নোবেল ২০২৩
আলফ্রেড নোবেল: একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
২ অক্টোবর থেকে শুরু হবে চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা। যাঁর নামে ও অর্থায়নে এই পুরস্কার, সেই আলফ্রেড নোবেলকে কেউ বলেন মৃত্যুর কারবারী, কেউ বলেন শান্তির দূত। বাস্তবে কেমন মানুষ ছিলেন তিনি? আলফ্রেড নোবেলের জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন…
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকি, নিরাসক্ত। জীবনে কোনোদিন ধূমপান করেননি, মদ পান করেননি, এমন কি বিয়েও করেননি। তেমন কোনো বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের। প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন—অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু কোনো রচনাই তিনি প্রকাশ করেননি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি ও ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন—যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে কজন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশন।
আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশনের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেওয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু দিক উন্মোচিত হয়। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দিক।
নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল—আলফ্রেড নোবেলের বাবা।
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেলের চতুর্থ সন্তান আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। তাঁর বড় তিনজনের একজন জন্মের পরেই মারা যায়। বাকি দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ। ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন প্রকৌশলী। তাঁর নিজের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। কনস্ট্রাকশনের কাজে নানারকম বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে নতুন অনেক পদ্ধতি আবিষ্কার করছিলেন তিনি। তাঁর ব্যবসায় মাঝে মাঝে খুবই সাফল্য আসছিল, আবার মাঝে মাঝে হারাচ্ছিলেন সর্বস্ব। আলফ্রেডের যখন জন্ম হয়, তখন ইমানুয়েল নোবেলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কনস্ট্রাকশন ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেছে। সুইডেনের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন তিনি তখন।
এদিকে জন্ম থেকেই ভীষণ রুগ্ন আলফ্রেড। পেটের পীড়া লেগেই আছে, হৃৎপিন্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সারাজীবনই শরীর নিয়ে ভুগেছেন আলফ্রেড নোবেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মাকে আঁকড়ে ধরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সারাক্ষণ শারীরিক কষ্টে ভোগার কারণে আলফ্রেড ছোটবেলা থেকেই কোনো ধরনের খেলাধূলার প্রতি উৎসাহ পাননি। তাই কোনো খেলার সঙ্গীও ছিল না। শৈশবে মা ছাড়া আর কারো সঙ্গেই তাঁর কোনো আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে কখনোই ছিলেন না হাসিখুশি উচ্ছল। তাঁকে কেউ কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি।
ইমানুয়েল নোবেল আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য নানারকম ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সফলতা ধরা দিচ্ছিল না। আলফ্রেডের বয়স যখন চার, তখন তিনি তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সুইডেনে রেখে ফিনল্যান্ড চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু করতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সে সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে। ইমানুয়েল দেখলেন সম্ভাব্য যুদ্ধের বাজারে গোলাবারুদ, মাইন আর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সরবরাহের বিপুল সম্ভাবনা। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। দ্রুত সাফল্য অর্জন করলেন, আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেল। ১৮৪২ সালে পুরো পরিবারকে নিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে।
আলফ্রেড যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে এলেন, তখন তাঁর বয়স নয়। চার বছর বয়স থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ইমানুয়েল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই কোনো ছেলেকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে টিউটর রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের পছন্দ, মেধা ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রেখে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাড়িতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের জন্য শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো ছেলেদের জন্য।
আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েননি। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়া। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালো লাগে সাহিত্য। সতের হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেলেন আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলেন কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, লেখকই হবেন।
আলফ্রেডের কাব্যচর্চার কথা জেনে গেলেন বাবা ইমানুয়েল। তিনি জানেন, কাব্যচর্চা করে অর্থোপার্জন করা যায় না। তাই চাচ্ছিলেন ছেলে এমন কিছু করুক, যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ হবে। নিজের কারখানায় ছেলেকে সম্পৃক্ত করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। ১৮৫০ সালে আলফ্রেডকে রাসায়নিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ইমানুয়েল নোবেল।
পরবর্তী তিন বছর আলফ্রেড জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকজন বিশিষ্ট প্রকৌশলী ও রসায়নবিদের অধীনে কাজ শিখলেন। আমেরিকায় কাজ করলেন সুইডিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জন এরিকসনের সঙ্গে, যিনি ‘মনিটর’ নামে একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন করেছিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে কাজ শিখলেন রসায়নবিদ আস্ক্যানিও সবরেরোর কাছে। আস্ক্যানিও সবরেরো নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। ভয়ংকর বিস্ফোরক এই নাইট্রোগ্লিসারিন এতটাই বিপজ্জনক যে সামান্য নাড়াচাড়াতেই প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। তাই এটাকে তখন কোনো ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আলফ্রেড ভাবতে শুরু করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে বশে আনা যায়।
১৮৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে বাবার কারখানায় যোগ দিলেন উনিশ বছর বয়সী আলফ্রেড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী বিপুল পরিমাণ নেভাল মাইন কিনছিল, আর তা সরবরাহ করছিল তাদের ‘ফাউন্ড্রিজ এন্ড মেশিন শপ্স অব নোবেল এন্ড সন্স’। যুদ্ধ যতদিন চলল, নোবেল পরিবারের উপার্জন ততই ফুলে ফেঁপে উঠল। বিপুল উৎসাহে ইমানুয়েল বেশ কয়েক বছরের জন্য মাইন তৈরি করে মজুদ করে ফেললেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ইমানুয়েলের গুদামভর্তি নেভাল মাইন পড়ে রইল অলসভাবে। দুবছরের মধ্যে কারখানা আবার দেউলিয়া হয়ে গেল।
এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারেন না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমতো গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল।
প্রথম প্রেমের মৃত্যুর পর বিষন্ন আলফ্রেড বেপরোয়ার মতো নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ শুরু করলেন। এ যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাওয়া গেল। ১৮৬০ সালে ২৭ বছর বয়সে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলেন।
এদিকে রাশিয়ায় বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইমানুয়েল নোবেল তাঁর পরিবারসহ রাশিয়া ছেড়ে ফিরে এলেন সুইডেনের হেলেনেবর্গে ১৮৬৩ সালে। আলফ্রেড ও তাঁর ছোটভাই এমিল মা-বাবার সঙ্গে সুইডেন ফিরলেন। বড় দুইভাই রবার্ট ও লুডভিগ তাঁদের নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রয়ে গেলেন রাশিয়ায়। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তাঁরা রাশিয়ায় বিপুল তেলসম্পদের মালিক হন। লুডভিগ নোবেলকে রাশিয়ার তেলসাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলা হতো।
সুইডেনে ফিরে এসে স্টকহোমে ল্যাবরেটরি স্থাপন করলেন ইমানুয়েল ও আলফ্রেড নোবেল। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চলছিলই। ১৮৬৩ সালের ১৪ অক্টোবর ৩০ বছর বয়সী নোবেল প্রথম প্যাটেন্ট পেলেন ‘মেথড অব প্রিপেয়ারিং গানপাউডার ফর বোথ ব্লাস্টিং এন্ড শুটিং’। ব্যাপক গবেষণায় মেতে উঠলেন আলফ্রেড।
ল্যাবরেটরিতে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে ছোটভাই এমিল নোবেল। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিরাট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় আলফ্রেডের ল্যাবরেটরি। ছোটভাই এমিলসহ পাঁচজন মারা যান এই দুর্ঘটনায়। ভীষণভাবে আহত হবার পরেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলফ্রেড নোবেল।
একটু সুস্থ হবার পর আবার কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু ছেলে এমিলের মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না বাবা ইমানুয়েল। স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল আলফ্রেড নোবেলের হাতে।
দুর্ঘটনার পর স্টকহোমের কোথাও ল্যাবরেটরি স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছেন না আলফ্রেড। কিন্তু তাঁর ব্লাস্টিং অয়েলের ব্যাপক চাহিদা। হ্রদের ওপর ভাসমান বার্জে অস্থায়ী ল্যাবরেটরি স্থাপন করে তৈরি করা হচ্ছে ব্লাস্টিং অয়েল। অবশেষে ১৮৬৫ সালের নভেম্বরে জার্মানির হামবুর্গের কাছে নাইট্রোগ্লিসারিন ফ্যাক্টরি তৈরির অনুমতি পেলেন। সেখানেও অনেক সাবধানে কাজ করা হচ্ছিল। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক একটা শেডে দুজনের বেশি কাজ করতেন না কখনোই। কিন্তু ১৮৬৬ সালে আবার ঘটল দুর্ঘটনা।
ল্যাবরেটরির ধ্বংসস্তূপ সরাবার সময় আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন তরল নাইট্রোগ্লিসারিন মিহি বালি ও মাটির সঙ্গে মিশে এক ধরনের পেস্টের মতো তৈরি হয়েছে। ওই পেস্টগুলো জোরে নিক্ষেপ করলে বিস্ফোরিত হয়, আগুনে পোড়ালেও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপে ও চাপে বিস্ফোরণ ঘটে না। আলফ্রেড পেয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নলোকের চাবি। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি উদ্ভাবন করলেন ডায়নামাইট। তারপর সাফল্যের ইতিহাস গড়ল এটি। ডায়নামাইট আবিষ্কারের ব্রিটিশ প্যাটেন্ট পেয়ে গেলেন মে মাসে। ছুটে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে—ডায়নামাইটের মার্কিন প্যাটেন্ট পাবার জন্য। দুবছর পরে মার্কিন প্যাটেন্ট পেলেন। পরের কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ডায়নামাইট ও অন্যান্য বিস্ফোরকের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীজুড়ে। তাঁর কারখানা তৈরি হলো ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডে। পরে পৃথিবীর বিশটি দেশের নব্বইটি শহরে আলফ্রেড নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল।
সবচেয়ে বড় কারখানা ফ্রান্সে থাকায় ১৮৭৩ সাল থেকে প্যারিসের মালাকফ এভিনিউতে বসবাস করতে শুরু করেন আলফ্রেড নোবেল। বিরাট বাড়ি। থাকার লোক মাত্র তিন জন, তিনি এবং কাজের লোক ও ড্রাইভার। প্রচন্ড ব্যস্ত আলফ্রেড। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র নিজেই দেখাশোনা করেন। নিজের হাতে সব ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রের উত্তর দেন। আবার তাদের কপিও রাখেন। টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেব রাখেন নিজেই। এর মধ্যেও যখন সময় পান নিজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেন।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই তাঁর। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন, উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন।
প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোনো নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোনো বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, ‘আমার বাড়ি হলো সেখানেই, যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।’
কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছ্বসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন, সঙ্গীহীন, একাকি জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই এক ধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না তাঁর। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না তিনি। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন।
শরীর তাঁর কোনোদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন, কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা হবে।
যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন, সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে ২৩ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেননি এত বছরেও। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার, তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন—তাঁকে কোনো মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনোকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।
১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকি বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাঁকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন কাউকে খুঁজে নেওয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোনো এক সময়।
অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন—‘প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।’
প্যারিসে ফিরে এসে দেখলেন, তাঁর বিজ্ঞাপনের সুবাদে অনেকগুলো দরখাস্ত এসে জমা হয়েছে। আলফ্রেড বাছাই করতে শুরু করলেন। সবার ইন্টারভিউ নেবার সময় তাঁর নেই। যা করার দরখাস্তের ভাষা, তথ্য এবং ছবি দেখে ঠিক করতে হবে। তিনি জানেন কী চাইছেন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে নিয়োগ দিতে যিনি তাঁর চিঠিপত্র লিখতে পারবেন পাঁচটি ভাষায়, যিনি ইতিহাস সচেতন হবেন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তো খুবই ভালো।
দরখাস্ত বাছাই করতে করতে তিনি পেয়ে গেলেন যা চাইছিলেন, তার চেয়েও বেশি। চমৎকার হাতের লেখা, চমৎকার শব্দচয়ন—পাঁচটি না হলেও ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান, এই তিনটি ভাষায় পারদর্শী—কাউন্টেস বার্থা সোফিয়া ফেলিটাস কিনস্কি ভন কিনিক—সংক্ষেপে বার্থা ভন কিনস্কি।
বার্থার সঙ্গে কাজের কথা বলতে বলতে নোবেল বিস্তারিতভাবে বললেন তিনি কী কী জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন, কী কী বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছে তাঁর কারখানায়, কীভাবে সারা পৃথিবীতে রাস্তাঘাট, রেললাইন তৈরির জন্য পাহাড়-পর্বত সমতল করার কাজে ডায়নামাইটের ব্যবহার বাড়ছে। বলতে বলতে আলফ্রেড খেয়াল করলেন, খুব আনন্দ পাচ্ছেন তিনি বার্থার সঙ্গে কথা বলতে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে তিনি যাঁর অপেক্ষা করছিলেন, তাঁকে পেয়ে গেছেন। বার্থাই হতে পারেন তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখের অংশীদার।
বার্থাকে কাছ থেকে দেখে, কয়েকদিন মিশে বার্থার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছেন আলফ্রেড। বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় তিনি ভালোবাসার কথা ভাবেননি একবারও। চেয়েছিলেন বয়স্কা কেউ এসে তাঁর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ঘরবাড়ির দেখাশোনাও করবেন। একজন কথা বলার লোক হবে তাঁর। সংসারে কারো সঙ্গেই তো মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সবার সঙ্গেই কেমন যেন বৈষয়িক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। বিশ বছর আগে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন, তাকে ভুলতে পারেননি। বার্থা স্মার্ট, সুন্দরী, শিক্ষিতা ও একাধিক ভাষায় পারদর্শী—তাঁর তো এরকমই কাউকে দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে বার্থার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন আলফ্রেড নোবেল।
কিন্তু বার্থা ছিলেন অন্যের বাগদত্তা। কিছুদিন পরেই তিনি আলফ্রেডের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। কদিন পর বার্থার চিঠি এল ককেশাস থেকে। আর্থারকে বিয়ে করে তিনি সুখে আছেন। সুন্দর করে চিঠির উত্তর দেন আলফ্রেড। বার্থার সঙ্গে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায় তাঁর। আমৃত্যু অটুট ছিল এ সম্পর্ক। পত্রযোগাযোগ ছিল আলফ্রেডের মৃত্যু পর্যন্ত।
১৮৭৬ সালে বার্থার হৃদয়ে জায়গা পেতে ব্যর্থ হয়ে আলফ্রেড মনে মনে বেশ জেদী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হৃদয়ের দরজা জোর করে বন্ধ করতে চাইলেও কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। সময় পেলেই তিনি ভিয়েনায় চলে যান, হেলথ রিসোর্টে থাকেন। একটু অবসর পেলেই ঘুরে বেড়ান। একদিন এক ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। দোকানে কাজ করছে অষ্টাদশী এক অস্ট্রিয়ান সুন্দরী—মিষ্টি একটা মেয়ে। মেয়েটির নাম সোফি হেস।
কয়েক দিনের মধ্যেই আলফ্রেড ফুল কেনার মতো করে ফুলের দোকানের কর্মচারী সোফি হেসকে একপ্রকার কিনেই নিলেন। অনেক বছর সোফিকে তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু কোনো সামাজিক স্বীকৃতি দেননি।
আলফ্রেডের ব্যবসা আরো বাড়ছে। ১৮৭৯ সালে রাশিয়ায় আরেকটি কোম্পানি খুলে নাম দিয়েছেন ‘ব্রাদার্স নোবেল’ বা ব্রানোবেল। রাশিয়াতে বড়ভাই রবার্ট ও লুডভিগ তার দেখাশোনা করছেন। ১৮৮৪ সালে আবিষ্কার করেছেন ধোঁয়াহীন গানপাউডার—ব্যালিসাইট। ব্যাপক চাহিদা এই ব্যালিসাইটের। ১৮৮৬ সালে ফরাসি অংশীদার পল বার্বির সঙ্গে মিলে নোবেল তাঁর সব ডায়নামাইট ফ্যাক্টরিকে একটা ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসেন।
১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগ নোবেল মারা যান। প্যারিসের সাংবাদিকেরা মনে করলেন বিখ্যাত আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো, ‘মৃত্যুর কারবারির মৃত্যু’। প্যারিসের প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রই বিস্তারিতভাবে নোবেলের বিস্ফোরক ও অস্ত্র ব্যবসার বিবরণ দিয়ে এভাবে সংবাদ রচনা করেছে যে পড়ার পরে আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক কীরকম প্রতিক্রিয়া হবে। তাঁর মনে হলো, পুরো ইউরোপে যেন খুশির বান ডেকেছে তাঁর মৃত্যুতে। এত ঘৃণা করে তাঁকে মানুষ? তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর এমন কিছু করা দরকার যাতে তাঁর মৃত্যুর পর মানুষ তাঁকে ‘মৃত্যুর কারবারি’ দানব হিসেবে মনে না রেখে অন্য কোনো কাজের জন্য মনে রাখবে। তিনি তাঁর উইল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।
পরের বছর ১৮৮৯ সালে বার্থা ভন শাটনারের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘লে ডাউন ইওর আর্মস’ প্রকাশিত হলো। অনেকগুলো ভাষায় অনুদিত হয় এ উপন্যাস। এই বইয়ের মাধ্যমে বার্থাও জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। আলফ্রেড নোবেলও বইটি পড়েন। তিনিও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে, কিন্তু এরকম আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনায় পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। তিনি বার্থাদের আন্দোলনে অর্থসাহায্য করেন—কিন্তু তার পরিমাণ তাঁর সামর্থ্যের তুলনায় খুবই নগণ্য।
বার্থাকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমার কারখানায় তৈরি মারণাস্ত্রই হয়তো একদিন পৃথিবীর সব যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আমি এমন মারণাস্ত্র তৈরি করতে চাই, যা দিয়ে যুদ্ধ করে সব যুদ্ধ একদিন শেষ হয়ে যাবে—কারণ তখন যুদ্ধ করার মতো আর কেউ বেঁচে থাকবে না।’
আলফ্রেড নোবেলের এই কথায় আর যাই হোক, যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাঁর কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। মারণাস্ত্র তৈরি করাই যে উচিৎ নয়, তা তিনি উপলব্ধি করেননি কখনো। তাই তো তিনি ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে সুইডেনের বোফোর্স অস্ত্র কারখানা কিনে নেন। রেগনার সলম্যান নামে এক প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেন এই অস্ত্র কারখানার তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই রেগনার সলম্যানই ছিলেন নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উইলের নির্বাহী ব্যবস্থাপক।
১৮৮৯ সালে আলফ্রেডের মা মারা যান। আলফ্রেড মানসিকভাবে একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ফরাসি সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কারণ তিনি ইতালিয়ান সরকারের সঙ্গে ধোঁয়াহীন গানপাউডার সরবরাহের চুক্তি করছেন। ফ্রান্সের সঙ্গে ইতালির সম্পর্ক খারাপ। ফ্রান্সে বাস করে ইতালির কাছে গানপাউডার বিক্রি করা দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু আলফ্রেড যেখানে টাকা পাচ্ছেন, সেখানেই বিক্রি করছেন। গান পাউডার কোথায় কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
১৮৯০ সালে ইতালিয়ান সরকারের সঙ্গে তাঁর চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিলেন ফ্রান্স সরকার। নোবেলের ফ্রান্সের ল্যাবরেটরি বন্ধ করে দেওয়া হলো। তাঁকে যেকোনো সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। নোবেল বুঝতে পারলেন, ফ্রান্সের দিন শেষ। তিনি দ্রুত ফ্রান্স থেকে সব গুটিয়ে চলে গেলেন ইতালি। ইতালির সান রেমোতে বাড়ি কিনলেন।
এদিকে তাঁর ফরাসি পার্টনার পল বার্বি আত্মহত্যা করেন। নোবেল জানতে পারেন, পল নোবেলকে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবসা করছিলেন। অথচ নোবেল পল বার্বিকে বিশ্বাস করে তাঁর সবগুলো ডায়নামাইটের কারখানাকে একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একের পর এক ধাক্কায় খুবই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন আলফ্রেড নোবেল।
১৮৯৫ সালে আলফ্রেড ব্রিটিশ আদালতে দায়ের করা মামলায় হেরে যান। তাঁর ধোঁয়াহীন গানপাউডারের ব্রিটিশ রাইট চলে যায়। এদিকে শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন, মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরতে শুরু করেছে তাঁকে। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে, তাও ভাবছেন। মৃত্যুর পর কোনোরকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় তাঁর শরীর সমাহিত হোক, তা তিনি চান না। তিনি ভাবতে লাগলেন, যদি তাঁর শরীরকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে গলিয়ে ফেলে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অন্তত মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ানোর কাজে লাগবে।
নোবেলের অনুশোচনা হচ্ছে সারাজীবন এত ধনসম্পদ অর্জন করেছেন বিস্ফোরক আর গোলাবারুদ আবিষ্কার ও বিক্রি করে। তাঁর তৈরি মাইন আর ডায়নামাইটে কত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধের নামে। ভবিষ্যতে আরও কত যুদ্ধ হবে। বিশ্বশান্তির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। সারাজীবন রোগে ভুগেছেন—চিকিৎসার উন্নতির জন্য কিছু করা দরকার। আর সাহিত্য তাঁর মনের খোরাক। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা না জানালে কীভাবে হয়? তিনি উইল তৈরি করলেন। কোনো উকিলের সাহায্য ছাড়াই উইল করলেন। স্বাক্ষর করে রেখে দিলেন নিজের কাজের ডেস্কে।
১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইতালির সান রেমোতে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান আলফ্রেড নোবেল। মৃত্যুর পর তাঁর উইলে দেখা যায়, তাঁর সম্পদের প্রায় চুরানব্বই শতাংশ দিয়ে গেছেন নোবেল ফাউন্ডেশন গড়ার জন্য। যার আর্থিক মূল্য সে সময় ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার—যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫ মিলিয়ন ডলারে। নোবেল ফাউন্ডেশনের দায়িত্বও লেখা আছে উইলে। প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান যাঁরা রাখবেন, তাঁদেরকে। উইল কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নোবেলের বোফোর্স অস্ত্রকারখানার ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রাগনার সোহল্ম্যানকে।
নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হলো। ১৯০১ সাল থেকে চালু হলো নোবেল পুরষ্কার। নোবেল ফাউন্ডেশন সোফি হেসের কাছ থেকে অনেক টাকার বিনিময়ে নোবেলের লেখা চিঠিগুলো কিনে নিল। তারপরেও যেন নোবেলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনোরকম সমস্যা তৈরি না হতে পারে সেজন্য সোফির সব চিঠি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত গোপন করে রাখা হয়েছিল নোবেল ফাউন্ডেশনের আর্কাইভে। নোবেলের বন্ধু বার্থা ভন শাটনার নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৫ সালে।
নোবেল পুরষ্কার চালু হবার পর কেটে গেছে একশ বছরেরও বেশি। এই একশ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি অর্থমূল্যের আরও অনেক পুরষ্কার চালু হয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে নোবেল পুরষ্কারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কোনোটিই। নোবেল পুরষ্কার এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও প্রতীক। আলফ্রেড নোবেলকে কেউ আর ‘মৃত্যুর কারবারি’ মনে করেন না। যে নোবেল নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতেন, নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েই চলেছেন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র: ১. Irwin Abrams, Alfred Nobel, Bertha von Suttner and the Nobel peace prize, Scanorama, Vol 23 (11), 1993
২. www.nobel.se
৩. Kenne Fant, Alfred Nobel: A Biography, Arcade Publishing, London, 2006.
৪. প্রদীপ দেব, কোয়ান্টাম ভালোবাসা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪।