগ কীভাবে পেলেন?’ কলিন্সের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় জন্ম নেওয়া।’ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ইতিহাসেও কলিন্সের উক্তিটা বেশ মানানসই। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্মের প্রেক্ষাপট খেয়াল করলে মনে হয়, রঙ্গমঞ্চ সাজানো-গোছানোই ছিল, অপেক্ষা ছিল শুধু একজন মহানায়কের আবির্ভাবের। তা সে নায়ক ঠিক সময়মতোই এসেছিলেন রঙ্গমঞ্চে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরো টুকরো ধাঁধা একত্রে যোগ করে সমাধান করেছিলেন জিগস পাজলের মতো গভীর এক রহস্যের। সেই মহানায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। 

আইনস্টাইনের মহানায়ক হয়ে ওঠার পেছনে উনিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকের শেষদিকে পদার্থবিদ্যার সবকিছু আবিষ্কারের একদম শেষপ্রান্তে বলে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল বিজ্ঞানীদের। শুধু মাপজোখ আরও সূক্ষ্ণ করার কাজটাই বাকি বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। এমনকি পদার্থবিদ্যার ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে করে খোদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে এ বিষয়ে পড়ালেখা করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন তাঁর এক শিক্ষক। তাঁর কথামতো প্ল্যাঙ্ক পদার্থবিজ্ঞানে না পড়লে আজ কোয়ান্টাম তত্ত্বেরই হয়তো জন্মই হতো না, নয়তো জন্মকাল অনেকখানি পিছিয়ে যেত তত্ত্বটির।

আসলে সেকালে নিউটনের বলবিদ্যা আর ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎচুম্বকীয় সমীকরণ দিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রায় সবকিছু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। তাই নতুন কিছু আবিষ্কারের আর প্রয়োজন মনে করেননি বিজ্ঞানীরা। ঠিক এ সময়ে নতুন কিছু সমস্যার মুখে পড়ল পদার্থবিজ্ঞান। এর একটি ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত সমস্যা। আরেকটি সমস্যা ছিল ইথারবিষয়ক। অথচ এ দুটি রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে এল। চোখের সামনে থেকে পাল্টে গেল আমাদের চিরচেনা পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ।  

এখানে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সমস্যাটি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। শুধু ইথার সংক্রান্ত সমস্যাটির কথাই বলা হবে। ইথার সমস্যার শুরু হয়েছিল আলোর কারণে। সতেরো শতকে আলোকে কণা হিসেবে ব্যাখ্যা করে ভালো ফল পান আইজ্যাক নিউটন। তাঁর খ্যাতির মতোই কণা তত্ত্বও ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী হয়ে উঠে। প্রায় সমসাময়িক বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস আলোকে তরঙ্গ হিসেবে প্রমাণ করলেও তা তেমন গুরুত্ব পায়নি। উনিশ শতকের শুরুতে আলোকে আবারও তরঙ্গ হিসেবে প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী টমাস ইয়াং।

টমাস ইয়াং
ছবি: উইকিপিডিয়া
নিউটনের বলবিদ্যা সব পদার্থবিদকে এই প্রশ্ন করতে শিক্ষা দেয়: কোনো কিছু কার সাপেক্ষে গতিশীল? সে হিসেবে নিউটনীয় গতিবিদ্যায় আলো ছিল আপেক্ষিক বেগের।

ওই শতকের মাঝামাঝি তরঙ্গ তত্ত্ব সমর্থন করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। ১৮৬৩ সালের দিকে ৮টি সমীকরণে (পরে ৪টিতে সংক্ষেপ করা হয়)  বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ধর্মগুলো বর্ণনা করেন তিনি। গতিশীল বা পরিবর্তনশীল বৈদ্যুতিক বলক্ষেত্র কীভাবে চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে এবং গতিশীল চুম্বকীয় বলক্ষেত্র কীভাবে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে—তা দেখানো হয় এসব সমীকরণে। সমীকরণগুলো থেকে অদ্ভুত এক ব্যাপার খেয়াল করেন ম্যাক্সওয়েলে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বেগ নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি দেখেন, এর গতি আর আলোর গতি হুবহু এক। তাতে তাঁর মনে হলো, আলোও এক প্রকার বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। দেখা গেল, শূন্যস্থানে আলো ধ্রুব বেগে চলাচল করে। আর এই বেগ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার (এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল)। এভাবেই বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব ও আলোকে একসূত্রে বাঁধতে সক্ষম হন ম্যাক্সওয়েল। 

এতে নতুন এক প্রশ্নেরও উদয় হলো। তরঙ্গ চলার জন্য মাধ্যমের দরকার। যেমন: শব্দ বাতাসে চলমান তরঙ্গ, মহাসাগর বা পুকুরের ঢেউ পানিতে চলমান তরঙ্গ। প্রশ্ন উঠল: আলো যদি তরঙ্গই হয়, তাহলে এটা কীসের মধ্যে দিয়ে চলে? সে উত্তর যোগাতে পদার্থবিজ্ঞানীরা একসময় একমত হলেন যে বোধহয় এ ক্ষেত্রেও কোনো বাহক আছে। কিন্তু সেটি কী? সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না। বিজ্ঞানীরা রহস্যময় এই বাহকের নাম দিলেন ইথার। বলা যায়, সেটা ছিল জোড়াতালি দেওয়া একটা সমাধান। ইথার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বললেন, এটি বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ চলাচলে সহায়তা করে।

‘ইথার’ নামের এক মাধ্যম দিয়ে স্পেস বা স্থান পরিপূর্ণ বলে কল্পনা করা হলো। শব্দ যেমন বাতাসের মধ্যে চাপতরঙ্গ, তেমনি আলোক রশ্মি ও বেতার সংকেত হল ইথারের মধ্যে একটি তরঙ্গ। ইথারকে চরম দৃঢ় কোনো মাধ্যম হিসেবে ধরে নেওয়া হলো। গ্রহ-নক্ষত্ররা কোনো বাধা ছাড়াও এর মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে পারে। কিন্তু ইথারকে সহজে সনাক্ত করার কোনো উপায় জানতেন না বিজ্ঞানীরা। তাই ধারণা করা হলো, ইথারের কোনো ভর নেই, সান্দ্রতা নেই (বা কোনো চটচটে ভাবও থাকবে না)। একে চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায় না। আবার সব ধরনের বিকিরণের জন্য এটি পুরোপুরি স্বচ্ছ। নইলে এর ভেতর দিয়ে তো আকাশের কোনো কিছুই দেখা যাওয়ার কথা নয়। এরকম পরস্পরবিরোধী গুণ ছাড়া নিউটনের পরম স্থান ও পরম কালের ধারণাগুলো যৌক্তিক করা যাচ্ছিল না। 

নিউটনের বলবিদ্যা সব পদার্থবিদকে এই প্রশ্ন করতে শিক্ষা দেয়: কোনো কিছু কার সাপেক্ষে গতিশীল? সে হিসেবে নিউটনীয় গতিবিদ্যায় আলো ছিল আপেক্ষিক বেগের। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে আলোর বেগ পাওয়া গেল ধ্রুব বা পরম। ফলে নতুন সমস্যা হাজির হলো পদার্থবিদদের সামনে। দেখা গেল, ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব নিউটনের গতিবিদ্যার সঙ্গে খাপ খায় না। কারণ স্থির থাকা এবং সমবেগে চলা দুজন পর্যবেক্ষকের কাছে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের রূপ আলাদা হবে। ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্র তত্ত্বে নিউটনের বলবিদ্যা প্রয়োগ করলে দেখা যায়, ইথার সাপেক্ষে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল মেপে স্থির অবস্থা আর সমবেগে চলা অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করা যাবে। এমনকি তাত্ত্বিকভাবে আলোর গতি স্থির হয়ে যাওয়াও সম্ভব। কিন্তু সাধারণ কিছু পরীক্ষায় বোঝা যায়, তা অসম্ভব ব্যাপার। 

আইজ্যাক নিউটন
ছবি: উইকিপিডিয়া

নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের এই দ্বন্দ্ব সে কালে বিজ্ঞানীদের অস্বস্তির কারণ ছিল। কারণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে তত্ত্ব দুটি ছিল সফল। বলবিদ্যা সংক্রান্ত সব ক্ষেত্রে নিউটনের তত্ত্ব ছিল অব্যর্থ, তেমনি বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দাওয়াই ছিল ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব। তাহলে কি ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ, নাকি নিউটনের বলবিদ্যা সংশোধন করা প্রয়োজন? 

ওই শতাব্দীর শেষদিকে ইথার মতবাদের আরও কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়তে শুরু করল। তখন আশা করা হলো, ইথারের ভেতর দিয়ে আলোর একটি নির্দিষ্ট বেগে চলা উচিত। কিন্তু যদি ইথারের ভেতর দিয়ে আলোর দিকে চলা হয়, তাহলে যুক্তি অনুযায়ী আলোর গতি কম পাওয়ার কথা। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, এভাবে আলোর সমান বেগে চললে আলোকে স্থির দেখা উচিত। আবার আলোর বিপরীত দিকে চললে আলোর গতি বেশি পাওয়ার কথা। কিন্তু বেশ কিছু পরীক্ষা ইথারের এই ধারণার সঙ্গে মেলানো গেল না।

এরকম একটি পরীক্ষা চালান আলবার্ট মাইকেলসন এবং এডওয়ার্ড মর্লি। ১৮৮৭ সালে এক ইন্টারেফেরোমিটার ব্যবহার করে যথেষ্ট নিখুঁতভাবে এ পরীক্ষাগুলো চালান এই দুই বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওর ক্লেভল্যান্ডে কেজ স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে চালানো এসব পরীক্ষায় পরস্পর সমকোণে দুটি আলোকরশ্মির আলোর বেগ তুলনা করেছিলেন তাঁরা। পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর এবং একইসঙ্গে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। কাজেই এই যন্ত্রগুলো ইথারের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন বেগ ও দিকে চলাফেরা করবে বলে মনে করা হয়েছিল। পৃথিবী পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘোরে। তাই নিউটনের তত্ত্ব মতে, ইথারের সাপেক্ষে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আলোর বেগ বেশি পাওয়ার কথা। অন্যদিকে উল্টোদিকে, মানে পশ্চিম থেকে পূর্বে কমে যাওয়া উচিত। আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে আলো ঘুরে আসতে পূর্ব-পশ্চিমের তুলনায় কম সময় লাগার কথা।

বেশ কয়েকবার পরীক্ষাটি চালান মাইকেলসন ও মর্লি। ফলাফল দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল তাঁদের। অবাক হয়ে দেখতে পেলেন, আলোর ওই দুটি রশ্মির মধ্যে কোনো দিকেই পুরো বছর বা দিনের কোনও সময়েই এ ধরনের কোনো পাথর্ক্য পাওয়া যাচ্ছে না। দুক্ষেত্রেই আলোর পথটুকু পাড়ি দিতে একই সময় লাগছে। ফলাফল দেখে মনে হলো, আলো যেন যেকোনো দর্শক সাপেক্ষে সব সময় একই বেগে চলাফেরা করছে। সোজা কথায়, কোনো দর্শক কত জোরে ছুটছে কিংবা কোন দিকে চলছে, তার তোয়াক্কাই করছে না আলো। এর মানে কী? তাহলে কি ইথার বলে কিছু নেই? নাকি এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

এ সময় দৃশ্যপটে এলেন আইরিশ পদার্থবিদ জর্জ ফিটজেরাল্ড এবং ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক লরেঞ্জ। মাইকেলসন-মর্লির এই পরীক্ষার পর ইথারকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগলেন এই দুই বিজ্ঞানী। তাঁরা যথাক্রমে ১৮৮৯ ও ১৮৯২ সালে বললেন, ইথারের ভেতর দিয়ে চলার সময় বিভিন্ন বস্তু সংকুচিত হবে এবং তাতে ঘড়িও চলবে ধীরে। এই সংকোচন ও ঘড়ির ধীর গতি এমন হবে যে, আলোর গতি মাপলে সব সময় একই পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে ইথারের সাপেক্ষে তাদের গতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

ফিটজেরাল্ড ও লরেঞ্জের এ কথার মানে হলো, মাইকেলসন-মর্লি ইথারের সাপেক্ষে আলোর গতি মাপতে যে যন্ত্র ব্যবহার করেছেন, তা গতিপথের দিক বরাবর সংকুচিত হয়ে গেছে। আর এই সংকোচনের পরিমাণ ও আলোর গতিবেগ কমে যাওয়ার পরিমাণ এক। সে কারণেই দুটি ফলাফল পরস্পরকে বাতিল করায় ওই যন্ত্রে কোনো প্রভাব ধরা পড়েনি।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত ইথার তত্ত্বকে বাঁচাতে পারেননি ফিটজেরাল্ড আর লরেঞ্জ। কারণ এর চেয়েও আরও যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাখ্যা ছিল। সেই অসাধারণ ব্যাখ্যাটি দিলেন ২৬ বছর বয়সী এক যুবক। তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন।

মাইকেলসন ও মর্লি
ছবি: উইকিপিডিয়া
জার্মানিতে আইনস্টাইনের বাবার ব্যবসা ব্যর্থ হয়। তাই ১৮৯৪ সালে তাঁদের পরিবার চলে যায় ইতালির মিলানে। নতুন সুযোগের আশায়।

২. 

মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার প্রায় এক দশক পর অদ্ভুত এক ভাবনা এসেছিল জার্মান এক কিশোরের মনে। ১৬ বছরের সেই কিশোর প্রশ্ন করেছিল, আলোর পিঠে কখনো যদি চড়ে বসা যায়, তাহলে কী ঘটবে? এই উদ্ভট ভাবনার কারণে সত্যিকারের সমাধান পাওয়া গেল ইথার রহস্যের। সেই কিশোরটির নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। 

আইনস্টাইন জন্ম ১৮৭৯ সালে, জার্মানির উলম শহরে। তার পরের বছর মিউনিখ শহরে চলে যায় তাঁর পরিবার। ওই শহরে ছোটখাটো বৈদ্যুতিক পণ্যের ব্যবসা চালু করেন তাঁর বাবা হারমান আর কাকা জ্যাকব। তবে তা তেমন সফলতার মুখ দেখেনি। আইনস্টাইন বিস্ময়বালক ছিলেন না। তাঁর প্রতিভা বা মেধাও বালক বয়সে বোঝা যায়নি। তবে তিনি স্কুলে একেবারেই খারাপ ছাত্রও ছিলেন না। তাঁকে খারাপ ছাত্র বলে যেসব দাবি করা হয়, সেগুলো আসলে অতিরঞ্জিত।

জার্মানিতে আইনস্টাইনের বাবার ব্যবসা ব্যর্থ হয়। তাই ১৮৯৪ সালে তাঁদের পরিবার চলে যায় ইতালির মিলানে। নতুন সুযোগের আশায়। কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্তে মিউনিখেই রয়ে যান আইনস্টাইন। স্কুল শেষ না করা পর্যন্ত আইনস্টাইনের ওই শহরে থেকে যাওয়া স্থির হয়। স্কুলের স্বেচ্ছাচারি আর কড়া নিয়মকানুন মোটেও পছন্দ ছিল না তাঁর। তাই কয়েক মাস পর পালিয়ে ইতালিতে পরিবারের কাছে যান তিনি। পরে সুইজারল্যান্ডে জুরিখের বিখ্যাত ফেডারেল পলিটেকনিক্যাল স্কুল (ইটিএইচ নামে পরিচিত) থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পড়ালেখা শেষ করেন ১৯০০ সালে।

আইনস্টাইনের ছিল তর্ক করার স্বভাব। অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁর এই তর্কপ্রবণ চরিত্রের কারণে ইটিএইচে তিনি কোনো অধ্যাপকেরই প্রিয় ছিলেন না। তাই পরে তাঁদের কেউই আইনস্টাইনকে সহকারী হিসেবে কাজে নেননি। অথচ যেকোনো একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়তে সেটা ছিল সে কালের প্রচলিত উপায়। এভাবে বেশ কিছু দিন বেকার ছিলেন আইনস্টাইন। দুবছর পর, অবশেষে বার্নের সুইস পেটেন্ট অফিসে জুনিয়র পদে তিনি তৃতীয় শ্রেণির এক চাকরি পান। সেটিও সম্ভব হয়েছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যানের বাবার সুপারিশে। 

এ চাকরি করার সময় ১৯০৫ সালে তিনটি গবেষণাপত্র লেখেন আইনস্টাইন। ওই বছরেই সেগুলো একে একে ছাপা হতে থাকে সে কালের জার্মানির বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল এনালেন ডার ফিজিক-এ। এ তিনটি গবেষণাপত্রের একটি পরমাণুর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল, দ্বিতীয়টি ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি। এ পেপারটির কারণে ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। আর তৃতীয়টির শিরোনাম ছিল অন দ্য ইলেকট্রডাইনামিকস অব মুভিং বডিজ। এতেই আপেক্ষিকতা নামের সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণার অবতারণা করেন তিনি। ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা’ থেকে এই ‘আপেক্ষিকতা’কে আলাদা করতে পরে এর সঙ্গে ‘বিশেষ’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। এই পেপার তিনটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাঁকে। 

আলোর গতি সব সময়ই একই থাকবে। মানে সব সময় সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার (আসলে ২৯৯৭৯২৪.৫৮ কিমি) হবে। কোনো নড়চড় হবে না।

পেটেন্ট অফিসে চাকরির সুবাধে অবসর সময়ে নিউটনের বলবিদ্যা আর ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের বিরোধ মেটাতে কাজ করতেন আইনস্টাইন। ১৬ বছর বয়সে তার মাথায় আসা ওই বিশেষ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতেই বোধহয় এই ভাবনা পেয়ে বসেছিল তাকে। মানে, সেই প্রশ্ন—আলোর পিঠে চেপে বসলে কী ঘটবে? তাতে দেখা যাবে, আলোক রশ্মির পিঠে যে চেপে বসেছে, তার কাছে আলো স্থির বা গতিহীন হয়ে গেছে। কিন্তু চলমান বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ কি স্রেফ স্থির বা গতিহীন হয়ে যাওয়া সম্ভব? গতি না থাকলে আলোর স্পন্দন বা শক্তি থাকে না, তাতে আলোরও কোনো অস্তিত্বও থাকার কথা নয়। তার মানে কি আলোর গতির কাছে এসে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অকার্যকর হয়ে যাবে? এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স।  

১৯০৫ সালের জুনে এই প্যারাডক্সের সমাধান খুঁজে পান আইনস্টাইন। নিজের গবেষণাপত্রে দেখালেন, এটা ঘটা অসম্ভব। তিনি বুঝতে পারলেন, ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব সঠিক হলে, অবশ্যই যেকোনো একটি ঘটবে। আলোর পিঠে যাত্রা করলে হয় অসম্ভব ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে, নয়তো আলোর পিঠে যাত্রা করা বা আলোর বেগে চলাই অসম্ভব। কোনটি সঠিক?

দুইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই মেনে নিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত এলেন, মহাবিশ্বের অন্য সব গতি আপেক্ষিক হলেও আলোর গতি সবসময় নিরপেক্ষ বা ধ্রুব থাকবে। মোদ্দা কথা, ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বটি থেকে পাওয়া আলোর পরম গতিটিই মেনে নিয়ে বললেন, পর্যবেক্ষকের গতি যতই হোক না কেন, সবার পরিমাপে আলোর বেগ একই পাওয়া যাবে। অর্থাৎ আলোর বেগ হবে পর্যবেক্ষকের গতির সাপেক্ষে নিরপেক্ষ এবং তা সবদিকেই একই থাকবে। এটিই আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রথম স্বতসিদ্ধ বা স্বীকার্য।

দ্বিতীয় স্বতসিদ্ধটি হলো, মুক্তভাবে চলমান সব পর্যবেক্ষক বা দর্শকের কাছে বিজ্ঞানের সব সূত্র সব সময় একই রকম হওয়া উচিত। এগুলো থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তি। ধরা যাক, একটি বাস ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার এবং আরেকটি বাস ২০ কিলোমিটার বেগে একই দিকে চলছে। এখন দ্বিতীয় বাসে থাকা কোনো দর্শকের কাছে প্রথম বাসটির আপেক্ষিক গতি মনে হবে ১০ কিলোমিটার। আবার বাস দুটি যদি বিপরীত দিকে চলে, তাহলে দর্শকের কাছে প্রথম বাসটির আপেক্ষিক গতি ৫০ কিলোমিটার মনে হবে। আবার দুটি বাস যদি একই বেগে পাশাপাশি চলতে থাকে, তাহলে রাস্তায় দাঁড়ানো যেকোনো দর্শকের কাছে বাস দুটির গতি ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার বলে মনে হলেও বাস দুটির যাত্রীদের কাছে বাস দুটিকে পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির বলে মনে হবে। পৃথিবীও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। তারপরও একে স্থির দেখা যায়। কারণ আমরা নিজেরাও পৃথিবীর সঙ্গে ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে চলমান।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আলোর ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটবে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আলোর বেগ হবে পর্যবেক্ষকের গতির সাপেক্ষে নিরপেক্ষ এবং তা সবদিকেই একই থাকবে—কথাটার অর্থ হলো, আলোর দিকে কিংবা বিপরীত, যেদিকেই যাওয়া যাক না কেন, আলোর গতি সব সময়ই একই থাকবে। মানে সব সময় সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার (আসলে ২৯৯৭৯২৪.৫৮ কিমি) হবে। কোনো নড়চড় হবে না। সোজা কথায়, কেউ যদি আলোর গতির দিকে সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার যায়, তাহলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আলোর গতিবেগ কমে সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ – ১০০ = ২৯৯,৯০০ কিলোমিটার হওয়ার কথা। কিংবা আলোর বিপরীত দিকে গেলে তার গতি বেড়ে ৩,০০,০০০ + ১০০ = ৩,০০,১০০ কিলোমিটার হওয়ার কথা। নিউটনীয় গতিবিদ্যার ধারণা আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, এর কোনোটাই হবে না। বরং আলোর গতি সব ক্ষেত্রেই সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার থাকবে। অর্থাৎ একমাত্র আলো আপেক্ষিকতা দিয়ে প্রভাবিত হবে না, সব সময় পরম থাকবে। 

অবশ্য আইনস্টাইনের এ কথা মেনে নিতে আমাদের অন্য কিছু ধারণা বিসর্জন দিতে হয়েছিল। সেটি হলো, সময় নামের বিশ্বজনীন পরিমাপের ধারণা। মানে যাকে সবরকম ঘড়ি দিয়ে মাপা হয়—এ ধারণাটি বাদ দেওয়া হলো। তার বদলে ধরে নেওয়া হলো, প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিগত সময় আছে। দুজন ব্যক্তি পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির থাকলেই কেবল তাদের দুজনের সময় মিলে যেতে পারে। কিন্তু তারা চলমান হলে, তাদের সময় আর তখন একইরকম হবে না। এই বৈপ্লবিক ধারণায় সময়, স্থান ও বাস্তবতা সম্পর্কেও আমাদের উপলদ্ধি পুরোটাই পাল্টে দিয়েছিল।

নিউটনের সময়ে পদার্থবিদ্যা ছিল সোজাসাপটা আর স্বতস্ফূর্ত। সে সময় স্থান মানে স্থানই বোঝাতো, সময় মানে সময়। আর এই দুটি কখনোই একসঙ্গে মিলিত হতো না। স্থানের জ্যামিতি বলতে ইউক্লিডের সমতল জ্যামিতিই বোঝাত। সময় ছিল স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন আর সব পর্যবেক্ষকের জন্য এক। একটি বস্তু চলমান হলে তার ভর ও আকার পরিবর্তিত হতো না। সেই সঙ্গে সময়ও সব জায়গায় একই হারে বয়ে যেত। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, স্থান ও কাল পরম নয়, আপেক্ষিক এবং এ দুটি পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ স্থান ও কালের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, দুটি একত্রে একটি অস্তিত্ব হিসেবে বর্তমান।

একাধিক পরীক্ষায় আইনস্টাইনের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সঠিক সময় দেওয়া দুটি ঘড়িকে পৃথিবীর চারদিকে পরস্পর থেকে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে এনে দেখা গেছে, তাদের সময়ের সামান্য পার্থক্য হয়। এতে অনেকের মনে হতে পারে, দীর্ঘজীবী হতে চাইলে বিমানে চড়ে পূর্ব দিকে একটানা উড়ে যাওয়া উচিত, যাতে বিমানের গতি পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে যোগ হতে পারে। আসলে এভাবে সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই যোগ করা সম্ভব।

নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের বিরোধ মেটাতে গিয়ে এভাবে প্রকৃতির গভীর নিয়ম আবিষ্কার করেন আইনস্টাইন। নিউটনের গতিবিদ্যায় কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করে সেগুলো সংশোধনও করেন। এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি নিউটনের বলবিদ্যার টানা দুশো বছরের সফলতা শেষ হয়ে গেল? আসলে এই দুই তত্ত্বের পার্থক্য অতিসূক্ষ্ণ। কোনো বস্তু আলোর গতির কাছাকাছি এলেই কেবল তাদের পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। আইনস্টাইনের এই আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বিশেষ আপেক্ষিকতা বলার এটাই অন্যতম কারণ। তাই রকেটের গতিপথ থেকে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব বলের ব্যাখ্যায় এখনো নিউটনের বলবিদ্যা ব্যবহার করা হয়। বস্তুর বেগ যখন আলোর বেগের কাছাকাছি, তখন প্রয়োজন পড়ে আপেক্ষিকতার। 

পদার্থবিজ্ঞানে সম্ভবত এটিই একমাত্র সমীকরণ যাকে টি-শার্ট, কফিমগে বা রাস্তাঘাটেও দেখা যায়। সমীকরণটির চমকপ্রদ ফলগুলো বুঝে উঠতে খোদ আইনস্টাইনের কিছুটা সময় লেগেছিল।

আপেক্ষিকতার গুরুত্বপূর্ণ এক ফলাফল হলো, ভর ও শক্তির ভেতরের সম্পর্ক। ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ডাজ দ্য ইনারশিয়া অব আ বডি ডিপেন্ড অন ইটস এনার্জি কনটেন্ট?’ শিরোনামের আরেকটি গবেষণাপত্রে এ সংক্রান্ত একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন আইনস্টাইন। এটিই তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2। আইনস্টাইন ধরে নেন, আলোর গতি সবার জন্যই সমান হবে। এটি আভাস দেয়, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারবে না। কণা হোক বা নভোযান, কোনোকিছুর গতি বাড়ানোর জন্য শক্তি ব্যবহার করা হলে বস্তুটির ভর বেড়ে যাবে এবং তার গতি আরও বাড়ানো কঠিন হয়ে উঠবে। তাতে একটি কণার গতি আলোর গতিতে আনা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। কারণ সেজন্য অসীম পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন। ভর ও শক্তি সমতুল্য, যাকে E=mc2 সমীকরণে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।

পদার্থবিজ্ঞানে সম্ভবত এটিই একমাত্র সমীকরণ যাকে টি-শার্ট, কফিমগে বা রাস্তাঘাটেও দেখা যায়। সমীকরণটির চমকপ্রদ ফলগুলো বুঝে উঠতে খোদ আইনস্টাইনের কিছুটা সময় লেগেছিল। এ সমীকরণের কারণে একসময় বোঝা গেল, ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ফিশন (বিভাজন) প্রক্রিয়ায় দুটি নিউক্লিয়াসে ভাগ করা হলে তাদের যোগফলে কিছুটা কম ভর পাওয়া যাবে। আর এই হারিয়ে যাওয়া ভর থেকে পাওয়া যাবে বিপুল শক্তি। অর্থাৎ এক কিলোগ্রাম বস্তু থেকে ২০ মিলিয়ন টন টিএনটির সমপরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে।

এই সমীকরণের কারণেই ১৯৩০ এর দশকে বোঝা গেল, সূর্যে শক্তি কীভাবে তৈরি হচ্ছে। ১৯৩৮ সালে জার্মান পদার্থবিদ হ্যানস বেথে বললেন, সূর্যের হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশন প্রক্রিয়ায় একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করছে। সেই সঙ্গে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ অনুযায়ী, বেরিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। নক্ষত্রগুলো কোটি কোটি বছর কীভাবে আলো আর তাপ ছড়াচ্ছে এভাবেই বোঝা গেল। অন্যদিকে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে চোখ নামতেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি বের করে আনা সম্ভব। এবার বিজ্ঞানীরা সেই বিপুল শক্তির দখলের লড়াইয়ে নামলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিল যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়করাও। 

১৯৩৯ সালে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ দানা বেধে উঠতে শুরু করেছিল। সে সময় এ ব্যাপারটার মর্মার্থ বুঝেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। তাঁরাই যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্প চালুর আর্জি জানিয়ে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেজন্য প্রভাব খাটাতে আইনস্টাইনকে রাজি করানো হয়। আইনস্টাইনও তাতে রাজিও হন। এর পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান প্রজেক্ট। ১৯৪২ সালে ইতালিয়ান-মার্কিন বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নেতৃত্বে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল বিজ্ঞানী প্রথম নিয়ন্ত্রিত ফিশন পারমাণবিক চুল্লি বানাতে সক্ষম হন। তারপর বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে ম্যানহাটান প্রজেক্টে তৈরি করা হয় দুটি পারমাণবিক বোমা—লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান। ১৯৪৫ সালে এ বোমাগুলো জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলে শহর দুটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়। 

আলবার্ট আইনস্টাইন
ছবি: উইকিপিডিয়া
আপেক্ষিকতার দ্বিতীয় স্বতসিদ্ধটি হল, মুক্তভাবে চলমান সব পর্যবেক্ষক বা দর্শকের কাছে বিজ্ঞানের সকল সূত্র সবসময়ই একইরকম হওয়া উচিত। এ কথাটি ১৯০২ সালে প্রথম বলেছিলেন হেনরি পয়েনকেয়ার।

৩. 

আপেক্ষিকতার ইতিহাসে দেখা যায়, আইনস্টাইনের জন্য কত চমৎকারভাবে মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছিল। ইথার মতবাদকে নস্যাৎ করে সবদিকেই আলোর গতি ধ্রুব বলে প্রমাণ করে রেখেছিলেন মাইকেলসন-মর্লি। এরপর দৈর্ঘ্য সংকোচনের বিষয়টি প্রথম আবিষ্কার করেন ফিটজেরাল্ড ও লরেঞ্জ। তাঁরাই প্রথম বললেন, প্রচণ্ড বেগে ধাবমান বস্তুর দৈর্ঘ্য সংকুচিত হবে। আবার দৈর্ঘ্য সংকোচন হলে বস্তুর ভর বেড়ে যাবে বলে ধারণা করেন লরেঞ্জ। দুটো ধারণাই আপেক্ষিকতার তত্ত্বে পরে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করে আইনস্টাইন। তবে এটি ব্যবহার করে ফিটজেরাল্ড ও লরেঞ্জ চেয়েছিলেন ইথারকে বাঁচাতে, আর ইথারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে আলোর পরমত্ব প্রমাণ করেছিলেন আইনস্টাইন। 

আবার আপেক্ষিকতার দ্বিতীয় স্বতসিদ্ধটি হল, মুক্তভাবে চলমান সব পর্যবেক্ষক বা দর্শকের কাছে বিজ্ঞানের সকল সূত্র সবসময়ই একইরকম হওয়া উচিত। এ কথাটি ১৯০২ সালে প্রথম বলেছিলেন হেনরি পয়েনকেয়ার। আবার সময়ও যে স্থানের তিনটি মাত্রার মতই আরেকটি মাত্রা সেটাও আইনস্টাইনের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন পয়েনকেয়ার। অবশ্য তাদেরও অনেক আগে, সেই ১৮৯৫ সালে টাইম মেশিন উপন্যাসে সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন লেখক এইচ জি ওয়েলেস। অনেকে দাবি করেন, E=mc2 এর মতো একটি সূত্রও নাকি আইনস্টাইনের অনেক আগেই আবিষ্কার করেছিলেন পয়েনকেয়ার। আবার স্থান এবং কাল একত্রে স্থান-কাল হিসেবে জুড়ে দিয়েছিলেন রাশান বংশোদ্ভুত জার্মান গণিতবিদ হারমান মিনকোভস্কি। তাহলে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আইনস্টাইনের অবদান কোথায়? 

এর উত্তর দিতে গেলে নিউটনের কাছে ফিরে যেতে হবে। নিউটনের অনেক আগেই রবার্ট হুক বিপরীত বর্গীয় সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করেন অনেকে। নিউটন নাকি স্রেফ এই সূত্রটি মেরে দিয়ে তাঁর মহাকর্ষ সূত্রে ব্যবহার করেছেন। কথাটি যদি সত্যিও হয়, তারপরও বলতে হয়, এখানেই বোঝা যায় নিউটনের প্রতিভা। বিপরীত বর্গীয় সূত্র হাতে পেয়েও তাঁর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি হুক। কিন্তু গভীর অন্তদৃষ্টির কারণে এটি ব্যবহার করে একইসঙ্গে মহাকাশের বস্তু আর পৃথিবীর চারপাশের বস্তুর গতিকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন নিউটন। সেটাই ছিল নিউটনের মেধা ও প্রতিভার সাক্ষর।

একই কথা খাটে আইনস্টাইনের বেলাতেও। আসলে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের টুকরো টুকরো অংশ সবার হাতেই জিগস পাজলের টুকরোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সবগুলো মিলিয়ে যে একটা একক চিত্র, সেটি কেবল বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিভাবান আইনস্টাইন। সে কারণেই তিনি জিনিয়াস। তাই আপেক্ষিকতার মঞ্চে তিনি উঠে এসেছিলেন মহানায়কের বেশে। 

সূত্র: দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল/স্টিফেন হকিং;

ইন পারসুট অব দ্য আননোন/ইয়ান স্টুয়ার্ট;

অ্যাসেন্ট অব গ্র্যাভিটি/মারকোস চোন;

রিয়েলিটি ইজ নট হোয়াট ইট সিমস/কার্লো রোভেলি;

ঈশ্বরকণা, মানুষ ইত্যাদি/পথিক গুহ