স্ট্রিং থিওরির গোড়ার কথা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিজ্ঞান এক চমকপ্রদ মোড় নেয়! এলোমেলো কণার জট থেকে জন্ম নেয় মহাবিশ্বের গোপন রহস্যের চাবিকাঠি—স্ট্রিং তত্ত্ব। কি সেই স্ট্রিং তত্ত্ব? কীভাবে এই তত্ত্ব আজকের অবস্থানে এল?

যুদ্ধ যেমন মানবতাধংসী ইতিহাস তৈরি করে, তেমনি মাঝেমধ্যে বিজ্ঞান গবেষণাতেও প্রাণ সঞ্চারী হয়ে ওঠে। এমনটা দেখা গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগমূহুর্তে। ইউরোপজুড়ে হিটলারের তাণ্ডব চলছে। এরই মধ্যে খবর রটেছে, হিটলার নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সেই বোমারু দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানীরা। তখন মার্কিন সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েন, ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানীকে জড়ো করেন ম্যানহাটন প্রজেক্টে। যেভাবেই হোক জার্মানির আগে বানাতে হবে নিউক্লিয়ার বোমা। কিন্তু এজন্য দরকার নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে প্রাণ সঞ্চার করা। সুতরাং মার্কিন সরকার মহাকাশ কিংবা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে বরাদ্দ কমিয়ে বেশিরভাগ অর্থই দেদারসে ঢালতে শুরু করে কণা পদার্থবিজ্ঞানে। কণাপদার্থবিজ্ঞান বলুন কিংবা নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান, যুগান্তকারী সব আবিষ্কার হয়েছে ওই সময়টাতেই। এর রেশ ছিল যুদ্ধের পরের দশকগুলোতেও।

গত শতাব্দীর ৩০ ও ৪০-এর দশকজুড়ে বিজ্ঞানীরা ক্লাউড চেম্বার আর ছোট ছোট সাইক্লোট্রনের সাহায্যে আবিষ্কার করেছেন নানা ধরনের ছোট বড় কণা। বিশেষ করে মহাজাগতিক রশ্মির সঙ্গে আসা হ্যাড্রন গোত্রের কণাগুলো। ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানীরা দেদারসে সেসব কণা আবিষ্কার করছেন আর নোবেল প্রাইজ বগলদাবা করছেন। এত্ত কণা, এত এত নোবেল দেখে নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিদ উইলিস ল্যাম্ব বিরক্তি অথবা কৌতুকের সুরে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে যিঁনি নতুন কণা আবিষ্কার করবেন, তাঁকে নোবেল না দিয়ে দশ হাজার ডলার জরিমানা করা উচিত।’ ল্যাম্ব যা-ই বলুন, সে সময় অত শত কণা আবিষ্কার হয়েছিল বলেই আজ পার্টিকেল ফিজিকসের ভাণ্ডার এত সম্মৃদ্ধ। কণাদের তৈরি রেখাচিত্র আর গণিতের সাহায্যেই একদিন খুলে গিয়েছিল স্ট্রিং তত্ত্বের পথ। 

আরও পড়ুন

১৯৬৮ সাল। সার্নের তরুণ গবেষক গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানোর হাতে তখন এক বোঝা তথ্য উপাত্ত। এগুলো এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিশ্বজুড়ে তখন চলছে ভারী কণাদের ভাঙনের খেলা। সাইক্লোট্রনে, অ্যাটম স্মাশারে এসব কণাদের ভাঙা হচ্ছে। সাইক্লোট্র্রনে প্রোটন কিংবা নিউট্রনের মতো ভারী কণাদের মধ্যে বৃত্তাকার পথে ঘোরানো হয়। বহুদূর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদের বেগও বাড়ানো হয় প্রতিনিয়ত। কণারা ত্বরিত হয়। এ জন্য এই যন্ত্রকে কণাত্বরক যন্ত্র বা ইংরেজিতে Particle accelerator বলা হয়। কণারা বিপুল বেগে ঘুরতে থাকে এবং প্রতিচক্রেই এর বেগ বেড়ে যায়।

এমন একটা সময় আসে, যখন আলোর বেগের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে যায় কণারা। আর তখনই দেখা যায় নিউটনের ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্রের ক্যারিশমা। এই সূত্র বলে, বেগ বৃদ্ধি করলে বস্তুর ভরবেগ বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। সমাণুপাতে বাড়ে তার থেকে পাওয়া বলের মানও। তাই একটা কণা যত ছোটই হোক তার বেগ যখন আলোর বেগে কাছাকাছি চলে যায়, তখন ভরবেগ যেমন বিপুল হয়, তেমনি গতিশক্তির মানও চরমে ওঠে। সুতরাং সেই সামান্য কণাটিও যখন অন্য বস্তুকে আঘাত করে, সেটা মারাত্মক শক্তিধর হয়ে ওঠে। সাইক্লোট্রনের কণাগুলোতেও তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে পৌঁছে যাওয়া কণাগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো, সেই সংঘর্ষে টুকরো টুকরো হয় কণাগুলো। জন্ম হয় তুলনামূলক হালকা কণাদের। সঙ্গে উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি। এই শক্তি ব্যবহার করে আরও ভারি কণাদের হদিসও মেলে।

স্ট্রিং তত্ত্বের জনক গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো
সার্ন

যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাবের সাইক্লোট্রন তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কণা ত্বরক যন্ত্র। এছাড়া সার্নেও কিছু ভালো ভালো ত্বরক যন্ত্র ছিল। কিন্তু যন্ত্র যেখানেই থাকুক, যেখানেই কণাদের ভাঙা হোক, বিশ্বের আরেক প্রান্তের বিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছে যায় সেই গবেষণার ফলাফল। ভেনেজিয়ানোর হাতে ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কণাদের ভাঙনের ফলাফল। সেগুলোর ছবিও হয়তো ছিল। কিন্তু খাঁটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে ছবির চেয়ে গণিত কিংবা গ্রাফচিত্রের মূল্য বেশি। ভারী কণাদের ভাঙনের ফলে নতুন যেসব কণাদের জন্ম হয়, তাদের একটার গতিপথ আরেকটার সঙ্গে মেলে না। তাই এদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।

গতিপথের ডেটাগুলো নিয়ে ভেনেজিয়ানো কাজ করছিলেন। ডেটাগুলোর মধ্যে কোনো মিল আছে কি না সেটাও খুঁজছিলেন। যখন মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি গণিতের বিভিন্ন ফাংশনে ফেলে এগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য খোঁজেন। শেষে আলোর রেখা পেলেন। দেখলেন কণাদের গতিথের ডেটাগুলো অয়লারের বেটা ফাংশনে ফেললে এদের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তার মানে, সাইক্লোট্রনে যে অজস্র কণাদের দেখা মিলছিল, আপাত দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন। কিন্তু ভেনেজিয়ানো দেখলেন, কিছুটা হলেও সম্পর্ক আছে। এই আবিষ্কারটা বৈপ্লবিক। আপাত দৃষ্টিতে এলোমেলো কিছু রেখাচিত্র, তার ভেতর গণিতিক নকশা খুঁজে পাওয়া, এটাই আধুনিক স্ট্রিং তত্ত্বের প্রথম আলোটা দেখিয়ে দেয়। তবে ভেনেজিয়ানো এ নিয়ে বেশি এগুতে পারেননি। একটা প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন জার্নালে।

আরও পড়ুন

কাছাকাছি সময়ে নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছিলেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। লিওনার্ড সাসকিন্ড, ড্যানিশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী হলজার নিয়েলসন এবং জাপানি-আমারেকিনা বিজ্ঞানী ইউচিরো নাম্বু। নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে কাজ করার বিস্তর সুযোগ তাঁদের। সুতরাং বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষণাগুলোর ফলাফলও তাঁদের হাতে এসে যেত সহজেই। এসেছিল ভেনেজিয়ানোর লেখা প্রবন্ধটিও।

ভেনেজিয়ানোর কাজটা বৈপ্লবিক ও আনকোরা। ইতিহাস বলে, কোনো বৈপ্লবিক তত্ত্বই অত সহজে প্রতিষ্ঠা পায় না। ভেনেজিয়ানোর বেটা ফাংশন তত্ত্ব তাই আমলে নেয়নি বৈজ্ঞানিক সমাজ। কিন্তু সবাই তো একপথে চলেন না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বেশিরভাগ বৈপ্লবিক তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলেও কিছু তরুণ প্রাণ সেটাকে বরণ করে নেন। গবেষণা, বিশ্লেষণ করে তৈরি করেন নতুন ইতিহাস। যেমনটা দেখা গিয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে। অন্যরা পাত্তা না দিলেও তরুণ আইনস্টাইন সেটা ব্যবহার করেই আলোকতড়িৎক্রিয়ার সমাধান বের করে ফেলেন।

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
উইকিমিডিয়া

তেমনি চন্দ্রশেখর লিমিটকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন ছুড়ে ফেলে দিলেও তরুণ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফাওলার সেটাকে লুফে নিয়েছিলেন। অনেক পরে এর জন্য তিনি বগলদাবা করতে সক্ষম হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। তেমনি ভেনেজিয়ানোর কাজটাকেও তিন মার্কিন বিজ্ঞানী গুরুত্বের সঙ্গে নেন, তা নিয়ে চলে কাঁটাছেঁড়া। খুব সহজেই তারা বের করেন ভেনেজিয়ানোর তত্ত্বের ত্রুটি-বিচ্যূতি।

তাঁরা জানতেন, বেটা ফাংশন আসলে এক ধরনের তরঙ্গ সমীকরণ। সেই তরঙ্গ তৈরি হয় দড়ি বা সুতার মতো বস্তু থেকে। সাসকিন্ড, নিয়েলসন আর নাম্বুরা তাই ভেনেজিয়ানোর সমাধানটা কণাদের ক্ষেত্রে বিবেচনা না করে, একমাত্রিক সুতার ক্ষেত্রে যাচাই করে দেখলেন। অর্থাৎ কণাদের কণা হিসেবে না দেখে স্ট্রিং সুতা হিসেবে বিচার করে সেগুলোর হিসাব করলেন। সেই হিসাব থেকেই সবল নিউক্লীয় বলের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হলো।

আরও পড়ুন

তাঁরা হিসাব করে দেখেন, কণার বদলে সেগুলোকে তন্তু বা খুব চিকন একমাত্রিক সুতা হিসেবে দেখা হলে, অয়লারের বেটা ফাংশনটি আরও সুন্দরভাবে মানিয়ে যায়। ভেনেজিয়ানো দুটি কণার সংঘর্ষের হিসাব কষেছিলেন। সেখান থেকে পেয়েছিলেন চার কণার স্ক্যাটারিং বা বিক্ষেপণ। কিন্তু কণা চারটি কেন?

ধরা যাক দুটি গতিশীল কণা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো, তারপর তারা ছুটে গেল দুদিকে। ব্যাপারটা স্রেফ এমন হলে দুটি কণাই হতো। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় সংঘর্ষের ফলে ভেঙে যায় কণাগুলো। ভরের হেরফের যেমন ঘটে, তেমনি পার্থক্য তৈরি হয় এদের ধর্মে ও বৈশিষ্ট্যে। অর্থাৎ সংঘর্ষের ফলে কণা দুটি ভেঙে দুটি নতুন কণার জন্ম দেয়। তাই পুরো বিক্ষেপণ পক্রিয়ায় মোট চারটি কণা জড়িত। এ ধরনের বিক্ষপণকে বলে চার কণার বিক্ষেপণ।

সাসকিন্ড, নিয়েলসন আর নাম্বু ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর অঙ্ক মিলিয়ে দেখলেন, কণাগুলোকে ঠিক কণা না ভেবে তন্তু হিসেবে দেখা হলে অয়লারের বেটা ফাংশনের সঙ্গে আরও ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায় ভেনেজিয়ানোর তত্ত্ব। কিন্তু তন্তু বা সুতাকে কেন একমাত্রিকই হতে হবে?

লিওনার্ড সাসকিন্ড
উইকিপিডিয়া

কারণ, কণাদের বৈশিষ্ট্য। অতিপারমাণবিক কণাদের বলা হয় একমাত্রিক বিন্দু কণা। যাদের আসলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কিংবা উচ্চতা থাকে না। শুধু স্থানের একটা বিন্দুতে অবস্থান করে মাত্র। তাই ভেনেজিয়ানোর তত্ত্বে কণার বদলে স্ট্রিং বা সুতা ধরতে হলে সেটা একমাত্রিক ছাড়া অন্য কোনো আকারের ধরে নিলে হিসেব মেলানো যেত না।

ভেনাজিয়ানোর তত্ত্বে বিজ্ঞানের নতুন জগতের আলো দেখা যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বের বাইরে গেলে বৈজ্ঞানিক সমাজে সহজে কদর পাওয়া যায় না। সাসকিন্ডরাও পাননি। সুতরাং হালে পানি পায়নি তাঁদের স্ট্রিং তত্ত্ব। তাঁরা একটা পেপার লিখেছিলেন। সেটা পাঠিয়েছিলেন একটা জার্নালে। তা জার্নালের সম্পাদক ছাপেননি। তাই বেশ কয়েক বছর চাপা পড়ে যায় স্ট্রিং তত্ত্ব। কিন্তু এই তত্ত্ব থেকে একটা আভাস পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের বহু আরাধ্য থিওরি অব এভরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্ব লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। এটা নিয়েই এক সময় আইনস্টাইনও মরিয়া ছিলেন।

আরও পড়ুন

ভেনেজিয়ানো সবল নিউক্লীয় বলগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়েই অয়লারের বেটা ফাংশনের সঙ্গে কণাদের গতিপথের সন্ধান পেয়েছিলেন। বেটা ফাংশন যেহেতু সুতা জাতীয় বস্তুর কম্পন ও গতীয় বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দিতে পারে, তাই নিউক্লিয়াসের ভেতরে নিউট্রন আর প্রোটন যে নিউক্লিয়ার বল দিয়ে যুক্ত থাকে, সেই সবল নিউক্লীয় বলের সঙ্গে নিশ্চয়ই সুতা বা তন্তুর কোনো সম্পর্ক আছে?

এই সম্পর্কটাই খুঁজছিলেন সাসকিন্ডরা। শেষমেষ তাঁরা পেয়েও যান। সাসকিন্ড, নিয়েলসন আর নাম্বুরা সবল নিউক্লীয় বলের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন এই তত্ত্বের সাহায্যে।

নিউট্রন ও প্রোটন যে মৌলিক কণা নয়, তা জানা গিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু সেগুলো কী দিয়ে তৈরি, তা নিয়ে দোলচাল ছিল। ১৯৬৪ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান প্রস্তাব করেন আরেক ক্ষুদ্র কণার তত্ত্ব। তিনি সেই কণাদের নাম দেন কোয়ার্ক। মোট ছয়টি ফ্লেভারের আছে। ফ্লেভার মানে এখানে গন্ধ নয়, কোয়ার্ক কণাদের ধরন। প্রতিটা ফ্লেভারের আবার চারটি কালার আছে। সেই কালারগুলোও আসলে সত্যিকারের রং নয়। এগুলোও কোয়ার্কদের একেকটি ধরন।

কোয়ার্কের ধারণা পোক্ত হওয়ার পর গ্লুয়নই হয়ে ওঠে সবল নিউক্লীয় বলের মূল বাহক কণা। এরপর কিন্তু সাসকিন্ড নিয়েলসন আর নাম্বুদের কাজ বেড়ে যায়।

নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে সক্রিয় সবল নিউক্লীয় কাজ করে মেসনের মাধ্যমে। মেসন এখানে বলবাহী কণা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে থাকা কোয়ার্কগুলো পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত থাকে—তার সমাধানও দিয়েছিলেন গেল-ম্যান। তিনি বলেন, ‘কোয়ার্কগুলো পরস্পরের মধ্যে গ্লুয়ন কণা বিনিময় করে।’ এর আগে মেসনকেই শুধু সবল নিউক্লীয় বলের বাহক কণা মনে করা হতো। কোয়ার্কের ধারণা পোক্ত হওয়ার পর গ্লুয়নই হয়ে ওঠে সবল নিউক্লীয় বলের মূল বাহক কণা। এরপর কিন্তু সাসকিন্ড নিয়েলসন আর নাম্বুদের কাজ বেড়ে যায়। মেসন ইন্ট্যার‍্যাকশনের ব্যাপারটা যত সহজে ব্যাখ্যা করা গিয়েছিল, তাঁরা ভেবেছিলেন কোয়ার্ক গ্লুয়ন ইন্টার‍্যাকশনও স্ট্রিং তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। সুতরাং কোয়ার্ক-গ্লুয়ন তত্ত্বে গিয়ে ধাক্কা খায় স্ট্রিং তত্ত্ব। অন্যদিকে মেরেকেটে বেরিয়ে যায় কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিকসের কাছে পরাজিত হয় স্ট্রিং তত্ত্ব। এরপর বেশ কয়েক বছর ধরে জন শোয়ার্জ নামে আরেক মার্কিন বিজ্ঞানী বাঁচিয়ে তোলেন স্ট্রিং তত্ত্বকে।

আরও পড়ুন

স্ট্রিং তত্ত্ব কী? এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বে মূল কণার সংখ্যা হলো মোট ১৬টি। এর মধ্যে সব ধরনের কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনসহ ১২টিকে বলে ফার্মিয়ন শ্রেণির কণা। আলোর ফোটন কণাসহ বাকি চারটিকে বলে বোসন শ্রেণির কণা। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্বানুযায়ী, এই ১৬টি কণাই শেষ কথা নয়। বস্তুর আরও ক্ষুদ্রতম কণার অস্তিত্ব রয়েছে। সেটা হলো স্ট্রিং বা তন্তু। স্ট্রিংয়ের ঘূর্ণনেই কণার সৃষ্টি।

ধরা যাক, ইলেকট্রন বা কোয়ার্কের কথা। এগুলোকে যদি খুব সূক্ষ্মভাবে দেখা যেত, তাহলে দেখতাম এগুলো কণা নয়, সুতার মতো অতি সূক্ষ্ম তন্তুর কম্পন। ধরি, একটা চিকন চুড়ির কথা। চুড়িকে ঘুরিয়ে মেঝের ওপর ছড়িয়ে দিলে তখন আর সেটাকে চুড়ির মতো দেখায় না। দেখায় টেনিস বল আকারে একটা গোলকের মতো। আবার চুড়ির ঘূর্ণন যখন থেমে যাবে, তখন চুড়িকে আর বলের মতো দেখাবে না। সুতার বিভিন্ন মাত্রায় কম্পনের ফলে বিভিন্ন কণার সৃষ্টি। যেমন ইলেকট্রনের জন্য তন্তুর কম্পনের মাত্রা এক রকম। কোয়ার্কের জন্য তন্তুর কম্পন মাত্রা আবার ভিন্ন। অন্য মৌলিক কণাদের জন্য তন্তুর আলাদা আলাদা মাত্রার কম্পন নির্দিষ্ট আছে। তন্তুর কম্পনের মাত্রাই ঠিক করে দেয়, তা থেকে সৃষ্ট কণার ভর, চার্জ, স্পিন কেমন হবে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোই এক ধরনের কণা থেকে আরেক ধরনের কণার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। আর এসব বিচিত্র কণা দিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের মহাবিশ্ব। এই মহাবিশ্ব তাই সুতোয় বোনা মহাবিশ্ব।

সূত্র:

১. দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিকস/লি স্মলিন

২.হোয়াই স্ট্রিং থিওরি/জেসেফ কনলন

৩. দ্য ফ্যাব্রিক অব কসমস/ব্রায়ান গ্রিন

৪. দ্য গড ইকুয়েশন/মিচিও কাকু/অনুবাদ: আবুল বাসার