নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহর নেলসন। এই শহর থেকে বেশ কিছু দূরে ব্রাইটওয়াটার ও স্প্রিং-গ্রোভের মাঝামাঝি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের জন্ম। ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট। তাঁর মা–বাবা খুব ছোটবেলায় নিউজিল্যান্ডে এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। বাবা জেমস রাদারফোর্ড এসেছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে আর মা মার্থা এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। মার্থা একটি স্কুলে পড়াতেন, আর জেমস চাষাবাদের পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়ির কাঠের চাকা মেরামত করতেন। জেমস-মার্থার ১২ ছেলেমেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান ছিলেন আর্নেস্ট। আর্নেস্টের বয়স যখন সাড়ে পাঁচ, তখন তাঁদের পরিবার আরও পাঁচ কিলোমিটার দূরে ফক্সহিলে চলে যায়। সেখানে সাধারণ সরকারি স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বাবা ও বড় ভাইদের সঙ্গে জমিতে চাষাবাদের কাজও করতে হতো আর্নেস্টকে। বড় হয়ে দক্ষ আলুচাষি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন আর্নেস্ট তার অন্য ভাইদের সঙ্গে।

স্কুলের লেখাপড়ায় রাদারফোর্ড খুব যে অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তা নয়। মা-বাবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল খুবই কম। স্কলারশিপ না পেলে বেশি দূর পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না। তাই স্কুল-কলেজের স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য যতটুকু ভালো করলে হতো, ঠিক ততটুকুই করতেন রাদারফোর্ড। ছোটবেলায় বিজ্ঞানের প্রতি আলাদা কোনো আকর্ষণ তৈরি হয়নি। কিন্তু হাইস্কুল এবং কলেজে পড়ার সময় যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ পেতেন রাদারফোর্ড।

১৮৮৭ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত নেলসন কলেজে মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনার পর ক্যান্টারবারি কলেজে ভর্তি হন। ক্যান্টারবারি কলেজই অনেক বছর পরে ক্যান্টারবারি ইউনিভার্সিটিতে পরিবর্তিত হয়। রাদারফোর্ডের পরীক্ষণ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এখান থেকেই। বিদ্যুৎ–চুম্বক তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তিনি এ সময়। বেতার তরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণ করার একটি কার্যকরী যন্ত্র তৈরি করেন তিনি। ১৮৯২ সালে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। বিএ পাস করার পর স্কুলের শিক্ষক হয়ে বিয়েশাদি করে সুখে দিন যাপন করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তাঁর প্রেমিকা মেরি নিউটনও এ রকম সুখী-গৃহকোণের স্বপ্ন দেখছিলেন তখন। কিন্তু স্কুলে চাকরি পাননি রাদারফোর্ড। তবে বিএ পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে এমএ পড়ার জন্য একটা স্কলারশিপ পেলেন রাদারফোর্ড। বিয়ে মুলতবি রেখে ১৮৯৩ সালে এমএ পাস করলেন রাদারফোর্ড।

নিউজিল্যান্ডের এমএ ডিগ্রিতেও একটি স্কুলমাস্টারি জুটছিল না। রাদারফোর্ড স্থির করলেন ইউরোপে চলে যাবেন আরও লেখাপড়া করার জন্য। কিন্তু সেই সময় ইউরোপের ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেতে হলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় দরখাস্ত করতে হতো। রাদারফোর্ড তাই এমএ পাস করার পরেও আবার বিএসসি কোর্সে ভর্তি হলেন ১৮৯৪ সালে। এ সময় ক্রাইস্টচার্চ বয়েজ হাইস্কুলের একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়লে রাদারফোর্ড কিছুদিন খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করার সুযোগ পান। কিন্তু সেই বেতনে ঘরসংসার করা সম্ভব ছিল না। তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করার জন্য একটি স্কলারশিপের দরখাস্ত করলেন।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৫১ সাল থেকে তাদের কলোনিভুক্ত দেশ, ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জন্য কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছিল। এসব দেশ থেকে মাত্র একজন বা দুজনকে বছরে ১৫০ পাউন্ড করে দুই বছর পড়াশোনার জন্য এই স্কলারশিপ দেওয়া হতো। ১৮৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের জন্য মাত্র একটি স্কলারশিপ ছিল। রাদারফোর্ড দরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু প্রথমে তিনি স্কলারশিপটি পাননি। অকল্যান্ডের একজন কেমিস্ট জেমস ম্যাকলরিন স্কলারশিপটি পেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাকলরিন তখন একটি চাকরি পেয়ে গেছেন আর সদ্য বিয়ে করেছেন, ইংল্যান্ডে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই তাঁর। ম্যাকলরিন স্কলারশিপটি প্রত্যাখ্যান করার পর তা রাদারফোর্ডকে দেওয়া হয়।

স্কলারশিপ পাওয়ার খবরটি যখন আসে, তখন রাদারফোর্ড আলুখেতে আলু তুলছিলেন। বিষয়ে পরে পরে তিনি বলেছেন, ‌‌‘ওই দিনই ছিল আমার জীবনের শেষ আলু তোলা।’

১৮৯৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে যোগ দিলেন রাদারফোর্ড। তিনিই ছিলেন ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের প্রথম বহিরাগত ছাত্র। এর আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর গবেষণায় ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যেত। জোসেফ জন টমসনের (জে জে থমসন) তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন রাদারফোর্ড।

ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে গবেষণা শুরুর মাসখানেক পরেই ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানিতে রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কার করেন। ইউরোপের সব পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীই তখন এক্স-রে সম্পর্কিত গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের পরিচালক জে জে টমসন তখন আয়নসংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন। গ্যাসের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চলার সময় এক্স-রে প্রয়োগ করলে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা দেখার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠলেন তিনি। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী হলেও জে জে টমসন হাতের কাজে খুব বেশি দক্ষ ছিলেন না। তাঁকে সাহায্য করার জন্য একজন দক্ষ সহযোগী দরকার। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই সবাই রাদারফোর্ডের কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেছেন। রাদারফোর্ড ক্যান্টারবারি কলেজের ল্যাবে বসে তৈরি করেছিলেন বেতার তরঙ্গের ডিটেক্টর। সেই ডিটেক্টর তিনি কেমব্রিজে নিয়ে এসেছেন। সেটা নিয়েই কাজ করছিলেন তিনি। বেতার তরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণের যন্ত্র নিয়ে সেই সময় ইতালিতে মার্কনি আর ভারতবর্ষে জগদীশচন্দ্র বসু স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছিলেন। সেই সময় কোথায় কী গবেষণা হচ্ছে, তা সব সময় জানার সুযোগ ছিল না।

টমসন যখন বললেন তাঁর এক্স-রে ও আয়নের গবেষণায় যোগ দিতে, রাদারফোর্ড রাজি হয়ে গেলেন। এক্স-রে আবিষ্কৃত হওয়ার কিছুদিন পরেই ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকরেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। রাদারফোর্ড এক্স-রে ও তেজস্ক্রিয়তা–সংক্রান্ত গবেষণার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন।

রাদারফোর্ড ও জে জে টমসনের যৌথ গবেষণার ফসল পেতে দেরি হলো না। ১৮৯৭ সালে আবিষ্কৃত হলো ইলেকট্রন। এক্স-রের ফলে যে আয়নাইজেশন হয়, তা–ও টমসন ও রাদারফোর্ড প্রথম আবিষ্কার করেন।

তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হওয়ার পর ফ্রান্সে মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি তেজস্ক্রিয়তার রাসায়নিক ধর্মসংক্রান্ত গবেষণা করতে করতে আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম। রাদারফোর্ড শুরু করলেন তেজস্ক্রিয়তার ভৌত ধর্মসংক্রান্ত গবেষণা। ১৮৯৭ সালের মধ্যেই রাদারফোর্ড আবিষ্কার করলেন ইউরেনিয়াম থেকে দুই ধরনের তেজস্ক্রিয়া বিকিরণ বের হয়। একধরনের বিকিরণ খুব বেশি দূর যেতে পারে না। তিনি কাজের সুবিধার্থে গ্রিক অক্ষর অনুসারে তার নাম দিলেন আলফা রেডিয়েশন। আরেক ধরনের বিকিরণ যেটা আলফা বিকিরণের তুলনায় অনেক দূর যেতে পারে (কয়েক সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত); রাদারফোর্ড এই বিকিরণের নাম দিলেন বেটা রেডিয়েশন। আরও কয়েক বছর পরে রাদারফোর্ড আরও একধরনের বিকিরণ আবিষ্কার করেন। সেটার নাম দিলেন গামা রেডিয়েশন।

গবেষণায় দ্রুত এত কিছু আবিষ্কার করার পরেও তখন পর্যন্ত কোনো স্থায়ী চাকরি হয়নি রাদারফোর্ডের। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। কারণ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পর্যন্ত কোনো বহিরাগতকে অধ্যাপনা করার সুযোগ দেওয়া হতো না। শুধু কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্নাতক ও স্নাতকোত্তরদেরই নিয়োগ দেওয়া হতো সেখানে। অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন রাদারফোর্ড। তাঁর দ্রুত একটি স্থায়ী চাকরি দরকার। কারণ, মেরি নিউটনের সঙ্গে তাঁর বিয়েটা ঝুলে আছে অনেক দিন। নিউজিল্যান্ড থেকে মেরি নিয়মিত চিঠি লিখে তাগাদা দিচ্ছেন তাঁকে।

রাদারফোর্ড দরখাস্ত করলেন কানাডার মন্ট্রিয়েলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে বেশ বড় একটি নতুন ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে উইলিয়াম ম্যাকডোনাল্ড নামের একজন ধনী তামাক ব্যবসায়ীর টাকায়। সেই ল্যাবে গবেষণা পরিচালনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ম্যাকডোনাল্ড প্রফেসর পদ। অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এই পদের জন্য দরখাস্ত করলেও জে জে টমসনের সুপারিশে পদটি দেওয়া হয় ২৭ বছরের তরুণ রাদারফোর্ডকে। ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে কেমব্রিজ থেকে কানাডায় চলে গেলেন রাদারফোর্ড। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ফিজিকস ডিপার্টমেন্টকে উত্তর আমেরিকার সেরা ফিজিকস ডিপার্টমেন্টে পরিণত করেন। তেজস্ক্রিয়তা–সংক্রান্ত গবেষণাই হয়ে ওঠে রাদারফোর্ডের প্রধান গবেষণার বিষয়।

দুই বছর পর ১৯০০ সালে রাদারফোর্ডের সময় এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য হয় নিউজিল্যান্ডে গিয়ে মেরিকে বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে আসার। আর্নেস্ট ও মেরি রাদারফোর্ডের দাম্পত্য জীবন ছিল বৈচিত্র্যহীন কিন্তু শান্তিপূর্ণ। রাদারফোর্ডের গবেষণার কিছুই বুঝতেন না মেরি। কিন্তু স্বামীর গর্বে খুবই গর্বিত ছিলেন তিনি। তাঁদের একমাত্র সন্তান এইলিনের জন্ম হয় ১৯০১ সালে।

রাদারফোর্ডের তেজস্ক্রিয়তার গবেষণায় প্রচুর রাসায়নিক কাজকর্ম দরকার। তাঁর গবেষণায় সাহায্য করার জন্য তিনি খুঁজে বের করলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ডেমনেস্ট্রেটর ফ্রেডেরিক সডিকে। ফ্রেডেরিক সডি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে কানাডায় এসেছেন চাকরি নিয়ে। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ডের গবেষণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলফা ও বিটা রেডিয়েশনের ফলে তেজস্ক্রিয় মৌলের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। ইউরেনিয়াম মৌল থেকে একটি আলফা কণা বেরিয়ে গেলে ইউরেনিয়াম থোরিয়ামে পরিণত হয়। আবার থোরিয়াম থেকে একটি আলফা কণা বের হয়ে গেলে থোরিয়াম পরিণত হয় রেডিয়ামে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে মৌলের এই যে পরিবর্তন, এটা প্রথম আবিষ্কার করেন রাদারফোর্ড।এই আবিষ্কারের জন্য তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান ১৯০৮ সালে। রসায়নে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রাদারফোর্ড বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জুনিয়র সহকর্মী ফ্রেডেরিক সডিও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯২১ সালে।

১৯০৩ সালে রাদারফোর্ড রয়্যাল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। ১৯০৪ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির রামফোর্ড মেডেল অর্জন করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় রাদারফোর্ডের প্রথম বই রেডিওঅ্যাকটিভিটি। এই বই ছিল রেডিওঅ্যাকটিভিটির ওপর পৃথিবীর প্রথম টেক্সটবুক। সেই সময় সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইয়ের মাধ্যমেই এই বিষয়টির শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। পরের বছর এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন রাদারফোর্ড। ১৯০৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় বই রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রান্সফরমেশনস।

কানাডা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে চাচ্ছিলেন রাদারফোর্ড। ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। এখানে তাঁর সহযোগী হিসেবে তিনি পান জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যান্স গাইগার এবং তাঁর তরুণ ছাত্র আর্নেস্ট মার্সডেনকে। তেজস্ক্রিয়তার গবেষণা অব্যাহত থাকে। গাইগার এই গবেষণার জন্যই উদ্ভাবন করেন রেডিয়েশন ডিটেক্টর, যা এখন আমরা সবাই চিনি গাইগার কাউন্টার হিসেবে।

১৯০৯ সালে আলফা কণার ধর্ম পরীক্ষা করার জন্য রাদারফোর্ড ও মার্সডেন অনেকগুলো ধারাবাহিক পরীক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেই পরীক্ষায় দেখা গেল ইউরেনিয়াম সল্ট থেকে আলফা কণা নির্গত হয়ে বেশির ভাগই পাতলা সোনার পাতের মধ্য দিয়ে বাধাহীনভাবে চলে গেল। কিন্তু কিছু আলফা কণা যেদিক থেকে নির্গত হয়েছে, পাতলা সোনার পাত থেকে সেদিকেই ফিরে এসেছে। এ ঘটনাকে রাদারফোর্ড পরে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘মনে হচ্ছিল একটা ১৫ কেজি ভরের কামানের গোলা একটি টিস্যু পেপারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে।

এই পরীক্ষণের পর ধারাবাহিকভাবে আরও অনেক পরীক্ষা করেন। তারপর রাদারফোর্ড এই সিদ্ধান্তে আসেন, পরমাণুর কেন্দ্রে আছে অত্যন্ত ঘনীভূত ভর, যা পরে নিউক্লিয়াস হিসেবে পরিচিত হয়। পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের উপস্থিতির পর ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের ভিত্তিতে ১৯১১ সালে পরমাণুর রাদারফোর্ড মডেল প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেখানে ইলেকট্রনগুলো কীভাবে থাকে, সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় মডেলটি সংশোধনের দরকার হয়। ১৯১২ সালে নীলস বোর ম্যানচেস্টারে এলেন রাদারফোর্ডের সঙ্গে গবেষণা করার জন্য। নীলস বোর রাদারফোর্ডের সহযোগিতায় আবিষ্কার করেন তাঁর বিখ্যাত বোর মডেল।

১৯১৩ সালে রাদারফোর্ড প্রকাশ করেন তাঁর তৃতীয় বই রেডিওঅ্যাকটিভ সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দেয়ার রেডিয়েশনস। ১৯১৪ সালে রাদারফোর্ডকে ব্রিটিশ সরকার নাইট উপাধি দেয়। নাইটহুড অর্জন করার পর তিনি হলেন স্যার রাদারফোর্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত রাদারফোর্ড ব্রিটিশ নেভির উদ্ভাবন ও গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করেন।

১৯১৯ সালে জে জে টমসন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার নিযুক্ত হলে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের পরিচালক পদ থেকে সরে আসেন। তাঁর সুপারিশে সেই পদে যোগ দেন রাদারফোর্ড। আমৃত্যু ওই পদেই ছিলেন রাদারফোর্ড। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের দায়িত্ব নিয়ে তিনি তাঁর ছাত্র জেমস চ্যাডউইকের সঙ্গে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে তিনি প্রোটন আবিষ্কার করেন। তাঁর ও চ্যাডউইকের দীর্ঘ গবেষণার ফসল নিউট্রন। ১৯২৮ সালে নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়। এ জন্য চ্যাডউইক নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৫ সালে।

১৯২৫ সালে রাদারফোর্ডকে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব মেরিট’ দেওয়া হয়। ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন রাদারফোর্ড। ১৯৩৭ সালে রাদারফোর্ডের চতুর্থ বই দ্য নিউয়ার আলকেমি প্রকাশিত হয়। ওই বছর ১৯ অক্টোবর রাদারফোর্ডের মৃত্যু হয়।

মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিলেন রাদারফোর্ড। খুব উচ্চ স্বরে কথা বলতেন তিনি। তিনি এত জোরে কথা বলতেন যে অনেক সময় নয়েস সেনসেটিভ যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেত তাঁর ল্যাবে। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে তিনি কখনো নাক গলাতেন না। এত সম্মাননা পাওয়ার পরেও তাঁর আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর সম্মানে রেডিওঅ্যাকটিভিটির প্রথম একক হিসেবে রাদারফোর্ড গৃহীত হয় ১৯৪৬ সালে। প্রতি সেকেন্ডে ১০ লাখ কণা বিকিরণের হারকে এক রাদারফোর্ড ধরা হয়। ১৯৫৩ সালে এর চেয়ে বড় আরেকটি একক প্রচলন করা হয় মেরি কুরির নামে। এক কুরি হলো সেকেন্ডে ৩৭ বিলিয়ন বিকিরণ। ১৯৭৪ সালে প্রচলন করা হয় বিকিরণের আন্তর্জাতিক একক বেকরেল। প্রতি সেকেন্ডে একটি বিকিরণ হলো বেকরেল। ১৯৭৫ সাল থেকে রাদারফোর্ড একক আর ব্যবহার করা হয় না। ১৯৯৭ সালে ১০৪ প্রোটনবিশিষ্ট পরমাণুর নাম রাখা হয় রাদারফোর্ডিয়াম (Rf)।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র:

১. ওয়ার্ল্ডস বুকস বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্টস, সপ্তম খণ্ড, ২০০৩।

২. দ্য সায়েন্টিস্ট/ জন গ্রিবিন, র৵ান্ডম হাউস, নিউইয়র্ক ২০০২।

৩. রিমার্কেবল ফিজিসিস্ট/ ইওয়ান জেমস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।

৪. আ ফোর্স অব ন্যাচার: দ্য ফ্রন্টিয়ার জিনিয়াস অব আর্নেস্ট রাদারফোর্ড রিচার্ড রিভস/রিচার্ড রিভস, নরটন অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮