শ্রদ্ধাঞ্জালী
সত্যেন্দ্রনাথ বসু: দুনিয়ার অর্ধেক কণা যাঁর নামে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটা পুরোনো ত্রুটি সমাধান করেছিলেন পরিসংখ্যানের সাহায্যে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বাঁক বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তাঁর সেই সমাধান। এজন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সেটা পাননি। তবে মহাবিশ্বের অর্ধেক মৌলিক কণার নাম তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে, এটাও কম বড় পাওয়া নয়। আজ এই বিজ্ঞানীর জন্মদিন। বিজ্ঞাানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯২৪ সাল। জার্মানির বার্লিন শহরের এই বাড়িকে প্রতিবেশীরা অন্য চোখেই দেখে। কারণ, এই বাড়ির বাসিন্দা খোদ আলবার্ট আইনস্টাইন। মাত্র তিন বছর আগে আইনস্টাইনকে পুরস্কার দিয়ে নিজে সম্মানিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার। আলফ্রেড নোবেলের উইলের শর্ত পূরণের জন্য পুরস্কারের সংশাবচনে অন্যান্য আবিষ্কারের সঙ্গে আলোর তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যার কাজটিও জুড়ে দিতে হয়েছে তাদের। আলোর তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ২০ বছর আগে আইনস্টাইন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের আলোর কোয়ান্টাম ধারণাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়েছেন। শতকজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের অব্যাখ্যাত ছিল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন)। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বললেন, আলো গুচ্ছাকারে বিকিরিত হয় এবং সেই ধারণা প্রয়োগ করে তিনি কালো বস্তুর বিকিরণের একটি সমীকরণ লিখে ফেলেন। তবে, তিনি সেখানে ব্যবহার করেছেন ধ্রুপদি বিজ্ঞানের কিছু কৌশল। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোর তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্ল্যাঙ্কের ধারণাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে বলেন, আলো কেবল গুচ্ছাকারে বিকিরিত হয় না, বরং তা গুচ্ছাকারে প্রবাহিতও হয়।
সেই থেকে প্রায় দুই দশক ধরে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ধারণাকে মেনে নিয়ে সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আইনস্টাইনসহ সবারই মনে একটি ছোট্ট খচখচানি রয়েই গেছে। কেননা প্ল্যাঙ্কের সমীরণ ধ্রুপদি বিজ্ঞানের কলাকৌশলে লেখা!
যেদিনের কথা বলছি, সেদিনও ঘুম থেকে উঠে আইনস্টাইন এ বিষয় নিয়েই ভাবছিলেন। নিজের লনে পায়চারি করার সময় তিনি মাঝেমধ্যেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন। সে কারণে বাসার সামনে থেকে ডাকহরকরা যখন ‘হেইল, আইনস্টাইন’ বলে হাঁক দিয়েছেন, তখনো তিনি সেটি টের পাননি। কী মনে করে ডাকহরকরা আইনস্টাইনের চিঠিপত্র বাড়ির সামনের ডাকবাক্সে না ফেলে লনে আইনস্টাইনের হাতে দিয়ে গেলেন। আইনস্টাইন দেখলেন কয়েকটি পোস্টকার্ড, কয়েকটি ছোট খাম এবং একটি বড় খাম। বড় খামটি নিয়ে তিনি একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন। খোলার সঙ্গে সঙ্গে খাম থেকে একট চিঠি মাটিতে পড়ে গেল। খাম নেড়েচেড়ে তিনি ঠিকানাটি পরিচিত কি না, মনে করতে পারলেন না। মাটি থেকে চিঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে পড়তে পড়তে ঘরের দিকে এগোতে থাকলেন আইনস্টাইন।
জুন মাসের ৪ তারিখে পত্রলেখক লিখেছেন, ‘আমি সাহস করে আপনার মতামতের জন্য এর সঙ্গে একটি নিবন্ধ পাঠাচ্ছি। এ বিষয়ে আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহী। আপনি দেখবেন, আমি এই নিবন্ধে প্ল্যাঙ্কের সমীকরণটি বের করেছি ধ্রুপদি ইলেকট্রোডায়নামিকস ছাড়াই…’
পত্রলেখক আইনস্টাইনকে অনুরোধ করছেন, যদি তিনি এটিকে ছাপার যোগ্য মনে করেন, তাহলে যেন জার্মান ভাষায় অনুবাদ ও বিজ্ঞান সাময়িকী সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। শেষ দিকে পত্রলেখক আরও লিখেছেন, তাঁর (আইনস্টাইন) হয়তো মনে নেই, কিন্তু কয়েক বছর আগে আইনস্টাইন কলকাতার দুই ব্যক্তিকে তাঁর আপেক্ষিকতাসংক্রান্ত নিবন্ধগুলো অনুবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। পত্রলেখক তাঁদেরই একজন।
চিঠি পড়েই আইনস্টাইন ওই নিবন্ধ নিয়ে বসে পড়লেন। আরে, এ তো দেখি প্ল্যাঙ্কের ঝামেলাটা সমাধান করে ফেলেছেন! পত্রলেখক প্ল্যাঙ্কের সমীকরণের সহগগুলো বের করেছেন একই ধরনের বস্তুকণা গণনা করে। অনেকটা ধ্রুপদি বিজ্ঞানের বোলজম্যানের সংখ্যায়নের মতো। কিন্তু এখানে ব্যবহৃত হয়েছে প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের জানানো কণা। আইনস্টাইন নিবন্ধটি পড়ে এতই অভিভূত হলেন যে নিজেই সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ফেললেন এবং পাঠিয়ে দিলেন সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক সাময়িকীতে এবং নিবন্ধটি ছাপা হয়ে গেল সাময়িকীর আগস্ট সংখ্যায়। সঙ্গে আইনস্টাইনের একটি মন্তব্য, যাতে বলা হয়েছে, লেখকের এই কাজ আইনস্টাইন এগিয়ে যাওয়ার পথে খুবই গুরত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। লেখকের পদ্ধতিতে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণাটিকেও পোক্ত করা যায় যা কি না, আইনস্টাইন চিন্তা করেছেন।
আইনস্টাইনের প্রশংসাসংবলিত পোস্টকার্ডটি ঢাকায় এসে পৌঁছাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। ঢাকার নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার সত্যেন্দ্রনাথ বসু পোস্টকার্ডটি হাতে নিয়ে আনন্দিত হন, যদিও তখনো তিনি জানতেন না, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি অমর হতে চলেছেন।
আইনস্টাইন সত্যেন বসুর পদ্ধতিতে আরও কাজ করেন এবং এর মাধ্যমে সূচিত হয় কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের। বসু আর আইনস্টাইনের উদ্ভাবিত কণাগণনার পদ্ধতির নামকরণ হয় ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’। যেসব বস্তুকণার পূর্ণ সংখ্যার স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা রয়েছে (যেমন আলোর কণা), সেগুলো এই সংখ্যায়ন মেনে চলে। ১৯৩০–এর দশকে বিজ্ঞানী পল ডিরাক এসব বস্তুকণার জন্য একটি সাধারণ নাম খোঁজেন এবং এই সংখ্যায়নের প্রধান ব্যক্তির নামে সেগুলোর নাম দেন বোসন—বোসন কণা। আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে। বাংলায় আমরা বসুকণাও বলতে পারি।
পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানে ভগ্নসংখ্যার স্পিনবিশিষ্ট কণাগুলোর নাম দেওয়া হয় ফার্মিয়ন। কাজেই বস্তুজগতের একটি অংশের নাম হয়ে যায় আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে, বিজ্ঞানজগতে যিনি পরিচিত এস এন বোস হিসেবে।
পরাধীন ভারতবর্ষের এক বাঙালির নাম কীভাবে অর্ধেক ভুবনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেল!
দুই
সত্যেন বসুর বাবা সুরেন্দ্রনাথ কিছুদিন ভারত রেলে চাকরি করেছেন। তাঁর দাদুও সরকারি কর্মী ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বসু আর আমোদিনী বসুর প্রথম সন্তান সত্যেন বসুর জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের প্রথম দিনে। সে সময় তাঁরা থাকতেন নদীয়া জেলার বড় জাগুলিয়া গ্রামে। কলকাতা তখনো বাংলার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেনি, যদিও সব আলামত স্পষ্ট হচ্ছিল। সুরেন্দ্র আর আমোদিনীর আরও ছয় সন্তান ছিল, তাঁরা সবাই ছিলেন মেয়ে। গ্রামের সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা শুরু হলেও বাবার চাকরির সুবাদে এদিক–সেদিক ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বসু পরিবারকে। নদীয়ার যে স্কুলে তিনি পড়েন, ওই স্কুলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুদিন পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি স্কুল ঘুরে সত্যেন ভর্তি হলেন হিন্দু স্কুলে। হিন্দু স্কুলের গণিতের শিক্ষক ছিলেন উপেন্দ্র বকশী। সত্যেনের গণিতের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি কোনো এক পরীক্ষায় তাঁকে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১১০ নম্বর দেন। বিস্মিত প্রধান শিক্ষককে বকশী বাবু বলেছিলেন, সত্যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেবল সব সমস্যার সমাধান করেনি, বরং সব সমস্যার সম্ভাব্য সব সমাধানও বের করেছে!
১৯০৮ সালে এই স্কুল থেকেই তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষার মাত্র দুই দিন আগে সত্যেন আক্রান্ত হন জলবসন্তে। ফলে সেবার আর তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। ১৯০৯ সালের পরীক্ষায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। চতুর্থ বিষয়েও তিনি ১০০ নম্বর পেয়েছিলেন। পরে ১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে মাস্টার্স—উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাস্টার্সে তাঁর ৯২ শতাংশ নম্বর প্রাপ্তি এখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড হিসেবে অক্ষুণ্ন আছে!
উভয় পরীক্ষায় বাংলার অপর বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। এর মধ্যে ২০ বছর বয়সে সত্যেন বসু ঊষাবতী বসুকে বিয়ে করেন।
১৯১৫ সালে পাস করার পর সত্যেন বসু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কেউ তাঁর মতো স্কলারকে চাকরি দিতে সম্মত হননি। আখেরে তাতে বিজ্ঞানেরই লাভ হয়েছে। কারণ, বাবা-দাদুর মতো সত্যেনও যদি রেলওয়েতে চাকরি করতেন, তাহলে হয়তো এই কাহিনি অন্য রকম হতো।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রদের খুঁজে বের করে সেখানে নিয়ে আসেন। সত্যেন বসু আর মেঘনাদ সাহা দুজনই বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে, গণিত বিভাগে। কলেজে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য তাঁদের বিষয় বেছে নিতে বলা হলে সত্যেন বসু জৈব পদার্থবিজ্ঞান এবং ফলিত গণিত বেছে নেন। এক বছর পর তাঁরা দুজনই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বদলি হন।
ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা দুজন গবেষণায় মনোযোগ দেন। তবে, বিজ্ঞান কলেজে সেই অর্থে গবেষণাগার বলে কিছু ছিল না। কেবল প্রেসিডেন্সি কলেজের গ্রন্থাগার, যেখানে কিছু বিজ্ঞান সাময়িকী পাওয়া যেত। অনেক বইও সেখানে ছিল না। তবে, সে সময় একটি ঘটনা ঘটে যা তাঁদের দুজনের জন্যই সৌভাগ্য বয়ে আনে। অস্ট্রিয়ার নাগরিক ড. ব্রাউলকে স্বাস্থ্যগত কারণে চিকিৎসকেরা কোনো একটি উষ্ণ দেশে থাকতে পরামর্শ দিলে তিনি কলকাতায় এসে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যোগ দেন। আসার সময় তিনি প্রচুর বইপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন যা বসু-সাহা তাঁদের পড়াশোনার কাজে লাগাতে শুরু করেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত কলকাতায় সত্যেন বসু বেশ কিছু গবেষণা করেন। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল মেঘনাদ সাহার সঙ্গে যৌথভাবে। সাহার সঙ্গে কাজগুলো পদার্থবিজ্ঞানে হলেও বিশুদ্ধ গণিতে সত্যেন বসু এ সময় একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিলে সত্যেন বসু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল জার্মান নিবন্ধগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা কলকাতা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদের কাজের সময় বসু-সাহা আইনস্টাইনের অনুমতি নিয়েছিলেন, যার কথা শুরুর পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয় ১৯২১ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন, রিডার হিসেবে। পড়ানোর বাইরেও তাঁর একটি বড় কাজ ছিল বিভাগটি গড়ে তোলা। সে সময় মেঘনাদ সাহাকে লেখা এক চিঠি থেকে জানা যায়, নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সাময়িকী জোগাড় করার চেষ্টা করছেন। এমনকি বিজ্ঞানের জন্য একটি আলাদা গ্রন্থাগারও গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। তবে, সবচেয়ে হতশ্রী ছিল পরীক্ষাগারগুলোর অবস্থা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রদের পড়ানোর সময়ে প্ল্যাঙ্কের সমীকরণ নিয়ে সত্যেন বসুর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভিন্নভাবে একই সূত্রে হাজির হন। কিন্তু তাঁর মাত্র চার পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রটি ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন ছাপাতে রাজি হয়নি। সাহস করে সত্যেন বসু তাঁর গবেষণা নিবন্ধটি আইনস্টাইনবরাবর পাঠিয়ে দেন! পরেরটুকু আমরা জানি।
আইনস্টাইন বোসের জানানো পথে সূচনা করেন কোয়ান্টাম সংখ্যায়নের এবং একের পর এক সৃষ্টি হয় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন, বোস-আইনস্টাইন বিতরণ, বোস-আইনস্টাইন সম্পর্কায়ন ইত্যাদি। এসবের প্রায় প্রতিটিতেই এখনো বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন। এই সেদিন, ২০১২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের সঙ্গেও বোসন কণার সংযুক্তি রয়েছে।
১৯২৪ সালের শুরুতে সত্যেন বসু দুই বছরের শিক্ষাছুটির জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু, তাঁর আবেদনটি ঝুলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। আইনস্টাইনের প্রশংসাসূচক পোস্টকার্ডটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব সংশয়ের অবসান ঘটায়। দুই বছরের শিক্ষাছুটি নিয়ে সত্যেন বসু পাড়ি জমান ইউরোপে। শুরুতে তাঁর ইচ্ছা ছিল, প্যারিসে মাসখানেক কাটিয়ে বাকি সময় জার্মানিতে কাটানোর। কারণ, ফরাসি ভাষায় তাঁর দখল ভালো হলেও জার্মান ভাষা নিয়ে তাঁর মনে কিছুটা সংশয় ছিল। কিন্তু, প্যারিসে যাওয়ার পর তিনি সেখানেই ভালো সুযোগ পেয়ে যান কাজের। বিশেষ করে বিজ্ঞানী পল লেনগিভেনের পরীক্ষাগারে কাজের সুযোগ হলে তিনি সেখানেই কিছুদিন থেকে যান। সে সময় তিনি দুইবার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ম্যারি কুরি এবং তরুণ কোয়ান্টাম বিজ্ঞানী মরিস-দ্য-ব্রগলির সঙ্গেও কিছু সময় কাটানোর সুযোগ পান। লেনগিভেনের সঙ্গে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে কাজ করেন। এই কাজ পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের সম্প্রসারণে অনুপ্রাণিত করে।
প্যারিসে এক বছর কাটিয়ে সত্যেন বসু ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে বার্লিনে পৌঁছান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আইনস্টাইন তখন দেশে ছিলেন না। তাই সত্যেন বসুকে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে আইনস্টাইনের সঙ্গলাভের জন্য। যদিও আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ সত্যেন বসুর হয়নি, কিন্তু আইনস্টাইন তাঁকে একটি অভিজ্ঞানপত্র দিয়ে দেন। সেটির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে বই নেওয়া এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সভায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান সত্যেন বসু। এ সময় তিনি জার্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে লিস মাইটনার, অটো হ্যান, ম্যাক্স ভন ল্যু, পল ইউজেন প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেন।
দুই বছর ইউরোপে কাটিয়ে সত্যেন বসু ঢাকায় ফিরে আসেন। মেঘনাদ সাহা নিজে নিজে ডক্টরেট করলেও সত্যেন বসু কিন্তু তা করেননি। তারপরও আইনস্টাইনের সুপারিশক্রমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হন। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষাগারগুলোকে সাজিয়ে তোলার জন্য তিনি এ সময় প্রচুর পরিশ্রম করেন। এ সময় তিনি গবেষণায় যত সময় দিতেন, পাশাপাশি সময় দিতেন কীভাবে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা বাড়ানো যায়, তার জন্য। ১৯২৯ সালে সত্যেন বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিজ্ঞানের সভাপতি আর ১৯৪৪ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
চার
১৯৫৬ সালে সত্যেন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ব্রিটেনের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৯ সাল থেকে ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সম্মানিত করে।
সত্যেন বসু মনে করতেন, দেশে বিজ্ঞানচর্চা বাড়াতে হলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ বাড়াতে হবে। তিনি বলতেন, ‘যাঁরা বলেন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয়তো বিজ্ঞান জানেন না।’ তাঁর উৎসাহেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞানের বই বিশ্বপরিচয় লিখেছেন। সত্যেন বসু বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর হাতেই জ্ঞান বিজ্ঞান নামের সাময়িকীটি আত্মপ্রকাশ করে।
বোসন কণার এই বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালেই সত্যেন বসুর নামে একটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে। বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সায়েন্সেস নামের এই গবেষণাকেন্দ্রে এমফিল ও ডক্টরাল পর্যায়ের গবেষণা পরিচালিত হয়। এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানে বসু প্রফেসর নামে একটি চেয়ারও চালু রয়েছে।
১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় বোসন কণার এই বিজ্ঞানী মারা যান।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, গণিত অলিম্পিয়াড