নোবেল পুরস্কার ২০২২ এর ঘোষণা শুরু হয়েছে চলতি বছর ৩ অক্টোবরে। বিশ্বের সবার চোখ এখন এই পুরস্কারের দিকে। কারা পাচ্ছেন পৃথিবীর অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার, তা নিয়ে দেশে দেশে চলছে আলোচনা।
নোবেল ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম নেই। কাউকে এই পুরস্কারে ভূষিত করার আগে বিচারকদের বেশ ঘাম ঝরাতে হয়। ভুল করে অপাত্রে গেলে সেটা নষ্ট করবে নোবেল পুরস্কারের সুনাম।
নোবেলজয়ী নির্ধারণ করতে কখনো যে ভুল হয় না, এমনটা নয়। বিশেষ করে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে প্রতিবছরই কমবেশি বিতর্ক তৈরি হয়। বিজ্ঞানের তিনটি বিভাগে এই ভুলের পরিমাণ কম।
বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার পরীক্ষা নিরীক্ষায় উৎরে গেলে তখনই তা নোবেল পাবার উপযুক্ত হয়। তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য নোবেল দেওয়া হয় না। এরপরও মানবজাতির জন্য কল্যাণকর নয় এমন আবিষ্কার পেয়েছে নোবেল পুরস্কার। এমনকি ভুল আবিষ্কারের জন্যও নোবেলের পাওয়ার ঘটনা আছে।
রসায়নে নোবেল ১৯১৮
জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিৎস হেবার নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি করার উপায় আবিষ্কার করেন। তাঁর এই পদ্ধতিটি বিশ্বজুড়ে সার তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছিল। কৃষিতে যোগ করেছিলো, নতুন মাত্রা। ফলে, ১৯১৮ সালে রসায়নের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে।
সমস্যা হচ্ছে, নোবেল কমিটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেবারের ভূমিকাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। ১৯১৫ যুদ্ধচলাকালে ফ্রিৎস হেবার বেলজিয়ামে জার্মান বাহিনীর পক্ষ থেকে বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণ তদারকি করে। ফলে হাজার হাজার মিত্র সেনা নিহত হয়। এমন মানবতাবিরোধী কাজের পরও হেবার ফ্রিৎসের নোবেল পাওয়ার বিষয়টি প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল ১৯২৬
১৯২৬ সালে এককভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান ড্যানিশ বিজ্ঞানী জোহানেস ফিবিগার। ইঁদুরের ক্যান্সারের কারণ আবিষ্কারের জন্য এ পুরস্কার জেতেন তিনি।
ফিবিগারের গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো, ইঁদুরের ক্যান্সারের কারণ স্পিরোপ্টেরা কার্সিনোমা (Spiroptera carcinoma) নামের বিশেষ ধরণের কেঁচো কৃমি। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তোলাপোকা খাওয়ার মাধ্যমে কৃমির লার্ভা গ্রহণকারী ইঁদুরগুলোই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, ইঁদুরের ক্যান্সারের কারণ কৃমি ছিল না। ইঁদুরগুলো মূলত ভিটামিন এ-এর অভাব থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। ভুল আবিষ্কারের জন্য নোবেল দেওয়ার এটি এক বিরল উদাহরণ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল ১৯৪৮
ডাইক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন বা ডিডিটি নামক কীটনাশকের কার্যকারিতা আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে এককভাবে নোবেল পুরস্কার পান সুইস বিজ্ঞানী পল হারম্যান মুলার।
শক্তিশালী কীটনাশক ডিডিটি আসলেই পোকামাকড় দমনে দারুণ কার্যকরী ছিল। এটি ব্যবহারে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর মশা মাছি এবং অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ মারা পড়তো। ফলে, ফসল রক্ষায় ব্যপকভাবে ব্যবহার শুরু হয় ডিডিটি। টাইফাস এবং ম্যালরিয়ার মতো পতঙ্গবাহিত রোগের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক মোক্ষম অস্ত্র। এর কল্যাণে দক্ষিণ ইউরোপ থেকে ম্যালেরিয়া প্রায় পুরোপুরি নির্মূল হয়। বাঁচে হাজারও মানুষের জীবন।
তবে, ১৯৬০-এর দশকে এসে পরিবেশবিদরা দেখতে পান, ডিডিটি বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ডিডিটি ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত হচ্ছে চারপাশ। ফলে, ১৯৭২ সালে ডিডিটি ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে অনেক দেশেও ডিডিটি নিষিদ্ধ করা হয় ২০০১ সালে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল ১৯৪৯
মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য লিউকোটমি বা লোবোটমি আবিষ্কার করেন পর্তুগিজ বিজ্ঞানী আন্তোনিও ইগাস মোনিজ। এ কারণে ওয়াল্টার রুডলফ হেসের সাথে যৌথভাবে ১৯৪৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।
লোবোটমি মূলত মস্তিষ্কের অস্ত্রপচারের একটি পদ্ধতি। ১৯৪০-এর দশকে যা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নোবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, আয়োজকেরা একে মানসিক রোগের ‘চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো মধ্যে একটি’ বলে বর্ণনা করেন।
কারণ, মুদ্রার অন্যপিঠ তখন তাঁদের অজানা ছিল। লোবোটমি মানসিক চিকিৎসায় কাজে লাগত ঠিকই, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল গুরুতর। লোবোটমিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হতো। মারাও যেত রোগী। এমনকি সফল অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীরাও হয়ে যেত মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াহীন বা অসাড়।
ভয়াবহ এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ১৯৫০-এর দশকেই এই পদ্ধতির প্রয়োগ কমতে থাকে। এর পরিবর্তে, মানসিক চিকিৎসার জন্য ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়।
মানবজাতির জন্য কল্যাণকর অবদান রাখার সম্মাননা হিসেবে আলফ্রেড নোবেল, চালু করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। শুধু টাকার অংক নয়, বিচারের মানদণ্ডে নোবেল কমিটির স্বচ্ছ অবস্থান এই পুরস্কারকে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের আসনে বসিয়েছে। ৭০০ কোটি মানুষের মাঝে থেকে ছয়টি বিভাগে গুটি কয়েক মানুষকে সম্মানিত করা সহজ কথা নয়। তাই, এই প্রক্রিয়ার কিছু ভুলত্রুটি হয়ত মেনে নেওয়া যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: ফিজিক্স ডট ওআরজি, নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি