পদার্থবিদ্যা
চার প্রজন্মের বেকেরেল
কেউ প্রকাশ করেছেন প্রায় ৫০০ গবেষণাপত্র, কেউ-বা আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয়তা। প্রজন্মান্তরে গবেষণার এক মজার ইতিহাস...
১৮৯৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে পরের কয়েক বছরে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অনেকগুলো যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম রন্টজেন যখন এক্স–রে আবিষ্কার করলেন, তখন এর সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে হইচই পড়ে গেল। কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা পড়লেন বিপদে। কারণ, তাঁরা তখনো জানেন না, পদার্থবিজ্ঞানের কোন তত্ত্বের সাহায্যে এক্স–রে উৎপন্ন হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে।
সে সময় তথ্য–যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ধীর। ইলেকট্রনই আবিষ্কৃত হয়নি, ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা তো দূরের কথা। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খবর তখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছানোর প্রধান উপায় ছিল ডাক বিভাগ। এক্স–রে আবিষ্কারক রন্টজেন তাঁর স্ত্রী আনার হাতের একটি এক্স–রে প্লেট তৈরি করলেন ১৮৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর। সেটাই ছিল কোনো মানবদেহের প্রথম এক্স–রে। এই এক্স–রে প্লেটের কপি রন্টজেন পাঠিয়েছিলেন বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস, হামবুর্গ, ম্যানচেস্টার ও স্ট্রাসবুর্গে তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধুদের কাছে। প্যারিসের পার্সেল এসেছিল ফরাসি গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি পয়েনক্যারের কাছে।
পয়েনক্যারে ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য। ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি বিজ্ঞান একাডেমির নিয়মিত সভায় উপস্থিত অন্য ফরাসি বিজ্ঞানীদের রন্টজেনের পাঠানো এক্স–রে প্লেট দেখতে দিলেন তিনি। বিজ্ঞান একাডেমির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। তিনি এক্স–রে প্লেটটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, ‘ডিসচার্জ টিউবের কোন পাশ থেকে এক্স–রে বের হয়েছে এখানে?’ পয়েনক্যারে উত্তর দিলেন, ‘মনে হচ্ছে, নেগেটিভ ইলেকট্রোডের বিপরীত দিকের কাচ, যেখান থেকে প্রতিপ্রভা (ফসফরেসেন্স) উৎপন্ন হচ্ছে, সেখান থেকেই এক্স–রে বের হচ্ছে।’১
প্রতিপ্রভা কীভাবে উৎপন্ন হয়, তা ভালোভাবেই জানেন হেনরি বেকেরেল। সে কালে প্রতিপ্রভ পদার্থ ও প্রতিপ্রভা উৎপাদনের বিজ্ঞানে বংশানুক্রমিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন তিনি। এর শুরু হয়েছিল তাঁর পিতামহ অ্যান্টনি-সিজার বেকেরেলের হাতে।
প্যারিসে রয়েল গার্ডেন অব মেডিসিনাল প্ল্যান্টস—ঔষধি গাছের বাগান তৈরি হয়েছিল ১৬৪০ সালে। পরবর্তী ১০০ বছরে এই বাগানের আয়তন ও গাছের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয় এবং সেটাকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণা জাদুঘর স্থাপিত হয়। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সের এই গবেষণা জাদুঘর ছিল বিশাল আয়োজনের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য ১২টি বৈজ্ঞানিক পদ ‘সায়েন্টিফিক চেয়ার’ তৈরি করে ফ্রান্সের প্রধান বিজ্ঞানীদের নিয়োগ দেওয়া হয় গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৮ সালে সৃষ্টি হয় ‘চেয়ার অব ফিজিকস’। প্রধান পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ পান অ্যান্টনি-সিজার বেকেরেল।
অ্যান্টনি-সিজারের জন্ম ১৭৮৮ সালে প্যারিসের অভিজাত পরিবারে। অ্যান্টনি-সিজারের পিতামহ ছিলেন ফ্রান্সের রাজার লেফটেন্যান্ট। বড় পদ–পদবি মানুষকে ক্ষমতার পাশাপাশি আভিজাত্যও এনে দেয়। ১৮ বছর বয়সে অ্যান্টনি-সিজারের সুযোগ হয় ‘ইকুল পলিটেকনিক’-এ ভর্তি হওয়ার। রাষ্ট্রীয় কারিগরি বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার ও প্রতিরক্ষা বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই এই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট তৈরি করা হয়েছিল। লেফটেন্যান্টের নাতি হওয়ার সুযোগে অ্যান্টনি-সিজার সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তাঁর যতটা আকর্ষণ ছিল, সামরিক–বিদ্যার প্রতি ততটা ছিল না। তাই প্রকৌশলবিদ্যা সম্পন্ন করার পর তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর শুরু হয় তাঁর স্বাধীন গবেষণা। তিনি ১৮১৫ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত নিরলস গবেষণা করেছেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে। ১৮২৯ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলোশিপ পান। ১৮৩৭ সালে পেয়েছেন রয়্যাল সোসাইটির কোপলে মেডেল। একাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ১৮৩৮ সালে। একই বছর তিনি গবেষণা জাদুঘরের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। প্রফেসরদের বাসা ছিল জাদুঘর কমপ্লেক্সের কাছে ঔষধি বাগানের ভেতরে। নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য সেখানকার কিছু অব্যবহৃত ঘর ও জায়গা নিয়ে একটি সাময়িক গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেদিন তিনি ভাবতেই পারেননি যে এই সাময়িক গবেষণাগারেই গবেষণা করবেন তাঁর পরের আরও তিন প্রজন্ম, পরবর্তী ১০০ বছর ধরে। অবসর গ্রহণের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় অ্যান্টনি-সিজার ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন এবং পাঁচ শতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।২
অ্যান্টনি-সিজার বেকেরেলের পুত্র এডমন্ড বেকেরেলের জন্ম ১৮২০ সালে। তিনিও বাবার মতোই ইকুল পলিটেকনিক থেকে ১৮৩৮ সালে ইঞ্জিনিয়ার হন। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর তিনি অনায়াসেই যেকোনো বড় সরকারি পদে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর বাবার সহকারী হিসেবে যোগ দেন ১৮৩৯ সালে। সেই সময় প্রফেসররা তাঁদের সহকারী হিসেবে নিজেদের পছন্দের যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারতেন। অ্যান্টনি-সিজার তাঁর নিজের ছেলেকেই গবেষণা সহকারীর পদে নিয়োগ দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিলেন। এডমন্ড বেকেরেল ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী বিজ্ঞানী। বাবার সঙ্গে যৌথভাবে তিনি অনেকগুলো বই ও গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৮৫২ সালে এডমন্ড প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন ফ্রান্সের ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফট ইনস্টিটিউটে। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলোর কলকবজা ও ব্যবহারের প্রণালি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য। পরে সেটাকে একটি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়। এখানে তাঁর সহকারী ছিলেন বিজ্ঞানী গ্যাস্টন প্লান্টে। গ্যাস্টন পরবর্তী সময়ে লেড ব্যাটারি উদ্ভাবন করেন।
১৮৬৩ সালে এডমন্ড বেকেরেল ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন এবং ক্রমে ১৮৮০ সালে একাডেমির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তখনো তাঁর বাবা বেঁচে ছিলেন এবং বিজ্ঞান একাডেমিতে তাঁর প্রভাব ছিল সীমাহীন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত বাবা-ছেলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে একাডেমির ফিজিকস সেকশন। ১৮৭৮ সালে অ্যান্টনি-সিজারের মৃত্যু হলে জাদুঘর গবেষণাগারের ফিজিকস চেয়ারের দায়িত্ব এসে পড়ে ছেলে এডমন্ডের হাতে।
এডমন্ড বেকেরেল গবেষণা করেছেন আলোর বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব সম্পর্কে। আলোর বর্ণালিতত্ত্বের গবেষণার অগ্রদূত ছিলেন তিনি। সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেছেন। ছেলে হেনরি বেকেরেলের মধ্যে প্রতিপ্রভা পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি।৩
এডমন্ড বেকেরেলের ছেলে হেনরি বেকেরেলের জন্ম ১৮৫২ সালের ১৫ ডিসেম্বর, জাদুঘর গবেষণাগারের প্রফেসরস কোয়ার্টারে। সেই কোয়ার্টারে তখন তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের পদার্থবিদ পিতামহ অ্যান্টনি-সিজার ও পিতা এডমন্ড বাস করছেন পরিবার–পরিজন নিয়ে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন হেনরি। পড়াশোনাও করেছেন পিতা–পিতামহের পথে—ইকুল পলিটেকনিকে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর ১৮৭৭ সালে যোগ দিয়েছেন ফরাসি সরকারের গণপূর্ত বিভাগে। সেই বছর তিনি বিয়ে করেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর কন্যা লুসি জো মেরিকে। পিতা–পিতামহের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্বতন্ত্রভাবে সুখের সংসার পাতেন তাঁরা। কিন্তু বিয়ের এক বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান জিনকে জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পরই লুসির মৃত্যু হয়। শিশুসন্তানকে নিয়ে হেনরি ফিরে আসেন তাঁর মা-বাবার বাড়িতে—প্রফেসরস কোয়ার্টারে।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এডমন্ড বেকেরেল নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে সেখানে তাঁর ছেলে হেনরি বেকেরেলকে নিয়োগ দেন। পরিপূর্ণ গবেষক হওয়ার ইচ্ছায় সরকারি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পদ ছেড়ে দিয়ে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে পিতা–পিতামহের পথ অনুসরণ করলেন হেনরি বেকেরেল। প্রতিপ্রভ ও অনুপ্রভ পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করতে খুবই আনন্দ পেতে শুরু করেছেন তিনি। তখনো সব গবেষণা পরীক্ষণলব্ধ ফলাফলনির্ভর। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ভিত্তির জন্য খুব বেশি নির্ভরযোগ্য সূত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
১৮৪৫ সালে আলোর পোলারাইজেশন আবিষ্কার করেন মাইকেল ফ্যারাডে। হেনরি বেকেরেল আলোর এই ধর্ম নিয়ে খুঁটিনাটি গবেষণা করলেন ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত। পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আলোর পোলারাইজেশন কী রকম হয়, তা মাপার জন্য বিশাল এক যন্ত্র তৈরি করলেন হেনরি বেকেরেল। এ–সংক্রান্ত পরীক্ষণগুলো থেকে তিনি দুই ধরনের গবেষণাক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করলেন—ভূতত্ত্ব ও চুম্বকতত্ত্ব। ১৮৮৩ সাল থেকে তাঁর গবেষণা কেন্দ্রীভূত হয় বিভিন্ন মাধ্যম ও কেলাসে অবলোহিত রশ্মির শোষণ ও নির্গমনের ফলে উদ্ভূত আলোর প্রভাব—প্রতিপ্রভা ও অনুপ্রভা রহস্যে। আলোর শোষণের গবেষণার ওপর তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৯ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৮৯০ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন। ১৮৯১ সালে তাঁর পিতা এডমন্ড বেকেরেলের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পিতার পদ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিকস চেয়ার পান। এই পদের পাশাপাশি ১৮৯৫ সালে তিনি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ফিজিকসের প্রফেসর পদেও যোগ দেন। ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির খুবই প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। এই একাডেমির নিয়মিত মিটিংয়েই তিনি ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম দেখেন রন্টজেনের পাঠানো এক্স–রে প্লেট এবং প্রতিপ্রভা–সংক্রান্ত গবেষণায় নিজের বিশ্বাসের কারণেই ধরে নিয়েছিলেন প্রতিপ্রভারই অন্য রকম একটি ঘটনা এক্স–রের উৎপত্তি। পয়েনক্যারের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন থেকে এটা বোঝা যায়।
হেনরি পয়েনক্যারে ও হেনরি বেকেরেল—দুজনেরই ধারণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড টিউবের কাচের গায়ে ধাক্কা দেওয়ার ফলে লুমিনেসেন্স বা প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকেই এক্স–রে উৎপন্ন হয়েছে। বেকেরেল ভাবলেন, এক্স–রে আর প্রতিপ্রভার সরাসরি সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণের জন্য পরদিনই গবেষণা শুরু করলেন হেনরি বেকেরেল। পিতা–পিতামহ তাঁর জন্য রেখে গেছেন খুবই গোছানো ও সেই সময়ের সব সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ গবেষণাগার। প্রতিপ্রভ পদার্থের অনেক রকমের কেলাস মজুত ছিল তাঁর গবেষণাগারে। তিনি সেগুলো নিয়ে একের পর এক পরীক্ষণ শুরু করলেন।
হেনরি বেকেরেলের পরীক্ষণের পদ্ধতি ছিল খুব সহজ। একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে মোটা কালো কাগজে ঢেকে তার ওপর প্রতিপ্রভ পদার্থের লবণের ক্রিস্টাল রেখে তাতে সরাসরি সূর্যের আলো প্রবেশ করানো। মোটা কালো কাগজ সূর্যের আলো থেকে ফটোগ্রাফিক প্লেটকে রক্ষা করবে। কিন্তু যখন সূর্যের আলোর সঙ্গে প্রতিপ্রভ ক্রিস্টালের মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিপ্রভা তৈরি হবে, সেই প্রতিপ্রভায় যদি এক্স–রে উৎপন্ন হয়, তা কালো কাগজ ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের রাসায়নিকের সঙ্গে বিক্রিয়া করবে। সেই বিক্রিয়ার ফলাফল ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করার পর সরাসরি দেখা যাবে। জিংক সালফেট, ক্যালসিয়াম সালফেট ইত্যাদি সব ক্রিস্টালই এক্স–রে তৈরি করতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু হেনরি বেকেরেল আশা করছেন, ইউরেনিয়াম সালফেটের লবণ থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যেতে পারে। ১৫ বছর আগে তিনি ইউরেনিয়াম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়ে গেছেন তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান, যিনি রঙিন ছবি উৎপাদন করার গবেষণা করছিলেন।
হেনরি বেকেরেল লিপম্যানের কাছ থেকে তাঁর ইউরেনিয়াম সল্ট ফেরত নিয়ে এসে পরীক্ষণের জন্য তৈরি হলেন। কালো কাগজে ঢাকা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ইউরেনিয়াম ও পটাশিয়ামের ডাবল সালফেট ক্রিস্টাল রাখা হলো। একটি ক্রিস্টাল ও কালো কাগজের মাঝখানে একটি ধাতব পয়সা সূর্যের আলোয় রেখে দেওয়া হলো কয়েক ঘণ্টার জন্য। এরপর তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করে দেখলেন খুব সামান্য একটু আলোর রেখা দেখা গেছে ফটোগ্রাফিক প্লেটে—পয়সার ছায়ার চারপাশে ও ক্রিস্টালের চারপাশে। এক্স–রে তৈরি হলে তো তা পয়সা ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটে পয়সার এক্স–রে তৈরি হতো। ক্রিস্টালের ওপর সূর্যের আলো পড়ে তাপ উৎপন্ন হয়ে যদি ক্রিস্টালের কোনো বাষ্প তৈরি হয়, তা ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা কাটানোর জন্য পাতলা কাচ দিয়ে ক্রিস্টাল ঢেকে দেওয়া হলো। এই ফলাফল ১৮৯৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সায়েন্স একাডেমির মিটিংয়ে উপস্থাপন করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু তাতে নিশ্চিত করে এক্স–রে উৎপন্ন হওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না। আরও পরীক্ষণ দরকার। একাডেমির পরবর্তী মিটিং ২ মার্চ। এর আগেই তাঁকে ফলাফল পেতে হবে।
কিন্তু বাদ সাধল প্যারিসের আকাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। ক্রিস্টালে ফেলার মতো যথেষ্ট সূর্যরশ্মি নেই কোথাও। ঝাপসা আলোয় কিছুক্ষণ ফেলে রাখার পর সবকিছু গুটিয়ে একটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে বাধ্য হলেন হেনরি বেকেরেল। ২৭ থেকে ২৮ তারিখেও সূর্যের মুখ দেখা গেল না। ১৮৯৬ সাল ছিল লিপইয়ার। বেকেরেল আশা করছিলেন, অন্তত ২৯ তারিখে হলেও কিছু রোদ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, সেই আশার গুড়েও বালি। এদিকে ২ তারিখের মিটিংয়ে কিছু ফলাফল তো দেখাতে হবে। তাই মার্চের ১ তারিখ ড্রয়ার খুলে ফটোগ্রাফিক ফিল্মের প্লেট ডেভেলপ করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু অবাক হয়ে গেলেন ফলাফল দেখে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে ক্রিস্টালের দাগ স্পষ্ট। যেখানে প্রতিপ্রভাই তৈরি হয়নি, সেখানে এই দাগ এল কীভাবে? ইউরেনিয়াম সল্ট থেকে কি নিজে নিজেই কোনো অজানা রশ্মি বের হচ্ছে? পদার্থের অজানা এক নতুন ধর্ম আবিষ্কৃত হলো সেদিন। এর নাম দেওয়া হলো বেকেরেল রশ্মি।
পরবর্তী কয়েক বছরে মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি এই অজানা ধর্মের গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম। মেরি কুরি পদার্থের এই নতুন ধর্মের নাম দিলেন রেডিওঅ্যাকটিভিটি। এরপর একে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানের জগতে ঘটে গেছে বিপুল বিপ্লব, যা বিংশ শতাব্দীকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সেটা আরেক দিনের গল্প।
নোবেল পুরস্কারের জন্য হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করা শুরু হয়েছিল ১৯০১ থেকেই। ১৯০১ সালে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত রসায়নবিদ মারসেলিন বারথেলো। ১৯০২ ও ১৯০৩ সালেও মারসেলিন হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরস্কারের জন্য। মারসেলিন ছাড়া ১৯০২ সালে আরও দুজন বিজ্ঞানী—ফরাসি গণিতবিদ গ্যাস্টন ডারবোক্স ও জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এমিল ওয়ারবুর্গ হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরস্কারের জন্য। ১৯০৩ সালে মারসেলিন ও গ্যাস্টন ছাড়া আরও চার বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য। তাঁরা ছিলেন রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য চার্লস বুকার্ড ও ইলিউটের মাসকার্ট, পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান ও হেনরি পয়েনক্যারে। ১৯০৩ সালে মেরি ও পিয়ের কুরির সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন হেনরি বেকেরেল।৪
হেনরি বেকেরেল ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর শুধু একজনের নামই নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি ছিলেন গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান। ১৯০৮ সালে গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু হেনরি বেকেরেল তা দেখে যেতে পারেননি। পুরস্কার ঘোষণার কয়েক মাস আগে ১৯০৮ সালের ২৫ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
হেনরি বেকেরেলের ছেলে জিন বেকেরেলের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। তিনিও তাঁর পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানী হয়েছেন। ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর বাবা হেনরি বেকেরেলের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিকস ডিপার্টমেন্টে। ১৯৪২ সালে তিনি গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন, যেখানে কাজ করেছেন তাঁর পূর্ববর্তী তিন প্রজন্ম। ১৯৪৬ সালে তিনি ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। তাই তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয় চার প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা।
