শহরের আলোর সীমা
সেদিন ছিল ব্যাংকের ছুটির দিন। শহরের বেশ বড় একটা ব্যাংকে ছোটখাটো একজন কেরানি হিসেবে কাজ করেন মিস্টার টম্পকিন্স।
ছুটির কারণে কিছুটা দেরি করে সেদিন ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সকালের খাবারটাও খেলেন বেশ ধীরেসুস্থে, আয়েশ করে। সারা দিন কী করবেন, খেতে খেতে সে পরিকল্পনা করতে লাগলেন। প্রথমে ভাবলেন, বিকেলে একটা সিনেমা দেখবেন। তাই সেদিনের খবরের কাগজটা খুলে সোজা চলে গেলেন বিনোদন পাতায়। কিন্তু কোনো সিনেমাই তার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হলো না। হলিউডের এসব ছাইপাঁশ তার একদম পছন্দ নয়। বিশেষ করে যেগুলোতে জনপ্রিয় তারকাদের মধ্যে অকারণ রোমান্স দেখানো হয়, সেগুলো রীতিমতো অপছন্দ করেন তিনি। সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে কোনো সিনেমাও যদি থাকত, তাহলেও চলত। সেখানে অসাধারণ কিছু ব্যাপার থাকতে পারত। এমনকি থাকতে পারত ফাটাফাটি ফ্যান্টাস্টিক কোনো কিছুও। কিন্তু সে রকম কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না।
আচমকা বিনোদন পাতার কোনায় ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকে গেল তার। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক লেকচারের ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আজ বিকেলে লেকচারটা অনুষ্ঠিত হবে। বিষয় আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি।
আবার যখন চোখ খুললেন, তখন নিজেকে একটা বেঞ্চে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। তবে সেটা অডিটরিয়ামের বেঞ্চ নয়। অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীদের সুবিধার জন্য নগর কর্তৃপক্ষের বানানো বেঞ্চ সেটা।
ঠিক আছে, এখানে যাওয়া যেতে পারে, ভাবলেন মিস্টার টম্পকিন্স। একটা কথা প্রায়ই তার কানে আসে। সারা বিশ্বে নাকি ডজনখানেক লোক আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব ঠিকমতো বোঝে। আজকের লেকচারটা শুনলে তিনিই হয়তো বুঝদার ১৩তম ব্যক্তি হবেন! অবশ্যই এ লেকচারে যাবেন তিনি। তার চাওয়াটা হয়তো ওখানে গেলে পাওয়া হয়ে যাবে।
মিস্টার টম্পকিন্স যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল অডিটরিয়ামে ঢুকলেন, তার আগেই লেকচার শুরু হয়ে গেছে। গোটা মিলনায়তন ছাত্রছাত্রীতে ভরা। বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। সবাই গভীর মনোযোগে ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা আর শ্বেতশুভ্র দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোকের কথা শুনছে। থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মৌলিক ধারণা উপস্থিত দর্শককে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন সেই প্রফেসর।
তবে সবটা মাথায় ঢুকল না মিস্টার টম্পকিন্সের। শুধু এটুকু বুঝতে পারলেন, এ তত্ত্বে সর্বোচ্চ গতিবেগ আর আলোর গতিবেগ বলে কিছু বিষয় আছে। আবার কোনো গতিশীল বস্তু কখনো আলোর গতিবেগ ছাড়িয়ে যেতে পারে না। ব্যাপারটির কারণে কিছু অদ্ভুত আর অসাধারণ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
সাদা দাড়িওয়ালা প্রফেসর বললেন, আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। সে কারণে দৈনন্দিন জীবনে আপেক্ষিকতার প্রভাব সেভাবে কারও চোখে পড়ে না। তবে এ অসাধারণ প্রভাবের প্রকৃতি বোঝা আসলে বেশ কঠিন। মিস্টার টম্পকিন্সের কাছে মনে হলো, এর সবকিছু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানবিরোধী। মানে কমনসেন্সের সঙ্গে মেলে না। তিনি মাপনদণ্ডের পরস্পরবিরোধিতা এবং ঘড়ির বেমানান আচরণ মনের পর্দায় কল্পনা করার চেষ্টা করলেন। আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলাচল করলে এই প্রভাব দেখা যায়। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় কী যে হলো, তার মাথাটা ধীরে ধীরে নিজের কাঁধের ওপর ঢলে পড়ল।
আবার যখন চোখ খুললেন, তখন নিজেকে একটা বেঞ্চে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। তবে সেটা অডিটরিয়ামের বেঞ্চ নয়। অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীদের সুবিধার জন্য নগর কর্তৃপক্ষের বানানো বেঞ্চ সেটা।
শহরটা বেশ পুরোনো। কিন্তু খুবই সুন্দর। রাস্তার দুই পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগে নির্মিত কলেজ ভবনগুলো। মিস্টার টম্পকিন্সের সন্দেহ হলো, তিনি অবশ্যই স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, চারপাশে তেমন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটতে দেখা গেল না। এমনকি রাস্তার কোনায় সটান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল এক পুলিশকেও। বাস্তবে পুলিশরা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তার কিছুদূর সামনে একটা টাওয়ার। সেখানে বসানো একটা বড় ঘড়ি। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার কাছাকাছি। রাস্তাটাও প্রায় ফাঁকা। শুধু একজন সাইকেলচালক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলেন এদিকে।
আশা করলেন, দ্রুতগতির কারণে অচিরে নিজেকেও চ্যাপ্টা বা ছোট হয়ে যেতে দেখতে পাবেন। নিজের মেদ-ভুঁড়িমার্কা ক্রমবর্ধমান দেহটা নিয়ে মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয় তার। তাই সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে মনে মনে বেশ খুশি হলেন।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু সাইকেলচালক যখন সামনের রাস্তা দিয়ে মিস্টার টম্পকিন্সকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিলেন, তখন ঘটল অবিশ্বাস্য ঘটনা। দৃশ্যটা দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল তার। সাইকেলচালক বয়সে তরুণ। কিন্তু সাইকেলটার গতির দিক বরাবর তরুণটাকে আকারে অস্বাভাবিক রকম চ্যাপ্টা বা ছোট দেখা যাচ্ছিল। যেন সংকুচিত হয়ে গেছেন তরুণ সাইকেলচালক। সিলিন্ডার আকৃতির কোনো লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখলেই কেবল সাইকেলচালককে অমন দেখতে পাওয়ার কথা।
এমন সময় টাওয়ারের ঘড়িতে পাঁচটার ঘণ্টা বাজল। ঘণ্টা শুনে তাড়াহুড়া দেখা গেল সাইকেলচালকের মধ্যে। প্যাডেল চালাতে লাগলেন আরও জোরে জোরে। তবে তাতেও খুব বেশি গতি তুলতে পারলেন বলে মনে হলো না। সেই চেষ্টার ফলাফল হিসেবে তাকে আগের চেয়ে আরও চ্যাপ্টা বা সংকুচিত হয়ে যেতে দেখলেন মিস্টার টম্পকিন্স। রাস্তায় সাইকেলচালক তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় তাকে দেখতে আস্ত একটা কার্ডবোর্ডের কাটআউটের মতো মনে হচ্ছিল।
কিন্তু ঘটনাটা কী ঘটছে, সেটা আচমকা বুঝতে পারলেন মিস্টার টম্পকিন্স। তখন গর্বে তার বুকটা বেশ একটু ফুলে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে কিছুক্ষণ আগে তিনি যে লেকচার শুনেছেন, সেটাই মনে পড়ল তার। আসলে এটা হলো চলন্ত বস্তুর সংকোচন। তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, ‘আসলে এই শহরে প্রাকৃতিক গতিসীমা কম। তাই রাস্তার কোনার পুলিশটাকে ও রকম অলস বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কেউ বেশি গতিতে গেল কি না, তা আর দেখার প্রয়োজন নেই তার।’
সেই মুহূর্তে রাস্তা দিয়ে একটা ট্যাক্সি যেতে দেখলেন মিস্টার টম্পকিন্স। ট্যাক্সিটা থেকে বিকট শব্দ হচ্ছিল। সেটাও সাইকেলচালকের মতো চ্যাপ্টা হয়ে ছোট হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল যেন হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সিটা।
মিস্টার টম্পকিন্স হঠাৎ সাইকেলচালককে ধরার কথা ভাবলেন। ওই তরুণকে বেশ ভালো মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। তার কাছে সবকিছু জিজ্ঞেস করা যায় বলে ভাবলেন তিনি। পুলিশের লোকটা তখন অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। এ সুযোগে পাশে রাখা একটা সাইকেল ধার করলেন তিনি। সাইকেলটা অন্য কারও। এরপর হনহন করে সাইকেল চালিয়ে রাস্তা ধরে রওনা হলেন। আগের সাইকেলচালক যেদিকে গেছেন, সেই পথ ধরলেন মিস্টার টম্পকিন্স।
আশা করলেন, দ্রুতগতির কারণে অচিরে নিজেকেও চ্যাপ্টা বা ছোট হয়ে যেতে দেখতে পাবেন। নিজের মেদ-ভুঁড়িমার্কা ক্রমবর্ধমান দেহটা নিয়ে মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয় তার। তাই সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে মনে মনে বেশ খুশি হলেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার! তার কিংবা তার সাইকেলে তেমন কিছুই ঘটল না। অবশ্য তার চারপাশের সবকিছু ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল। রাস্তাটা আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেল, দোকানের জানালাগুলো হয়ে গেল সরু ছিদ্রের মতো আর রাস্তার কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুলিশকে মনে হলো দুনিয়ার সবচেয়ে সরু মানুষ।
‘হায় খোদা!’ বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন মিস্টার টম্পকিন্স, ‘এখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারছি। এখান থেকেই আসলে আপেক্ষিকতা শব্দটা এসেছে। প্যাডেল যে–ই চালাক না কেন, আমার সাপেক্ষে চলমান সবকিছু আমার কাছে সংকুচিত বা চ্যাপ্টা বলে মনে হবে!’
আর যা–ই হোক, সাইকেলটা বেশ ভালোই চালাতে পারেন মিস্টার টম্পকিন্স। তাই সেই তরুণ সাইকেলচালকের নাগাল পেতে সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সাইকেলটার গতি তোলা সহজ কাজ মনে হলো না। প্যাডেলে যতটা সম্ভব জোরে জোরে পা চালাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তার ফলে যেটুকু গতি বাড়ছিল, তা নগণ্য। জোরে প্যাডেল চাপার কারণে ততক্ষণে তার পায়ে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। তবু যাত্রা শুরুর পর তখন পর্যন্ত রাস্তার একটা ল্যাম্পপোস্টও পার হতে পারেননি। মনে হচ্ছে, যতই জোরে চলার চেষ্টা করা হোক না কেন, কোনো লাভ নেই।
মিস্টার টম্পকিন্স বুঝতে পারলেন, কিছুক্ষণ আগে দেখা সাইকেলচালক আর ট্যাক্সিটা কেন জোরে যেতে পারছিল না। এমন সময় সাদা দাড়িওয়ালা প্রফেসরের কথাটাও মনে পড়ল। অডিটরিয়ামে তিনি বলেছিলেন, আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে যাওয়া অসম্ভব। তিনি খেয়াল করলেন, শহরটার ভবনগুলো তখনো অনেক চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে। ওদিকে তার সামনের সাইকেলচালকও আর বেশি দূরে নেই বলে মনে হলো।
রাস্তায় দ্বিতীয়বার মোড় নেওয়ার সময় সেই তরুণকে ওভারটেক করলেন তিনি। ওভারটেকের সময় তার পাশাপাশি সাইকেল চালাতে গিয়ে মিস্টার টম্পকিন্সের আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। তিনি দেখলেন, সাইকেলচালকের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই, আকার–আকৃতি একেবারে স্বাভাবিক। ‘ওহ্, এর পেছনের কারণ হলো, আমরা পরস্পরের সাপেক্ষে এখন আর গতিশীল নই।’ তিনি বুঝতে পারলেন।
মিস্টার টম্পকিন্স তরুণকে ডেকে বললেন, ‘এই যে শুনছেন! এই শহরের গতিসীমা তো অনেক কম। সে জন্য আপনাদের এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হয় না?’
‘কী বললেন? গতিসীমা?’ তরুণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে তো কোনো গতিসীমা নেই। আমি তো যেখানে খুশি সেখানেই ইচ্ছেমতো গতিতে যেতে পারি। অন্তত এই পুরোনো সাইকেলের বদলে কোনো মোটরসাইকেল হলে তো কথাই নেই।’
‘কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আপনি আমাকে পেরিয়ে গেলেন। তখন আপনাকে বেশ ভালোমতো খেয়াল করে দেখেছি আমি।’ বললেন মিস্টার টম্পকিন্স।
মিস্টার টম্পকিন্সও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, এই সময়টুকু তার কাছে মাত্র কয়েক মিনিট বলে মনে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানে পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট দেখাচ্ছে।
‘ওহ্, তাই নাকি?’ তরুণ বললেন। তার কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ল। ‘আপনি আমাকে প্রথম দেখার পর আমরা পাঁচ ব্লক পার হয়ে এসেছি। আমার ধারণা, সেটা খেয়াল করেননি। এটা কি আপনার কাছে যথেষ্ট দ্রুত বলে মনে হচ্ছে না?’
‘কিন্তু এই পথটুকু তো খুবই অল্প।’ যুক্তি দেখালেন মিস্টার টম্পকিন্স।
‘আমরা দ্রুত চললাম, নাকি পথ ছোট হয়ে গেছে, তার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পোস্ট অফিসে আসতে আমাকে ১০ ব্লক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। প্যাডেলে যত জোরে চাপ দিই, ব্লকগুলো তত ছোট হয়ে যায়। তাতে আমি দ্রুত সেখানে পৌঁছে যেতে পারি। এই তো আমরা পৌঁছে গেছি।’ সাইকেল থেকে নেমে বললেন তরুণটি।
ঝট করে পোস্ট অফিসের ঘড়ির দিকে তাকান মিস্টার টম্পকিন্স। সেখানকার ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। সেটা দেখে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বললেন তিনি, ‘আচ্ছা! এই ১০ ব্লক রাস্তা পার হতে আপনার তো আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে। আপনাকে যখন প্রথম দেখলাম, তখন বেজেছিল পাঁচটা!’
‘কিন্তু এই আধা ঘণ্টা সময় কি আপনি খেয়াল করতে পেরেছেন?’ সাইকেলচালক জিজ্ঞেস করলেন এবার।
মিস্টার টম্পকিন্সও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, এই সময়টুকু তার কাছে মাত্র কয়েক মিনিট বলে মনে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানে পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট দেখাচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে! পোস্ট অফিসের ঘড়িটা এগিয়ে আছে নাকি?’
‘অবশ্যই কিংবা আপনার ঘড়িটা হয়তো স্লো। তার কারণ, আপনি দ্রুত চলাচল করেছেন। আচ্ছা, আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো? আপনি কি চাঁদ থেকে এখানে এসেছেন নাকি?’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে পোস্ট অফিসের দিকে চলে গেলেন তরুণ।
এই কথোপকথনের পর মিস্টার টম্পকিন্স বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, এই অদ্ভুত ঘটনাগুলো তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তার পাশে বুড়ো প্রফেসর ভদ্রলোক নেই। তরুণটা যে এ এলাকায় স্থানীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জন্মের পর থেকেই এখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কাজেই এই অদ্ভুত জগৎ সম্পর্কে এখন নিজেই খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই মিস্টার টম্পকিন্সের।
নিজের হাতঘড়িটা পোস্ট অফিসের ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন। তার হাতঘড়ি আর পোস্ট অফিসের ঘড়িটা আসলে সমানতালে চলছে কি না, তা যাচাই করতে সেখানে দাঁড়িয়ে টানা ১০ মিনিট ঘড়ি দুটি মিলিয়ে দেখলেন। ১০ মিনিট পর তিনি বুঝতে পারলেন, দুটি ঘড়িই সমানতালে চলছে। তার হাতঘড়িও নষ্ট হয়নি।
আবার সাইকেলে চেপে বসলেন তিনি। রাস্তাটা ধরে আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা রেলস্টেশন দেখতে পেলেন। সেখানেও আরেকটা ঘড়ি দেখা গেল। নিজের হাতঘড়িটা আবার মিলিয়ে দেখলেন রেলস্টেশনের ঘড়ির সঙ্গে। এবারও তার হাতঘড়িটা কিছুটা স্লো হতে দেখা গেল। ‘এটাও সম্ভবত কোনো আপেক্ষিক প্রভাবের কারণে হচ্ছে।’ মনে মনে ভাবলেন মিস্টার টম্পকিন্স। বিষয়টা নিয়ে এমন কাউকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবলেন, যিনি ওই সাইকেলচালকের চেয়ে বুদ্ধিমান।
অচিরেই পাওয়া গেল সুযোগটা। ট্রেন থেকে এক ভদ্রলোককে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর। লোকটা স্টেশন থেকে বাইরে যাওয়ার পথের দিকে হাঁটতে লাগলেন। এমন সময় এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো লোকটার। লোকটাকে ‘প্রিয় দাদু’ বলে সম্বোধন করলেন মহিলাটি। তা শুনে ভীষণ অবাক হলেন মিস্টার টম্পকিন্স। লোকটার লাগেজ তুলতে সহায়তা করার অজুহাত দেখিয়ে তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন তিনি।
‘এক্সকিউজ মি! আপনার পারিবারিক বিষয়ে নাক গলানোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’ মিস্টার টম্পকিন্স বললেন, ‘কিন্তু আপনি কি আসলেই এই বয়স্ক ভদ্রমহিলার দাদা হন? আমি আসলে এখানে নতুন এসেছি। আর আমি কখনো...’
‘বুঝতে পারছি,’ গোঁফ নাড়িয়ে হেসে বললেন ভদ্রলোক। ‘অনুমান করছি, আপনি আমাকে পাগল বা ও রকম কিছু ভাববেন। কিন্তু বিষয়টা আসলে বেশ সরল। কাজের খাতিরে আমাকে অনেক বেশি ভ্রমণ করতে হয়। তাই জীবনের বেশির ভাগ সময়ই আমাকে কাটাতে হয় ট্রেনে। এ জন্যই এই শহরে থাকা আমার আত্মীয়দের চেয়ে আমার বয়স ধীরে ধীরে বাড়ে। আমার নাতনি বেঁচে থাকতে থাকতে ওকে দেখতে আসতে পেরেছি, সে জন্য আমি খুব খুশি! তবে ক্ষমা করবেন, আমাকে এখন ওর সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠতে হবে।’ কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে স্টেশন ছেড়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। আরেক প্রস্থ সমস্যায় পড়লেন মিস্টার টম্পকিন্স।
স্টেশনের বুফের দিকে এগিয়ে গেলেন মিস্টার টম্পকিন্স। গোটা কয়েক স্যান্ডউইচ খেলেন। তাতে দেহ-মনে কিছুটা জোর ফিরে পেলেন। টম্পকিন্স এমন দাবিও করতে চাইলেন যে বিখ্যাত আপেক্ষিকতা নীতিতে তিনি একটা অসংগতি খুঁজে পেয়েছেন।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই, সবকিছুই যদি আপেক্ষিক হয়, তাহলে নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে ওই ভ্রমণকারী ভদ্রলোক খুবই বয়স্ক বলে মনে হবে। আবার ভদ্রলোকের কাছে তার আত্মীয়স্বজনের মনে হবে খুবই বয়স্ক। অথচ দুই পক্ষই হয়তো বেশ তরুণ থেকে যাবে। কিন্তু আমি এ মুহূর্তে যা বললাম, তা একেবারে অর্থহীন। কারও ধূসর চুল তো আর আপেক্ষিক হতে পারে না!’ কাজেই ঘটনা আসলে কী, তা উদ্ঘাটনের জন্য শেষবারের মতো চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন টম্পকিন্স।
বুফেতে রেলওয়ের ইউনিফর্ম পরা এক লোক একা একা বসে ছিলেন। তার দিকে ঘুরলেন মিস্টার টম্পকিন্স।
‘আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’ টম্পকিন্স শুরু করলেন, ‘আমাকে কি একটা কথা বলতে পারবেন? যারা শুধু একটা জায়গাতেই থাকে, তাদের তুলনায় ট্রেনের যাত্রীদের বয়স এত ধীরে ধীরে বাড়ে কেন? এর জন্য দায়ী কে?’
‘এর জন্য আমিই দায়ী।’ সরলভাবে জবাব দিলেন লোকটি।
হঠাৎ ভারী একটা হাত তার কাঁধ ঝাঁকাতে লাগল। মিস্টার টম্পকিন্স চমকে উঠে দেখতে পেলেন, তিনি আসলে স্টেশনের ক্যাফেতে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামের চেয়ারে বসে আছেন।
‘কী বললেন!’ বিস্মিত হলেন মিস্টার টম্পকিন্স। ‘তাহলে আপনিই কি প্রাচীন আলকেমিস্টদের সেই পরশপাথর সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন? আপনি তো তাহলে চিকিৎসাজগতে বিখ্যাত একজন মানুষ। আপনি কি এই শহরের চিকিৎসকদের প্রধান কর্তাব্যক্তি?’
‘না। আমি এই রেলওয়ের ব্রেকম্যানের কাজ করি।’ একটু নড়েচড়ে বসে জবাব দিলেন লোকটি।
‘ব্রেকম্যান! আপনি বলতে চাইছেন ব্রেকম্যান...’ অবাক হলেন মিস্টার টম্পকিন্স। তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ‘আপনি বলতে চাইছেন, এই স্টেশনে যখন কোনো ট্রেন আসে, তখন আপনি ব্রেক চাপেন?’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমি ব্রেক চাপলেই ট্রেন ধীরে ধীরে থেমে যায় আর ট্রেনের যাত্রীরা অন্যদের সাপেক্ষে বয়সপ্রাপ্ত হয়। অবশ্য যে ইঞ্জিনচালক ট্রেনটার গতি বাড়ান, তারও এ কাজে ভূমিকা আছে।’
‘কিন্তু তাদের তরুণ থাকার কারণ কী?’ চরম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন মিস্টার টম্পকিন্স।
‘আসলে সেটা আমি সঠিক জানি না।’ ব্রেকম্যান বললেন, ‘তবে ঘটনাটা বরাবর এ রকম ঘটতে দেখি। একবার ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক আমার ট্রেনে চড়েছিলেন। তাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে বেশ লম্বা আর জটিল বক্তব্য দিলেন তিনি। সেগুলোর মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝতে পারিনি। সবশেষে বললেন, এটা ত্বরণ আর ধীরগতির জন্য ঘটে। শুধু গতিই নয়, ত্বরণও নাকি সময়কে প্রভাবিত করে। কোনো লোক যখনই ট্রেনে চড়ে স্টেশন থেকে এখানে–সেখানে যাবে, সেটা সময়কে প্রভাবিত করবে। যে ট্রেনে চড়ে না, সে এই পরিবর্তন বুঝতে পারবে না। এ রকম কিছু শুনেছেন কখনো?’
‘ন-না।’ সন্দেহের সুরে বললেন মিস্টার টম্পকিন্স। এরপর মাথা দোলাতে দোলাতে দূরে সরে গেলেন ব্রেকম্যান।
হঠাৎ ভারী একটা হাত তার কাঁধ ঝাঁকাতে লাগল। মিস্টার টম্পকিন্স চমকে উঠে দেখতে পেলেন, তিনি আসলে স্টেশনের ক্যাফেতে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামের চেয়ারে বসে আছেন। এই চেয়ারে বসেই বুড়ো প্রফেসরের বক্তৃতা শুনছিলেন তিনি। অডিটরিয়ামটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ঘরের আলোও ম্লান। তার ঘুম ভাঙিয়েছেন আসলে অডিটরিয়ামের দারোয়ান। তিনি বললেন, ‘আমরা অডিটরিয়াম বন্ধ করে দিচ্ছি। ঘুমাতে চাইলে নিজের বাসায় চলে যান।’
ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার দিকে এগোতে লাগলেন মিস্টার টম্পকিন্স।
জর্জ গ্যামো: গত শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ছিলেন ইউক্রেনিয়ান-মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও কসমোলজিস্ট জর্জ গ্যামো (১৯০৪-১৯৬৮ সাল)। তিনি ছিলেন বিগ ব্যাং তত্ত্বের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। বিজ্ঞানে তাঁর অবদান অনেক। বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে সবার জন্য বিজ্ঞানের বইও লিখেছেন। জনপ্রিয় ধারার সেসব বই পাঠকের মন জয় করেছে। এর মধ্যে ‘মিস্টার টম্পকিন্স’ সিরিজ বেশ নামকরা। ১৯৩৯ সালে মিস্টার টম্পকিন্স ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড শিরোনামে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর মিস্টার টম্পকিন্সকে নিয়ে আরও তিনটি বই লিখেছেন গ্যামো। বর্তমানকালের অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছোটবেলায় সিরিজটি পড়ে বিজ্ঞানী হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।