সরে যাচ্ছে পৃথিবীর মেরুবিন্দু

চুম্বক সম্পর্কে আমরা কিছু না কিছু জানি! যেমন, একটি চুম্বকের দুটি মেরু থাকে—একটির নাম উত্তর মেরু, অন্যটির নাম দক্ষিণ মেরু। দুটি বিপরীত মেরু একে অন্যকে আকর্ষণ করে এবং একই ধরনের দুটি মেরু একে অন্যকে বিকর্ষণ করে। দুটি চুম্বককে কাছাকাছি এনে মুক্তভাবে ঝুলিয়ে দিলে দেখা যায়, একটির উত্তর মেরু অন্যটির দক্ষিণ মেরুর দিকে ঘুরে যায়। আমরা এ–ও জানি, একটি চুম্বককে যত ছোট করেই ভাঙি না কেন, সবচেয়ে ছোট অংশটিও একটি চুম্বক এবং এরও দুটি মেরু থাকবে। শুধু একটি মেরুর চুম্বক এখনো পাওয়া যায়নি।

পৃথিবীর পৃষ্ঠে একটি দণ্ড চুম্বককে মুক্তভাবে ঝুলিয়ে দিলে যে মেরু উত্তর দিকে মুখ করে থাকে, তাকে উত্তর মেরু বলে, এভাবেই একটি চুম্বকের উত্তর মেরুর নাম ঠিক করা হয়েছে। অন্য মেরুটি দক্ষিণ মেরু, যা কিনা দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকে। একটি চুম্বকের উত্তর মেরু কেন উত্তর দিকে মুখ করে থাকবে? কারণ পৃথিবী নিজেও একটি চুম্বক। পৃথিবীর চৌম্বকত্বের কারণেই একটি দণ্ড চুম্বককে মুক্তভাবে ঝুলিয়ে দিলে চুম্বকটি একটি বিশেষ দিকে করে স্থির হয়ে যায়। পৃথিবী চুম্বকেরও দুটি মেরু থাকতে হবে। একটি উত্তর মেরু এবং অন্যটি দক্ষিণ মেরু। আমরা জানি, উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে, তাহলে পৃথিবী চুম্বকের উত্তর মেরু আসলে ভৌগোলিক দক্ষিণ দিকে। এবং পৃথিবী চুম্বকের দক্ষিণ মেরু হলো ভৌগোলিক উত্তর দিকে। পৃথিবী চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু হলো সেই দুটি বিন্দু, যেখানে একটি কম্পাস রাখলে কম্পাসটি একেবারে খাড়া হয়ে থাকবে।

চৌম্বকত্বের পেছনে থাকে একটি কারেন্ট বা বিদ্যুৎপ্রবাহ। এমনকি একটি পরমাণুর যে চৌম্বকত্ব, তা–ও কারেন্টের জন্যই হয়ে থাকে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ভারী একটি নিউক্লিয়াস এবং এর চারদিকে ইলেকট্রনগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের জন্যই একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ তৈরি হয় এবং এর একটি চুম্বক মোমেন্ট থাকে (চুম্বক মোমেন্ট হলো চুম্বকশক্তির একটি মাপকাঠি; ইলেকট্রনের স্পিনের কারণেও এর একটি স্পিন ম্যাগনেটিক মোমেন্ট থাকে এবং একটি লুপের ভেতর ইলেকট্রিক ফ্লাক্সের পরিবর্তন হলে একটি আবেশিত চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়)। এর মানে হলো, প্রতিটি ইলেকট্রনই একটি দণ্ড চুম্বকের মতো আচরণ করে। ইলেকট্রনের স্বতন্ত্র চুম্বকগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে কীভাবে থাকবে, এর ওপর নির্ভর করেই পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চুম্বক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় (ফেরোম্যাগনেটিক, প্যারাম্যাগনেটিক এবং ডায়াম্যাগনেটিক)।

একটি কথা বলে রাখা দরকার, কারেন্টের কারণে এর চারপাশে একটি চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হলেও দৈনন্দিন কারেন্টের কারণে চুম্বকক্ষেত্রের মান খুবই কম। যদি কারেন্টের জন্যই চুম্বক তৈরি হয়, তাহলে পৃথিবী চুম্বকের জন্য কোন কারেন্ট দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের জানতে হবে পৃথিবীর ভেতরে কী আছে। আমাদের পৃথিবীটা মোটামুটি ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি এবড়োখেবড়ো গোলক। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এর কেন্দ্রের দিকে গেলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং প্রথম কয়েক শ কিলোমিটার শক্ত পাথরের তৈরি। এর পরের তিন হাজার কিলোমিটার পাওয়া যাবে কঠিন অবস্থার বিভিন্ন ধাতু। তারপর হলো গলিত ধাতুর এক বিশাল সাগর, যার বেশির ভাগ হলো লোহা এবং অল্প কিছু নিকেল। সবচেয়ে ভেতরে থাকে কঠিন লোহা এবং নিকেলের মিশ্রণ, যার ব্যাসার্ধ প্রায় বারো শ কিলোমিটার। কেন্দ্রের লোহার তাপমাত্রা অনেক বেশি হলেও অতিরিক্ত চাপের জন্য এই লোহা গলিত অবস্থায় না থেকে কঠিন অবস্থায় আছে।

পৃথিবীর চৌম্বকত্বের পরিষ্কার কোনো উত্তর এখনো জানা নেই। যেহেতু একখণ্ড লোহাকে খুব সহজেই একটি চুম্বকে পরিণত করা যায়। তাহলে কি পৃথিবীকেন্দ্রের এই বিশাল কঠিন লোহার গোলক একটি বড় চুম্বক হিসেবে কাজ করে? এর উত্তর হলো, না (পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা অনেক বেশি), কারণ একটি লোহার দণ্ড চুম্বককের তাপমাত্রা বাড়াতে থাকলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার (কুরি তাপমাত্রা) বেশি হলেই এটি আর দণ্ড চুম্বক হিসেবে কাজ করবে না।

বিভিন্ন মডেলের মাধ্যমে পৃথিবীর চৌম্বকত্ব ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এ রকম একটি মডেল হলো, পৃথিবীর অভ্যন্তরের গলিত লোহা সারাক্ষণই প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণেই একটি কারেন্ট তৈরি হচ্ছে। কারেন্টের ফলাফল একটি চুম্বক। কিন্তু গলিত লোহা কোথায় কত বেগে ঘুরছে, তারও স্পষ্ট হিসাব জানা যায়নি। এর পরেও অনেক কথা আছে। গলিত লোহার ভেতরে যে কারেন্ট, তা বেশি দিন চলতে পারে না। গলিত লোহার রেজিস্ট্যান্স বা রোধ আছে। ফলে সেখানকার প্রবাহিত কারেন্ট একসময় থেমে যাওয়ার কথা (কোনো এক হিসাবে ২০ হাজার বছরের মধ্যে এই কারেন্ট থেমে যাওয়ার কথা)। কিন্তু প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে থেকেই পৃথিবীর চৌম্বকত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার মানে এই কারেন্ট চলছে তো চলছেই। এখন প্রশ্ন হলো, এই কারেন্ট চালানোর শক্তি কোথা থেকে আসে? ধারণা করা হয়, এই কারেন্টের শক্তি আসে পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপশক্তি থেকে। তার মানে গলিত লোহার অংশের তাপ কমতে থাকবে এবং তাপ কমার কারণে গলিত লোহার অংশও কমতে থাকবে।

কীভাবে এই গলিত লোহার কারেন্ট এখনো চালু আছে, তা বোঝার জন্য একটি মডেল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লোহার একটি চাকতিকে যদি কোনো চুম্বকক্ষেত্রে রেখে ঘোরানো হয়, তাহলে চাকতিতে একটি কারেন্ট তৈরি হবে। এই কারেন্টের কারণেও একটি চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হবে। কারেন্ট কোন দিকে প্রবাহিত হবে, এর ওপর নির্ভর করে আগের চুম্বকক্ষেত্রের মান বাড়তে পারে আবার কমতেও পারে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ভেতরের কারেন্টের কারণে আদি চুম্বকক্ষেত্রের মান বেড়ে গেছে। তা না হলে পৃথিবীর চৌম্বকত্ব এত দিন ধরে টিকে থাকতে পারত না। কিন্তু শর্ত হলো, লোহার চাকতিটি অবশ্যই ঘূর্ণমান থাকতে হবে।

পৃথিবীর চৌম্বকত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য সবচেয়ে সহজ ধারণা হলো যে একটি দণ্ড চুম্বক পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের সঙ্গে সামান্য একটি কোণে হেলে আছে। কারণ, পৃথিবীর ভৌগোলিক উত্তর মেরু, যা কিনা ঘূর্ণমান অক্ষ নির্দেশ করে, আর পৃথিবীর চুম্বকের দক্ষিণ মেরু একই অবস্থানে নেই। পৃথিবী যদি সত্যিই একটি সরল দণ্ড চুম্বক হতো, তাহলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে এর শক্তি সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা এবং দুটি মেরু থেকেই বিষুব রেখার দিকে নামলে সমহারে চৌম্বকত্ব হ্রাস পাওয়ার কথা। এ ছাড়া বিষুব রেখা বরাবর চৌম্বকত্বের মান সবচেয়ে কম হবে। পৃথিবী চুম্বকের জন্য ব্যাপারটা মোটামুটি এ রকম হলেও, পুরোপুরি সত্য নয় বরং বেশ জটিল। তার মানে পৃথিবীর চৌম্বকত্ব শুধু একটি দণ্ড চুম্বক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, পৃথিবীপৃষ্ঠে চৌম্বকত্বের মান এবং দিক দুটিই খুব জটিল ব্যাপার।

পৃথিবী চুম্বকের দক্ষিণ মেরু, যা কিনা ভৌগোলিক উত্তর দিকে, কানাডা থেকে সোজা সাইবেরিয়ার দিকে যাচ্ছে (অনেকটাই পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের কাছাকাছি)। গত এক শ বছরে গড়ে ১৫ কিলোমিটার করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সম্প্রতি এর বেগ অনেক বেড়ে গেছে, বছরে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার হারে। এই হঠাৎ বেগ বৃদ্ধি বিজ্ঞানীদের সামনে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে (এখানেই ভালো কিছু আশা করা যায়, বিজ্ঞানের জগতে অনেক সময় বড় ধরনের জটিলতা থেকে খুব সহজ একটি উত্তর বের হয়ে আসে)। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, গলিত লোহার এবং নিকেলের যে সাগর, সেখানে সীমিত অঞ্চলে বড় ধরনের একটা কিছু হচ্ছে (সাগরের টর্নেডো, সাইক্লোন বা এই জাতীয় কিছু)। একটা হচ্ছে কানাডার নিচে এবং আরেকটা হচ্ছে সাইবেরিয়ার নিচে। সাইবেরিয়ারটা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলেই উত্তর মেরু দিনে দিনে সাইবেরিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। যদিও এর স্পষ্ট উত্তর এখনো অজানা। এর বাইরে আরও সমস্যা হলো, পৃথিবী চুম্বকের উত্তর মেরু, যা কিনা ভৌগোলিক দক্ষিণ দিকে, গত এক শ বছরে প্রায় একই জায়গায় আছে।

পৃথিবী চুম্বকের দিক সব সময় স্থির থাকে না। এর উত্তর–দক্ষিণ নড়াচড়া করে, ফলে সময়ের সঙ্গে পৃথিবীপৃষ্ঠে চুম্বকক্ষেত্রের মান এবং দিক পরিবর্তিত হয়, এমনকি উত্তর–দক্ষিণ নিজেদের অবস্থানও পরিবর্তন করে। এটা সাধারণত মিলিয়ন বছরে একবার হয়, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মানে না। গত চার শ বছরে পৃথিবীর চুম্বকের চুম্বক মোমেন্ট মোটামুটি একই হারে এবং বেশ দ্রুতগতিতেই কমে আসছে। এটাই কি উত্তর–দক্ষিণ মেরুর অবস্থান পরিবর্তনের পূর্ব বার্তা? উত্তরটা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। গত কয়েক শ বছরে কমে গেলেও পৃথিবী চুম্বকের বর্তমান চুম্বক মোমেন্ট কিন্তু গত এক মিলিয়ন বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

পৃথিবীর চৌম্বকত্ব আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পৃথিবী চুম্বকের কারণে সূর্য থেকে আসা আয়নিত কণা পৃথিবীর ভেতরে ঢুকতে পারে না। যা কিনা পৃথিবীতে প্রাণ টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই জরুরি। পৃথিবীপৃষ্ঠে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও পৃথিবীর চুম্বক দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে সমুদ্রপথে চলাচলের জন্য একসময় কম্পাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যদিও বর্তমানে স্যাটেলাইটের সহায়তায় জিপিএসের মাধ্যমে খুব নিখুঁতভাবে আমাদের অবস্থান জানতে পারি।

পৃথিবীর বাইরে সৌরজগতের অন্য গ্রহদেরও চৌম্বকত্ব আছে, যদিও শুক্র ও মঙ্গলে চুম্বকক্ষেত্রের মান খুবই কম। সূর্যের নিজেরও চৌম্বকত্ব আছে এমনকি গ্যালাক্সির চৌম্বকত্ব আছে। এগুলোর প্রতিটি বিষয়ই খুবই আশ্চর্যের বেশ জটিল।

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়