জলবিদ্যুৎ তৈরি হয় যেভাবে

পানির ঢেউয়ের এই শক্তিকে মানুষের কাজে লাগানোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। শত শত বছর ধরে মানুষ পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শস্য মাড়াই, আটা তৈরির মতো পরিশ্রমের কাজগুলো করেছে। আধুনিক যুগে মানুষ আরও একধাপ এগিয়ে তৈরি করছে জলবিদ্যুৎ।

ভরযুক্ত বস্তু মাত্রই তার মাঝে রয়েছে শক্তির উপস্থিতি। কিন্তু আমরা সবচেয়ে সহজে কাজে লাগাতে পারি গতিশীল বস্তুর শক্তি। অর্থাৎ গতিশক্তি।

আমাদের এই গ্রহের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পানি। প্রচুর পানি অবিরত বয়ে চলছে পৃথিবীর বুক চিড়ে। তৈরি করেছে সাগর মহাসাগর, নদী ঝর্ণাসহ আরও নানা কিছু। পৃথিবীর ঘূর্ণন, বায়ুমণ্ডলীয় তাপ-চাপের হ্রাস-বৃদ্ধি, ভূ-সংস্থান ইত্যাদি নানা কারণে ঢেউ তৈরি হচ্ছে প্রবাহমান পানিতে। সমুদ্র বা স্রোতস্বিনী নদীতে কখনো নামলে ঢেউয়ের শক্তি নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন।

পানির ঢেউয়ের এই শক্তিকে মানুষের কাজে লাগানোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। শত শত বছর ধরে মানুষ পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শস্য মাড়াই, আটা তৈরির মতো পরিশ্রমের কাজগুলো করেছে। আধুনিক যুগে মানুষ আরও একধাপ এগিয়ে তৈরি করছে জলবিদ্যুৎ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৬.৩৪ শতাংশের জোগান এসেছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এমন ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পাঁচটিই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র।

এক ধরনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল অবকাঠামো বাঁধ। নদীর ঢালু গতিপথে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁধের উঁচু পাশে পানি জমা করে রাখা যায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে।

প্রবাহিত পানির শক্তিটা আসে মূলত অভিকর্ষ (মানে, পৃথিবীর মহাকর্ষ) থেকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের তাপে বা উদ্ভিদের প্রস্বেদনের কারণে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আকাশে। ওপরে উঠে আস্তে আস্তে শীতল হতে থাকে জলীয়বাষ্প। পরিণত হয় পানির কণায়। এরপর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে আবার পৃথিবীর বুকে। তাপমাত্রা অনেক কম হলে জলীয়বাষ্প বরফে পরিণত হয়ে তুষার আকারে ঝড়ে পড়ে। বৃষ্টি বা তুষারপাত বেশি হয় উঁচু এলাকাগুলোতে। ফলে এসব পানি গড়িয়ে তৈরি করে নদী। সবশেষে এসে পড়ে সমুদ্রে। পুরো ব্যাপারটিকে বলা হয় পানিচক্র।

এই যে উঁচু এলাকা থেকে থেকে বৃষ্টির পানি নদী বা সমুদ্রে প্রবাহিত হচ্ছে, এর কারণ মহাকর্ষ। আমরা সবসময় শুনি, পানি উঁচু স্থান থেকে নিচু জায়গার দিকে প্রবাহিত হয়। কথাটি কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়।

পানি বা যেকোনো তরলই মহাশূন্যে কোনো পাত্র ছাড়াই একজায়গায় জমা হয়ে থাকে। ভেসে বেড়ায়। কারণ সেখানে মহাকর্ষের টান বা অভিকর্ষজ ত্বরণ নেই। উঁচুনিচু ব্যাপারটা বিজ্ঞানের ভাষায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান কম-বেশি ছাড়া আর কিছু না। ভূপৃষ্ঠের যে অংশটি কেন্দ্র থেকে যত দূরে, অর্থাৎ উঁচুতে, সেই অংশের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান তত বেশি। একইভাবে যে অংশটি কেন্দ্রের কাছাকাছি বা নিচুতে, সেই অংশের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান তত কম।

তাই পানি বা যেকোনো তরল মূলত বেশি অভিকর্ষজ ত্বরণ থেকে কম অভিকর্ষজ ত্বরণের দিকে চলে। পানি পায় গতি। ভরযুক্ত কোনো বস্তু গতিশীল হলেই তৈরি হয় গতিশক্তি। এভাবেই প্রবাহিত পানিতে আসে শক্তি।

পানি বা যেকোনো তরলই মহাশূন্যে কোনো পাত্র ছাড়াই একজায়গায় জমা হয়ে থাকে। ভেসে বেড়ায়। কারণ সেখানে মহাকর্ষের টান বা অভিকর্ষজ ত্বরণ নেই। উঁচুনিচু ব্যাপারটা বিজ্ঞানের ভাষায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান কম-বেশি ছাড়া আর কিছু না।

পানির গতিশক্তিকে ধরার জন্য জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত হয় টারবাইন নামে বিশেষ ধরনের পাখাযুক্ত চাকা। গতিশীল পানি এসে ধাক্কা দেয় পাখায়। ঘুরতে থাকা চাকা। এই চাকার সঙ্গে যুক্ত থাকে জেনারেটর। তাই চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটরও ঘুরতে থাকে। ফ্যারাডের বিদ্যুৎচুম্বকীয় আবেশের সূত্রানুযায়ী, জেনারেটর যান্ত্রিক শক্তিকে পরিণত করে বিদ্যুৎ শক্তিতে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যে ডিজেল চালিত জেনারেটর দেখি, সেগুলোর সঙ্গে এই জেনারেটরগুলোর মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। ডিজেল চালিত জেনারেটরকে ঘোরাতে ব্যবহৃত হয় ডিজেল ইঞ্জিন। আর এখানে জেনারেটর ঘোরাতে কাজে লাগানো হয় পানির শক্তিকে।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রধানত দুই ধরনের হয়। এক ধরনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বলা হয় ‘রান অব দ্য রিভার’ বা ‘চলমান নদীভিত্তিক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র’। এগুলো স্রোতস্বিনী নদীর বাঁকে বা সরু স্থানে স্থাপন করা হয়। নদীর ক্রমাগত স্রোতের সাহায্যে টারবাইনকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হয় এতে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ও স্রোত যখন বেশি থাকে, তখন বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় এসব কেন্দ্রে। খরা মৌসুমে নদী শুকিয়ে এলে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণও কমে যায়।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাধারণত ছোট পরিসরে তৈরি করা হয়। ফলে খরচ হয় কম। নদীতে স্রোত থাকলে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ তৈরি হয় এসব কেন্দ্রে। উৎপাদিত তড়িৎশক্তি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ এখানে কম।

সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এমন ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পাঁচটিই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র।
Tomi Naglič

দ্বিতীয় ধরনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মূল অবকাঠামো বাঁধ। নদীর ঢালু গতিপথে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁধের উঁচু পাশে পানি জমা করে রাখা যায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে। পরে স্লুইস গেটের মাধ্যমে পানি প্রবাহের পথ খুলে দিলে প্রচণ্ড বেগে পানি ছুটে এসে টারবাইনকে ঘুরায়। জেনারেটরে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। পানির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক্ষেত্রে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একই কারণে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে অনেক সময় নিচু এলাকায় কৃত্রিম খরা ও বন্যা দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় নিচু এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে কোনো কার্বন নিঃসরণ হয় না। পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব এসব কেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে জলবিদ্যুৎ তাই আশার জায়গা আমাদের।  

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন

আরও পড়ুন