অভিকর্ষজ ত্বরণ সম্পর্কে প্রায় সবাই জানে। প্রতি একক ভরকে পৃথিবী নিজের দিকে যে হারে টানে, সেটাই হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ। মহাকর্ষ বলের কারণে এটা তৈরি হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে ওঠা যায়, মানে পৃথিবী আর বস্তুর মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, g-এর মান তত কমে।
আবার মাটি খুঁড়ে যদি নিচের দিকে নামা শুরু করেন, তাহলেও একই ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ অভিকর্ষজ ত্বরণের মান কমবে। তবে এবার কিন্তু দূরত্ব বাড়ার কারণে কমবে না। কমবে পৃথিবীর কার্যকর ভর কমার কারণে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে যদি কোনোভাবে পৃথিবী কেন্দ্রে যেতে পারেন, তাহলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্য হয়ে যাবে!
পৃথিবী কেন্দ্রে যাওয়া আসলেই সম্ভব কিনা, তা নিয়ে এক দফা তর্ক হতেই পারে। কিন্তু যেতে পারলে সেখানে যে মহাশূন্যের মতো ভরহীন এক অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীরা কেন এত নিশ্চিত যে, পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে g-এর মান শূন্য হয়ে যাবে?
শুরুটা করা যাক মহাকর্ষ দিয়ে। মহাকর্ষ হলো মহাবিশ্বের দুটি বস্তুর ভরের কারণে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ। এই আকর্ষণ বল নির্ভর করে বস্তু দুটির ভরের গুণফলের ওপর (ভর বেশি হলে আকর্ষণ বেশি) এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে (দূরত্ব বাড়লে আকর্ষণ দ্রুত কমে)। সহজ কথায়, যত বেশি ভর, তত বেশি টান। আর যত কাছে, তত বেশি টান।
কিন্তু পৃথিবীর কেন্দ্রের বেলায় এই হিসাবটা একটু ভিন্নভাবে কাজ করে। আমি আপনি যখন পৃথিবীর ওপরে থাকি, তখন পুরো পৃথিবীর ভর আমাদের টানতে থাকে নিজের দিকে। আমরাও আমাদের ভর দিয়ে পৃথিবীকে টানি। তবে আমাদের আকর্ষণ বল বা টানটা অতি সামান্য। পৃথিবীর এই বিশাল ভর ভূপৃষ্ঠে থাকা অবস্থায় আমার আপনার তুলনায় এক দিকে থাকে। যেমন, দাঁড়িয়ে থাকলে থাকে পায়ের দিকে। আবার কাউকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলে পৃথিবীর ভর থাকে মাথার দিকে।
মজাটা হয়, আমরা যখন মাটিতে গর্ত খুড়ে নিচে নামতে থাকি, তখন। পৃথিবীর ভরটা একদিকে কাজ করার পরিবর্তে আমাদের ডানে-বাঁয়ে-ওপরে-নিচে সবদিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ফলে বদলাতে শুরু করে পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ।
যত গভীরে নামতে থাকবেন, পায়ের নিচের ভর তত কমতে থাকবে এবং ওপরের ভর বাড়বে। ফলে নিচের দিকে টানার বল যেমন কমতে থাকে, ওপরের দিকে টানার বল তেমন বাড়ে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে বস্তুর মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করবে তা 'শেল থিওরেম' (Shell Theorem) দিয়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এই উপপাদ্য অনুযায়ী, আপনি যদি একটি নিরেট গোলকের ভেতরে থাকেন (যেমন পৃথিবী), তাহলে আপনার সবদিকে থাকা খোলসের ভরের কারণে তৈরি মহাকর্ষ বল কাজ করা শুরু করবে। ফলে, মোট বলের পরিমাণ হবে শূন্য।
অর্থাৎ আপনি যখন ভূপৃষ্ঠে থাকেন, তখন পৃথিবীর পুরো ভর আপনাকে নিচের দিকে টানে। কিন্তু আপনি যখন গভীরে নামতে শুরু করেন, তখন আপনার পায়ের নিচের পৃথিবীর ভর আপনাকে নিচের দিকে টানে। আর আপনার মাথার ওপরের পৃথিবীর অংশটুকু আপনাকে ওপরের দিকে টানতে শুরু করে!
যত গভীরে নামতে থাকবেন, পায়ের নিচের ভর তত কমতে থাকবে এবং ওপরের ভর বাড়বে। ফলে নিচের দিকে টানার বল যেমন কমতে থাকে, ওপরের দিকে টানার বল তেমন বাড়ে। এই দুটি বিপরীতমুখী বল একে অপরের প্রভাবকে ক্রমশ বাতিল করে দেয়।
এভাবে যখন আপনি একদম পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছে যাবেন, তখন আপনার নিচে আর কোনো ‘অতিরিক্ত ভর’ অবশিষ্ট থাকবে না। পৃথিবীর পুরো ভরটাই এখন আপনার চারপাশে সমানভাবে ছড়িয়ে যাবে।
এই অবস্থায়, পৃথিবীর প্রতিটি কণা আপনাকে সমানভাবে এবং বিপরীত দিক থেকে টানতে থাকবে। ডানে যেটুকু টানবে, বাঁয়ে ঠিক ততটুকুই টানবে। সামনে যতটুকু টানবে, পেছনেও ততটুকু। এই আকর্ষণগুলো একে অপরের প্রভাবকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেবে। ফলাফল, আপনার ওপর প্রযুক্ত পৃথিবীর মোট মহাকর্ষীয় বল হয়ে যাবে শূন্য।
আর অভিকর্ষজ ত্বরণ (g) যেহেতু সরাসরি এই মহাকর্ষ বলের ওপর নির্ভরশীল (F=mg), তাই বল শূন্য হলে g-এর মানও শূন্য হয়ে যায়।