অসম্ভবের বিজ্ঞানী মিচিও কাকু

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রের একটা হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর বয়স তখন ৭৭ বছর। পরদিন প্রধান প্রধান মার্কিন দৈনিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হলো তাঁর মৃত্যুসংবাদ। কোনো কোনো পত্রিকায় আইনস্টাইনের ব্যবহূত এলোমেলো ডেস্কের একটা ছবিও ছাপা হয়েছিল।

ডেস্কটার ঠিক পেছনেই হিজিবিজি সমীকরণে ভর্তি একটা ব্ল্যাকবোর্ড। ক্যাপশনে বলা হয়েছিল: এই ডেস্কেই রয়েছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের খসড়া। কিন্তু সেটি অসমাপ্ত। আসলে জীবনের শেষ তিন দশক ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি সূত্রবদ্ধ করতে দিন-রাত কাজ করছিলেন আইনস্টাইন। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত জানা সব কটি বলকে একীভূত করে একটিমাত্র তত্ত্বে প্রকাশের ইচ্ছা ছিল তাঁর। সেই তত্ত্বের পোশাকি নাম এখন থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব। অবশ্য তেমন কোনো তত্ত্ব খাড়া করতে ব্যর্থ হন আপেক্ষিকতার জনক আইনস্টাইন।

স্কুলে নিজের ক্লাসে বসে পরদিন আইনস্টাইনের মৃত্যুর খবর শুনল ছোট্ট এক বালক। বয়স তার সবে আট। কিন্তু কে এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী—তা বুঝতে পারল না ছেলেটি। শ্রেণিশিক্ষক সবার উদ্দেশে বুঝিয়ে বললেন সেকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা। বললেন, তাঁর আবিষ্কার আর তাঁর শেষ না হওয়া কাজের কথা। কিন্তু ওটুকুতে মন ভরল না বালকের। এই বিজ্ঞানী সম্প্লর্কে আরও জানতে লাইব্রেরিতে ছুটল কৌতূহলী ছেলেটি। বেছে বেছে আইনস্টাইন আর তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে লেখা বেশ কিছু বই পড়ল। সবটুকু যে মাথায় ঢুকল, তা-ও নয়। অধিকাংশই রহস্যে মোড়া। তবে সেগুলো পড়তে গিয়ে দারুণ এক রোমাঞ্চ জাগল মনে। সেদিন লাইব্রেরি থেকে অন্য এক মানুষ হয়ে বেরিয়ে এল ছেলেটি। বড় হয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সেদিন থেকে। সেই সঙ্গে একটা থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে বের করারও পণ করল মনে মনে। আইনস্টাইনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই যার মূল উদ্দেশ্য। সেই ছেলেটিই আজকের অন্যতম জনপ্রিয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক মিচিও কাকু।

২.

এই ছেলেটির জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৪ জানুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালফোর্নিয়ার স্যান জোসে। ১৯০৬ সালের দিকে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফান্সিসকো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধ্বংসস্তুপের জঞ্জাল সাফ করতে দেশ-বিদেশ থেকে কিছু শ্রমিক আনা হয়েছিল। সেসময় জাপান থেকে মার্কিন দেশে পাড়ি জমান মিচিও কাকুর দাদা। এরপর আর দেশে ফিরে যাননি। সে দেশেই জন্ম নেন মিচিও কাকুর বাবা এবং মা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তাই সেদেশের জাপানি নাগরিকদের মার্কিন সমাজ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। এরকমই এক ক্যাম্পে মিচিও কাকুর বাবা-মায়ের দেখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। যুদ্ধের পর জন্ম নেন মিচিও কাকু। তাদের সেসময়ের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বেশ কষ্ট করেই বেড়ে উঠতে থাকেন মিচিও কাকু।

তবুও বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল ছোটবেলাতেই। সে কথা তো শুরুতেই বলেছি। এরপর সেই রেশ আর কাটেনি তাঁর। বেড়েই চলল বলা চলে। এর পেছনে আরও ভূমিকা রেখেছিল সেসময় টিভিতে প্রচারিত কিছু কার্টুন সিরিজ। ফ্ল্যাশ গর্ডন সিরিজ। এছাড়া গল্পের বইপড়ার নেশাও ছিল কাকুর। বিশেষ করে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি গ্রোগ্রাসে গিলতেন তিনি। এভাবে ভবিষ্যতের এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ থাকবে। একে অনেকেই ফ্যান্টাসি বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু মিচিও কাকু বলতে চান, অসম্ভব হল আপেক্ষিক ব্যাপার। বিজ্ঞান দিয়ে এসব অসম্ভবকে বোঝার চেষ্টা করে গেছেন তিনি।

হাইস্কুলে পড়ার সময় নিজের জন্য একটা অ্যাটম স্ম্যাশার বানানোর কথা ভাবলেন মিচিও কাকু। বড়দিনের ছুটিতে অন্য ছেলেরা যখন আনন্দ উত্সবে ব্যস্ত, তখন অ্যাটম স্ম্যাশার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন তিনি। সেই ঘাম পায়েও ফেললেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের মাঠে ২২ মাইল দীর্ঘ তামার তার প্যাঁচালেন। এরপর বাবা-মায়ের গ্যারেজে তৈরি করলেন ২.৩ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট বিটাট্রন পার্টিকেল একসিলারেটর। সেটি চালাতে ৬ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগত। যন্ত্রটি থেকে তৈরি হলো শক্তিশালী বিদ্যুৎ-চুম্বক। পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে সেটা ছিল প্রায় ২০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। আসলে এই অ্যাটম স্ম্যাশার দিয়ে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত স্ম্যাশারটা চালু করে কাজের কাজ যেটা হয়েছিল, সেটা বেশ হতাশাজনক। কাকুর মায়ের বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এতে একদম ভেঙে পড়েছিল। ব্ল্যাকআউটে থাকতে হয়েছিল তাদের বেশ কিছুটা সময়।

অবশ্য দাগ নেই তো শেখাও নেই—এই বিজ্ঞাপনী ভাষার মতোও এই পারিবারিক ক্ষতি থেকেও কিছু শিখতে পেরেছিলেন কাকু। এমনকি ভবিষ্যতে তাঁর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পেছনেও এটিই সবচেয়ে বড় নিয়ামক হয়ে দেখা দেয়। অ্যাটম স্ম্যাশারটা বগলদাবা করে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেন তিনি। তাঁর যন্ত্রটা ছিল গতানুগতিক আর দশটা বিজ্ঞান প্রজেক্টের মধ্যে একেবারে আলাদা। ছোট্ট একটা কিশোরের বানানো এ রকম যন্ত্র দেখে সেবার তাক লেগে গেল পদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলারের। মার্কিন হাইড্রোজেন বোমার জনক তিনি। বিজ্ঞান মেলায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন টেলার। অসাধারণ এই বিজ্ঞান প্রজেক্টের কারণে সেবার বিজ্ঞান মেলায় হার্জ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কলারশিপ জিতে নিল কিশোর এই প্রডিজি। এরপর পেলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি। এটিই তাঁর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য পূরণে প্রায় সব বাধা ডিঙাতে সহায়তা করল।

এরপর ক্রমেই এগোতে থাকেন ছোট্টবেলার দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে। সত্তরের দশকে থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করেন। সে জন্য যোগ দেন বহুল আলোচিত-সমালোচিত স্ট্রিং থিওরিস্টদের দলে। তাঁর গবেষণা থেকে জন্ম হলো স্ট্রিং থিওরির শাখা স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির। এটিই বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি এনে দিল তাঁকে। গবেষণা ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। নিউইয়র্কের সিটি কলেজে।

তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পর মিচিও কাকুকে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করেন অনেকে। আবার তাঁকে ‘পরবর্তী কার্ল সাগান’ হিসেবে অভিহিত করেন কেউ কেউ। কারণ, বিজ্ঞানী হিসেবে শুধু গবেষণাতেই মুখ গুঁজে বসে থাকেননি তিনি, সর্বস্তরে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে একাধিক বই লিখেছেন, উপস্থাপনা করেছেন বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন রেডিও ও টিভি অনুষ্ঠানে। বিবিসি, ডিসকভারি চ্যানেল, হিস্ট্রি চ্যানেল ও সায়েন্স চ্যানেলে তিনি পরিচিত মুখ। নিয়মিত বিজ্ঞানবিষয়ক কলাম লেখেন জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিনগুলোতে। বিজ্ঞানের জটিল-কঠিন বিষয়গুলো সবার জন্য সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করাই এসবের উদ্দেশ্য। তাই লেখক হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে। তাঁর বেশ কিছু বই অনূদিত হয়েছে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষাতেও।

মিচিও কাকুর লেখা জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস অন্যতম। বইটির বিষয়বস্তু বিকল্প মহাবিশ্ব তথা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সমান্তরাল মহাবিশ্বের আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না, কিংবা তার হদিস কীভাবে পাওয়া যাবে অথবা আমাদের মহাবিশ্ব কখনো ধ্বংসের মুখে পড়লে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করে বিকল্প ওই সব মহাবিশ্বে যাওয়া সম্ভব কি না বা সেখানে যাওয়ার সম্ভাব্য উপায়—সেসব প্রশ্নের তাত্ত্বিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন মিচিও কাকু।

এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল, আইনস্টাইনস কসমস, ফিজিকস আব দ্য ফিউচার, দ্য গড ইকুয়েশন, ফিউচার অব হিউমিনিটি।

আজ এই তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী ৭৫ বছর পূর্ণ করে ৭৬-এ পা দিলেন। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে মিচিও কাকুর জন্য শুভেচ্ছা।