অভিজ্ঞতা
বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের প্রতিষ্ঠানে, নোবেলজয়ীদের সাহচর্যে
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিকস। ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে অবস্থিত। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের প্রতিষ্ঠান। সেখানে চার মাসের জন্য গিয়েছিলেন ভারতীয় পদার্থবিদ পুরুষোত্তম চক্রবর্তী। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা…
আইসিটিপিতে থাকাকালীন অনেক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয় আমার। সৌভাগ্য হয় তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। এঁদের মধ্যে আব্দুস সালাম ছাড়াও আরও কয়েকজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন।
ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিকস’, সংক্ষেপে আইসিটিপি। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ও তাঁর নামাঙ্কিত এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস থেকে ডেপুটেশনে আমাকে চার মাসের জন্য পাঠানো হয় আইসিটিপিতে। উদ্দেশ্য, ওখানে ‘কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিকস’-এর ওপরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা। কলকাতা থেকে একমাত্র আমিই ওই কর্মশালায় যোগদানের সুযোগ পেয়েছিলাম।
ত্রিয়েস্তে ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর এবং সমুদ্র বন্দর। অ্যাড্রিয়াটিক সাগর এবং ইতালি-স্লোভেনিয়া সীমান্তের মাঝখানে যে সরু অঞ্চলটি রয়েছে, তার শেষ প্রান্তে শহরটির অবস্থান। এর দক্ষিণ, পূর্ব এবং উত্তর—তিন দিকেই স্লোভেনিয়া। বাকি একদিকে ত্রিয়েস্তে উপসাগর। জার্মান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এবং স্লাভিক সংস্কৃতির দেশগুলোর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় ইতিহাসের বিভিন্ন সময়জুড়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বলে বিবেচিত হতো। ১৩৮২ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত যে হাবসবুর্গ রাজতন্ত্র অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য শাসন করেছে, তার সবচেয়ে পুরোনো স্থানগুলোর একটি এই ত্রিয়েস্তে। সে সময় এটি ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর ছিল। ভূমধ্যসাগরের একটি সমৃদ্ধ বন্দর হওয়ায় ত্রিয়েস্তে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম শহরে (ভিয়েনা, বুদাপেস্ট এবং প্রাগের পরে) পরিণত হয়। fin-de-siècle (মূলত এ শব্দগুচ্ছ বলে ১৯ শতকের শেষ সময়টুকু বোঝানো হয়) যুগে এটি সাহিত্য ও সঙ্গীতেরও অন্যতম কেন্দ্র ছিল। অবশ্য অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির সঙ্গে ত্রিয়েস্তের একত্রীকরণের পর শহরটির ইউরোপীয় গুরুত্ব বেশ কমে গেছে। ১৯৩০-এর দশক এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আবার এখানে অর্থনৈতিক উন্নতি শুরু হয়। ইউরোপের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের স্নায়ুযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এ শহর। বর্তমানে এটি ইতালির সবচেয়ে সুন্দর ও ধনী শহরগুলোর একটি, বিশেষত সমুদ্রবাণিজ্যের কারণে।
আইসিটিপিতে থাকাকালীন অনেক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয় আমার। সৌভাগ্য হয় তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। এঁদের মধ্যে আব্দুস সালাম ছাড়াও আরও কয়েকজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন। কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে মনে পড়ছে। যেমন সুইজারল্যান্ডের আইবিএম জুরিখের গার্ড বাইনিং ও হেইনরিখ রোহরার, যাঁরা সদ্য স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কপি আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। দুজনেই এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছরই হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাকটর গবেষণা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় সারা পৃথিবীতে। সে বিষয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আমাদের কর্মশালার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সুবাদে তদানীন্তন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয় নিয়ে রীতিমতো তর্কবিতর্ক শোনার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারিনি। তখন বিসিএস (BCS: Bardeen-Cooper-Shrieffer) তত্ত্বই ছিল একমাত্র মাইক্রোস্কপি থিওরি অব সুপারকন্ডাকটিভিটি। সেই থিওরি একরকম সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীতে। সেই বিসিএস তত্ত্বখ্যাত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট শ্রিফারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পেরে নিজেকে মনে হয়েছিল পরম সৌভাগ্যবান। সেই একই সম্মেলনে এসেছিলেন আরেক নোবেলজয়ী রাশিয়ার ভিতালি গিনজবার্গ। তাঁর পান্ডিত্য ছিল অপরিসীম। সুপারকন্ডাকটিভিটি ও সুপারফ্লুইডিটি—দুটো বিষয়েই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ।
আইসিটিপি কর্মশালার শেষ দিকে এল সেই সুবর্ণ সুযোগ। আমার কাছে ওটা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। এক দুপুরে আইসিটিপির ‘আদ্রিয়াটিকো’ ক্যান্টিনে সবে লাঞ্চ খেতে বসেছি, একেবারে একই টেবিলে আমার বিপরীতেই বসে পড়লেন প্রফেসর আব্দুস সালাম।
এসেছিলেন পোলিশ একাডেমি অব সায়েন্সের পদার্থবিজ্ঞানী টমাজ ডিয়েল, যিনি একইসঙ্গে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’ ইউনিভার্সিটিরও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ক্রায়োজেনিকস এবং স্পিনট্রোনিকসের ওপর গবেষণায় তাঁর খ্যাতি ভূবনজোড়া। আলাপ-পরিচয় থেকে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, একই রুম শেয়ার করা ইত্যাদি আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হবার সুযোগ করে দেয়। আইসিটিপি কর্মশালায় আমার একটি বক্তৃতা শুনে টমাজ এত খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে সরাসরি আমন্ত্রণই জানিয়ে ফেললেন পোলিশ একাডেমি অব সায়েন্স ঘুরে দেখার জন্য। পরের বছর সেই আমন্ত্রণের সদ্ব্যবহার করতে পোল্যান্ড গিয়েছিলাম। পোলিশ একাডেমি অব সায়েন্স ও লুবলিনে (মাদাম কুরির জন্মস্থান) বিখ্যাত মেরি কুরি স্ক্লোডওস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে এত সুখ্যাতি পেয়েছিলাম যে ভাবলে আজও নিজেকে গর্বিত মনে হয়। মেরি কুরি ইউনিভার্সিটির ভেতরে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব ফিজিকসের অধিকর্তা অধ্যাপক বগডান আ্যাডমচিকের ভালোবাসাযুক্ত আমন্ত্রণ ও তাঁর আথিতেয়তার টানে পোল্যান্ডে আরও কয়েকবার গিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি ইনস্টিটিউট অব ফিজিকসে। পোল্যান্ড আমার ভালোবাসার দেশ, এক বিরাট অভিজ্ঞতার দেশ! এ বিষয়ে পরে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করব।
আইসিটিপি কর্মশালার শেষ দিকে এল সেই সুবর্ণ সুযোগ। আমার কাছে ওটা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। এক দুপুরে আইসিটিপির ‘আদ্রিয়াটিকো’ ক্যান্টিনে সবে লাঞ্চ খেতে বসেছি, একেবারে একই টেবিলে আমার বিপরীতেই বসে পড়লেন প্রফেসর আব্দুস সালাম। আমার বিপরীতে বসে আছেন আইসিটিপির প্রতিষ্ঠাতা ও অধিকর্তা নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম—এ যে কল্পনাতীত! ১৯৭৯ সালে আব্দুস সালাম তাঁর ‘থিওরি অব ইউনিফিকেশন অব উইক অ্যান্ড ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারেকশনস বিটুইন এলিমেন্টারি পার্টিকেলস’-এর জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর এই আবিষ্কার যে পরে হিগস-বোসন আবিষ্কারের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। সেদিন খাবার টেবিলে বসে আমার সঙ্গে অধ্যাপক সালামের খোলামেলা হাস্যময় আলাপচারিতা আজও আমার স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে আছে।
একেবারে শোকে মূহ্যমান ও নিরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ ছিল না! আকাশ-পাতাল ভাবছি কী করব! একটু পরেই কাচের মধ্য দিয়ে আমার দিল্লিগামী ফ্লাইটটিকে টেক অফ করতে দেখলাম এবং নিমেষেই সে আমার লাগেজকে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল।
২.
দেখতে দেখতে চার মাস শেষ হয়ে গেল। ত্রিয়েস্তে বিমান বন্দর থেকে প্লেনে এক ঘন্টার মধ্যেই রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে পৌঁছালাম। প্রায় ঘন্টা ছয়েক পরেই দিল্লির প্লেনে উঠতে হবে। মনে আছে, রোম থেকে ইতালীয় এয়ারলাইন্স ‘আলিতালিয়া’তে দিল্লি পৌঁছাবার কথা। টিকিট দেখিয়ে চেক-ইন পর্ব চুকিয়ে লাগেজ পাঠিয়ে দিলাম কনভেয়র বেল্টে। বোর্ডিং পাস হস্তগত হলো। ইমিগ্রেশন হয়ে যাওয়ার পর একেবারে ভেতরে এসে নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভাবলাম, অনেকটা সময় আছে, একটু ঘোরাঘুরি করা যাক। পকেটে বিশেষ পয়সা নেই। সর্বসাকুল্যে দশ ডলারের মতো হবে। কাঁধে শুধু একটি ছোট ব্যাগ, যার মধ্যে কিছু কাগজপত্র, পাসপোর্ট ও ওয়ালেট। ব্লেজারের পকেটে বোর্ডিং পাস। এক ডলার দিয়ে কফি খেলাম। এয়ারপোর্টের ভেতরে স্টলগুলো ঘুরে দেখতে ভালো লাগে এবং প্রয়োজন না থাকলেও দু-একটি ছোটখাটো জিনিস কিনতে আরও ভালো লাগে। তাই দু-চারটি দোকান পরিদর্শন ও একটু পায়চারি করতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইকে নারীকন্ঠ নিঃসৃত ঘোষণা ভেসে এল, ‘আলিতালিয়া দিল্লি ফ্লাইট নাম্বার ১২; প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু প্লিজ প্রসিড টু দ্য গেট নাম্বার বি-৫৭ ইমিডিয়েটলি ফর বোর্ডিং।’
ছুটতে শুরু করলাম। নির্ধারিত গেটের কাছে এসে দেখি বিরাট লম্বা লাইন। একদম পেছনে দাঁড়িয়েই হঠাৎ ব্লেজারের পকেটে চোখ পড়ল। সর্বনাশ, বোর্ডিং পাস কোথায়! তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেলাম না। হাত-পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। চোখে পানি চলে এল। হায় হায়, কী করব এখন! এই ভাবতে ভাবতে বোর্ডিং গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে একজন বলল, ‘বোর্ডিং পাস, প্লিজ!’
বোকার মতো ক্ষীণ কন্ঠস্বরে যা বললাম, সেটা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমি তো বোর্ডিং পাস হারিয়ে ফেলেছি। ওটা ছাড়াই আপনি কি দয়া করে আমাকে ঢুকতে দেবেন?’
ও প্রান্ত থেকে উত্তর, ‘কী?’
আমি বললাম, ‘কষ্ট করে আমার নামটা কম্পিউটারে দেখুন। আমি এই ফ্লাইটেরই একজন যাত্রী।’
ভদ্রমহিলা কম্পিউটার ঘেঁটে জানালেন, ‘দুঃখিত। আপনার নাম খুঁজে পাচ্ছি না। যাত্রীতালিকায় আপনার নাম নেই।’
আমি তো বিষ্ময়ে হতবাক। বলে কী! আমার নামটাই নেই কম্পিউটারে এই ফ্লাইটের যাত্রীতালিকায়?
বুঝতে অসুবিধে হলো না যে আমার বোর্ডিং পাসটি বিক্রি হয়ে গিয়েছে অন্য কারও নামে, এবং সেটা এয়ারপোর্টের ভেতরেই কারো দুস্কৃতি! ইতালিতে ছিনতাইয়ের কথা আগেও শুনেছি। সেটার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষী আজ হলাম। বুঝতে পারলাম, আমার ব্লেজারের পকেট থেকে উঁকি মারা বোর্ডিং পাসটি কেউ আমার অজান্তেই পকেটমারি করেছে ও রাতারাতি আমার নাম প্যাসেঞ্জার লিস্ট থেকে মুছে দিয়েছে। অর্থাৎ আমার বোর্ডিং পাসটি এই মুহূর্তে অন্য কারো মালিকানাধীন হয়ে গেছে।
একেবারে শোকে মূহ্যমান ও নিরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ ছিল না! আকাশ-পাতাল ভাবছি কী করব! একটু পরেই কাচের মধ্য দিয়ে আমার দিল্লিগামী ফ্লাইটটিকে টেক অফ করতে দেখলাম এবং নিমেষেই সে আমার লাগেজকে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল।
আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। বললাম, ‘আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ! আমার লাগেজও সঙ্গে নেই। পরিবার আমার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা নেই।’ এবারে ভদ্রলোক একটু ভদ্র স্বরে বললেন, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’
কিছুক্ষণের জন্য চতুর্দিক একদম ফাঁকা। পরবর্তী অন্য কোনো ফ্লাইটের বোর্ড লেগে গেল সেই গেটে। কাউন্টারে এখন অন্য নারীরা। কার সঙ্গে কথা বলব, বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম, এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলা যাক। দেখা যাক, উনি কিছু সুরাহা করতে পারেন কি না। দেখা করলাম ম্যানেজারের সঙ্গে। উনি ইতালীয় অ্যাকসেন্টে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন ‘ও কে, ইউ হ্যাভ তু বাই এ ফ্রেস তিকেত ফর দি নেক্সত ফ্লাইত। আই অ্যাম গোয়িং তু ইসু এ তিকেত ফর ইউ।’ (পরের ফ্লাইটের জন্য তোমার টিকিট কিনতে হবে। আমি তোমার জন্য টিকিট করে দিচ্ছি।) জবাবে বললাম, ‘আমার কাছে তো টাকা নেই। টিকিট কিনব কীভাবে?’ ভদ্রলোক বেশ রেগে বলে উঠলেন ‘আই দোন্ত নো। ইউ মাস্ত বাই ইওর তিকেত।’ (মানে, অত সাত-পাঁচ আমি বুঝি না, বাপু। টিকিট তোমাকে কিনতেই হবে।)
আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। বললাম, ‘আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ! আমার লাগেজও সঙ্গে নেই। পরিবার আমার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা নেই।’ এবারে ভদ্রলোক একটু ভদ্র স্বরে বললেন, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে গড় গড় করে বললাম, ‘ত্রিয়েস্তের আইসিটিপি থেকে। আইসিটিপিতে কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিকসবিষয়ক একটা আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগদান করতে এসেছিলাম এখানে।’
মুহূর্তে ভদ্রলোকের মেজাজ একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। অনেকটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ইসিটিপি, ব্রাভো!’ বুঝতে পারলাম, ইতালিতে আইসিটিপির খুবই কদর ও মর্যাদা। ভদ্রলোক আমাকে বিনীত ভাবে বললেন ‘ওকে, উই আর গোইং তু ইসু এ তিকেত ফর দি নেক্সত্ আলিতালিয়া দেল্লি ফ্লাইত ফর ইউ। ইউ দোন্ত হ্যাভ তু পে। বাত দি ফ্লাইত ইজ নত তুদে, ইত ইজ দে আফতার তু-মরো।’ (মানে, টাকা দেওয়া লাগবে না। আমরা আপনার জন্য টিকিট করে দেব। তবে ফ্লাইট কালকে।) আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভদ্রলোককে ধন্যবাদের পর ধন্যবাদ দিতে থাকলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নতুন টিকিট হাতে এসে গেল। ভদ্রলোককে বললাম, ‘আচ্ছা, আমি কি এখানে থাকতে পারি দুটো রাত?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘না না, আপনাকে বেরিয়ে আগামীকাল আবার ইমিগ্রেশন পেরোতে হবে।’
আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। দুদিন কোথায় থাকব, খাব কী? পকেটে মাত্র দশ ডলার সম্বল! সে এক কঠিন পরীক্ষা। স্রষ্টা বোধহয় আমাকে সেদিন অসীম দয়া করেছিলেন, তা না হলে আমার দুদিন হয়তো রোমের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো! এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে এসে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুব কাছাকাছি সস্তায় কোনো থাকার জায়গা আছে?’ লোকটি ইংরেজি ভালোই বলতে পারে দেখলাম। সে আমাকে বলল, ‘তোমাকে এয়ারপোর্টের খুব কাছে উপকূলবর্তী ফিউমিচিনোতে নামিয়ে দিচ্ছি। ওখানে অনেক ছোট ছোট ঘর আছে, যার ভাড়া দিনে ১০ ডলারের মতো।’ বললাম, ‘ঠিক আছে।’ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ‘ফিউমিচিনো’ জায়গাটিতে এসে পৌঁছালাম। পাঁচ ডলার চলে গেল ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে দিতে। পড়ে রইল আর পাঁচ ডলার।
একেবারে সমুদ্র সৈকত। কয়েকশ জেলে মাছ ধরছে আর পাড়ে পাহাড়ের মতো মাছ স্তুপাকার করে রাখছে। মাছের গন্ধে একেবারে ম ম করছে সমস্ত অঞ্চলটি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে গেলাম সমুদ্রকূলবর্তী লোকালয়ের দিকে। সারিবদ্ধ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘর। একজন লোক কোনোরকমে ঢুকতে পারে। দুফুটের মতো চওড়া একটি তক্তপোশ। কোনো বিছানা নেই, একটি ছোট্ট বালিশ মাত্র। ঘরগুলোয় কোনো জলের ব্যবস্থা নেই। বাথরুম বা পায়খানা একটি আছে কিছুটা দূরে; অনেকের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। প্রতিটি ঘরের দৈনিক ভাড়া ৮ ডলার। মালকিন একজন ইতালীয় বয়স্কা মহিলা, আনুমানিক ৭০ বছর বয়স! তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে দাড়াতেই আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। পাশেই কাউকে দিয়ে পার্শ্ববর্তী এক দোকান থেকে পাসপোর্টের একটি ফটোকপি করিয়ে আনলেন এবং পাসপোর্টটি আমায় ফেরত দিলেন। একটি ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইটি তোমার, ১৬ ডলার লাগবে দুরাত্রের জন্য।’
আমি ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছি, মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। ওঁকে মা বলে সম্বোধন করলাম। বললাম, ‘মা, আমার কাছে মাত্র পাঁচ ডলার আছে। এটা দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে আমাকে পরশু আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে। এ ছাড়া আমার কাছে কোনো পয়সা নেই। আমার বোর্ডিং পাস চুরি হয়ে গিয়েছে। আমার দিল্লীগামী পরবর্তী ফ্লাইট আগামী পরশু। আমি তোমাকে কী করে পয়সা দেব, আর কি-ই যে খাব, তাই তো জানি না।’ ওই ভদ্রমহিলা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর দেখলাম ওঁর চোখে জল! আমাকে বললেন, ‘তুমি থাকো এখানে। একটা পয়সাও দিতে হবে না। তোমার খাবার আমি তোমার ঘরে পৌঁছে দেব। তুমি একটু হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
একটু পরেই একটি কাচের প্লেটে গরম স্প্যাগেটি, সঙ্গে একটি চামচ। চিজের গুঁড়ো ছড়ানো প্লেটভর্তি মোলায়েম স্প্যাগেটি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মনে হলো যেন পরম করুণাময় ওপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সেই মহীয়সী নারীও যে এক মহামানবী, তাতে কোনো সংশয় ছিল না। দুটো দিন দুটো রাত সেই স্নেহময়ী মায়ের আশ্রয়েই কেটে গিয়েছিল পরম নির্ভরতায়! দুদিন পরে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে অবশেষে আমার লাগেজটি উদ্ধার করতে পেরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।
লেখক: পদার্থবিজ্ঞানী, কলকাতা, ভারত