সুপারম্যান কি আসলেই বাড়ি-ঘর কাঁধে তুলে উড়ে যেতে পারবে

সুপারহিরোর ভক্ত কিন্তু জাস্টিস লিগ মুভি দেখেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিতে একসঙ্গে পর্দায় হাজির হয়েছিল ডিসি কমিকসের জনপ্রিয় সব সুপারহিরো চরিত্র—সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, ফ্ল্যাশ, সাইবর্গ ও আকুয়াম্যান। এদের প্রত্যেককে নিয়ে অনেক আগে ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে সুপারভিলেন স্টিপেনউলফকে থামাতে সেবারই প্রথম লাইভ অ্যাকশন মুভিতে একজোট হয়ে মাঠে নামে সব সুপারহিরো। মুভিটি মুক্তির আগে থেকেই অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। পরে সেটা দর্শকদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করল, সে অবশ্য ভিন্ন আলোচনা। আজ বরং আমরা কথা বলব সেই আলোচিত মুভির একটি বিশেষ দৃশ্য নিয়ে। চিন্তা নেই প্রিয় পাঠক, কোনো স্পয়লার দেব না।

সিনেমার সেই বিশেষ দৃশ্যে দেখা যায়, সুপারম্যান ও ফ্ল্যাশ পাল্লা দিয়ে একটি শহরের অধিবাসীদের শত্রুদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শুরুতেই মহাবিশ্বের দ্রুততম মানব ব্যারি অ্যালেন ওরফে ফ্ল্যাশ গাড়িতে থাকা একটি পরিবারকে ঠেলে এক নিমেষে শহরের বাইরে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। সুপারম্যানকে বেশ টক্কর দেওয়া গেছে ভেবে ফ্ল্যাশের মুখে তখন ফুটে উঠেছিল চওড়া হাসি। কিন্তু বিধি বাম! এক মুহূর্ত পরেই মিলিয়ে যায় তার হাসি। কারণ, ওদিকে যে মাথায় করে এক গাদা মানুষ সমেত গোটা একটা বিল্ডিং উড়িয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে আসতে যাচ্ছে সুপারম্যান! অর্থাৎ, অবধারিতভাবেই সুপারম্যান ফ্ল্যাশের চেয়ে ১-০ তে এগিয়ে।

সুপারম্যান ১-০ ফ্ল্যাশ

শুধু মুভি নয়, সুপারম্যানের মূল কমিক বইয়েও বিল্ডিং নিয়ে উড়ে বেড়ানোর ঘটনা আছে। সুপারম্যানকে দুই হাতে দুটো আলাদা বিল্ডিং নিয়ে উড়ে বেড়াতে দেখা যায় সেখানে। প্রিয় পাঠক, সাধারণ মানুষের পক্ষে সরাসরি বা কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও এভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গোটা বিল্ডিং নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী সুপারম্যানের পক্ষেও এভাবে গোটা বিল্ডিং তুলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এতে বিজ্ঞানের একটি অতি পরিচিত মৌলিক নীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন ঘটে। চলুন, একটু বিশ্লেষণ করা যাক। 

সুপারম্যান এক হাতের বদলে দুই হাত ব্যবহার করে আগের মতো বল প্রয়োগ করে টেবিলটি ঠেলতে থাকে, তাহলে কি চাপের মান একই থাকবে? নাকি পরিবর্তন হবে?

এক.

সমস্যা মূলত ‘চাপ’ নিয়ে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আসুন এ সম্পর্কে খানিকটা জেনে নিই। প্রাত্যহিক জীবনে ‘চাপ’ শব্দটি আমরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও বিজ্ঞানে এর একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। কেতাবি ভাষায় চাপের খটমটে সংজ্ঞাটি এরকম, ‘কোনো বল যদি কোনো ক্ষেত্রের ওপরে লম্বভাবে ক্রিয়া করে, তাহলে এর প্রতি একক ক্ষেত্রফলের ওপরে প্রযুক্ত বলের মানই চাপ।’

সহজ ভাষায় বললে, যতটুকু জায়গা জুড়ে আপনি বল প্রয়োগ করছেন, সেই জায়গার ক্ষেত্রফল দিয়ে বলের মানকে ভাগ করলে পাওয়া যায় চাপ। এই রাশির একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রযুক্ত বলের মানে তারতম্য না করে শুধু প্রয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেই চাপের মান পরিবর্তন হয়। ধরুন, সুপারম্যান এক হাতে একটি টেবিল ঠেলে (বল প্রয়োগের মাধ্যমে) সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় টেবিলের সঙ্গে তার হাতের তালু এবং আঙ্গুলের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। তখন বল প্রয়োগের মানকে F এবং টেবিল স্পর্শকারী হাতের অংশের ক্ষেত্রফলকে A ধরে নিলে চাপের মান হবে—

P = F / A

এবার যদি সুপারম্যান এক হাতের বদলে দুই হাত ব্যবহার করে আগের মতো বল প্রয়োগ করে টেবিলটি ঠেলতে থাকে, তাহলে কি চাপের মান একই থাকবে? নাকি পরিবর্তন হবে? আগের চেয়ে চাপের মান কম হবে। কারণ, দুই হাত ব্যবহারের অর্থ হলো, বল প্রয়োগের এলাকার ক্ষেত্রফল দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া। ফলে ওপরের সমীকরণ অনুসারে, চাপ আগের তুলনায় অর্ধেক হয়ে যাবে। আর যদি পরের ছবির মতো পুরো শরীর ব্যবহার করে (অর্থাৎ, ক্ষেত্রফল আরও বাড়বে) টেবিলটি ঠেলতে থাকে, তাহলে অবধারিতভাবেই চাপ আরও কমবে।

যাহোক, এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। বিল্ডিং উড়িয়ে নেওয়ার সময়ে সুপারম্যান হাত দিয়ে এর গায়ে ঠিক কতটা চাপ প্রয়োগ করে, তা পরিমাপ করার চেষ্টা করা যাক। এ জন্য শুরুতে আমাদের জানতে হবে, বিল্ডিংটা কতটা ভারী। অর্থাৎ, বিল্ডিংয়ের ভর কত? কিন্তু সমস্যা হলো, চাইলেও চট জলদি কোনো বিল্ডিংয়ের ভর জানা সম্ভব নয়। কারণ, তা নির্ভর করে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর। যেমন বিল্ডিংয়ের নির্মাণ উপকরণ, ডিজাইন ইত্যাদির ওপরে। নিখুঁত ভর জানতে হলে প্রয়োজন বিস্তর জটিল হিসাব-নিকাশ। সেসব ঝামেলায় না গিয়ে আমরা একটা বিল্ডিংয়ের ভর মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারি। ১৫ × ১৫ × ৪০ মিটার আকৃতির, অর্থাৎ ৯ হাজার ঘনমিটার আয়তনের বিল্ডিংয়ের ভরের মান হওয়ার কথা আনুমানিক ৩ হাজার টনের কাছাকাছি। এই উপসংহারে পৌঁছাতে ধরে নেওয়া হয়েছে, অবকাঠামোটি গতানুগতিক উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এবার পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ দিয়ে গুণ করলে আমরা খুব সহজেই এর ওজনের মান বের করতে পারব। এই মান গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩ কোটি নিউটনে। একে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হলে সুপারম্যানকে ওপরের দিকে (ওজনের বিপরীতে) কমপক্ষে সমান বল প্রয়োগ করতে হবে। অমিত শক্তিশালী সুপারম্যানের জন্য যা ছেলেখেলার সমতুল্য!

সুপারম্যানের প্রয়োগ করা বলের মান তো পাওয়া গেল। এবার দেখা যাক বল প্রয়োগের এলাকা তথা ক্ষেত্রফল। মুভির দৃশ্য অনুযায়ী, সুপারম্যান দুই হাতে বিল্ডিং উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাই বলের প্রয়োগের এলাকা হবে তার দুই হাতের তালু এবং আঙুলের ক্ষেত্রফলের সমান। সুপারম্যান বেশ বড় ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাই দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার হাতের আকারও বেশ বড়ই হওয়ার কথা। হাতের আকার নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ধরে নিতে পারি, সুপারম্যানের এক হাতের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল হবে প্রায় ০.০২৩ বর্গমিটার। সে অনুসারে, দুই হাত মিলিয়ে বল প্রয়োগের মোট ক্ষেত্রফল দাঁড়াবে ০.০৪৬ বর্গমিটার। এবার তথ্যগুলো আগের সমীকরণে বসানো যাক।

P=F / A

= 30,000,000 / 0.046

= 650 × 106 Pa

= 650 Pa

সুপারম্যান যদি বিল্ডিংয়ের এক পাশে ধরে উঠানোর চেষ্টা না করে একেবারে মাঝ বরাবর নিচ থেকে ওপরের দিকে বল প্রয়োগ করে, তাহলে কেমন হবে?

দুই.

প্রত্যেক বস্তু একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারে। সীমা অতিক্রম করলে বস্তুটি ভেঙে যায়। একে বলা হয় ‘কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ’। ইটের ক্ষেত্রে এর সর্বোচ্চ মান ৭ মেগাপ্যাসকেল। অর্থাৎ যেকোনো ইটের ওপর যদি ৭ মেগাপ্যাসকেলের চেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে প্রথমে সেটিতে ফাটল দেখা দেবে। এরপর চাপ অব্যাহত থাকলে এক সময়ে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। গ্রানাইটের বেলায় কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থের সর্বোচ্চ মান প্রায় ৩০০ মেগাপ্যাসকেল। সুপারম্যানের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া বিল্ডিংটি ঠিক কী দিয়ে তৈরি, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে গতানুগতিক নির্মাণ উপকরণগুলোর কোনোটিরই কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থের মান ওপরে পাওয়া চাপের তুলনায় বেশি নয়। এর অর্থ হলো, অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরেও সুপারম্যানের পক্ষে কোনোভাবেই বিল্ডিং ওপরে ওঠানো সম্ভব নয়। কারণ, বিল্ডিং শূন্যে ওঠানোর জন্য যে স্থানেই বল প্রয়োগ করা হোক না কেন, তা ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে যাবে। আসলে এ ধরনের অবকাঠামোগুলো ওপরে উঠানোর কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয় না। তাই বিল্ডিং শূন্যে তুলতে গেলে তা ভেঙে যাবেই।

আচ্ছা, সুপারম্যান যদি বিল্ডিংয়ের এক পাশে ধরে উঠানোর চেষ্টা না করে একেবারে মাঝ বরাবর নিচ থেকে ওপরের দিকে বল প্রয়োগ করে, তাহলে কেমন হবে? লাভ নেই। আমাদের সুপারহিরো তখন একরকম বিল্ডিংয়ের মেঝে ভেদ করেই ওপরের দিকে উঠে যাবে। তবু বিল্ডিং ঘাড়ে করে উড়ে বেড়ানো সম্ভব হবে না। পুরো বিষয়টা অনেকটা সরু আলপিন দিয়ে বড়সড় আকারের কেক ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করার মতো। প্রিয় পাঠক, আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে নিজেই আলপিন দিয়ে গোটা একটা কেক উঠানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন! সফল হলে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!

বড় আলপিনের সাহায্যে মামুলি কেক তুলতে ব্যর্থ হয়ে হতবুদ্ধি অবস্থায় সুপারম্যান
এই জিনিসের বাস্তব অস্তিত্ব এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু তারপরেও এর মাধ্যমে সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানকে লঙ্ঘন করার দায় থেকে লেখকেরা কিছুটা হলেও নিস্তার পান বৈকি!

তিন

পদার্থবিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিল্ডিং উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি শুরুর দিকের কমিক বই লেখকদের নজর এড়িয়ে গেলেও পরের প্রজন্মের গল্পকারদের জন্য বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এটা। তাঁরা এই ঘটনার তুলনামূলক যৌক্তিক ব্যখ্যা দেওয়ার উপায় খুঁজতে শুরু করেন। উপায় না দেখে সুপারম্যানের সম্পূর্ণ নতুন এক অতিমানবীয় ক্ষমতার কথা সামনে আনেন তাঁরা, যা আগের অন্য কোনো কমিক বইয়ে উল্লেখ করা হয়নি। সেটির নাম দেয়া হয় ‘টেকটাইল টেলিকাইনেসিস’। এটি অনুসারে, সুপারম্যান স্পর্শের মাধ্যমে ভারী বস্তুর চারপাশে ফোর্স ফিল্ড (শক্তির বলয়) তৈরি করতে পারে। তারপর মানসিক শক্তি ব্যবহার করে গোটা ভারী বস্তুসমেত ফোর্স ফিল্ডকে শূন্যে ভাসাতে বা উড়িয়ে নিতে পারে। এই কৌশলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় স্পর্শের মাধ্যমে বল প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব চাপ সমস্যা। বলা বাহুল্য, এই জিনিসের বাস্তব অস্তিত্ব এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু তারপরেও এর মাধ্যমে সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানকে লঙ্ঘন করার দায় থেকে লেখকেরা কিছুটা হলেও নিস্তার পান বৈকি! সুপারহিরো ভক্তরা কাল্পনিক অতিমানবীয় ক্ষমতাকে সাদরে গ্রহণ করতে রাজি থাকলেও, ভুল বিজ্ঞানকে একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেন না। 

সুত্র: দ্য ফিজিকস অব সুপারহিরোস, জেমস কাকালিওস

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড