কোয়ান্টামের চমকপ্রদ জগতে

বর্তমান যুগে অনেকেই কোয়ান্টাম শব্দটির অর্থ নিরেট টুকরো টুকরো জিনিস বলে বুঝে থাকেন। বাজারে আত্মোন্নয়নের একটি ট্রেনিং ‘মেথড’ চালু আছে ‘কোয়ান্টাম’ শব্দটি ব্যবহার করে। আমার অবশ্য এই মেথড সম্পর্কে আর কোনো অতিরিক্ত জ্ঞান নেই। হালের ‘নিউ এজ’ গুরু ডা. দীপক চোপড়া ‘কোয়ান্টাম’ শব্দটির অপপ্রয়োগ করে বেশ কিছু বই প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু পদার্থবিদদের সঙ্গে তাঁর বাহাসের কিছু ইউটিউব ভিডিও আছে। সেগুলো দেখলে বোঝা যায় কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা নেই। এই বিতর্কের পরও দীপক চোপড়া হাল ছেড়ে দেননি এবং তাঁর অনুসারীদের সংখ্যাও একেবারে হাতে গোনা নয়। এ থেকে বোঝা যায়, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান প্রণয়নের ৯০ বছর পরও আমাদের এটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ বিন্যাস ব্যাখ্যা করার জন্য শক্তির গুচ্ছের কোয়ান্টায়নের ধারণা প্রচলন করেছিলেন। তা কিন্তু দুই দশক পরেই মৌলিক স্বকীয়তাটুকু হারায়। এমনিতেই প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইন-বোরের হাতে গড়া কোয়ান্টাম তত্ত্ব একটা জোড়াতালি লাগানো কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল এবং অনেকেই এটার জগাখিচুড়ি মার্কা তত্ত্ব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। যেমন নিলস বোর রাদারফোর্ডের দেওয়া পরমাণুচিত্রের পরিবর্তন/পরিবর্ধন ঘটালেন, তাতে ব্যবহার করলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তখন রাদারফোর্ড তাঁকে ইলেকট্রনের লাফ দেওয়ার ধারণার অসংগতি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এই সুযোগে পাঠককে এই বোর চিত্রে ইলেকট্রন কীভাবে লাফ দেয়, তা মনে করিয়ে দিই। বোরের চিত্রে পরমাণুর ইলেকট্রন রাদারফোর্ডের চিত্রের মতো যেকোনো কক্ষপথে থাকতে পারে না। বরং কতগুলো বিশেষ কক্ষপথে থাকতে পারে, সেসব কক্ষপথে থাকাকালে সে কোনো বিকিরণ করে না (এর ব্যাখ্যা বোরের চিত্রেও নেই—সে জন্যই এই চিত্রগুলো অসম্পূর্ণ)। বোরের প্রস্তাব অনুযায়ী বেশি শক্তির অনুমোদিত স্তর (এটাকে এরপর থেকে উচ্চস্তর বলব) থেকে ইলেকট্রন যখন একটি কম শক্তির অনুমোদিত স্তরে (আর এটাকে বলব নিম্নস্তর) নেমে আসে, তখন সে একটি ফোটন ছেড়ে দেয়। সেই ছেড়ে দেওয়া ফোটনের শক্তি ওই দুই স্তরের শক্তির ব্যবধানের সমান (ছবি ১)। বোরের প্রস্তাবে কীভাবে ইলেকট্রন এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নেমে আসে তার ব্যাখ্যা নেই। তিনি শুধু একটা তাত্ক্ষণিক লাফ দেওয়ার মাঝেই পুরো ব্যাপারটিকেই বেঁধে রাখতে চাইলেন। কিন্তু এটাই রাদারফোর্ডের কাছে মনে হলো এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা।

ছবি ১ : বোরের চিত্রে ফোটন

রাদারফোর্ডের খটকার কারণ বুঝতে চাইলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ইলেকট্রনের কোনো স্মৃতিশক্তি নেই। এটা একে তো মৌলিক কণা, তার ওপর সব ইলেকট্রনেরই মৌলিক বৈশিষ্ট্য একই (যেমন—ভর, চার্জ ইত্যাদি)। তার মানে ইলেকট্রন যখন এক স্তর থেকে অন্য স্তরে লাফ দেয়, সে তার আগের স্তরে অবস্থানের ইতিহাসটিকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। এখন উচ্চস্তর থেকে নামার সময় ইলেকট্রনকে আগে ফোটন ছাড়তে হবে। আর সেই ফোটনের শক্তি হতে হবে উচ্চস্তর আর নিম্নস্তরের শক্তির পার্থক্যের সমান। ঝামেলাটা হলো, ইলেকট্রন রয়েছে উচ্চ স্তরে, তার পক্ষে নিম্নস্তরের খবর রাখার জন্য কোনো মেমোরি নেই। সে কী করে জানবে নিম্নস্তরের শক্তি কত? এটা সম্ভব হতো যদি ইলেকট্রন উচ্চস্তরে অবস্থান করেই নিম্নস্তরে বেড়াতে আসতে পারত!

কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান প্রণয়নের আগে এই ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি। কারণ নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের কাঠামোয় এটা সম্ভব নয়। এ জন্যই আমরা যখন পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ দেওয়ার সময়ই অবস্থান বনাম সময়ের এই রকম (২ আর ৩ নম্বর) ছবিগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। কারণ, দেখা যাচ্ছে, শুরু আর শেষ অবস্থানে আমরা কণার সুনির্দিষ্ট অবস্থান পেলেও এই দুই সময়ের মাঝে কখনো কখনো একই কণার একই মুহূর্তে দুই জায়গায় সহাবস্থান খুঁজে পাচ্ছি।

ছবি ২: নিউটনের চিত্রে অনুমোদিত পথ
ছবি ৩: আরেকটি অনুমোদিত পথ

যদি আমরা পরমাণু থেকে আলো বা অন্য সব বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ না বেরোতে দেখতাম তা হলে একই সময়ে দুই জায়গায় থাকার মতো অদ্ভুত ঘটনা প্রস্তাব করতাম না। আলোর মৌলিক কণা বা ফোটনের মধ্যেও একই ঘটনা ঘটে। সেটা আমি বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় ‘ফোটনের অদ্ভুতুড়ে কাহিনি’ নামে একটা ফিচারে ব্যাখ্যা করেছিলাম। আলোর কণার এই দুই জায়গায় সহাবস্থান আমরা আলোর তরঙ্গ প্রকৃতির মাধ্যমে সহজেই আত্মস্থ করে নিতে পারি। কিন্তু একই ঘটনা ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে আমাদের হজম করতে একটু কষ্ট করতে হবে। তবে ইলেকট্রন কি তরঙ্গ প্রকৃতি দেখাতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে—হ্যাঁ। পরীক্ষাগারেই ইলেকট্টনের ব্যতিচার, অপবর্তন ইত্যাদি ঘটনা পর্ষবেক্ষণ করা হয়েছে। সে পরীক্ষণগুলোর ব্যাপারে আলোচনা বোধ হয় বিজ্ঞানচিন্তার অন্যান্য পাতায় করা হয়েছে। আর আমাদের এই আলোচনায় সে ব্যাপারগুলোর ব্যাখ্যা না করলেও চলবে। কিন্তু যদি ইলেকট্রন একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করতে পারে তাহলে কি আমরা তাকে একই সময়ে দুই জায়গায় দেখতে পারব? এর উত্তর হচ্ছে—না।

ইলেকট্রন একটি চার্জিত। একটা ইলেকট্রন একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে গেলে চার্জের সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘিত হবে। ফোটনের যেহেতু এ রকম চার্জের বাধ্যবাধকতা নেই, তাই একে একরকমভাবে ক্লোন করা সম্ভব। তবে এই স্বল্প পরিসরে এর বেশি আলোচনা করব না—আশা করি, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদকমণ্ডলী টেলিপোর্টেশন এবং ক্লোনিং নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সংখ্যা করবেন।

আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমরা দেখেছিলাম, তরঙ্গ হিসেবে গণ্য করলে কোয়ান্টাম কণার কোনো সময়ে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে না। এটা থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, তরঙ্গের ধারণা ব্যবহার না করেও আমরা কোয়ান্টাম কণা নিয়ে কাজ করতে পারব। এর কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকবে না—যতক্ষণ না আমরা তার অবস্থান মাপতে যাচ্ছি। এই ধারণাটির সবচেয়ে চমত্কার উপস্থাপন হয়েছিল মার্কিন বিজ্ঞানী রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যানের হাতে। তাঁর এই কোয়ান্টাম ঘরানাটিকে আমরা Path-integral formalism বা পথ-যোজন চিত্র বলে অভিহিত করে থাকি। তাঁর যুক্তি খুবই সহজবোধ্য—যখন আমরা দেখছি না, কণার তখন কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেই। অতএব আদি ও অন্তিম এই দুই অবস্থার মাঝে কণা যেকোনো নির্দিষ্ট পথও মেনে চলতে বাধ্য নয়। অতএব, আমাদের সব পথকেই গণ্য

করতে হবে।

ছবি ৪: শুরু থেকে শেষে যেতে অনেক পথের সমাহার

সহজ একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাব। ধরা যাক, কুমিল্লা হয়ে যেতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাকে কেউ কুমিল্লা গিয়ে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে দিতে পারে, তার ফলে পণ্ড হয়ে যাবে আমার পুরো যাত্রাটাই। তখন চট্টগ্রামে আমাকে পাওয়ার সম্ভাবনা হবে শূন্য। কিন্তু আমি যদি একটা কোয়ান্টাম কণা হতাম, সে ক্ষেত্রে কেউ আমাকে কুমিল্লায় থামালেও সেটা আমার যাত্রা অসংখ্য পথের মাঝের একটি পথকে বাদ দিত। কিন্তু আমার কোয়ান্টাম ভার্সন অন্য সব পথ দিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পারত। তবে আমাকে চট্টগ্রামে পাওয়ার সম্ভাবনা ১ হতো না, তার থেকে কম হতো। এভাবেই ফাইনম্যানের চিত্রে আমরা কোয়ান্টামের সব অদ্ভুত ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারি।

আহা, আমরা যদি সবাই কোয়ান্টাম কণা হতে পারতাম, তাহলে ট্রাফিক জ্যাম আমাদের কোনো যাত্রায় বাদ সাধতে পারত না।

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়