প্রকৃতিতে যত ধরনের মৌল পাওয়া যায় তার চারভাগের তিনভাগই ধাতব। এসব মৌলের অন্যতম কিছু বৈশিষ্ট্য হলো, এরা তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। আলো প্রতিফলিত করবে। ঘাতসহ হবে। ইচ্ছেমতো বাঁকিয়ে যেকোনো আকৃতি দেওয়া যাবে। আঘাতে উচ্চ কম্পাংকের শব্দ তৈরি হবে, মানে কঠিন হবে। লোহা, তামা, নিকেল বা টিনের মতো প্রায় সব ধাতুর সঙ্গে মেলে এসব বৈশিষ্ট্য। গোলমাল বাঁধে পারদের বেলায়। দেখতে চকচকে এ ধাতু তাপ কিংবা বিদ্যুৎ পরিবহনও করে ঠিকঠাক মতো। কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রায় নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে পারে না। আঘাত করলে ধাতব শব্দও পাওয়া যায় না সাধারণত। পাবেন কি করে, সে তো তরল অবস্থায় থাকে। এ কারণেই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় একে চাইলেই নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ তরল পদার্থের যত গুণাবলি আছে, সবই দেখা যায় পারদের ক্ষেত্রে। কিন্তু কেন পারদের এই বেয়াড়া আচরণ? কক্ষ তাপমাত্রায় কেন পারদ অন্যান্য ধাতুর মতো কঠিন অবস্থায় না থেকে তরল অবস্থায় থাকে?
পারদের এই আচরণকে ঠিক বেয়াড়া বলা চলে না। সব ধাতব পদার্থকেই তরলে পরিণত করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু তাপের। ধাতব বৈশিষ্ট্য এক হলেও সবার গলনাঙ্ক এক নয়। অর্থাৎ একেক ধাতব মৌল একেক তাপমাত্রায় গিয়ে তাদের কাঠিন্য হারায়। পরিণত হয় তরলে। টিনের কথাই বলা যাক। কঠিন এ ধাতব পদার্থকে আপনি যদি ২৩১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করেন, তাহলেই এটা তরলে রূপ নেবে। অন্যদিকে ট্যাংস্টেনকে তরল করতে হলে দিতে হবে ৩ হাজার ৪২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। পারদের বেলায় তাপমাত্রাটি প্রায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধাতব পদার্থের মধ্যে পারদের গলনাঙ্কই সবচেয়ে কম।
কারণ, পারদের অনন্য ইলেকট্রন বিন্যাস। পারদ পরমাণুর শেষ কক্ষপথে থাকা ইলেকট্রনগুলো খুব জোরালোভাবে নিজের নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে আবদ্ধ থাকে। সহজে অন্য পারদ পরমাণুর ইলেকট্রনের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে চায় না। ফলে পদার্থটিতে খুব কম ধাতব বন্ধনশক্তি বিরাজ করে। পদার্থের পরমাণুগুলো একে অন্যের থেকে আলাদা করতে যে শক্তির দরকার হয়, তা ওই পদার্থের বন্ধনশক্তি। অন্যভাবে বললে, যে পরিমাণ শক্তিতে পরমাণুগুলো একে অন্যের সঙ্গে লেগে থাকে তা পদার্থের বন্ধনশক্তি। বন্ধন কতটা শক্তিশালী তার ওপর গলনাঙ্ক নির্ভর করে। কোনো পদার্থের বন্ধনশক্তি যত কম হবে, তার পরমাণুগুলো তত অল্প তাপমাত্রায় আলাদা হবে। একক পরমাণুর গতিশক্তি বাড়বে। একসময় পদার্থটি কঠিন থেকে তরলে রূপ নেবে।
পারদের তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনলে অণুর গতি হ্রাস পায়। একটা সময় গতি শক্তি কমে অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে।
সব ধাতব পদার্থে পরমাণুগুলো এই আচরণই করে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের গতিশক্তি বেড়ে যায়। দ্রুত গতিতে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। পারদে ঘটনাটা ঘটে অনেক কম তাপমাত্রায়। কারণটা আগেই বলেছি। কম তাপমাত্রায় পারদের পরমাণুগুলো আলাদা হয়ে ছুটতে থাকার কারণে এর আয়তন বাড়ে। পারদ থার্মোমিটারে মূলত এটাই দেখি। সামান্য তাপমাত্রা বেড়ে গেলেই ফাঁকা নল বেয়ে পারদ উঠে যায় ওপরে। অর্থাৎ তরলের ঘনত্ব কমে আয়তন বেড়ে যায় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে।
বিপরীতে পারদের তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনলে অণুর গতি হ্রাস পায়। একটা সময় (প্রায় মাইনাস ৩৮.৮৩ সেলসিয়াসের নিচে আসলে) গতি শক্তি কমে অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে। ফলে কঠিন পদার্থে রূপ নেয়। মজার বিষয় হলো, তাপমাত্রা কমাতে কমাতে যদি পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে পারদ অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টিভ পদার্থে পরিণত হবে। অর্থাৎ তখন এর মধ্য দিয়ে কোনো প্রকার রোধ বা বাঁধা ছাড়াই তড়িৎ প্রবাহিত হবে। ডাচ পদার্থবিদ হেইক কামেরলিং ওনেস ১৯১২ সালে এ বিষয়টি আবিষ্কার করেন।