মিচিও কাকুর কাছে ছয়টি প্রশ্ন

বর্তমানে অন্যতম আলোচিত বিজ্ঞানী মিচিও কাকু। তিনি একাধারে গবেষক, জনপ্রিয় লেখক ও টিভি উপস্থাপক। অল অ্যাবাউট স্পেস ম্যাগাজিনে বহুল আলোচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। সেখান থেকে বাছাই করা কয়েকটি ছাপা হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।

প্রোফাইল

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সিটি কলেজে কর্মরত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অধ্যাপক মিচিও কাকু। সেখানে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে অধ্যাপনা করছেন। বহুল আলোচিত স্ট্রিং থিওরির উপশাখা স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির সহ-প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। একসময় থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্বের পেছনে ছুটেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন। কিন্তু তা এখনো অমীমাংসিত। থিওরি অব এভিরিথিং খুঁজে বের করাও কাকুর অন্যতম লক্ষ্য। এতে তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আইনস্টাইন। অনেক দিন ধরে বিজ্ঞানকে নানাভাবে সবার কাছে জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করেছেন মিচিও কাকু। সে জন্য রেডিও, টিভিতে তিনি নিয়মিত বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া জনপ্রিয় ধারার বেশ কিছু বইও লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে বিয়ন্ড আইনস্টাইন, ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল, ফিজিকস অব দ্য ফিউচার, প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, ফিউচার অব হিউম্যানিটি উল্লেখযোগ্য।

প্রশ্ন :

মহাবিশ্বে চারটি মৌলিক বল দেখা যায়। এগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

মহাবিশ্ব চারটি মৌলিক বল দিয়ে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে আছে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল, যা শহরগুলো আলোকিত করে। লাইট বাল্ব, টেলিভিশন, রেডিও ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির জন্য দায়ী এ বল। এরপর আছে মহাকর্ষ, যেটি সূর্যকে, সূর্য ও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহকে একসঙ্গে ধরে রাখে। এমনকি আপনার পা–কে মাটির সঙ্গে আটকে রাখে এই বল। এরপর আছে দুটি পারমাণবিক বল—দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও সবল নিউক্লিয়ার বল। প্রথমটি তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের জন্য দায়ী এবং দ্বিতীয়টি প্রোটন ও নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে আটকে রাখে।

এই সব কটি বল মিলেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই মহাবিশ্ব। মহাবিশ্ব সম্পর্কে এরা জানতে সহায়তা করে বলেই এরা এত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন :

র‍্যাপিড ড্রাইভ কি কখনো সম্ভব হবে?

আইনস্টাইন বলেছিলেন, আলোর বাধা (আলোর গতিসীমা) ভাঙা খুব কঠিন। আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে চাইলে ফিউশন রকেট, প্রতিবস্তুর রকেট কিংবা র‍্যামজেট ফিউশন রকেট দরকার। কিন্তু আলোর বেগ অতিক্রম করতে চাইলে বিপুল পরিমাণ শক্তি দরকার। এই শক্তির পরিমাণ একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্র বা একটি কৃষ্ণগহ্বরের সমান। ভবিষ্যতে এই বিপুল ধনাত্মক শক্তিতে কোনোভাবে লাগাম পরানো গেলে স্থান-কালের ভেতর দিয়ে একটা প্রবেশপথ খোলা হয়তো সম্ভব হবে। কিন্তু একে স্থিতিশীল করতে দরকার হবে ঋণাত্মক শক্তি।

তাই কখনো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির বিরল সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হলে (যা দিয়ে প্রবেশপথ খোলা যাবে এবং তা স্থিতিশীল করা যাবে) র‍্যাপিড ড্রাইভ সম্ভবও হয়ে উঠতে পারে।

শিল্পীর তুলিতে আলকুবিরি র‍্যাপিড ড্রাইভ। এর মাধ্যমে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলা সম্ভব হবে বলে মনে করা হয়। মেক্সিকান পদার্থবিদ মিগুয়েল আলকুবিরির নামে দেওয়া হয়েছে এই যন্ত্রটির নাম।

প্রশ্ন :

কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট কী? বিশেষ করে টেলিপোর্টেশনের ক্ষেত্রে?

ঐক্যতানে থাকা দুটি ইলেকট্রনকে আলাদা করতে গেলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে নাড়িরুজ্জুর মতো অদৃশ্য বন্ধনে সংযুক্ত। তাই একটি কণায় মৃদু ঝাঁকুনি দেওয়া হলে অন্য কণাটিও কোনো একভাবে বুঝতে পারে তার যমজ কণাটির কিছু ঘটেছে। এই বুঝতে পারার প্রক্রিয়াটি আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে ঘটে। আইনস্টাইন প্রক্রিয়াটা পছন্দ করতে পারেননি। আসলে তিনি এটি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অসার প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।

তবে আইনস্টাইন আসলে ভুল করেছিলেন। পরীক্ষাটি গবেষণাগারে চালিয়ে দেখা যায়। তবে শেষ হাসিটা কিন্তু হেসেছিলেন আইনস্টাইন। কারণ একসময় দেখা গেল, এভাবে ব্যবহারযোগ্য কোনো তথ্য পাঠানো যায় না। এতে তথ্য এলোমেলোভাবে স্থানান্তরিত হয়। তবে কিছু বিজ্ঞানী বলেন, আলোর চেয়ে কম বেগে গেলে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন হয়তো সম্ভব হতে পারে।

স্টার ট্রেকে সিনেমায় যে ধরনের টেলিপোর্টেশন দেখানো হয়, কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। আমরা তথ্যকে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে পাঠানোর কথা বলছি। আর পরমাণু এবং ফোটনের ক্ষেত্রে এটা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। আমরা কণাকে ১০০ ফুটের বেশি দূরে পাঠাতে পারি। কাজেই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন সম্ভব, তবে তা অতিপারমাণবিক পরিসরেই কেবল সম্ভব। স্টার ট্রেকের মতো কোনো ট্রান্সপোর্টার এখনো আমাদের কাছে নেই।

প্রশ্ন :

পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথায় প্রাণ থাকা কি সম্ভব?

যদি বিশ্বাস করেন, আমাদের ছায়াপথে পৃথিবীর মতো বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ আছে, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে: সেসব গ্রহে কি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে? যদি থাকে, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে না কেন? উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা আমাদের তুলে দিচ্ছে না কেন?

আমার প্রশ্ন হলো, বনে বেড়াতে গিয়ে যদি হরিণ বা কাঠবিড়ালির সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে কি তাদের সঙ্গে আপনি কথা বলবেন? শুরুতে হরিণ ও কাঠবিড়ালির সঙ্গে হয়তো আপনি কথা বলতে চাইবেন। কিন্তু একসময় সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবেন। কারণ আপনার কথার উত্তর দিতে পারবে না তারা। কোনো প্রস্তাবও দেবে না তারা। সে কারণে তাদের রেখেই চলে আসতে হবে। আমার ধারণা, অতি উন্নত কোনো সভ্যতা আমাদেরও ঠিক বনের ওই হরিণ আর কাঠবিড়ালির মতোই ভাবে।

আবার ধরা যাক, বনের মধ্যে একটা পিঁপড়ার ঢিবি দেখলেন। তারপর কি পিঁপড়াদের কাছে গিয়ে বলবেন, ‘তোমাদের জন্য উপহার এনেছি। পাউরুটি এনেছি। তোমাদের পারমাণবিক শক্তি দেব। তোমাদের রানির কাছে আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলো?’

আমি মনে করি, এলিয়েনরা যদি হাজার হাজার আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে আসার মতো উন্নতই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পক্ষে তাদের খুব বেশি কিছু দেওয়ার নেই। তাদের বরং আমরা বিরক্ত করে মারব।

অনেকে বলেন, এলিয়েনরা খুব ভয়ংকর হতে পারে এবং আমাদের শত্রুও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। তারা খুবই উন্নত হলে আমাদের ঘাঁটাবে না। কিন্তু তারা যদি ডাকাতি করতে আসে? তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা পৃথিবীতে এসে সবকিছু ডাকাতি করে নিয়ে যাবে। কিন্তু মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়াও আরও অনেক গ্রহ আছে, সেগুলোতে কেউ থাকে না। তাই অধিবাসী থাকা কোনো গ্রহে ডাকাতি চালানোর চেয়ে ও ধরনের কোনো গ্রহ বেছে নেওয়াই তো ভালো। তাই আমি মনে করি, তারা আমাদের ঘাটাবে না।

প্রশ্ন :

আমরা কোনো সিমুলেশন বসবাস করছি, তেমনটি হওয়া কি সম্ভব?

এর বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। অনেকের ধারণা, বাস্তবতা আসলে সিমুলেশন বা নকল হতে পারে, অনেকটা ম্যাট্রিক্স সিনেমার মতো। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। প্রথমত নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে এবং যদি ধরে নেওয়া হয় যে আবহমণ্ডল পরমাণুর বদলে অতিক্ষুদ্র মার্বেল দিয়ে গঠিত, তাহলেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটারও এই আবহমণ্ডল সিমুলেট করতে পারবে না। সেটি অনেক জটিল। সবচেয়ে ছোট যে বস্তুটি আবহাওয়া সিমুলেট করতে পারে, সেটি আমাদের স্বয়ং দৃশ্যমান আবহাওয়া। কাজেই আবহাওয়াকে সিমুলেট করা যায় না, কারণ এতে অগণিত কণা থাকে।

দুর্ঘটনাক্রমে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা একে আরও কঠিন করে তুলেছে। পরমাণুর স্পিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপ, ডাউন ও পার্শ্ব থাকতে পারে। তাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও কণাদের গতি সিমুলেট করার চেষ্টা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বাধ্য।

সে কারণে আমার বিশ্বাস হয় না যে, আমরা কোনো সিমুলেশনের মধ্য বসবাস করি। কোথাও কোনো সুপার সিডি-রমে প্লে বাটন চাপার পর আমরা এই সব কথাবার্তা চালাচ্ছি, সেটাও বিশ্বাস হয় না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা খুবই জটিল, এতে অনেক সম্ভাবনা থাকে। তাই বাস্তবতাকে এমনভাবে কোনো সিডি-রমে কমিয়ে কেউ একজন প্লে বাটন টিপে দেওয়াও সম্ভব।

প্রশ্ন :

স্ট্রিং থিওরি কী? এ তত্ত্বকে কেন থিওরি অব এভরিথিং বলা হয়?

স্ট্রি থিওরি হলো একটিমাত্র সমীকরণ, যা মহাবিশ্বের সব সূত্রকে সংক্ষেপিত করতে পারে। আইনস্টাইন তাঁর জীবনের ৩০ বছর ছুটেছিলেন থিওরি অব এভরিথিংয়ের পেছনে। তিনি এমন একটি সমীকরণ আশা করতেন, যার দৈর্ঘ্য ১ ইঞ্চির চেয়ে বড় হবে না। আর এই সমীকরণের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চেয়েছিলেন।

আমাদের কাছে মহাবিশ্বের দুটি অসাধারণ তত্ত্ব আছে। এর একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব, যেটা খুব ছোট পরিসরে কাজ করে। এর মাধ্যমে আমরা পারমাণবিক বোমা, স্মার্টফোন, কম্পিউটারসহ ইন্টারনেট পেয়েছি। এটি খুব ছোট কণাদের তত্ত্ব। আরেকটি তত্ত্ব বড় পরিসর নিয়ে কাজ করে। সেটি সাধারণ আপেক্ষিকতা, বা আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব। এটি গ্রহ, নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিস্ফোরণ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এ দুটি তত্ত্ব একজন আরেকজনকে পছন্দ করে না। এটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার।

আমাদের ধারণা, এমন একটি তত্ত্ব থাকতে পারে, যা কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে একসূত্রে গাঁথতে পারবে। মহাবিশ্বে এত কণা দেখা যায় কেন? আমরা এ পর্যন্ত ইলেকট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনোসহ আরও অনেক কণা পেয়েছি। কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমরা পরমাণু ত্বরকযন্ত্র বানিয়েছি আরও কণা আবিষ্কারের জন্য। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে ৩৬টি কোয়ার্ক এবং ১৭টি মুক্ত প্যারামিটার আছে। আমাদের ধারণা, এসব অতিপারমাণবিক কণারা গানের স্বরলিপির মতো। অর্থাৎ অতিক্ষুদ্র কম্পনশীল স্ট্রিং বা তারের ওপরের মিউজিক্যাল নোট। তাহলে পদার্থবিজ্ঞান কী? পদার্থবিজ্ঞান হলো ঐকতান বা সুরেলা ধ্বনি। অতিক্ষুদ্র কম্পিত তারের ঐকতানের সূত্রগুলো হলো পদার্থবিজ্ঞান। তাহলে রসায়ন কী? রসায়ন হলো মেলোডি। তারগুলো একটার ওপর আরেকটা যখন ধাক্কা খায় তখন আপনি মেলোডি বাজাতে পারবেন। এভাবে অণু গঠিত হয়। আর মহাবিশ্ব কী? মহাবিশ্ব হলো সিম্ফোনি, তারগুলোর সিম্ফোনি। তাহলে ঈশ্বরের মন কী? ঈশ্বরের মন হলো ১১ মাত্রার হাইপার স্পেসের মধ্যে অনুরণন হওয়া মহাজাগতিক সংগীত।

বস্তু কী? গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথের অস্তিত্ব আছে কেন? প্রাণ বা ডিএনএ থাকার কারণ কী? এর কারণ সংগীত ছাড়া আর কিছুই নয়। ইলেকট্রন, নিউট্রিনো, প্রোটন, ডিএনএ, নক্ষত্র এবং ছায়াপথের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এই সংগীতই যথেষ্ট। একইভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও আছে এই সংগীত। এটাই হলো স্ট্রিং থিওরি। সে কারণেই স্ট্রিং থিওরিকে থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে, আমরা কম্পিত স্ট্রিং বা তারের ওপরের স্বরলিপি এবং তার ওপর চমৎকারভাবে বেজে চলা মেলোডি ছাড়া আর কিছুই নই।

সূত্র :অল অ্যাবাউট স্পেস ম্যাগাজিন