পরমাণুর রাজ্যে ঘুমিয়ে থাকা দানব

এক সময় পরমাণু তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না অনেক বিজ্ঞানী। রোজ দুবেলা নিয়ম করে পরমাণু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন তাঁরা। কেউ কারও কথা মানতে নারাজ। ঠিক এ সময় পরমাণুর পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে শক্ত এক প্রমাণ হাজির করেন জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। সে সম্পর্কে বিস্তারিত...

শুরুতেই চলো একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য কল্পনা করা যাক। ধরা যাক, কোনো কারণে এতকাল ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেটা হতে পারে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে। কিংবা হতে পারে মানুষের তৈরি পারমাণবিক বোমার মতো ভয়াবহ কোনো অস্ত্রের ব্যবহারে। এমন সময় একটা বিশেষ সুযোগ পাওয়া গেল। পরের প্রজন্মের জন্য ছোট্ট একটা বার্তা লিখে রাখা যাবে। সেটা হবে এমন এক তথ্য, যার ওপর ভর করে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা আবারও গড়ে তুলতে পারবে নতুন সভ্যতা। তাহলে ধ্বংসের মুখে পড়া এ সভ্যতার কোন তথ্যটি লিখে রাখা উচিত?

সে উত্তরটা দিয়েছিলেন বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান। তাঁর মতে, তথ্যটা হবে: ‘সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি।’ অনেকেই ভাবছ, এ আর এমন কী কথা! এটা কী এমন কাজে লাগবে? কিন্তু ফাইনম্যানের যুক্তি হলো, এই তথ্যটুকু জানলে টিকে যাওয়া মানবজাতি একদিন না একদিন আবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। ধ্বংসস্তুপ থেকে আবারও উন্নতির চূড়ায় উঠবে মানুষ।

ভ্রু কুঁচকে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারো, এ তথ্যের মধ্যে কী এমন আছে, যা এত গুরুত্বপূর্ণ? কী কাজ এ ছোট্ট কথার? কী সেই শক্তি?

রিচার্ড ফাইনম্যান

জবাব জানতে আমাদের যেতে হবে একটু পেছন দিকে। তোমার পেছনে নয়, সময়ের পেছনে। মানে অতীতকালে। সেই প্রাচীন যুগে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের পৃথিবীতে। মনে মনে টাইম ট্রাভেল বলতে পারো একে।

মানুষ সহজাতভাবে কৌতুহলী। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পাবে বাড়ির ছোটদের দেখলে। কৌতুহল থেকেই মানুষ ছোটবেলা থেকে প্রশ্ন করে—এটা কী? ওটা কী? ওটা কেন? বড় হয়েও অনেকের প্রশ্ন করার স্বভাবটা যায় না। বড়রাও মনে মনে প্রশ্ন করেন। অন্যকেও জিজ্ঞেস করেন। কিংবা প্রশ্ন ছুড়ে দেন বইপত্রে। অনেক সময় সেগুলো ঘ্যানঘ্যানেও মনে হতে পারে। অনেকে শুধু প্রশ্ন করেই থেমে থাকেন না, নিজে জবাবও খোঁজেন। এভাবে একেবারে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেন এসব মানুষ। তাঁদের আমরা বলি বিজ্ঞানী, গবেষক।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ নিজেকে নিয়ে, জীবজন্তু বা গাছপালা নিয়ে, পৃথিবী, মহাবিশ্ব এবং প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে আসছে। কিন্তু সেসবের বেশিরভাগেরই লেখাজোকা নেই। তবে মানুষ হিসেবে আমরা সেসব প্রশ্ন আন্দাজ করতে পারি। সেগুলো আসলে একক কোনো মানুষের নয়, বরং গোটা মানবজাতির মনের জিজ্ঞাসা। কারণ আমাদের সবার মনেই এসব প্রশ্ন খেলা করে। লিখিত আকারে মানবজাতির এসব প্রশ্ন ও তার উত্তর খোঁজার চেষ্টার প্রমাণ মেলে প্রাচীন ব্যবিলন, মিশর, গ্রিক, ভারত ও চীন সভ্যতায়। যেমন মহাবিশ্ব এল কোথা থেকে? আমরা এখানে এলাম কী করে? মানুষ, জীবজন্তু ও পৃথিবীসহ মহাবিশ্বের সবকিছু কী দিয়ে তৈরি?

শেষের প্রশ্নটার জবাব খুঁজতে গিয়ে প্রাচীন মানুষেরা এক সময় হিসেব করে দেখল, সবকিছু চারটি উপাদান দিয়ে তৈরি। সেগুলো হলো: মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস। এগুলোকেই মৌলিক উপাদান বলে ভেবেছিল গ্রিস দেশের পণ্ডিতরা। প্রায় একই সময়ে ভারতীয় পণ্ডিতরা বললেন পাঁচটি উপাদানের কথা। সেগুলো হলো: মাটি, পানি, আগুন, বাতাস ও আকাশ। এখানে সবকিছু গ্রিকদের মতোই, শুধু একটি উপাদান বাড়তি: আকাশ। আরও পরে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে গ্রিক পণ্ডিত ডেমোক্রিটাস বললেন, সবকিছু অ্যাটম দিয়ে তৈরি। গ্রিক এ শব্দের অর্থ অবিভাজ্য। গণিতে ভাগ অংক কষতে গিয়ে আমরা এই শব্দ ব্যবহার করি। সেখানে অবিভাজ্য মানে, যাকে আর বিভাজন বা ভাগ করা যায় না। এখানেও সেই একই অর্থ বহন করে শব্দটা। সহজ কথায়, যাকে আর ভাঙা সম্ভব নয়।

গ্রিক পণ্ডিত ডেমোক্রিটাস

কোনো বস্তুকে ভাঙতে শুরু করলে কী হবে? প্রথমে দুই টুকরো, তারপর চার টুকরো, আট টুকরো… ১৬ টুকরো… ৩২… ৬৪…১২৮…এভাবে কত দূর ভাঙা যাবে? আজীবন? নাকি এর কোনো সীমা আছে? এক পর্যায়ে থেমে যাবে?

ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, একটা বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা পর্যায়ে আসবে, যখন বস্তুটাকে আর ভাঙা যাবে না। অর্থাৎ বস্তুটার সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে। সেই কণাকেই অ্যাটম বললেন ডেমোক্রিটাস। ভারতীয় পণ্ডিতরাও প্রায় একই সময়ে এরকম অবিভাজ্য কণার নাম দেন পরমাণু। মানে পরম অণু। এখন অ্যাটমকে বাংলায় বলা হয় পরমাণু। আর এ ধারণাকে বলা হয় পরমাণু মতবাদ।

ইলেকট্রন কণার ওপর ভিত্তি করে একটা পরমাণুর গঠন কেমন হতে পারে, তা আন্দাজের চেষ্টা করেন টমসন।

এ মতবাদ অনুযায়ী, জগতের সবকিছুর মূল গাঠনিক একক পরমাণু। মানে একটা বিল্ডিংয়ের একক যেমন ইট, তেমনি মহাবিশ্বের সবকিছুর একক হলো পরমাণু। অর্থাৎ, তুমি-আমি, বাবা-মা, ভাই-বোন, কুকুর-বিড়াল, জীবজন্তু, বইখাতা, বাড়িঘর, খেলনাপাতি, পাহাড়-পবর্ত, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুই তৈরি হয়েছে অতিক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে। তবে গ্রিকদের পরমাণু মতবাদ ছিল অসম্পূর্ণ। পরমাণুর অনেককিছুই তারা জানত না। এক অর্থে, তাদের ধারণাটি ছিল অনেকাংশে ভুল। পরমাণু সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা গেল প্রায় আড়াই হাজার বছর পর, আধুনিক কালে এসে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে এসেও কিছু কাজের সুবিধার্থে সবকিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত বলে মনে করতেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সত্যি সত্যি পরমাণু মতবাদে বিশ্বাস করত না অনেকেই। এ সময়ে কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে বিজ্ঞানীরা নড়চড়ে বসতে বাধ্য হন। যেমন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কার, ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেলের ইউরেনিয়াম থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কারের ঘটনা। তাঁদের আবিষ্কারের পর ইউরেনিয়াম নিয়ে আগ্রহী হন পিয়ের ও মেরি কুরি দম্পতি। এতে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে আরও দারুণ কিছু ব্যাপার আবিষ্কার করেন তাঁরা। পরমাণু সম্পর্কেও জানা গেল নতুন কিছু তথ্য। কিছুদিন পরই, ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন নামে একটি কণা আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে জে টমসন। পরীক্ষায় দেখা গেল, কণাটা পরমাণুর অংশ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পরমাণুকে ভেঙে আরও ছোট করা যায়। অর্থাৎ পরমাণু অবিভাজ্য নয়, বিভাজ্য। তাহলে পরমাণু সম্পর্কে গ্রিকদের ধারণা অনেকটাই ভুল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর কোথায় থাকে? কীভাবে থাকে? এর কাজকারবার কী?

ইলেকট্রন কণার ওপর ভিত্তি করে একটা পরমাণুর গঠন কেমন হতে পারে, তা আন্দাজের চেষ্টা করেন টমসন। তিনি বললেন, পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলো থাকে পুডিংয়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিসমিসের মতো। বা সেমাইয়ের মধ্যে কিসমিসের মতো।

তখনও পরমাণু তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী। রোজ দুবেলা নিয়ম করে পরমাণু নিয়ে তর্ক-বির্তক করেন তাঁরা। কেউ কারও কথা মানতে নারাজ। ঠিক এ সময় পরমাণুর পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে শক্ত এক প্রমাণ হাজির করেন জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। সেটা ১৯০৫ সালের ঘটনা। এক গবেষণাপত্রে তিনি পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণসহ পরমাণুর আকার কীভাবে মাপা যাবে, তারও পথ দেখিয়ে দেন। কবছর পর সেই পথ অনুসরণ করে এক বিজ্ঞানী পরমাণুর আকার মেপেও ফেলেন। তবু পরমাণু নিয়ে অনেকের সন্দেহ যায় না। ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থাকেন কেউ কেউ।

এরকম জোর তর্ক-বির্তকের মধ্যেই পরমাণুর ভেতরের আরেকটি কণা আবিষ্কৃত হয়। সেটি আবিষ্কার করেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। কণাটির নাম দেন প্রোটন। গ্রিক এ শব্দের অর্থ প্রথম। রাদারফোর্ড বললেন, প্রোটন থাকে পরমাণুর কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের নাম দেওয়া হল নিউক্লিয়াস। আর ইলেকট্রনগুলো তাকে কেন্দ্র করে ঘোরে। অনেকটা সৌরজগতের মতো। গ্রহগুলো যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, ইলেকট্রনগুলোও প্রোটনকে কেন্দ্র করে অনেকটা তেমনি বনবন করে ঘুরছে। তবে নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের কক্ষপথের মাঝখানে বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা। সেই অর্থে পরমাণুর বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, একটা পরমাণুর চেয়ে তার নিউক্লিয়াস প্রায় ১ লাখ ভাগ ছোট। বিজ্ঞানীরা বললেন, পরমাণুর আকার যদি একটা গির্জার সমান হয়, তাহলে নিউক্লিয়াস হল ওই গির্জার ভেতরের এক ছোট্ট মাছি। তাহলেই বোঝ অবস্থা!

বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড

‘র’-এর ফোঁটা বা ইংরেজি ‘ফুলস্টপ’ লিখতে যেটুকু কালি লাগে, তাতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন কার্বন পরমাণু থাকে (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি। তাহলে ১০০ বিলিয়নে কত কোটি?)। তাই একটা পরমাণুকে খালি চোখে দেখা যায় না। তবে একটা পরমাণু যদি খালি চোখে দেখতে চাও, তাহলে ‘র'-এর ফোঁটাকে প্রায় ১০০ মিটার বড় করতে হবে। খেলার মাঠে যে ১০০ মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, তার সমান। আর পরমাণুর নিউক্লিয়াস দেখতে হলে, ফোঁটাটাকে বড় করতে হবে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার। ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার। তেতুলিয়ার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৪০০ কিমি। তাহলে ১০ হাজার কিলোমিটার কত দূরে? তেতুলিয়া থেকে কক্সবাজার ১০ বার আসা-যাওয়ার সমান, নাকি?

যাই হোক, কবছরের মধ্যে পরমাণু তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেল শক্ত ভিতের ওপর। এতে কাজে লাগানো হল জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তত্ত্ব। সেটি করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন ডেনমার্কের বিজ্ঞানী নীলস বোর, ফরাসি বিজ্ঞানী লুই ডি ব্রগলি, বাঙালী পদার্থবিদ সত্যেন বসু, জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল ডিরাকসহ আরও অনেকে। তাঁদের গড়ে তোলা সেই তত্ত্বকে এখন বলা হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তখন আর পরমাণুকে অবিশ্বাস করার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে চুপ মেরে গেলেন বিরোধীরা।

১৯৩২ সালে আবিষ্কৃত হল পরমাণুর আরেকটি মৌলিক কণা। তার নাম নিউট্রন। এভাবে পাওয়া গেল পরমাণুর গভীরে ক্ষুদ্র জগতের পুরো চিত্রটা। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন ও নিউট্রন কণা দিয়ে। আর তার চারপাশে অনবরত ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। এভাবেই প্রকৃতির মৌলগুলো গড়ে ওঠে। যেমন হাইড্রোজেন মৌলে থাকে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন। একেই বলা হয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে হালকা মৌল। এরপরই আছে হিলিয়াম। এ মৌলে থাকে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন এবং তার চারপাশে ঘোরে দুটি ইলেকট্রন। এভাবে প্রাকৃতিকভাবে ৯২টি মৌল গঠিত হতে পারে। ৯২ নম্বর মৌলের নাম ইউরেনিয়াম। এই তেজস্ক্রিয় মৌলটা নিয়ে আগেই বলেছি। ইউরেনিয়াম পরমাণুতে ৯২টি প্রোটন থাকে। ইলেকট্রনও থাকে ৯২টি। কিন্তু এক ধরনের ইউরেনিয়ামে নিউট্রন থাকে ১৪৬টি, আরেক ধরনের ইউরেনিয়ামে থাকে ১৪৩টি নিউট্রন। সবগুলো মৌলিক কণারই ভর আছে। সুতরাং বুঝতেই পারছো, হাইড্রোজেনের চেয়ে ইউরেনিয়ামের ভর অনেক গুণ বেশি। তাই একেই বলা হয় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সবচেয়ে ভারী মৌল।

এক টন কয়লা পুড়িয়ে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়, তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তি পাওয়া যায় মাত্র এক গ্রাম পরমাণু দিয়ে।

বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিমভাবেও নতুন নতুন ভারী মৌল তৈরি করতে পারেন। যেমন নেপচুনিয়াম, প্লুটোনিয়াম, অ্যামেরিসিয়াম ইত্যাদি কৃত্রিম ভাবে বানানো মৌল। সবমিলিয়ে বর্তমানে পৃথিবীতে মোট মৌলের সংখ্যা ১১৮টি। এ পর্যন্ত থেমে থাকলে ঠিকই ছিল, কিন্তু বিজ্ঞান তো থেমে থাকে না। বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাও থামে না। নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আবিষ্কৃত হয় আরও নতুন বিষয়। সঙ্গে উদয় হয় নতুন নতুন জিজ্ঞাসা।

এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, পরমাণুকে ভাঙলে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব। সে কাজটা করা হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে নিউট্রন কণা ছুড়ে। তাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পরমাণু কেন্দ্র। ফলে সেখান থেকে বিপুল শক্তি বেরিয়ে আসে। সঙ্গে ছিটকে বেরোয় আরও কিছু নিউট্রন কণা। এই নিউট্রন কণা আবার অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসে সজোরে আঘাত হানে। এভাবে শুরু হয় চেইন রিঅ্যাকশন। একটার পর একটা পরমাণু ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় বিপুল শক্তি। ব্যাপারটা যেনো চেরাগের ভেতর বন্দি থাকা ঘুমন্ত বিশালদেহী কোনো দৈত্য ঘুম ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসার মতো। হুট করে বেরিয়ে এসেই অন্ধের মতো দুদ্দাড় সামনের সবকিছু ভেঙেচুড়ে ছারখার করে দিতে থাকে।

এভাবে এক টন কয়লা পুড়িয়ে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়, তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তি পাওয়া যায় মাত্র এক গ্রাম পরমাণু দিয়ে। সাম্প্রতিক এক হিসেবে দেখা গেছে, মাত্র সাড়ে চার গ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা লাগবে প্রায় ৪০০ কেজি, গ্যাস লাগবে প্রায় ৩৬০ ঘন মিটার এবং ডিজেলের মতো জ্বালানি লাগবে প্রায় ৩৫০ লিটার। মানে এক কেজি নিউক্লিয়ার জ্বালানি সমান প্রায় ৬০ টন জ্বালানি তেল বা ১০০ টন কয়লা (সূত্র: বিবিসি, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)।

কাজেই পরমাণুর কেন্দ্র যে বিপুল শক্তির ভাণ্ডার, তা বুঝে গেল মানুষ। পরমাণু খুঁড়ে সেই শক্তি বের করে আনতে দেশে-দেশে উঠে-পড়ে লাগলেন বিজ্ঞানীরা। তার হদিশও মিলল শিগগিরই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শুরুতেই সেই শক্তি ব্যবহার করা হল যুদ্ধক্ষেত্রে। বানানো হল পরমাণু বোমা বা পারমাণবিক বোমা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। একপক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া। আরেক পক্ষে জার্মানি, জাপান, ইতালি, তুরস্ক। যুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুটি বোমা ফেলল যুক্তরাষ্ট্র। বোমা দুটির নাম লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান। নাম লিটল বয় হলে কী হবে, সেই বোমার আঘাতটা ছিল দানবের মতোই। তার আঘাতে মুহূর্তেই হিরোশিমা মিশে গেল ধুলির সঙ্গে। নাগাসাকিতে ফ্যাট ম্যানের আঘাতেও গুড়িয়ে গেল সবকিছু। শহর দুটির কোনো গাছপালা বা ভবন সেদিন আস্ত ছিল না। বোমা দুটির আঘাতে মারা গেল প্রায় সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ। গুরুতর আহত হল আরও অসংখ্য মানুষ।

এর মাধ্যমেই বিশ্ববাসী প্রথমবার বুঝতে পারল, খুদে পরমাণুর মধ্যে লুকিয়ে আছে অতিকায় এক দানব। আলাদিনের চেরাগের সেই বিশাল দৈত্যের মতো যার প্রচণ্ড শক্তি। যা মুহূর্তেই ছারখার করে দিতে পারে সবকিছু। চাইলে, সেটা দিয়ে চোখের পলকে গোটা একটা শহর, চাইকি মানবসভ্যতাও ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। মানুষ আতঙ্কিত হল ভীষণ। কিন্তু ভালো কিছু কি করা যায় না?

হ্যাঁ, সেটাও করা সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শক্তিকে মানবকল্যানে কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করেন বিজ্ঞানীরা। অচিরে উপায়ও বের করে ফেলেন। এরপর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ আরও নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পরমাণুর এই শক্তি। বাংলাদেশের রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেও এভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। তাতে এ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মিটবে বেশ ভালোমতোই।

পরমাণুর গভীর রাজ্যের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানার দরকারটা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। আজকের দুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর। আর এই প্রযুক্তি দুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে পরমাণুর চরিত্র বা আচার-আচরণ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার কারণে। সেই জ্ঞানটুকু না থাকলে আজকে আমাদের হাতের মুঠোর কম্পিউটার, ট্যাব, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট কিংবা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুই থাকত না। কাজেই শুরুতে যে ফাইনম্যানের কথাটা বলেছিলাম মনে আছে? ওই যে, ‘সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি’। সভ্যতা ধ্বংসের আগে কথাটা পরের প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যেতে বলেছিলেন তিনি। তাঁর সে কথাটা সত্যি কিনা নিজেই একবার ভেবে দেখো। 

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: পরমাণু ও পরমাণু শক্তি/ আইজ্যাক আসিমভ

পার্টিকেল ফিজিকস / ফ্রাঙ্ক ক্লোজ 

বিবিসি

উইকিপিডিয়া