ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ্রিজের কোক আছে। দুটোতেই দুই হাতের দুটো আঙুল অল্প সময়ের জন্য ডুবিয়ে দেখা যেতে পারে। এতে বোঝা যাবে চা গরম এবং কোক ঠান্ডা। এবার দুটো কাপই টেবিলে রেখে দেওয়া যাক কিছুক্ষণের জন্য। কয়েক ঘণ্টা পর আবার আঙুল ডোবালে দেখা যাবে চা আর গরম নেই এবং কোকও আর ঠান্ডা নেই। দুটোই একই তাপমাত্রায় চলে এসেছে, যাকে আমরা ঘরের তাপমাত্রা বলি। ঘরের তাপমাত্রা বলতে আমরা পরিবেশের তাপমাত্রাকে বোঝাই।
গরম চা কীভাবে ঠান্ডা হলো? শুরুতে চায়ের ভেতর এমন একটা কিছু ছিল, যা এখন নেই, একে আমরা তাপ বলি। তাপ একধরনের শক্তি, অন্যভাবে বলা যায় শক্তির একটি রূপ হলো তাপ। আর ঠান্ডা বা গরমের যে অনুভূতি, তাকে বলি তাপমাত্রা। একটি বস্তু শূন্য কেলভিনের (প্রায় মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ওপর থাকলেই তাপ বিকিরণ করতে থাকে। এই বিকিরণের মাত্রা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার ওপর, বস্তুর তাপের ওপর নয়। বিকিরণ করার মানে হলো, তাপ হারানো। কাপের চা তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
এবার প্রশ্ন হলো ঠান্ডা কোক কীভাবে ঠান্ডা থেকে ঘরের তাপমাত্রায় এল? কোকের তাপমাত্রা কম থাকলেও তা শূন্য কেলভিন নয়। সুতরাং কোকও তাপ বিকিরণ করেছে। তারপরও কোক কীভাবে আগের চেয়ে গরম হলো? কারণ, বস্তু একই সঙ্গে তাপ বিকিরণ করে (এখানে শুধু বিকিরণ অংশটা ধরছি। বিকিরণ ছাড়াও একটি বস্তু আরও দুটি উপায়ে তাপ হারাতে পারে, যেগুলোকে পরিচলন এবং পরিবহন বলে। পৃথিবী কেন গরম, এর ব্যাখ্যার জন্য মূলত বিকিরণই প্রয়োজন) এবং তাপ গ্রহণ করে বা শোষণ করে। কোথা থেকে তাপ গ্রহণ করে? বস্তুর পরিবেশ থেকে। যেমন কোক তাপ গ্রহণ করেছে আশপাশের বাতাস থেকে, আসলে পুরো পরিবেশ থেকেই, যে পরিবেশে আছে টেবিল–চেয়ার, ঘরের দেয়াল। তার মানে কোকভর্তি কাপের আশপাশে যা কিছু আছে এর সব কিছু থেকেই কোক তাপ গ্রহণ করেছে। কোক তাপ হারিয়েছে এবং কোক তাপ গ্রহণ করেছে; কিন্তু কোক বেশি তাপ গ্রহণ করেছে এবং তাপ অল্প হারিয়েছে। সে জন্যই কোকের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চা তাপ বেশি হারিয়েছে এবং অল্প তাপ গ্রহণ করেছে। তাপ বেশি গ্রহণ করবে, না তাপ বেশি হারাবে, তা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রা এবং পরিবেশের তাপমাত্রার পার্থক্যের ওপর। সারাক্ষণই একটি বস্তু এবং এর পরিবেশের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান চলছে। এমনকি যখন বস্তু এবং পরিবেশ দুটোই একই তাপমাত্রায় তখনো তাপের আদান–প্রদান চলছে। এ অবস্থায় বস্তু যে হারে তাপ হারাচ্ছে ঠিকই একই হারে তাপ গ্রহণ করছে। ফলে বস্তুর তাপমাত্রার কোনো হেরফের হচ্ছে না। এর মানে হলো প্রতিটি বস্তুই একই সঙ্গে তাপ হারাচ্ছে এবং তাপ গ্রহণ করছে (তাপ হারাতে হলে বস্তুর তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য কেলভিনের বেশি হতে হবে)।
এবার চলে যাই বিকিরণে। বিকিরণ হলো তরঙ্গের মাধ্যমে তাপ নির্গত করা। আলো যেমন তরঙ্গ, ঠিক তেমনি তরঙ্গ দিয়ে একটি বস্তু তাপ বিকিরণ করে। একটি তরঙ্গের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে, একটি হলো এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং অন্যটি কম্পাঙ্ক। বিকিরিত তাপের বেগ আলোর বেগের সমান। তার মানে তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে কম্পনসংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই আমরা তরঙ্গ বা আলোর বেগ বের করতে পারি। শূন্য মাধ্যমে আলো ১ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার যায়।
যেহেতু তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কের গুণফল একটি নির্দিষ্ট রাশি, যা কিনা আলোর বেগ, শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা শুধু কম্পাঙ্ক নিয়ে কথা বললেই চলে। আমরা এখানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলব। এখন ইলেকট্রিক হিটারের কয়েলকে গরম করতে থাকলে কয়েল থেকে তাপ বেরিয়ে আসতে থাকবে এবং এর রংও বদলাতে থাকবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। হিটারের কয়েল যত বেশি গরম হতে থাকবে, তত কম দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ বিকিরণ করবে। আমাদের চোখে নির্দিষ্ট সব ধরনের তরঙ্গ দেখা যায় না। সে জন্য অল্প তাপমাত্রায় থাকলে আমরা হাত দিয়ে ধরলে গরম বুঝি, কিন্তু চোখে কোনো আলো দেখতে পাই না। কিন্তু বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে এই আলো ঠিকই দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হলো পৃথিবী গরম কেন?
এখানে একটি মজার বিষয় বলি, কাচের ভেতর দিয়ে সব ধরনের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে না। সূর্যের আলোর মধ্যে অনেক অনেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থাকে। এর একটি অংশ আমাদের দেখার কাজে লাগে। সূর্যের আলোর বড় অংশটি সহজেই কাচের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। যার ফলে কাচের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর আলো ঢুকে পড়ে। এখন ধরি জানালা বন্ধ আছে এবং জানালায় কোনো পর্দা নেই। কাচের জানালা দিয়ে ঘরে আলো ঢুকে পড়েছে। আলোর কারণে ঘরের ভেতরের জিনিস সব গরম হয়ে গেল বা তাপমাত্রা বেড়ে গেল। এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ওরাও বেশি হারে তাপ বিকিরণ করতে থাকে। কিন্তু ওগুলোর তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়তে পারে না। ফলে ওদের বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, যা কাচের জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে না। তার মানে হলো ঘরে তাপ ঢুকছে (আলো হিসেবে) কিন্তু ঘর থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে পারছে না, যদিও তাপের সামান্য অংশ বের হতে পারে। ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের চেয়ে গরম থাকে। ঠিক একইভাবে গরমের দিনে গাড়ি অনেকক্ষণ রোদে থাকলে, গাড়ির ভেতরটা বাইরের চেয়ে অনেক গরম হয়ে যায়। শীতপ্রধান দেশে কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘর বানিয়ে ওর ভেতর সবজি চাষ করা হয়। এগুলোকে গ্রিনহাউস বলে। এ ধরনের ঘরগুলো কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা থাকে বলে বাইরের সঙ্গে বাতাসের আদান–প্রদান হয় না। এতে করে ভেতরে যদি কোনো তাপের উৎস থাকে, যেমন হিটার, তাহলে তাপ সহজে বাইরে যেতে পারে না। যার ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের থেকে গরম থাকে এবং গ্রিনহাউসগুলোকে সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রায় রাখা হয়। বড় তরঙ্গের আলো যে কাচ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না, এটাও গ্রিনহাউস গরম রাখতে সামান্য একটা ভূমিকা রাখে বটে!
পৃথিবীর চারদিকে যে বায়ুমণ্ডল, তা অনেকটাই কাচের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারদিক বায়ুমণ্ডল প্রায় এক শ কিলোমিটার বিস্তৃত বলে ধরা হয়। কিন্তু এর বেশির ভাগই (ভর অনুপাতে প্রায় ৯০ শতাংশ) আছে ১৬ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে। এর ভেতর দিয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ অত সহজে যাতায়াত করতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের কারণে সূর্যের আলোর বড় একটি অংশ প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। কিছু অংশ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আসে। এতে পৃথিবী (মাটি, নদী, গাছ ইত্যাদি) তাপ গ্রহণ করে গরম হয়। গরম হলেই তাপ বিকিরণ শুরু করে, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়, এদের বেশির ভাগই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী গরম থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীর কম্বল, যা পৃথিবীর তাপ ধরে রাখে। এ কারণেই পৃথিবী বেশ গরম, যা আমাদের জন্য সহনীয়। পৃথিবীর চারপাশে যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত, তাহলে দিনের বেলায় সরাসরি সূর্যের আলোতে তাপমাত্রা এমন হতো যে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম, আর রাতের বেলায় তাপমাত্রা এত কম হতো যে আমরা সবাই শক্ত বরফ হয়ে যেতাম।
বায়ুমণ্ডলে অনেক ধরনের মৌল এবং যৌগ আছে। যেগুলো তাপ চলাচলে ভূমিকা রাখে। এদের মধ্যে একটি হলো কার্বন ডাই অক্সাইড। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে তাপ সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে যেতে পারে না। ফলে তাপ পৃথিবীতেই আটকা পড়ে থাকে এবং পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের জোগান দেয় প্রাণিজগৎ (নিশ্বাস) এবং কলকারখানা। কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। যেটুকু বাড়বে তা আমাদের সহ্যক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর পানির একটা অংশ জমাট বরফ হয়ে আছে (পর্বতগুলোতে এবং মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ)। সামান্য তাপমাত্রা বাড়তেই জমাট বরফ একটু বেশি হারে গলতে থাকবে এবং নদীপথে এসে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। ধারণা করা হয়, এর ফলে পৃথিবীর নিচু অঞ্চলগুলো ডুবে যাবে। তখন নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। পৃথিবী (আসলে মহাবিশ্বই) চমৎকার একটি তাপীয় সাম্যাবস্থায় আছে, এর সাম্যতা সামান্য নষ্ট হলেই বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এবং অনেক অনেক দিন পর নতুন করে ভিন্ন একটি সাম্যাবস্থা তৈরি হতে পারে। যে সাম্যাবস্থায় মানুষের অস্তিত্ব না–ও থাকতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত