অনিচ্ছুক বিপ্লবী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক। আজ ২৩ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন তাঁর জীবন, কর্ম ও গবেষণা সম্পর্কে...

উত্তর ইউরোপের ঠিক যেনো পেটের মধ্যে ঢুকে আছে বাল্টিক সাগর। তাঁর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা শহর, কিয়েল। এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য হোলস্টাইনের রাজধানী এটি। শহরটি বর্তমানে জার্মানির অধীনে থাকলেও এককালে তা ছিল ডেনমার্কের শাসনাধীন। এ শহরে কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা করেন জোহান জুলিয়াস উইলহেম প্ল্যাঙ্ক। ঈশ্বর ও মানুষের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই দায়িত্ববান মানুষটি ছিলেন সংকল্পে অটল, নিষ্ঠাবান আর দেশপ্রেমিক। কিয়েলের বন্দরনগরী বাল্টিক সাগরের পশ্চিম তীরের অবস্থিত শ্লেসবিগ শহর। এ শহরের কুটেরস্ট্রাসা এলাকার এক বাসায় স্ত্র্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন তিনি। ঠিকানা ১৭ কুটেরস্ট্রাসা।

এ বাড়িতে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এমা প্যাটজিগের গর্ভে ১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম নিল একটি শিশু। তাঁর নাম রাখা হল কার্ল আর্নেস্ট লুডভিগ মার্ক্স প্ল্যাঙ্ক। ১০ বছর বয়েসে ছেলেটি নিজের নাম মার্ক্স (Marx) একটু ছেঁটে ম্যাক্স (Max) লিখতে শুরু করে। কারণ এ বানানটি তাঁর কাছে সহজ মনে হয়েছিল। বাকী জীবন এই নামটিই ব্যবহার করেছেন তিনি: ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

প্ল্যাঙ্কের জন্মের সময় জার্মানি নামের কোনো দেশের অস্তিত্ব ছিল না। বরং জার্মান ভাষাভাষী ৩৯টি আলাদা প্রদেশের একটা সাধারণ সংবিধান ছিল।

ঐতিহ্যগতভাবে প্ল্যাঙ্ক পরিবার ছিল উচ্চশিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী। তাঁদের পরিবার অনেক আগে থেকে গির্জা আর রাষ্ট্রের সেবায় নিজেদের উত্সর্গ করেছিল। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের প্রপিতামহ গটলিয়েব জ্যাকব প্ল্যাঙ্ক এবং পিতামহ হেনরিক লুডভিগ প্ল্যাঙ্ক দুজনেই ছিলেন গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক। আর তাঁর বাবা অধ্যাপক উইলহেম প্ল্যাঙ্কের কথা তো আগেই বলেছি।

এমা প্যাটজিগের গর্ভে উইলহেম প্ল্যাঙ্কের মোট পাঁচটি সন্তান জন্মেছিল। চতুর্থ সন্তানই হলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তিনি ছিলেন ওই পরিবারের মোট সাতটি সন্তানের মধ্যে ৬ষ্ঠ (তাঁর বাবার আগের সংসারে আরও দুই সন্তান ছিল)। তাঁর জন্মের সময় তাঁর সৎ ভাইবোন এমা আর হুগোর বয়স ছিল প্রায় ১৩ বছরের কাছাকাছি। অন্যদিকে তাঁর আপন ভাইবোনদের মধ্যে হারমানের বয়স সাত, অ্যাডেনব্রেটের পাঁচ বছর আর হিল্ডাগার্ডের ছিল তিন বছর। ম্যাক্সের জন্মের আরও পাঁচ বছর পর জন্ম হয় পরিবারের সবার ছোট সদস্য অটো প্ল্যাঙ্কের। মা এমা প্ল্যাঙ্ক ছিলেন একজন হাসিখুশি আর আবেগপ্রবণ নারী। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছেলে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সাথে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ বজায় ছিল।

প্ল্যাঙ্কের জন্মের সময় জার্মানি নামের কোনো দেশের অস্তিত্ব ছিল না। বরং জার্মান ভাষাভাষী ৩৯টি আলাদা প্রদেশের একটা সাধারণ সংবিধান ছিল। একে বলা হত জার্মান কনফেডারেশন বা জার্মান সংঘ। নামে সংঘ হলেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল বেশ আলগা। এ কনফেডারেশনের মধ্যে তত্কালীন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য এবং প্রুশিয়া কিংডম ছাড়াও ছিল স্যাক্সোনি, ব্যাভারিয়া, হেস, ব্যাডেনসহ আরও অনেকগুলো প্রদেশ। কিয়েল ছিল শ্লেসবিগ-হোলস্টাইন এলাকার একটি উপকূলীয় ছোট্ট শহর, যা ছিল ডেনমার্কের রাজার শাসনাধীন। প্রায় ১৫ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ এলাকার প্রধান পেশা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। জাহাজের মাধ্যমে তারা দূরদূরান্তে দেশ-বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করত।

ছোট্টবেলার যে আবছা স্মৃতিটি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মনে অনেক দিন দাগ কেটে ছিল, সেটি হল রাস্তা দিয়ে দলে দলে সৈন্য মার্চ করে যাওয়ার দৃশ্য।

বাল্টিক সাগরের তীরের কর্মব্যস্ত এই এলাকায় ম্যাক্সের শৈশব বেশ আনন্দেই কেটেছে। শৈশব উপভোগ করার জন্য ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তিনি। কিয়েলের কুটেরস্ট্রাসা এলাকার তাঁদের বাড়িতে সবসময় ভাইবোন আর চাকর-বাকরদের হৈ চৈ আর আনন্দ উত্সব যেন লেগেই থাকত। এসবের মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকেন ছোট্ট ম্যাক্স। ছোটবেলা থেকেই পড়ার ও শেখার সবরকম সুযোগ ও সুবিধা দিয়েছিলেন বাবা-মা। তাঁদের উত্সাহে একে একে প্রায় সবকিছুর প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তাই অল্প বয়স থেকে ভাষা, গণিত, ধর্ম আর সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি হয় তাঁর মধ্যে। সত্যি বলতে কী, সবগুলোতেই প্রায় সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। আবার পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে একসময় তিনি কঠোর পরিশ্রমীও হয়ে ওঠেন।

ছোট্টবেলার যে আবছা স্মৃতিটি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মনে অনেক দিন দাগ কেটে ছিল, সেটি হল রাস্তা দিয়ে দলে দলে সৈন্য মার্চ করে যাওয়ার দৃশ্য। পরে তিনি জেনেছেন, ওটা ছিল দ্বিতীয় শ্লেসবিগ যুদ্ধ। ১৮৬৪ সালের ওই যুদ্ধে আসলে প্রুসিয়ান এবং অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীকে মার্চ করতে দেখেছিলেন তিনি। ডেনমার্কের রাজকীয় সেনাবাহিনির বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ করতে কিয়েল শহরের ওপর দিয়ে এই সেনাবাহিনী যখন মার্চ করে যাচ্ছিল, তখন ম্যাক্সের বয়স মাত্র ছয় বছর। প্রুসিয়ান আর অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনী সেবার ডেনমার্কের রাজকীয় বাহিনিকে সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। এরপর প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলহেমের অধীনে আসে কিয়েল শহর। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর যুদ্ধ শেষ হলেও এর ভয়াবহতা পরবর্তী জীবনেও তাঁকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে।

এর দুই বছর পরে ওই অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ দানা বেধে ওঠে। প্রুশিয়া এবং তাঁর উত্তরাঞ্চলের মিত্ররা অস্ট্রিয়া ও দক্ষিণাঞ্চলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেটি ১৯৬৬ সালের ঘটনা। এতে ভাঙন দেখা দেয় জার্মান ফেডারেশনে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে নতুন কনফেডারেশন বা সংঘ গড়ে তোলে প্রুশিয়া। এ সংঘ থেকে বাদ পড়ে অস্ট্রিয়া, ব্যাভারিয়া ও তাঁর প্রতিবেশি এলাকাগুলো।

এই বাদ পড়া অঞ্চল থেকে ১৮৬৭ সালে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার ডাক আসে তাঁর পিতা উইলহেম প্ল্যাঙ্কের। মিউনিখের নামকরা লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার আমন্ত্রণ পান তিনি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাতে সম্মতিও দেন উইলহেম প্ল্যাঙ্ক। শিগগিরই তাঁদের পরিবার কিয়েলের পাট চুকিয়ে আল্পস পবর্তের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মিউনিখ শহরে চলে যায়। প্রুশিয়া থেকে দক্ষিণের ব্যাভারিয়া রাজ্যে। তখন ম্যাক্সের বয়স মাত্র নয় বছর। এ সময়ের অনেক স্মৃতিই স্পষ্ট মনে রাখতে পেরেছিলেন ম্যাক্স।

গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাইবোনসহ প্রায়ই এক গ্রাম্য এলাকা এলডেনায় বেড়াতে যেতেন বালক ম্যাক্স। সেখানে সাপের মত এঁকেবেঁকে পথ চলে উত্তর সাগরে গিয়ে মিশেছে এলবি নদী। এ নদীর তীর ধরে এগিয়ে গিয়ে একসময় এলডেনায় পৌঁছাতেন তারা। ভাইবোন আর সমবয়সী আত্মীয়দের সঙ্গে সারা দিন হৈ চৈ আর ছোটাছুটি করে কাটিয়ে দিতেন সেখানে। গরমের দিনগুলোতে গাছের ছায়ায় বসে, কিংবা সন্ধ্যাবাতির ঝাপসা আলোয় মাঝে মাঝে চলত গল্পের বই পড়া। স্কটিশ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কট ছিল তাঁর প্রিয়। আইভানহো, তালিসমানসহ অন্যান্য বইয়ের পাতায় বুদ হয়ে চলে যেতেন তেপান্তরের স্বপ্নের কোন জগতে। কিংবা ভাইবোন আর বন্ধুরা মিলে নিজেরাই গীতিনাটকে অভিনয় করে আনন্দঘন সময় কাটিয়ে দিতেন কখনো কখনো। এলডেনার এই আটপৌরে ঠিকানাটি একসময় হয়ে ওঠে তাঁদের পারিবারিক গ্রীষ্মকালীন নিয়মিত আস্তানা। একে ঘিরে তাঁর এতসব আনন্দের স্মৃতি যে এলডেনাকে শৈশবের স্বর্গ বলে মনে করতেন তিনি। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও এ সময়ের স্মৃতিচারণ করে আফসোস করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

রাজায় রাজায় এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্যেই স্বাভাবিক নিয়মে পড়ালেখার পাট শুরু হয় ম্যাক্সের। মিউনিখে সেকালের নামকরা সেকেন্ডারি স্কুল ম্যাক্সিমিলিয়ান জিমনেসিয়াম স্কুলে ভর্তি হন প্ল্যাঙ্ক।

১৮৭০ সালের গ্রীষ্মে প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেয় প্রতিবেশি দেশ ফ্রান্স। চতুর জার্মান চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক একে একটা বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে দেখতে পান। অনেক দিক ধরে জার্মানভাষী রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে নিজেদের সাম্রাজ্যের ছায়াতলে আনার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণায় বিনা মেঘে সেটাই যেন পেয়ে গেলেন একেবারে হাতের মুঠোয়। যুদ্ধের সাজ সাজ রব পড়ে গেল জার্মানভাষী রাজ্যগুলোতে। মাত্র ছয় মাসের মাথায় খুব সামান্য হতাহত আর ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে যুদ্ধে জিতে গেলেন বিসমার্ক। তবে আরও অনেকের মত পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল দেশপ্রেমিক প্ল্যাঙ্ক পরিবার। ম্যাক্সের বড় ভাই হারমান সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের দিকে যুদ্ধের প্রায় শেষপর্যায়ে মারা যান তিনি। বিজয়ী প্রুশিয়ান সম্রাট প্রথম উইলহেম নতুন একীভূত জামার্নির রাজা হন। কিন্তু নতুন সাম্রাজ্যের জোড়াতালির মধ্যে নিজেদের রক্তের ছিটে লেগে থাকতে দেখতে পেল প্ল্যাঙ্ক পরিবার।

রাজায় রাজায় এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্যেই স্বাভাবিক নিয়মে পড়ালেখার পাট শুরু হয় ম্যাক্সের। মিউনিখে সেকালের নামকরা সেকেন্ডারি স্কুল ম্যাক্সিমিলিয়ান জিমনেসিয়াম স্কুলে ভর্তি হন প্ল্যাঙ্ক। শুরু থেকেই মেধার সাক্ষর রাখতে শুরু করেন তিনি। পড়ালেখায় মেধাবী হলেও তাঁকে দেখে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি যে, বড় হয়ে একদিন নামকরা বিজ্ঞানী হবেন তিনি। কারণ কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও ক্লাসে কখনো প্রথম হতে পারেননি ম্যাক্স। তবে প্রায় সবসময় সেরার কাছাকাছি থাকতেন। তাঁর অবস্থান থাকত সেরা তিন বা পাঁচের মধ্যে। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় ধরাবাধা কারিকুলামে পর্যাপ্ত বাস্তব জ্ঞান বজায় রাখতে মুখস্তবিদ্যার প্রতিও বেশ গুরুত্ব দেওয়া হতো। একবার স্কুল রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, কিছু ছেলেমানুষি থাকা সত্ত্বেও প্ল্যাঙ্ক ১০ বছর বয়সে খুবই স্বচ্ছ আর যৌক্তিক মনের অধিকারী।

ম্যাক্সিমিলিয়ান জিমনেসিয়ামে শিক্ষক হারমান মুলারের অধীনে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও গতিবিদ্যায় হাতেখড়ি নেন তিনি। মুলারের কাছ থেকে তিনি শক্তির সংরক্ষশীলতাঁর নীতি সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারেন। এভাবে পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে কিশোর ম্যাক্সের। প্রাকৃতিক এসব নিয়ম-কানুনের কারণে তাঁর মনে জেগে ওঠা অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতেন তিনি। স্কুলে অন্যদের তুলনায় একটু যেন বেশি পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। তাই অন্যদের চেয়ে কিছুটা আগেই স্কুল শেষ করতে পারেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

স্কুলে থাকতে বিজ্ঞান ছাড়াও প্ল্যাঙ্কের প্রিয় বিষয় ছিল সঙ্গীত ও ভাষাবিদ্যা। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা শুরু হয় স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনেক আগে থেকেই। পরিবারের উত্সাহে ছোটবেলা থেকে তিনি পিয়ানো বাজানো ও গান শেখেন। স্বাভাবিকভাবে এতে আকর্ষণ বোধহয় একটু বেশিই ছিল। তাই ১৬ বছর বয়েসে অন্য সবার মতো মিউনিখের কোন সরাইখানায় আড্ডায় নয়, বরং অপেরা হাউজ আর কনসার্ট হলগুলো আকর্ষণ করত তরুণ প্ল্যাঙ্ককে। কারণ তিনি পিয়ানো, অর্গান ও সেলো বাজাতে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একইসাথে গান লিখতেন, অপেরা কম্পোজেও তাঁর দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো। পারিবারিক অনুষ্ঠানে, স্কুলে বা গির্জায় নিয়মিত বাজাতেন, গান গাইতেন। স্কুলের সঙ্গীত বিষয়ক যেকোন প্রতিযোগিতায় তাঁর পুরস্কার ছিল একদম বাধা। ঝোকের বশে তিনি পেশাদার পিয়ানিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন সেই বয়সে। অবশ্য চাইলে সেটা হয়ত হতেও পারতেন। তাহলে সঙ্গীত জগতের আরেক প্রতিভাবান, মেধাবী কাউকে পাওয়া যেত হয়ত, কিন্তু পদার্থবিদ্যার ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই লেখা হতো অন্যভাবে।

১৯৩১ সালে বার্লিনে এক দাওয়াতে আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ও তাঁদের বন্ধুরা
ছবি: উইকিপিডিয়া

কিন্তু তাতে বাধ সাধে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর রহস্যময় প্রকৃতিতে গভীরভাবে জানা ও বোঝার কৌতুহল। এই অদম্য কৌতুহলের কাছে হেরে সেই ঝোঁক একসময় কাটিয়ে ওঠেন প্ল্যাঙ্ক। মাথা থেকে সঙ্গীতের ভূত নামিয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন।

এই লক্ষ্য ভেদ করতে জার্মানির অন্যতম নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৮৭৪ সালের অক্টোবরে। সেখানে ভর্তি হওয়ার আগে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ালেখা করলে ভবিষ্যত কেমন হবে সেই পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা পদার্থবিদ ও গণিতবিদ ফিলিপ ভন জলির কাছে। সেকালের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতো জলিও মনে করতেন, পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সবকিছু আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। এখন কেবল অগুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বাকি রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্ল্যাঙ্ককে পদার্থবিদ্যায় নয়, গণিতে পড়ার পরামর্শ দেন তিনি।

মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিন বছর গণিত আর গবেষণাগারে পদার্থবিদ্যা হাতকলমে শিখতে হল তাঁকে। কারণ তখনও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ক্লাস হতো না।

জবাবে প্ল্যাঙ্ক বলেছিলেন, তিনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চান না, শুধু এই ক্ষেত্রটির মৌলিক বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে চান। মনের ইচ্ছা চাপা দিয়ে তবুও গুরুর পরামর্শ মাথায় পেতে নিয়ে শুরম্নতে গণিতে ভর্তি হন। কিন্তু নিজের সাথে বেশিদিন আপোষ করতে পারলেন না। নিজের অদম্য কৌতুহলের কাছে হার মেনে অচিরেই সিদ্ধান্ত পালটান। বেছে নেন পছন্দের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান। মনের মধ্যে প্রকৃতির কার্যবিধি বোঝার ক্রমেই বাড়তে থাকা কৌতুহল মেটাতেই এ সিদ্ধান্ত।

নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না প্ল্যাঙ্কের। তাঁর চাওয়া ছিল, শুধু এ পর্যন্ত যা কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে তা ভালোভাবে ও গভীরভাবে বুঝতে। সেই তৃষ্ণা মেটাতে অধিকাংশ সময় পড়ালেখায় মশগুল থাকতেন তিনি। পদার্থবিদ্যার নতুন নতুন বিষয় শিখতে গিয়ে বস্তু সম্পর্কেও নতুন নতুন চিন্তা করতে শিখলেন। এ সময় তিনি পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারেন, বিশেষ করে তাপগতিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো। তাঁর মতে, তত্ত্ব হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা। যেসব বিষয় দেখা যায় না, তা নিয়ে বুঝতে ও চিন্তা করার উপায় হল তত্ত্ব। এই উলপদ্ধির পর ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন প্ল্যাঙ্ক। তাঁর বদলে তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা করতে চাইতেন। বিশেষ করে বস্তু ও তাঁর প্রকৃতি সম্পর্কে পড়ালেখা করতে গিয়ে বিভিন্ন অবস্থায় বস্তুর ক্ষেত্রে কী ঘটে তা শেখেন তিনি। বস্তু ও তাপের প্রতি কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। একসময় আগ্রহী হন তাপ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণায়। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে তাপগতিবিদ্যা নিয়ে, তাপ, আলো আর শক্তি নিয়ে যার কাজকারবার।

মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিন বছর গণিত আর গবেষণাগারে পদার্থবিদ্যা হাতকলমে শিখতে হল তাঁকে। কারণ তখনও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ক্লাস হতো না। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই জলির তত্ত্বাবধানে জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মত পরীক্ষামূলক গবেষণা করেন তিনি। উত্তপ্ত প্লাটিনামের উপস্থিতিতে হাইড্রোজেন গ্যাসের ব্যাপনের প্রকৃতির পরীক্ষা ছিল সেটি। এরপর আর পরীক্ষামূলক কোন পরীক্ষার ধারে কাছেও আসেননি, তাত্ত্বিক গবেষণাতেই জীবন উত্সর্গ করেন তিনি।

তাত্ত্বিক গবেষণা করতে গিয়েই ১৯০০ সালের আকস্মিকভাবে তিনি জন্ম দেন নতুন এক পদার্থবিজ্ঞান। সেটিই কোয়ান্টাম তত্ত্ব। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে বিজ্ঞানের নতুন এই রাজ্যের জন্ম দেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না তাঁর। কিন্তু কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে এ ছাড়া আর তাঁর আর করার কিছুই ছিল না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার কারণেই তাঁকে বলা হয় অনিচ্ছুক বিপ্লবী।

আজ ২৩ এপ্রিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের জন্মদিন। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

সূত্র: পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন স্রষ্টা/ এ এম হারুন-অর-রশীদ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা (১৯৯৫)

কোয়ান্টাম জগত/ হায়দার আকবর খান রনো, বাংলা একাডেমি, ঢাকা (২০১৭)

কণা তরঙ্গ/ রেজা এলিয়েন, বর্ণায়ন, ঢাকা (২০১৭)

কোয়ান্টাম: আইনস্টাইন, বোর অ্যান্ড দ্য গ্রেট ডিবেট অ্যাবাউট দ্য নেচার অব রিয়েলিটি/ মনোজিত্ কুমার, আইকন বুকস, যুক্তরাজ্য (২০০৯)

সায়েন্টিফিক বায়োগ্রাফি অ্যান্ড আদার পেপার/ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক

প্ল্যাঙ্ক: ড্রাইভেন বাই ভিশন, ব্রোকেন বাই ওয়ার/ ব্র্যান্ডন আর. ব্রাউন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, যুক্তরাষ্ট্র (২০১৫)

দ্য ডাইলেমা অব এন আপরাইট ম্যান/ জে. এল. হেলব্রন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস (১৯৮৬)

কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক/আবুল বাসার, বাতিঘর (২০২১)

উইকিপিডিয়া