একটা চার মাত্রার ষড়ভুজ আপনার রান্নাঘরের টেবিলের ভেতর দিয়ে গেলে কী রকম ছাপ ফেলবে? বিষয়টা কল্পনা করাও হয়তো কঠিন, তাই না? কিন্তু কিছু মানুষ এটা কল্পনা করতে পারেন। সেসব মানুষের সংখ্যা অবশ্য হাতেগোনা। তেমনই একজন ছিলেন গণিতবিদ অ্যালিসিয়া বুল স্টট। যুক্তিবিদ জর্জ বুলের মেয়ে তিনি। চার মাত্রার বস্তু তিন মাত্রার জগতে প্রবেশ করলে তার আকার কেমন হবে, তা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মডেল বানিয়ে দেখান তিনি। কয়েক দশক পর কম্পিউটারে হিসাব করে দেখা গেল, বুল স্টটের অনুমান ছিল নিখুঁত।
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছে জ্যামিতি মানে পেনসিল, স্কেল, ত্রিভুজ আর বৃত্ত। স্কুলে সমান্তরাল রেখা আর কোণ নিয়ে যেসব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো, সেগুলোই। কিন্তু বুল স্টট জ্যামিতিকে সেসবের চেয়েও বেশি কিছু ভেবেছিলেন!
জ্যামিতি দুই বা তিন মাত্রার বোধগম্য জগৎ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এই তত্ত্ব স্থানের তিন মাত্রার সঙ্গে সময়কে জুড়ে দেয়। তৈরি হয় চার মাত্রার একটা মঞ্চ। এই মঞ্চেই ঘটে মহাবিশ্বের সবকিছু।
তবে জ্যামিতি এমন মাত্রাও ব্যবহার করতে পারে, যেগুলো বাস্তব নয়। ধরুন আবহাওয়াবিদ্যার কথা। বায়ুমণ্ডলের একটা বিন্দুর অনেক মাত্রা থাকতে পারে। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, তাপমাত্রা, চাপ, বাতাসের গতি বা এমন আরও অনেক কিছু। গবেষকেরা এই মাত্রাগুলোকেই উচ্চতর মাত্রার আকার হিসেবে এঁকে ফেলেন। এতে বায়ুমণ্ডলের কার্যপ্রণালী বুঝতে সুবিধা হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ স্নেজানা লরেন্স বলেন, ‘এভাবে গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করে অনেক মাত্রায় কী ঘটবে তা হিসাব করা যায়।’
থিওরি অব এভরিথিং খোঁজার জন্য কিছু পদার্থবিজ্ঞানী আরও অদ্ভুত জ্যামিতিক ধারণার ওপর ভরসা করছেন। এগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘এমপ্লিটুহেড্রন’।
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে মহাবিশ্বের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার জন্য অপরিহার্য মনে হয় অতিরিক্ত মাত্রাকে। কেউ কেউ বলেন, আমাদের বাস্তবতা হয়তো কোনো উচ্চতর মাত্রার প্রতিফলন মাত্র। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও পদার্থবিজ্ঞানীরা যদি এই ধারণা নিয়ে কিছু সহজ অনুমান করেন, তাহলে মৌলিক কণা আর কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে এমন হিসাব করা সম্ভব, যা আগে অসম্ভব ছিল।
থিওরি অব এভরিথিং খোঁজার জন্য কিছু পদার্থবিজ্ঞানী আরও অদ্ভুত জ্যামিতিক ধারণার ওপর ভরসা করছেন। এগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘এমপ্লিটুহেড্রন’। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জারোস্লাভ ত্রিনকা আর নিউ জার্সির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির নিমা আরকানি-হামেদ এটি তৈরি করেছেন। একে ভাবতে পারেন একটি বিমূর্ত, বহুমাত্রিক স্ফটিক হিসেবে। এর বৈশিষ্ট্যগুলো কণা পদার্থবিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো বর্ণনার বিকল্প উপায়।
আরেকটি ধারণা হলো ‘কসাল ডায়নামিক্যাল ট্রায়াঙ্গুলেশন’। নেদারল্যান্ডের র্যাডবাউড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনেট লল এটি তৈরি করেছেন। এখানে অনেক জ্যামিতিক আকার জুড়ে একসঙ্গে স্থান-কালের বর্ণনা তৈরি করা যায়। মনে হয় এতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর সাধারণ আপেক্ষিকতার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আর এই দুটো ধারণা সাধারণত একসঙ্গে চলে না। লল বলেন, ‘এটি শুধু বিমূর্ত জ্যামিতিক ধারণা নয়, বরং মহাবিশ্বের আসল বৈশিষ্ট্যের পরীক্ষাযোগ্য প্রতিফলন। এটি আমাদের মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ পর্যবেক্ষণে প্রতিফলিত হতে পারে।’
এই ধারণাগুলোর কোনোটিই এখনো থিওরি অব এভরিথিং তত্ত্ব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কেউ কেউ সন্দেহ করেন, এমন কোনো তত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার আশা করতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। আর বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো জ্যামিতির ভাষায় লেখা। সেজন্যই পদার্থবিজ্ঞানীরা থিওরি অব এভরিথিং খুঁজছেন জ্যামিতির সাহায্যে। তবে এসব ধারণা সত্যি হোক বা না হোক, জ্যামিতি যে শুধু ষড়ভুজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা তো নিশ্চিত!