রক্ত ও টমেটোর সস কেন নন-নিউটনিয়ান পদার্থ

তরল পদার্থকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? তরলের ঘ্রাণ, বর্ণ, স্বাদ ইত্যাদি নানা বৈশিষ্ট্য তরল পদার্থকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য বেশ উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার। অনেকে আবার এই তালিকায় অম্লত্বকে যোগ করতে বেশ স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন। তবে পদার্থবিদদের কাছে তরলকে সংজ্ঞায়িত করার সবচেয়ে ভালো উপায়ের নাম সান্দ্রতা। প্রতিটি তরলের সান্দ্রতার মান ভিন্ন। মানের ভিন্নতার কারণে তরলগুলোর প্রবাহিত হওয়ার ক্ষমতাও কম-বেশি হয়। মধুর মতো উচ্চ সান্দ্রতা বিশিষ্ট তরলগুলো সহজে প্রবাহিত হতে পারে না। অন্যদিকে পানির মতো কম সান্দ্রতার তরলগুলোর প্রবাহ বেশ সাবলীল। আবার এমন প্রবাহীর অস্তিত্বও বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, যাদের সান্দ্রতার মান শূন্য। এদেরকে বলা হয় সুপারফ্লুইড। এরা কোনো ধরণের বাঁধা অনুভব করা ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে।

প্রিয় পাঠক, বলুন তো, কোন প্রবাহীর সান্দ্রতায় কি পরিবর্তন আনা সম্ভব? অর্থাৎ, কোনো কিছুর মান পরিবর্তন করলে অথবা বাইরে থেকে কোন কিছু প্রয়োগ করার মাধ্যমে কি এদের সান্দ্রতার মান কম-বেশি করানো যাবে?

আমাদের পরিচিত প্রবাহীগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের প্রবাহীগুলোতে চাপ বা পীড়নের মাধ্যমে সান্দ্রতায় পরিবর্তন আনা যায় না। এদের নাম দেওয়া হয়েছে নিউটনিয়ান প্রবাহী। পানি, মধু, তেল, বাতাস ইত্যাদি সবাই এদের উদাহরণ। অন্যদিকে আরেক বিশেষ ধরণের প্রবাহী আছে যাদের সান্দ্রতা বাহ্যিক চাপ বা ব্যবর্তন পীড়নের কারণে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এদের বলা হয় নন-নিউটনিয়ান প্রবাহী। পীড়নের পরিবর্তনের কারণে এদের সান্দ্রতার মান কমে যেতে বা বেড়ে যেতে পারে। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় ধীর প্রবাহ সম্পন্ন প্রবাহীগুলো দ্রুত প্রবাহিত হওয়া শুরু করবে। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। দ্রুত প্রবাহ সম্পন্ন প্রবাহীগুলো অনেকটা জমাট বেঁধে পরিণত হবে ধীর প্রবাহ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রবাহীতে। কোন ঘটনাটি ঘটবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করবে প্রবাহীর প্রকৃতির ওপর।

২.

এবার কিছু নন-নিউটনিয়ান প্রবাহীর বাস্তব উদাহরণ নিয়ে কথা বলা যাক। এদের খোঁজ পেতে খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষের দেহের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হওয়া রক্ত নন-নিউটনিয়ান প্রবাহীর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রক্ত সাধারণ পানির তুলনায় ঘন। সান্দ্রতার মান বেশি হওয়ায় এরা পানির মতো দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে না। দেহের বিভিন্ন জায়গায় এরা পৌঁছে যায় বিভিন্ন রক্তনালী ব্যবহার করে। মজার বিষয় হলো, এদের অনেকগুলোর প্রশস্থতা খুবই কম। তাই সান্দ্রতার বিচারে সেগুলোর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়া তো দূরে থাক, প্রবেশই করতে পারার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে মোটেও এমন হচ্ছে না। তাহলে রহস্যটা কী?

ছবি ১: লোহিত রক্ত কণিকার একলা চল নীতি

উত্তর লুকিয়ে আছে নন-নিউটনিয়ান প্রবাহীতে। আগেই বলেছি রক্ত সাধারণ কোনো প্রবাহী নয়। ব্যবর্তন পীড়ন (Shear stress) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের সান্দ্রতার মান কমতে থাকে। অর্থাৎ, রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে এর সান্দ্রতার মান কমে যায়। তাই খুব সহজেই এরা সবচেয়ে সরু রক্তনালীতেও অবাধে ঢুকে যেতে পারে এবং প্রবাহিত হতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। এখন কথা হলো, এরা এমন আচরণ করে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে লোহিত রক্ত কণিকার কাছে। রক্তের অন্যতম মূল উপকরণ লোহিত রক্তকণিকা। প্রশস্ত রক্তনালীর মধ্য দিয়ে চলাচলের সময় এরা দলবদ্ধ অবস্থায় থাকে। ফলে রক্ত প্রবাহিত হতে একে অন্যকে বাঁধা দেয়। কিন্তু সরু নালীর মধ্যে প্রবেশের সময়ে এরা ব্যবর্তন পীড়নের কারণে দলবদ্ধ অবস্থায় প্রবাহিত হতে পারে না। পাশাপাশি এদের আকৃতিতেও পরিবর্তন আসে। যেন সামগ্রিকভাবে রক্তের সান্দ্রতা কমে যায় এবং এরা সহজে প্রবাহিত হতে পারে।

রক্তের মতোই আরেকটি নন-নিউটনিয়ান প্রবাহীর উদাহরণ আমাদের অতি পরিচিত টমেটো সস। সান্দ্রতা বেশি হওয়ার কারণে বোতল থেকে সস ঢালার সময় নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। কারণ, সম্পূর্ণ উপুড় করে ধরলেও এরা সহজে নিচে পড়তে চায় না। তবে আমরা যদি বোতলকে ঝাঁকাই, তাহলে এদের সান্দ্রতা কমে যায়। ফলে সহজেই সস নিচে পড়বে।

৩.

এবার আরেক ধরণের নন-নিউটনিয়ান প্রবাহী নিয়ে কথা বলা যাক। দেখতে অনেকটা ঘন স্যুপের মত এই প্রবাহীর নাম উবলেক (Oobleck)। এদের আচরণ একটু আগে বর্ণনা করা রক্ত বা সসের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, পীড়নের কারণে এদের সান্দ্রতার মান কমে যায় না, বরং বহুগুণে বাড়ে!

উবলেক দিয়ে বেশ মজার কিছু এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চলুন দেখা আসা যাক, কীভাবে এদের তৈরি করতে হয়। ঘরে বসে যে কেউ খুব সহজেই এদের তৈরি করতে পারে। এজন্য শুধু প্রয়োজন হবে পানি এবং কর্নস্টার্চ। উবলেক তৈরির জন্য এদের ১:১.৫ বা ১:২ অনুপাতে ধীরে ধীরে মেশাতে হবে। মেশানোর প্রক্রিয়াটি বেশ সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। যতক্ষণ না প্রথম দেখায় তরল সদৃশ একটি পদার্থের দেখা মিলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধীরে ধীরে মেশানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

মেশানোর প্রক্রিয়া শেষ করার পর যদি একটি চামচ দিয়ে উবলেকের মধ্যে দ্রুত ও জোরে নাড়া দিয়ে চামচ বের করে আনা হয়, তাহলে অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটবে। এক নিমিষেই উবলেক কঠিন পদার্থের মত শক্ত আকার ধারণ করবে। চাইলেও চামচটিকে আর উবলেকের ভেতরে প্রবেশ করানো যাবে না। নিচের ছবিতে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

ছবি ২: উবলেকের ভূতুড়ে কাণ্ড

এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার পরিপূর্ণ সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানতে পারেননি। নাটকীয়ভাবে সান্দ্রতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় আকারের স্টার্চ কণাগুলোই মূল ভূমিকা পালন বলে তাঁদের ধারণা। যখন এদের চারপাশে পানির অণু থাকে তখন এরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাইরে থেকে দ্রুত গতিতে বল প্রয়োগ করা হলে পানির অণুগুলো দূরে সরে যায়। এতে কর্নস্টার্চ কণাগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ঘর্ষণ বল কাজ করা শুরু করে। ফলে সামগ্রিকভাবে কঠিন পদার্থের মতো আচরণ শুরু করে উবলেক।

আগেই বলেছি, উবলেক দিয়ে বেশ কিছু মজার কাণ্ড করা যায়। ধরুন, কেউ একজন খেলাচ্ছলে হাতে কিছু উবলেক নিয়ে দ্রুত নাড়াতে থাকল। যতক্ষণ তিনি এদের নাড়াবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো কঠিন পদার্থ হিসেবে থাকবে। নাড়ানো বন্ধ করলেই হাতের ফাঁক গলে তরল পদার্থ হিসেবে নিচে পড়ে যাবে। আবার, যদি হাতের কাছে কোনো বড় আকারের সাউন্ড বক্স থাকে, তাহলে সেটির সাহায্যে উবলেকের নাচ দেখার ব্যবস্থা করা যাবে। এ জন্য প্রথমে সাউন্ড বক্সকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দিতে হবে। তারপর বক্সের যে অংশ দিয়ে শব্দ বা বিট বের হয়, সেখানে প্লাস্টিকের ওপরে সামান্য পরিমাণ উবলেক রেখে দিতে হবে। এবার যদি গান ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে শব্দ ও বিটের তালে তালে উবলেক লাফিয়ে ওপরে উঠতে থাকবে এবং মজার সব আকৃতি তৈরি করবে। নিচের ছবিতে বিষয়টি দেখানো হয়েছে। 

ছবি ৩ সুইমিং পুল ভরতি উবলেক

উবলেক দিয়ে বড় পরিসরে আরেকটি মজার কাণ্ড করা যায়। সেজন্য প্রয়োজন একটি সুইমিং পুলের। প্রথমেই এর পানির সঙ্গে সঠিক অনুপাতে কর্নস্টার্চ মিশিয়ে উবলেক তৈরি করে পুল ভর্তি করে ফেলতে হবে। এবার যদি কেউ সেই পুলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে দেখা যাবে তিনি না ডুবে অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। অর্থাৎ, উবলেক ভর্তি পুলে হেঁটে বেড়ানো সম্ভব। পা দিয়ে উবলেকের ওপর বল প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে সেটি জমে কঠিন পদার্থের মতো আচরণ করা শুরু করে। তাই ডুবে যাওয়ার কোন আশংকা নেই। সুযোগ থাকলে আপনিও বাসায় বসে করে ফেলতে পারেন এক্সপেরিমেন্টটি।

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র: কোয়ার্কি কোয়ার্ক: আ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস