নিউক্লিয়ার বলের কাহন - ৫

কেমন করে সূচনা হলো কণাত্বরক যন্ত্রের? এর প্রয়োজনই-বা পড়ল কেন? পরমাণুর ভেতরে উঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের এই নবযাত্রার পেছনের কথা…

মধ্যযুগেও মানুষ ভাবত, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আর তারকামণ্ডলী একটা উপুড় করা বাটির গায়ে কতগুলো আলোর উৎস। বলা বাহুল্য, গ্যালিলিওর দুরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিল। তারপরও মহাকাশবিজ্ঞানে আরও কত যে চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা ১৯২০ সালেও বিজ্ঞানীরা বোধ হয় অনুমান করতে পারেননি। এই সময়ের মধ্যে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রণয়ন শেষ করে ফেলেছিলেন। মহাবিশ্বের জ্যামিতি কী হতে পারে, তা নিয়ে তাঁর পাশাপাশি অন্যরাও গবেষণা চালাচ্ছিলেন। সেখানে বড় সমস্যা ছিল, মহাবিশ্বের মধ্যে কী কী উপাদান আছে, সে ব্যাপারে কারও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। অবশ্য এক শ বছর পরও যে আমরা এই প্রশ্নের সদুত্তর জানি, তা কিন্তু নয়!

এখন, আমরা এই পর্যায় পর্যন্ত যা জানি, তা সংক্ষেপে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

ক. পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস রয়েছে, যা পরমাণুর ভরের প্রায় সবটা ধারণ করে। এই নিউক্লিয়াসের ভেতরে রয়েছে প্রোটন ও নিউট্রন, যাদের আমরা দলগতভাবে নিউক্লিয়ন নামে ডাকব। আর নিউক্লিয়াসের চারপাশে রয়েছে কতগুলো কক্ষপথে চলমান ইলেকট্রন।

খ. নিউক্লিয়নগুলোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী আকর্ষণ বিদ্যমান, যার উদ্ভবের জন্য মেসন নামের কণার আদান–প্রদান দায়ী।

গ. পৃথিবীর বুকে পাওয়া তেজস্ক্রিয় ভারী মৌল ছাড়া পৃথিবীর বাইরে থেকেও কসমিক রশ্মি আসছে। এর প্রভাব তেজস্ক্রিয় কণার মতোই। এই কণাগুলো অন্যান্য নিউক্লিয়াসের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিকণা তৈরি করতে পারে। এর উপস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী কোয়ান্টাম সমীকরণের মাধ্যমেই করা হয়েছিল।

আগেই বলেছি, চৌম্বকক্ষেত্রে চলমান কসমিক বা মহাজাগতিক রশ্মির ছবি পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমেই কার্ল অ্যান্ডারসন ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী নেড্ডারমেয়ার ১৯৩৬ সালে আরেকটি নতুন কণা আবিষ্কার করলেন। চৌম্বকক্ষেত্রে এই নতুন কণার গতিপথের বক্রতা দেখা গেল। সেটা ওই একই চৌম্বকক্ষেত্রে পাওয়া প্রোটন ও ইলেকট্রনের গতিপথের বক্রতার মাঝামাঝি মানের। অর্থাৎ এই নতুন কণার ভর এ দুই প্রকার কণার মাঝামাঝি। এর মানে কি এই কণা জাপানি বিজ্ঞানী ইউকাওয়ার প্রস্তাবিত কণা, যার ভর ঠিক এই মাত্রারই হওয়ার কথা?

এর উত্তর পেতে বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হলো আরও ১০ বছর। এটা বোঝার জন্য আমাদের কয়েকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। ইউকাওয়া যে মেসন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার কাজ মূলত নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান প্রোটন বা নিউট্রনগুলোর মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করা। তাহলে নিউক্লিয়াসে এই মেসন কণাগুলো খুব সহজেই শোষিত হবে, ঠিক যেভাবে আলো (অর্থাৎ ফোটন কণা) কোনো কালো বস্তুর ওপর পড়লে শোষিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিজ্ঞানীরা যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁদের মনোযোগ আবারও মৌলিক গবেষণায় ফিরে আসে।

কার্ল অ্যান্ডারসন ও নেড্ডারমেয়ার যে ‍‍‍‘মেসন’ কণা দেখতে পেলেন, তা যদি আদতেই ইউকাওয়ার মেসন হয়ে থাকে, তাহলে তো তার নিউক্লিয়াসে শোষিত হওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর একদল ইতালীয় পদার্থবিদ দেখালেন, এই মেসন কণাগুলো লোহার পাতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় যে মাত্রায় শোষিত হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক কম মাত্রায় শোষিত হচ্ছে। এই পরীক্ষাগুলো তাঁরা ১৯৪০ সালের দিকে শুরু করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেটা শেষ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে কথিত আছে, গবেষণার যন্ত্রপাতি রক্ষার জন্য এই ইতালীয় বিজ্ঞানীরা সেগুলোকে ইতালীয় গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছিলেন। যাহোক তাঁদের গবেষণায় বোঝা গেল, অ্যান্ডারসনদের আবিষ্কৃত কণাটি আর যা–ই হোক, ইউকাওয়ার মেসন কণা নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিজ্ঞানীরা যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁদের মনোযোগ আবারও মৌলিক গবেষণায় ফিরে আসে। তবে এখানে পারমাণবিক বোমা তৈরির সময় যেসব প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোর প্রয়োগ ঘটায় দ্রুতই নতুন নতুন কণার আবিষ্কার ঘটতে থাকে। পরিস্থিতির এই দ্রুত ‘উন্নতি’র পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল।

কসমিক রশ্মি নিয়ে কাজ করার প্রধান অসুবিধা ছিল, এর উৎসের ওপর আমাদের কোনো হাত ছিল না। অর্থাৎ আমরা ইচ্ছেমতো সময়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে পারতাম না অথবা কণাটির শক্তি কত হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। বলতে গেলে, ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে উপযুক্ত কণার আগমনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় কসমিক কণা নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের। এখন যেকোনো পরীক্ষণের ফলাফল মেনে নিতে হলে সেই পরীক্ষা শুধু একবার করলে হয় না, সেটার পুনরাবৃত্তি করতে হয় এবং কসমিক রশ্মির ক্ষেত্রে এই সুবিধা পাওয়া যায় না। ডেটার সংখ্যা কম হলে পরিসংখ্যানের নিরীক্ষা ভালো হয় না। যদিও কসমিক রশ্মিতে থাকা অনেক কণারই শক্তি ওই সময়ে পরীক্ষাগারে থাকা তেজস্ক্রিয় উৎসের শক্তি থেকে বেশ বেশি ছিল; তারপরও যাতে কসমিক রশ্মির ওপর নির্ভর না করতে হয়, সে জন্য কণাত্বরক যন্ত্র (Particle accelerator) উদ্ভাবন করা দরকার হয়ে পড়ল।

একদিক থেকে চিন্তা করলে সবচেয়ে সহজ কণাত্বরক হচ্ছে একটি সমান্তরাল পাত ধারক। কারণ, তার দুই পাতের মধ্যে যে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থাকে, তা বৈদ্যুতিক চার্জবিশিষ্ট যেকোনো কণার বেগ বাড়ায়, ফলে তার গতিশক্তিকেও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্যই চার্জটিকে তার বিপরীত চার্জবিশিষ্ট পাতের দিকে চালিত করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এভাবে গতিশক্তি খুব বেশি মাত্রায় বাড়ানো যায় না। কারণ, কণায় যে শক্তি সঞ্চালন করা হয়, তা আসে দুই পাতের বিভব পার্থক্য থেকে (ঠিক যেমন ওপর থেকে পতনশীল বস্তুর গতিশক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে)। আর এই বিভব পার্থক্য গবেষণাগারে ইচ্ছেমতো বৃদ্ধি করা যায় না। কারণ, একপর্যায়ে যেকোনো ধারক থেকে বৈদ্যুতিক ডিসচার্জ ঘটবেই। তাহলে আমরা কীভাবে কণার গতিশক্তির মান বাড়াতে পারি? একটা উপায় হতে পারে, আমরা উচ্চ বিভব পার্থক্যে রাখা একটি ধারক ব্যবহার না করে‌ কম বিভব পার্থক্যে রাখা একাধিক ধারক পরপর (সিরিজে) রাখতে পারি। তাতে অবশ্য আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়।

বাঁয়ে ধারকের ধনাত্মক পাত আর ডানে ঋণাত্মক পাত

ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য প্রথমে একটিমাত্র ধারকের কথা চিন্তা করি। ওপরের বাঁয়ের চিত্রে (চিত্র ১) ধারকের ধনাত্মক পাতকে সাদা ও ঋণাত্মক পাতকে কালো দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র রয়েছে, যা ডান দিকমুখী হয়ে আছে এবং পাত দুটোর মধ্যে অবস্থিত ধনাত্মক চার্জের গতিশক্তি সে ক্ষেত্রটি বৃদ্ধি করবে। কারণ, বৈদ্যুতিক বলটি চার্জের বেগ বাড়িয়ে দেবে। এখন আমাদের মনে হতে পারে, এ রকম কয়েকটি ধারক পরপর সাজিয়ে রাখলে আমরা এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চার্জের গতিশক্তি ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নিতে পারি। কিন্তু এটা বলা সহজ হলেও কাজটা করা এত সোজা নয়। কারণটা কী? সেটা বোঝানোর জন্য পরপর কয়েকটি পাত ধারক সমান্তরালভাবে সাজিয়ে রাখি (চিত্র ২)।

বাঁয়ের ছবির মতো কিছু ধারক পরপর সাজিয়ে রাখা

আগের মতোই ঋণাত্মক পাতকে সাদা আর ধনাত্মক পাতকে কালো রং দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আগের মতোই বাঁ থেকে চলমান ধনাত্মক চার্জ প্রথম সাদা পাত (১) থেকে কালো পাতের (২) দিকে চলমান থাকার সময় চার্জের গতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু পরে, সাদা পাতের (৩) দিকে যাওয়ার সময় যে বৈদ্যুতিক বল উল্টো দিকে কাজ করবে আর তার ফলাফলে গতিশক্তি না বেড়ে বরং কমতে থাকবে, এই সমস্যার সমাধান কী? এটার সমাধান বেশ কয়েকভাবে বিজ্ঞানীরা করলেন। কিন্তু যেটা সব কটা সমাধানই প্রয়োজন হলো, তা হলো একমুখী বিদ্যুৎ বা বিভব পার্থক্য ব্যবহার না করে পরিবর্তিত (Alternating) বিদ্যুৎ বা বিভব পার্থক্য ব্যবহার করা। এখনকার আধুনিক কণাত্বরকগুলোতে (Particle accelerator) এ নীতিই ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করব।

(চলবে...)

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ